‘আহলে হাদীস’ অধ্যুষিত এলাকার এক ভাই ফোন করে এক পুরনো তর্ক সম্পর্কে নতুন করে জানতে চাইলেন। এ নিয়ে উনার সাথে বছর কয়েক আগে কথা হয়েছিল। ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা পড়া-না পড়া, তারাবীহ নামাজের রাকায়াত সংখ্যা ইত্যাদি ধরনের ফিক্বহি মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে। যখন উনাকে হাদীসের সহীহ গ্রন্থসমূহ হতে উনাদের এলাকায় না শোনা কিন্তু সহীহ এমন হাদীসগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়া শুধুমাত্র মূল মতন পড়ে শুনাচ্ছিলাম, এক বিকেলে, তিনি তাজ্জব হয়ে শুনলেন। আসরের নামাজের পর পরই আমরা বসেছিলাম, মাগরিবের আজান শুনে উঠেছি। সেদিন থেকেই সম্ভবত: তিনি স্বীয় ‘আহলে হাদীসে’র মাজহাব ছেড়েছেন। আমিও এ পথের পথিক। আমি ছেড়েছি হানাফি মাজহাব। অবশ্য কখন আমি হানাফি মাজহাব গ্রহণ করেছি বা গ্রহন করা বলতে যা বুঝায়, তদনুযায়ী কোনো মজহাব আদৌ কখনো গ্রহন করেছি কিনা জানিনা!
‘আমি মুসলমান’ – এতটুকু পরিচয়ই নিজের ও অন্য কারো জন্য যথেষ্ট মনে করি। ইসলামই যদি জন্মগত না হয়, তাহলে শুধুমাত্র এলাকাগত কারণেই কেউ বিশেষ কোনো মাজহাবের অনুসারী হবে কেন?
সমস্যা হলো, আমরা মূল হাদীস পাঠ করিনা। বড়জোর সিলেবাসে থাকার কারণে অথবা সওয়াবের নিয়তে ‘রিয়াদুস সালেহীন’ টাইপের কিছু একটা পড়ি। হাদীস পড়তে হবে মূল টেক্সট থেকে। আরবী পড়তে না পারলে (গল্প-উপন্যাস পড়ার মতো করে হলেও) ইতোমধ্যে অনূদিত হাদীসের মৌলিক গ্রন্থসমূহের মতনগুলো (মূল বক্তব্য) পড়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
কুরআন হলো প্রেরণা লাভের উৎস। ইসলামের প্রায়োগিক ও পূর্ণাঙ্গ দিকটি হাদীসনির্ভর। কোরআনের যে কোন অংশ পড়েই যে কেউ হেদায়েত লাভ করতে পারবে। কিন্তু সহীহ হাদীসের সংশ্লিষ্ট সব রেফারেন্স জানা না থাকলে কোনো বিষয়ে সঠিক ফায়সালা গ্রহণ বা প্রদান করা অসম্ভব।
যাহোক, ওই ভাই তারাবীহ’র নামাজ ৮ রাকায়াতের বেশি পড়ার কোনো হাদীস সিহাহ সিত্তাহ’র মধ্যে থাকলে জানাতে বলেছেন। আমি মাদ্রাসায় পড়ি নাই। তাই, এই পুরনো বিতর্ক নিয়ে নতুন বা পুরনো কোনো ফতোয়া-চর্চার প্রশ্ন ওঠে না। ওপরর্যুক্ত প্রেক্ষিতে এ বিষয়ে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে শেয়ার করছি মাত্র।
তারাবীহ নামাজ ২০ রাকায়াতের পড়ার পক্ষে যারা সোচ্চার, নিজেদের দাবীর সমর্থনে তারা প্রধানত যে রেফারেন্স দেয় তা তাদের দাবীকে (পূর্ণভাবে) সমর্থন করে না। অপরদিকে ৮ রাকায়াতের পক্ষে যারা আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদীসকে (মূলত: আছার) পেশ করা হয় সেটিও তাদের দাবীকে পুরোপুরি সমর্থন করে না।
২০ রাকায়াতপন্থীদের অসংগতিসমূহ
ক. রাসূল (স.) ৩ রাত মসজিদে বা-জামায়াত তারাবীহ পড়িয়েছেন। কতিপয় হাদীসে এর বর্ণনা থাকলেও রাকাআত সংখ্যার কোন উল্লেখ সেখানে নাই!
খ. যে কাজ স্বয়ং রাসূল (স.) করার তাগিদ অনুভব করেন নাই, আবু বকর (রা.) করেন নাই, উমর (রা.) ও বহু বছর করনে নাই সেটি পরবর্তীতে যত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে প্রতিপালিত হোক না কেন, তা নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি নয়!
গ. এক রমজানে নৈশ ভ্রমণে উমর (রা.) যখন দেখলেন, লোকেরা একা একা, কেউ কেউ ছোট ছোট জামাতে নফল নামাজ (পরবর্তীতে তারবীহ’র নামাজ হিসাবে পরিচিত) পড়ছেন তখন তিনি হযরত কাআব (রা.)’র অধীনে তাদেরকে একক জামায়াতবদ্ধ করে দেন। তিনি নিজে সেই জামায়াতে শরীক ছিলেন না! [যে কোন হাদীসের কিতাব থেকে হাদীসটির শেষাংশ পড়লে এটি জানতে পারবেন।]
ঘ. ২০ রাকায়াত পন্থীরা এ বিষয়ে ইজমার দাবী করেন। কোন বিষয়ে ইজমা ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়ে থাকলে তা আবার নতুন করে সদা-সর্বদা দাবী করা বা জানান দেয়ার তাৎপর্য কী? ‘এ বিষয়ে ইজমা হয়ে গেছে’ – ধরনের পূণ: পূণ: দাবীইতো প্রমাণ করে বিষয়টি অনিষ্পন্ন!
ঙ. তথাকথিত ‘খতমে তারাবীহ’র নামে ‘তুফান মেইলে’ কোরআন খতম দেয়ার [২০ রাকায়াতওয়ালাদের মসজিদসমূহে যা দেখা যায়!] পক্ষে এমনকি কাণ্ডজ্ঞানপ্রসূতও কোনো যুক্তি আছে? তেলাওয়াতের ন্যূনতম দ্রুত ‘হাদর’ পদ্ধতিকেও মেনটেন না করে কোনোমতে ২০ রাকায়াত শেষ করার পরে আস্তে-ধীরে ‘তারতীল’ সহকারে ৩ রাকায়াত বিতির পড়া হয়! অবাক কাণ্ড!
ইবাদতসহ যে কোন বিষয়ে যথাসম্ভব সহজতাকে অনুসরণ করার সুন্নাহকে যারা মানতে চায় না, এমন কঠোরতাবাদিদের পক্ষেই কোরআনের এমন ‘গণ-অবমাননা’ সম্ভব হতে পারে!
৮ রাকায়াতপন্থীদের অসংগতিসমূহ
আয়িশা (রা.) এর রেওয়ায়েত সূত্রে যে সহীহ হাদীসকে ‘আহলে হাদীস’পন্থীরা ‘শেষ-প্রমাণ’ হিসাবে তুলে ধরেন, দুঃখজনকহলেও সত্য যে, এটি তাদের বাস্তব আমলকে প্রত্যয়ন করে না!
১. উক্ত হাদীসকে যদি ভিত্তি বা চূড়ান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে বা-জামায়াত ৩০ দিন তারাবীহ পড়া সঠিক হয় না।
২. ‘তারাবীহ’র নামাজ’ নামে কোনো নামাজের আদৌ অস্তিত্ব থাকার কথা না। যেহেতু রাসূল (স.) উক্ত ৮ রাকাআত তাহজ্জুদ হিসাবে পড়েছেন।
৩. দুই রাকায়াত দুই রাকায়াত হিসাবে তারাবীহ পড়ার কথা না। কেননা, রাসূলুল্লাহ (স.) ৪ রাকায়াত ৪ রাকায়াত করে মোট [সুদীর্ঘ] ৮ রাকায়াত পড়েছেন।
৪. তারাবীহ’র ক্ষেত্রে এই হাদীসকে দলীল হিসাবে পেশ করলেও ওনারা বিতির পড়েন ১ রাকাত যা উক্ত হাদীসের সরাসরি লংঘন!
৫. সুনান আন-নাসাঈ’র ২য় খন্ডের অধ্যায় ২০, অনুচ্ছেদ ২ (কিয়ামুল লাইল) -এ সংশ্লিষ্ট এই হাদীসে বর্ণিত ১১ রাকায়াতের ডিস্ট্রিবিউশান আয়িশা (রা.)-এর সূত্রে অন্যভাবে দেখা যায়: রাসুলূল্লাহ (স.) এক নিয়তে ৮ রাকায়াত পড়ার পর বসে বসে ২ রাকায়াত পড়তেন। অত:পর আরো এক রাকায়াত পড়তেন। তাতে মোট ১১ রাকায়াত হতো। [সা’দ (রা.)কে বলা হবহু এই বাক্যটিই সেই দীর্ঘ, দেড় পৃষ্ঠা, হাদীসের অংশ!]
হাদীস অনুসরণ করার দাবী করলে সংশ্লিষ্ট সকল সহীহ হাদীসেরই সম-অনুসরণ করা উচিত। তাই না? এবার দেখা যাক ৮ রাকায়াতের অতিরিক্ত তারাবীহ পড়ার কোনো সহীহ হাদীসের হদিস সিহাহ সিত্তাহ’র কোনো গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে কিনা –
(ক) সাহাবা আজমাইন হতে অব্যাহতভাবে লোকেরা হাদীস লিখলেও আমরা ইমাম মালিকের মুয়াত্তাকে প্রথম সহীহ গ্রন্থ হিসাবে মানি। সেটির ১ম খন্ডের ৬ষ্ট অধ্যায় (রমযানের নামায)-এর ২য় পরিচ্ছদের ৫নং হাদীসের মতন হলো:
“লোকজন উমর ইবনে খাত্তাব(রা.) এর খিলাফতকালে রমযানে তেইশ রাকা’আত তারাবীহ্ পড়তেন – তিন রাকা’আত বিতর এবং বিশ রাকা’আত তারাবীহ। এটি হযরত উমর (রা.) শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়াছেন।”
(খ) জামে আত-তিরমিযী’র ২ খন্ড ৭ম অধ্যায় অনুচ্ছেদ ৮০ ‘রমযান মাসের কিয়াম’ শিরোনামে হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত ৭৫৩নং হাদীসে রাসূলুল্লাহ (স.) কর্তৃক রমজানের শেষ দশকে একদিন পর একদিন হিসাবে মোট তিনদিন বা-জামায়াত তারাবীহ পড়ানোর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। সেখানে রাকায়াত সংখ্যার কোনো উল্লেখ নাই। ইমাম তিরমিযী তার সুনানে পরবর্তী হাদীস বর্ণনার পূর্বে এই হাদীস সংশ্লিষ্ট একটি টীকা লিখেন:
‘আবু ঈসা বলেন, হাদীসটি হাসান ও সহীহ। রমযান মাসের রাতসমূহে দণ্ডায়মান হওয়া সম্পর্কে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কোন কোন আলেম বলেন, বিতরসহ এর রাকাআত সংখ্যা একচল্লিশ। এ হল মদীনাবাসীদের অভিমত এবং এখানকার লোকেরা এইরূপ আমল করেন। কিন্তু অধিকাংশ আলেমের অভিমত আলী ও উমার (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম থেকে বর্ণিত রিওয়ায়াত অনুযায়ী অর্থাৎ (তারাবীহ’র) রাকাআত সংখ্যা বিশ। সুফিয়ান সওরী, ইবনুল মুবারক ও শাফিঈ(র)-এর অভিমত। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, আমাদের নগর মক্কায়ও লোকদের বিশ রাকাআত পড়তে দেখেছি। আহমদ (র) বলেন, এই বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের রিওয়ায়াত বর্ণিত আছে। তিনি এব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেননি। ইসহাক বলেন, উবাই ইবনে কাব (রা)-র বর্ণনা অনুযায়ী আমরা একচল্লিশ রাকাআত পড়াই পছন্দ করি।’
(গ) সহীহ হাদীসের প্রখ্যত সংকলন মেশকাত শরীফের ২য় খণ্ড ‘বাবু ক্বিয়ামি শাহরি রামাদ্বানা’র ৩য় পরিচ্ছদের ১২২৯নং হাদীসটি নিম্নরূপ:
“হযরত আ’রাজ (রা.) হইতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, আমরা লোকদেরকে এরূপ দেখেছি,তাঁরা মাহে রমজানে (কুনুতে) কাফিরদেরকে বদদোয়া করতেন। আরও দেখেছি, ইমাম ৮ রাকাতে সূরা বাকারাহ সম্পূর্ণ পাঠ করতেন। যখন ইমাম এটি ১২ রাকাতে পড়তেন, লোকগণ মনে করত যে, তিনি নামাযকে খুব সংক্ষেপ করলেন। – মালেক”
এ ছাড়াও ইবনে আবি শাইবা ও বায়হাকীর হাদীসগ্রন্থে ২০ রাকায়াত তারাবীহর পক্ষে বেশ কয়েকটি সহীহ হাদীস রয়েছে। আমার দেখা-জানা মোতাবেক ‘আহলে হাদীসে’র লোকজনেরা সিহাহ সিত্তাহ’র বাহিরের হাদীসগ্রন্থসমূহকে খুব একটা মানতে চান না। তাই সেগুলোর উদ্ধৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকলাম।
কৈফিয়ত
তারাবীহ’র নামাজ ৮ রাকাআত না ২০ রাকায়াত – এ ধরনের একটি সাইড ইস্যু নিয়ে আমার মতো [নিরপেক্ষ?] মানুষ পোষ্ট না দেয়াই ভালো। ঈদে বাড়ি গিয়ে একজন বিজ্ঞ সহকর্মী যখন কয়েক বছর পর উনাদের এলাকার চাপে পড়ে পূণরায় এসব রেফারেন্স চাইলেন তখন হয়তোবা এগুলো আরো অনেকের কাজে লাগতে পারে। তাছাড়া, উনাকে এবিষয়ে মেইল করার ওয়াদা করেছি। ভাবলাম, কষ্ট করে যখন লিখলামই, তখন অন্যরাও পড়ুক। এ-ই আর কি! তবে, ভাই ও বোনেরা, আমি আলেম নই। দয়া করে অনাবশ্যক বিতর্ক তুলিয়া বিব্রত করিবেন না …! যাহা কিছু জানার, সরাসরি হাদীসের অধ্যায়গুলো হতে জানার চেষ্টা করুন!
আসুন, সব ধরনের বৈপরিত্য, একপেশে দৃষ্টিভঙ্গী ও কঠোরতাসুলভ আচরণ হতে আমরা সবাই বিরত থাকি। দ্বীন কায়েমের মতো বড় ধরনের ফরজকে নিয়ে ‘ফরজ-স্ট্যান্ডার্ডে’ ফিকির করি এবং ফরজ বাদে বাদবাকী সব নফল (সুন্নাতসহ) নিয়ে বাদ-বিসম্বাদ করা হতে বিরত থাকি। ভালো থাকুন!!!!!!!!!!!!