সম্প্রতি একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম। দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকে। বিশেষ সাক্ষাৎকার। আমাদের এখানে, মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উপস্থাপনাকে মূল্যায়ন করা হয় স্যান্ডউইচ পদ্ধতিতে। বলা হয়, এই লেখা বা বক্তব্যের এই এই ভাল দিক। এইটা এইটা এই কারণে আপত্তিজনক। সেই দৃষ্টিতে সাক্ষাৎকারটির ভাল-মন্দ উভয় দিক নিয়ে বলা সমীচিন হলেও লেখা সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারটি সম্পর্কে আমি এইখানে ভিন্নমত, আপত্তি ও প্রশ্নগুলো নিয়েই শুধু বলবো।

সাক্ষাৎকার দাতা সম্পর্কে পূর্ব-মুগ্ধতার দৃষ্টিতে না দেখে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখলে সাক্ষাৎকারটিকে মনে হবে জগাখিচুড়িমার্কা। এলোমেলো, অসংলগ্ন ও একপেশে। (উনিশ শ’) ষাট-সত্তুরের দশকের মতো একটা ইসলামী সমাজতন্ত্রী ধারা এ’দেশে আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এই সাক্ষাৎকারটিতে সেটার লক্ষণ ফুটে উঠেছে।

যেমন, সাক্ষাৎকার দাতা বলেছেন,

‘আমরা দেখতে পেলাম, ভাবাদর্শ আর সাংস্কৃতিক ফল্টলাইনে (বিভাজক রেখায়) বাংলাদেশকে বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। … গত ৫০ বছরে এর মীমাংসা হয়নি। কিন্তু আমাদের চেষ্টা ছিল।’

– এইখানে আমাদের জাতীয় বিভক্তির পিছনে সর্বস্তরে বিশেষ করে মধ্যবিত্তের সুবিধাবাদী মনোভাব যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে, তা বলা যেত। আদর্শ থাকলে, আদর্শবোধ থাকলে, তদনুরূপ ভাবাদর্শও থাকবে। আদর্শের মতো ভাবাদর্শেও পার্থক্য, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত হবে। স্বপক্ষ বিজয়ী হওয়াটাই ব্যাপার। ভাবাদর্শ ও সাংস্কৃতিক ফল্টলাইন থাকা এবং ফ্রন্টলাইন ফাইট ছাড়া কী আদর্শ টেকে?

বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে নিজেই নিজেদেরকে পাইওনিয়ার দাবী

স্বৈরাচারের সময়ে নানা ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা তো হয়েছে। আমরাও করেছি। সাক্ষাৎকার দাতা এবং উনার লোকজনও করেছে। আরো অনেকেই করেছে। বুদ্ধি-জ্ঞানসম্পন্ন কেউ তো আর বসে থাকে নাই। অথচ, উনি উনাদের কর্মকাণ্ডকেই ফোকাস করেছেন। তাতে আপত্তির কিছু নাই। কিন্তু উনি এবং উনার পক্ষের লোকজন যেভাবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার রূপকার হওয়ার দাবী করছেন, তা হাস্যকর। মাস্টারমাইন্ড হওয়ার দাবী করি নাই, এইটা বলে দেয়া বক্তব্যে নিজেকে কার্যত মাস্টারমাইন্ড হিসেবেই তিনি দাবী করা করেছেন। অন্যত্র।

তিনি মানে সাক্ষাৎকারদাতা কতটি আড্ডা দিয়েছেন তা উল্লেখ করতে না ভুললেও ডাকসু নির্বাচনের প্রসঙ্গকে স্কিপ করে গেছেন। নুরুল হক নুরু কীভাবে সিম্বল অব রেসিসটেন্স হয়ে দাঁড়ালো তা এড়িয়ে তিনি সরাসরি নুরুল হক নুরুর সংগঠন কেন ভাঙলো, সে প্রসঙ্গে চলে গেছেন। ডাকসু নির্বাচনে নুরু ছিল প্রতিরোধের প্রতীক। নুরুর অবদান এবং তাকে সামনে রেখে যারা তখন আগাইছিলেন তাদের অবদানের স্বীকৃতি এই সাক্ষাৎকারে নাই।

ঢাবি ক্যাম্পাসে আওয়ামী গোষ্ঠীর বাইরে তৎকালীন সময়ে যারা ছিলেন তাদের কোনো হদিস এই সাক্ষাৎকারে নাই। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে ইসলামী ছাত্রশিবিরের লোকজন বুদ্ধিবৃত্তিচর্চা থেকে শুরু করে পরোক্ষ রাজনীতি, সবকিছুতেই আগাগোড়া সক্রিয় ছিল। নেতৃত্ব দিয়েছে, কখনো সামনে থেকে কখনো পেছন থেকে।

শিবিরের অনস্বীকার্য অবদানকে স্বীকার না করার অসততা

আচ্ছা,

‘ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন হলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হবে। কিছু নেতৃত্বও তুলে আনা যাবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যে সরকারের পতনের বিষয়টি তো ছিলই।’

– এই বক্তব্য থেকে আমরা কী বুঝবো? তারা আন্দোলনের ছক করছিলেন, ইত্যাদি। তাই তো?

ছাত্রলীগকে ঘায়েল করার যে কোনো সুযোগকে ছাত্রশিবির কাজে লাগিয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের বেনামি নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকেই প্রথম একদফা অর্থাৎ হাসিনা পতনের ডাক দেয়া হয়েছে। কৌশলগত কারণে বিএনপি কিম্বা জামায়াত-শিবিরের কেউ ক্রেডিট দাবী না করলেও ওয়াকেবহাল মহল তো জানেন, কে কোথায় কখন কী করেছে। ২৮শে অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে জামাত-শিবির মেরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করেছিল। ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সরকারের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসছিল। আরেকটা পাল্টা মাইর দিয়ে এই বিএনপি ও জামাত-শিবিরই তাদেরকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে।

গেইম থিওরির সূত্র মোতাবেক এখানে কথিত মাস্টারমাইন্ডদের ভূমিকা ছিল অপরাপর সব প্লেয়ারদের মতোই। নেসেসারি, বাট নট সাফিশিয়েন্ট।

আন্দোলনের ক্রেডিট

স্বৈরাচার হাসিনার আমলে এমনকি মোড়ের চায়ের দোকানেও এটি বলা হতো, একটা রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ছাড়া স্বাভাবিক পন্থায় এই অপশক্তিকে নামানো যাবে না। এক দৃষ্টিতে, আওয়ামী লীগ বিরোধী এই আন্দোলনে সফলতার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো স্বয়ং হাসিনার। ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে কেউ যদি আমলে নেয়, তাহলে শেখ হাসিনা যা করেছে তার ভিত্তিতে বলা যায়, সে দলের সভানেত্রী হয়েও নিজ দল ও সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক ‘ষড়যন্ত্র’ করেছে।

আন্দোলনের কৃতিত্ব হাইজ্যাক করার সব মতলবি কথা দিয়ে সাক্ষাৎকারটি ভর্তি। যেমন, বলা হচ্ছে,

‘আন্দোলনের ৫ জুন থেকে ১ জুলাই পর্যন্ত সময়টা ছাত্রশক্তির সদস্যরা সমগ্র বাংলাদেশে আন্দোলনের সাংগঠনিক বিস্তার ঘটালেন। ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত আমরা সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থনও পাইনি৷ নানা রাজনৈতিক দল আর বুদ্ধিজীবীর কাছে আমরা গিয়েছি। কেউই উৎসাহী ছিল না।’

হাইকোর্ট কর্তৃক কোটা পূণর্বহাল করার অব্যবহিত পর হতে, অর্থাৎ জুনের ৫ তারিখ হতে মাসের শেষের দিকে ঈদের ছুটির আগ পর্যন্ত চবি ক্যাম্পাসে দেখেছি, প্রতিদিনই প্রটেস্ট প্রোগ্রাম হয়েছে। এ’ভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালিত হয়েছে সারাদেশে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আমার কাছে প্রমাণ আছে, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বেনামে যুক্ত হয়েছে জুলাই’র একেবারে শুরু হতে। জুলাইয়ের ১৬ তারিখের পরে নিরঙ্কুশভাবে তারাই মাঠে ছিল। ছাত্র সমন্বয়কবৃন্দ ও রাজনৈতিক সংগঠনের লোকজন কৌশলগতভাবে পরষ্পরকে পরষ্পর ‘কাজে লাগিয়েছে’ মাত্র। ওই যে বললাম, গেইম থিওরির সূত্র মোতাবেক।

সাক্ষাৎকার দাতা আন্দোলনের মাঠচিত্র বর্ণনার পরিবর্তে নিজের ঢোল পিটিয়েছেন অযথা। আমি জুলাইয়ের ৯ তারিখে একটা খাম হতে ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ শ্লোগানটার ছবি নিয়ে ফেইসবুকে কড়া স্ট্যাটাস দেই। পরের দিন চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক ঐক্যের সমাবেশে কড়া বক্তব্য রাখি। এভাবে বললে অনেকেরই বলার মতো অনেক কিছু আছে।

যদিও ‘প্রথম আলো’ শুধু ‘দায় ও দরদ’পন্থীদেরকেই শুধু খুঁজে পায়। স্বাভাবিক …

রনজিৎ স্যারের ১ ভোটের কৃতিত্ব

একবার আমরা আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন নির্বাচনে ১ ভোটে জয়লাভ করি। পালি বিভাগের ড. রনজিৎ বড়ুয়া স্যার দাবী করতেন এটি তারই ভোট। কথাটা টেকনিক্যালি কারেক্ট। স্যার বলতেন, ‘মোজাম্মেল খেয়াল রাইখো, আমার ভোটে কিন্তু তোমারা জিতছো।’ শৈবাল দিঘীরে বলে উচ্চ করে শির, মনে রেখো দিলাম তোমার এক ফোঁটা শিশির’ – এর শ্লোকের মতো বাংলা ব্লকেডের ‘অভিনব’ কর্মসূচীর কারণে নাকি ছাত্রদের আন্দোলনে জনতা যোগ দেয়।

বলা হচ্ছে,

‘বাংলা ব্লকেডের পরের সপ্তাহজুড়ে আমরা এটি বুঝতে পারি৷ আমাদের পরিকল্পনা ছিল জনগণকে পক্ষে নিয়ে আসার। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর জনমুখী সংযোগ আমরা ঘটাতে পারেনি। বাংলা ব্লকেডের মাধ্যমে ঢাকা শহরের জনসমর্থন আদায় করতে সমর্থ হলাম।’

যারা ছোট হাতুড়ি দিয়ে বড় পাথর ভাঙ্গে তারা পাথরের একই স্পটে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। এক পর্যায়ে লম্বা হাতলে লাগানো ওই ছোট্ট হাতুড়ির একটা আঘাতেই বড় পাথরটা টুকরা হয়ে ভেংগে পড়ে। হাসিনাবিরোধী আন্দোলন ছিল ঠিক তেমনই। মানুষজন ছিল এদের ওপর চরমমাত্রায় বিরক্ত। ক্ষুদ্ধ। আন্দোলনের ডাক ছিল অজুহাত মাত্র। হ্যাঁ, বাচ্চারাও মনে করে, তারা আংগুল ধরে টেনে বড়দেরকে তাদের ইচ্ছা মতো হাটাচ্ছে…! কী আর বলবো…!

‘শেখ হাসিনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’

আন্দোলনের প্রথম দিকে ইনক্লুসিভ শ্লোগান দিয়ে সরকারকে আশ্বস্ত রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। একটা পর্যায় পর্যন্ত এই কৌশল কাজও করেছে ভাল। তাই তো তারা প্রথম দিকে ততটা বাঁধা দেয় নাই। অথচ, ‘জাতিসংঘ স্বীকৃত’ মাষ্টারমাইন্ড মহোদয় বলছেন,

‘এত দিন যারা প্রতিবাদ করতে পারেনি, তারা প্রতিবাদ জানাতে শুরু করল। সরকার তখনো ছাত্রদের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। আমরা সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছি।’

একটু পরেই তিনি ছাত্রসংগঠনসমূহের অংশগ্রহণকে স্বীকার করে নিয়ে বললেন,

‘আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সংহতি তত দিনে বাড়তে শুরু করেছে। ছাত্রসংগঠনের সদস্যরা তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে এসে সমন্বয়ক ও কর্মী হিসেবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করলেন। আমরাও চেয়েছি সবাই থাকুক, গণ–আন্দোলন হোক। … আমাদের আশঙ্কা ছিল, এ আন্দোলন ব্যর্থ হলে ছাত্রশক্তিই বা কীভাবে টিকে থাকবে!’

রাজনৈতিক দলের কর্মীদের না হলেও তাদের নেতা যারা সমন্বয়ক পরিচয়ে সামনে এসেছে তাদেরকে আপনারা চিনতেন। তারা রাজনৈতিক সংগঠনের তরফ থেকেই কাজ করছেন, তা জানার কথা অস্বীকার করা হলো বোকার মতো মিথ্যা কথা বলা। এই আন্দোলনে সকল রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত ছিল আগাগোড়া। আমাকে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অনরেকর্ড বলেছে, তারা তাদের মূল সংগঠনের অনুমতি ও সহযোগিতা নিয়েই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিল।

জুলাইয়ের শুরু থেকে এই আন্দোলনে কাজ করা ছিল সকল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দলের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত, একসেপ্ট দুই লীগ: আওয়ামী লীগ ও তাবলীগ। যদিও এদের প্রচুর লোকজন একেবারে জুনের শুরু থেকেই আন্দোলনে নেমে পড়েছিল।

আপনারা যদি শ্লোগানের মাস্টারমাইন্ডই হতেন, তাহলে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ শ্লোগানকে আপনারা পরবর্তীতে যেভাবে ‘শুদ্ধ’ করতে চেয়েছেন, তা জনগণ মেনে নিতো। প্রকৃত ঘটনা হলো, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্লোগান বানিয়েছে। আপনাদের কোনো হদিস ছাড়াই আমরা ছাত্রদের মুখে চবি জিরো পয়েন্টে এই শ্লোগান শুনেছি, রাজাকার গালি দেয়ার পর পরই। সে রাতেই। সারা দেশে।

গুরু মজহারের মতো চেতনার জালিয়াতি-চর্চা

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। ‘জাতির পিতা’ সমগ্র জাতিকে গুলির মুখে ফেলে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে সেফ কাস্টডিতে চলে গেলেন। তাজউদ্দীন সাহেব ১০ই এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন করার সময়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা দিলেন। একটা কিছুর ঘোষণা দিতে হয়, জাস্ট সে হিসেবে। এরপর থেকে মতলবি লোকজন পরবর্তীতে প্রথম সংবিধানের প্রিআমবলে চাপিয়ে দেয়া ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য দাবী করছে, ‘৭২এর সংবিধানের  ৪ মূলনীতি নয়, বরং মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার কর্তৃক ঘোষিত ৩ মূলনীতির ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আমি একটা লেখায় বিস্তারিত লিখেছি, এখানে মূল কথাটুকু বলছি। না, কোনো নীতির ভিত্তিতে বা কোনো আলাদা ধরনের দেশ গঠনের জন্য লোকেরা যুদ্ধ করেনি।

লোকেরা জুলুম থেকে বাঁচার জন্য লড়াই করেছে। আক্রমণকারীদেরকে প্রতিহত করার জন্য লড়াই করেছে। চেতনার কথা যদি বলেন, আমি কথা বলে দেখেছি, ইসলামের শহীদি চেতনাই ছিল সেই চাপিয়ে দেয়া অপ্রস্তুত যুদ্ধের মূল চেতনা।

‘৭১এর মতো ‘২৪শেও দেখছি, সেইম স্ট্যান্টের চেতনাবাজি শুরু হয়ে গেছে।

আলোচিত এই সাক্ষাৎকারে বলা হচ্ছে,

‘এই গণ–অভ্যুত্থানকে আমি অনেক কিছুর মীমাংসা আকারে দেখি। সাংস্কৃতিক প্রশ্নে মীমাংসা, আদর্শিক প্রশ্নে মীমাংসা।’

সম্প্রতি যে আন্দোলন হলো তেমন আন্দোলনের নজির আমি ইতিহাসে পাই নাই। সাম্প্রতিক বিশ্বে তো নয়ই। সেই আলোচনায় যাচ্ছি না। শুধু এ’টুকু এখানে বলতে চাচ্ছি, ’৩৬ জুলাই’ বলতে সারা বিশ্বের মানুষ হাসিনার পতন দিবসকেই বুঝেছে। বুঝবে।

বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জল খাওয়ার এই বিরল ঘটনাতে নির্ভেজাল ঐক্যমত ছিল শুধু ‘হাসিনাগিরি’র অবসান ঘটানোতে। আর কোনো ‘মীমাংসা’ এখানে হয়নি। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার – এ’গুলো খুব vague তথা inderminate কথাবার্তা। কথা সংক্ষেপ করার জন্য উদাহরণ হিসেবে বলছি, LGBT নিয়ে কোনো মীমাংসা কি হয়েছে? কোথায়? কীভাবে? বিতর্কটাই প্রমাণ করে এ’বিষয়ে ঐক্যমত ছিল না।

Let Sheikh Hasina go, এটি ছাড়া জুলাইয়ের গণআন্দোলন ও অভ্যুত্থানে কোনো কিছুই determinate ওয়েতে মীমাংসিত হয়নি। লোকদের মধ্যে কিছু সাধারণ গুড উইশ আছে। কিছু রেটরিক আছে। সেগুলোও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ।

আন্দোলনের অলিখিত ইশতেহার ও তরুণ নেতৃত্ব প্রসঙ্গ

এখানেও দেখছি মতলবি কথাবার্তা। ‘সব মিলিয়ে আন্দোলনের অলিখিত ইশতেহারটা কী?’ – এই প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষাৎকারদাতা বললেন,

‘আকাঙ্ক্ষা যে সব সময় সোচ্চার ছিল, তা নয়। বহু আকাঙ্ক্ষা সুপ্তও ছিল। নতুন বাংলাদেশে অনেকেই অনেক কিছু দেখতে চায়। তরুণেরা প্রাথমিকভাবে চায় প্রতিনিধিত্ব। শুধু নির্বাচনে নয়, সবখানেই যেন তারা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে।’

ইতিহাসে সব বড় বড় ঘটনায় দেখা যায়, কিছু সংঘবদ্ধ লোক দলভুক্ত অন্যান্যদের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজেদের ইচ্ছামতো গুলি চালায়। সময় মতো খেলে দেয়। ‘সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা’র কথা শোনে এখানেও সে ধরনের কিছু একটা হয়েছে বা ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে, এটি স্পষ্ট।

‘নির্বাচনে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব’ কীভাবে তারা নিশ্চিত করতে চায়? কোটা ব্যবস্থা ছাড়া আমি তো এর উপায় দেখছি, একটাই। সেটি হলো বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে তাদের যোগদান করে ওই পার্টির লীডারশীপ ল্যাডার বেয়ে নেতৃত্বে আসা।

এ’ছাড়া তারা নিজেরাও দল গঠন করতে পারে। সমূহ আশংকা, কোনো ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং না হলে এই ভবিষ্যৎ কিংস পার্টি নির্ঘাৎ ফেল করবে।

নারীরা কি আসলেই কোটার দাবী পরিত্যাগ করেছে?

তালেগোলে নারী কোটা বিলুপ্ত হয়েছে। তো? নারীরা কি আসলেই কোটার দাবী ত্যাগ করেছে? আমার মনে হয় না, এনজিওবাদী নারীনেত্রীরা কোটার দাবী পরিত্যাগ করেছে। তারা আস্তে আস্তে এই ইস্যুতে সোচ্চার হবে। এটি তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। দেখবেন।

সাক্ষাৎদানকারী বলছেন,

‘১০ শতাংশ কোটা থাকা সত্ত্বেও মেয়েরা এসে বলল, আমরা কোটা চাই না। কেন? কারণ তাদের আত্মমর্যাদায় লাগছিল। … এ আন্দোলনকে আপনি মর্যাদাবোধের পুনরুদ্ধার প্রকল্প আর নানা শ্রেণি–আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিনিধিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখতে পারেন।’

আন্দোলনটা আমাদের দেশেই হয়েছে। এই আমরাই তো আন্দোলন করেছি। মরি নাই, সেটা তো আমাদের কোনো ডিসক্রেডিট না। আমরা তো সবকিছু জানি। ঘটনার সাক্ষী এবং অংশ। এই আন্দোলন ছিল স্রেফ আত্মরক্ষার লড়াই। মর্যাদার প্রশ্ন পরের কথা। শেখ হাসিনা অঘোষিতভাবে উত্তর কোরিয়া স্টাইলে তৎকালীন ইটালির ফ্যাসিবাদ এখানে কায়েম করেছিল। ওর বাপ যা করতে পারে নাই, সে তাই করেছে। দেশের ভাগ্য ভাল, পিতা শুরুতে ফেইল করেছিল। দেশের দুর্ভাগ্য, কন্যার হাতে তার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। মৌলবাদ ঠেকানোর শর্তে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে এই এনজিওবাদী সুশীল বাপেরা হাসিনাকে বাকশালের ষোলকলা পূর্ণ করার সুযোগ দিয়েছিল। হাসিনাকে হাসিনাগিরি করার অবারিত সুযোগ নিশ্চিত করেছিল।

মানুষ স্রেফ বাঁচতে চেয়েছে। তাই জীবনপণ হয়েছে। লড়াই করেছে। অকাতরে জীবন দিয়েছে। অঙ্গহানিকে মেনে নিয়েছে। পুরো ব্যাপারটাতে আগেই বলেছি, হাসিনা স্বয়ং হলো ট্রুলি টপমোস্ট কন্ট্রিবিউটর।

‘বিভাজনের রাজনীতি’ প্রসঙ্গে চাতুর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা

‘সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত জায়গায় বিভাজনের রাজনীতির একটা মীমাংসা তারা চায়। এমন এক পরিসর চায় যেখানে সবাই সবার কথা বলতে পারবে, প্রত্যেকের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে। কোনো রকমের যদি আর কিন্তু ছাড়াই মৌলিক মানবাধিকার আর নাগরিক অধিকার তারা ভোগ করবে’

সাক্ষাৎকারদানকারীর এই বক্তব্য যদি সঠিক হয় তাহলে আন্দোলনে সিংহভাগ স্টেক হোল্ডার ইসলামপন্থী জনগণ কেন পাঠ্যপুস্তকে ‘ইসলামবিরোধী’ এক্সপার্টদের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলো? এখন কি বলতে চাইবেন, ইসলামপন্থীদের স্টেক কম? অথবা, নাই? নাকি, তারা ‘ভুল বুঝছে’?

বামপন্থীরা কি তাদের মৌলবাদ ঠেকানোর ন্যারেটিভ ভুলে গেছে? তারা চেয়েছিল, আওয়ামী লীগকে দিয়ে ইসলামপন্থীদের নির্মূল করবে। তাদের দৃষ্টিতে তারা তা করতে পেরেছে। এরপর তারা আওয়ামীলীগবিরোধী পক্ষের সাথে শেষ পর্যায়ে যোগ দিয়ে চেয়েছে আওয়ামী লীগকে হঠিয়ে নিজেরা দেশটা দখল করবে। আপাতদৃষ্টিতে তারা তা পেরেছে। তাদের বলয়ের লোকজনকে দিয়ে একটা এনজিও সরকার গঠন করতে পেরেছে।

এখন তাদের হয়ে মাস্টারমাইন্ড মহোদয় দাবী করছেন,

‘পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রেখে নির্বাচনে গেলে অন্য দল এলেও তারা অগণতান্ত্রিক রূপ ধারণ করবে। এ অবস্থায় … যারা বাংলাদেশে নতুন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষায় গণ–অভ্যুত্থান করেছে, তারাও যে আন্তদলীয় সংস্কার চাইবে, এটাও তো স্বাভাবিক।’

এরা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আওয়ামী কায়দায় সংস্কার চাপাতে চাচ্ছে। তারা এটি মানতে চাচ্ছে না, আওয়ামী লীগকে হঠিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে আওয়ামীবিরোধী শক্তিগুলো। জনগণ বরাবরই ছিল এখনো আছে বেশিরভাগ ধানের শীষ, পাল্লা মার্কা আর তাদের এলাইদের সাপোর্টার।

জনগণ বরং চায়, এই দুই মার্কা যাতে মিলেমিশে থাকে। একটা ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশানে বিএনপি, জামায়াত আর তাদের সমমনাদের বাইরের দলগুলো খড়খুটার মতো ভেসে যাবে। তাই আওয়ামী লীগবিরোধী ছোট দলগুলোর উচিত রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়া এই দুই বড় দলের সাথে জোট করে রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টা করা।

সাক্ষাৎকার দানকারীর সমস্যা হলো, তিনি এটি মানতে নারাজ, যারা গণ-অভ্যুত্থান করেছে তাদের বৃহদাংশই প্রত্যক্ষভাবে বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদের লোক। চিন্তায় যদি তার এই মৌলিক গলদ না থাকতো তাহলে তিনি ‘বিএনপি-জামায়াত বনাম গণ-অভ্যুত্থানকারী’ – এই ধরনের একটা ফলস বাইনারিতে লিপ্ত হতেন না।

ক্লাব রাজনীতি চাই না’র ব্যাখ্যা কী?

‘তরুণেরা বাংলাদেশে প্রচলিত ক্লাব রাজনীতি চাইছে না। তাদের চাওয়া দুরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতি’ – দাবী ‘নদীময় ইসলামের’ অনুরক্ত মাস্টারমাইন্ড মহোদয়ের। তার মতে,

‘রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পুরোনো অভ্যাস ও সংস্কৃতি বজায় রাখতে চাইবে। অথচ আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তন করতে হবে, দলগুলোতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে।’

কিউরিয়াস মন জানতে চায়, যেটার তারা বিরোধিতা করে সেই লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি ছাড়া প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে তরুণদের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর উপায় কী? একটু খোলাসা করে বলবেন?

রাজনীতির ফর্মূলা না জেনে রাজনীতি নিয়ে সিরিয়াস কিছু বলা বা করার চেষ্টা

পাওয়ার পলিটিক্সের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অন্তঃদলীয় কোন্দল। দলের ভেতরকার ছোট ছোট গ্রুপগুলোর পাওয়ার স্ট্রাগলের মাধ্যমে দলগুলো শক্তিশালী হয়। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ছাড়া শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে উঠে না। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘সৎ কাজে তোমরা পরষ্পর প্রতিযোগিতা করো’। গণতান্ত্রিক রাজনীতিসহ সকল ধরনের রাজনীতির এটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। শর্ত। অথচ, সাক্ষাৎকার দানকারী বলছেন,

‘আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোদ্ধারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে তারাসহ প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে আমরা আহ্বান জানাতে পারি, নিছক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা ছেড়ে তারা যেন রাষ্ট্র গঠনের দৃষ্টিভঙ্গিটা নিয়ে আসে।

আগে প্রতিযোগিতা ছিল কে কার আগে ক্ষমতায় বসতে পারে, লুটপাট করতে পারে। এখন প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত দেশকে কে কোন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশকে সামনে রেখেই রাজনীতি গোছানো উচিত।’

পুরো উদ্ধৃতিটুকু ভাল করে পড়ে দেখেন, এখানে তাদের বিরাট ভয়, ঠিক আওয়ালী লীগের মতো, জনগণ যথেষ্ট শিক্ষিত হয়ে উঠেনি। তারা নিজেদের ভাল নিজেরা ভাল করে বোঝে না। তাদেরকে এখনি অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দিলে তারা ভুল করে ফেলবে। আর তাতে করে ‘পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ আর ‘বদভ্যাস’ জিইয়ে থাকবে।

রাজনীতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। প্রশাসন চালানো রিয়েল ক্যাপাসিটির ব্যাপার। মিষ্টি মিষ্টি কথা দিয়ে এনজিওবাদী আদর্শের রাজনীতি চলে। ক্ষমতার রাজনীতি চলে না। ক্ষমতায় যেতে হলে ক্ষমতার রাজনীতি করতে হয়। রাজনীতির ফর্মূলা মেনে রাজনীতি করতে হয়। conflict is an integral part of power politics। কনফ্লিক্টের মাত্রা, ক্ষেত্র ও নৈতিক মান কী হবে, তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

ক্যাডার সিস্টেম? অথবা, কাউন্সিলর সিস্টেম?

সাক্ষাৎকার দাতা বলছেন,

‘কেবল রাষ্ট্র সংস্কার করলেই তো হবে না। দলগুলোর ভেতরেও সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কীভাবে নির্বাচিত হবে, তার প্রক্রিয়া সংস্কার করা উচিত। তাদের অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রয়োজন। দলগুলোর বিশুদ্ধিকরণের জন্য সামাজিক চাপ তৈরি করতে হবে। পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর বদভ্যাস জিইয়ে রাখার জন্য তো এত মানুষ জীবন দেয়নি।’

মানুষজন কেন জীবন দিয়েছে, এটি জানা কঠিন কিছু নয়। তাদের বিরাট অংশ ফেইসবুকে লিখতো। মৃত্যুর আগে ফেইসবুকে তারা কী লিখেছে? তাদের সোশ্যাল ইনভল্ভমেন্ট কী ছিল? কাছের মানুষজনকে মৃত্যুর আগে তারা কী বলে গেছেন? যারা মৃত্যুর দুয়ার হতে ফেরত এসেছে তারা কী জন্য জীবনবাজি ধরেছিল? বেশি দিন তো আগের নয়। খোঁজ নেন। আমি নিজেও তো মৃত্যুর মুখ হতে ফেরত এসেছি। কই আমার মাথার মধ্যে পুরনো রাজনীতি, নতুন রাজনীতি, কোনো মাস্টারমাইণ্ড, গণচিন্তা, ইনক্লুসিভ ল্যাংগুয়েজ, এ’ধরনের কিছুই কাজ করেনি।

আমরা শুধুমাত্র স্বৈরাচারকে হঠাতে চেয়েছি। ভেবেছি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা অধিকতর ভাল থাকবো। এইটুকু। আগেই বলেছি, এই অকুতভয় প্রতিজ্ঞা, এই অসীম সাহসের মূল উৎস ছিল আমাদের ঈমান, ন্যায়বোধ ও দেশপ্রেম।

এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সংস্কার আনার জন্য যে নব্যচেতনাপন্থীরা যা বলছেন, সেটার পথ কী? কোন পদ্ধতিতে? এবং কীভাবে?

যদ্দুর জানি, জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী সংগঠন এবং বাম সংগঠনগুলোতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয় দলের মানসম্পন্ন কর্মী তথা ক্যাডারদের ভোটে। বিএনপি-আওয়ামী লীগের মতো সংগঠনগুলোতে নেতৃত্ব নির্বাচন হয় সম্মেলনের ডেলিগেট হিসেবে আসা কাউন্সিলরদের ভোটে।

সংস্কার দাবীদারদের কাছে প্রশ্ন, এই দুই পদ্ধতির বাইরে তারা আসলে কী চাচ্ছেন? পরিষ্কার করে বলা যায় না?

ইসলামপন্থীরা কাদের সাথে সংলাপ করবে? কেন?

সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে তিনি ইসলামপন্থা নিয়ে সাংঘাতিক হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছেন। বলা যায়, তার প্রতিটি কথাই ভুল, ব্যাখ্যাসাপেক্ষ, একপেশে ও আরোপিত। তিনি বলছেন,

‘বাংলাদেশে যত ধরনের ইসলামপন্থী চিন্তাধারা আছে, গত ৫০ বছর তাদের সঙ্গে কোনো সংলাপ না হওয়ায় সংক্ষুব্ধতার জন্ম হয়েছে। সংক্ষুব্ধতা মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে।’

ইসলামপন্থীদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে দেখানোর সেই পরিচিত অপচেষ্টা। ইসলামপন্থীরা কাদের সাথে সংলাপ করবে? কেন?

একজন ইসলামপন্থী হিসেবে আমি তো জানি, আমাদের সাথে প্রতিনিয়ত সংলাপ হচ্ছে জনগণের। জনগণ আমাদেরকে পছন্দ করে। সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে, বিশেষ করে কালচারাল ও মিডিয়া ফ্যাসিবাদ কায়েম করে জনগণের সাথে আমাদের দূরত্ব দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আল্লাহর মাইর, আলহামদুলিল্লাহ! পরাজয় হয়েছে সব কুচক্রীদের। এতদিন তারা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করেছে। এখন তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে ভর করে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে বরং জনসমর্থনহীন যতসব মিডিয়া বুদ্ধিজীবী কুচক্রীদের।

মাস্টারমাইন্ড মহোদয়ের ভক্তকূলকে বলছি- না, ইসলামপন্থীরা এতিমখানা হতে উঠে আসা অসহায় জনগোষ্ঠী নয়। তারা আপনাদের কলিজার ভেতর হতে বের হয়ে আসা সাচ্চা ঈমানদার। আপনাদের পাশে বা সামনে বসে এ’সব ইসলামপন্থীরা আপনাদেরই ভাষায় আনএপলোজেটিক ওয়েতে কথা বলে। তারা নিরীহ মাদ্রাসাপড়ুয়ামাত্র নন। আপনাদের কোনা সংলাপেই তারা মুসলমানিত্বের বিনিময়ে আপনাদের মর্জি মোতাবেক ব্যাখ্যার কথিত বাঙালী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে না।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, ঢাকাতে নয়-

সেকুলারিজমের নামে ইসলামবিদ্বেষের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সেকুলার উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে, ঢাকাতে নয়। রমজানের সময়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকামাত্রই বুঝতে পারছিলাম, আমি দেশের ভেতরকার অন্য এক দেশে চলে এসেছি।

সাক্ষাৎকারদানকারী তরুণ বুদ্ধিজীবী মহোদয় যখন বলেন,

‘গ্রামের মানুষ তো ঢাকা শহরকেই রাষ্ট্র হিসেবে দেখে। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের কেউ কিছু দেবে না। নিজেদের ব্যবস্থা তারা নিজেরাই করে নিয়েছে। নিজেদের একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সেখানে আধুনিক জামাকাপড় পরে কেউ গেলে তারা সন্দেহ আ বিদ্বেষের শিকার হয়। কারণ, গ্রামের মানুষ তাদের নিজেদের মতো সীমানা তৈরি করে নিয়েছে—তুমি ঢাকায় যা খুশি করো, এখানে করতে পারবে না।’

তখন তিনি প্রাকারান্তরে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চান। তার সেই চেষ্টা বৃথা। মানুষ এখন দাবী করছে, আমাদের টাকায় যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেখানে কী হয় তা জানার অধিকার আমাদের আছে। বরং দেশের বৃহত্তর জনগণের কৃষ্টি, কালচার, জীবন ও মূল্যবোধ তথা ঐতিহ্যে ফেরার এই দৃশ্যমান আকাঙ্ক্ষা এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতর থেকেই প্রবল হয়ে উঠছে। বুয়েটের শহীদ আবরার থেকে শুরু করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদ, তাদের আকাঙ্ক্ষা কী ছিল, একটু স্মরণ করলে বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন সমন্বয়কদের সমন্বয়কের কথার ফাঁকি কতটুকু এবং ঠিক কোন জায়গায়।

‘লালসালু’ কে লিখেছিল? মাজারে কারা যায়?

আহা, মিথ্যা কথা কত ফাঁপা…!

সমন্বয়কদের সমন্বয়ককে মতলবি প্রথম আলোর প্রতিনিধি প্রশ্ন করেছেন, ‘মাজার তো গরিব মুসলমানের প্রতিষ্ঠান। এ’গুলো ভাঙল কারা?’ প্রধান সমন্বয়ক মহোদায় উত্তরে বলেছেন,

‘মাজার ভাঙার ঘটনার পেছনে একটা রাজনৈতিক আক্রোশ আছে। … ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতীক ভেঙে ফেলা হয়েছে, সেটা একটা দিক। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেকোনো কিছু ভাঙার বিরুদ্ধে।’

শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙ্গার জন্য এখানে তিনি দৃশ্যত ইনডাইরেক্ট এপলজি করছেন। আর মাজারের ব্যাপারে যা বলেছেন তা ভুল। মাজারে ধনীরা গরীবদের চেয়ে বেশি যায়। ধনীরা মাজারে টাকাও বেশি দেয়। গরীব মানুষ সংখ্যায় বেশি। এ’টুকু ছাড়া আর পার্থক্য নাই। বরং বলা যায়, মাজার হলো বড়লোকদের ব্যবসা। ধনীরা সবখানে গরীবদের শোষণ করে। মাজারও নয় এর ব্যতিক্রম।

আমার বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে। মাইজভাণ্ডারের কাছে। আশা করি আমাকে কেউ মাজার ব্যবসা শেখাতে আসবেন না। কারণ, মাজার ব্যবসা সম্পর্কে আমি আপনার চেয়ে বেশি জানি। খোঁজ নিলে আপনিও জানতে পারবেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালু’র চেয়ে অধিকতর বাস্তবধর্মী কোনো উপন্যাস আমি পড়ি নাই।

তওবার রাজনীতির ভুল ব্যাখ্যা

সাক্ষাৎকার দানকারী মহোদয় তদীয় উস্তাদ ফরহাদ মজহারের মতো কথাকে টুইস্ট করে কথা বলাতে দেখছি এই বয়সেই যথেষ্ট উস্তাদি হাসিল করেছেন। এ’জন্যই ফরহাদ মজহারকে আমি ঈর্ষা করি। সে যাই হোক, নদীময় ইসলাম কিংবা নদীয়ার ইসলামে ভাবানুসারী সাক্ষাৎকারদানকারী মহোদয় বলছেন,

‘বাংলাদেশে খেলাফতের কথা প্রথম শুরু করেছেন হাফেজ্জী হুজুর। তাঁর দলের নামও ছিল খেলাফত আন্দোলন। তাঁর রাজনীতির একটা মজার পরিভাষা আছে—তওবার রাজনীতি। মানে, পূর্বেকার রাজনৈতিক ভুলগুলো থেকে তওবা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে।’

হায় আল্লাহ! কোথায় ‘তওবার রাজনীতি’ আর কোথায় ‘পূর্বেকার রাজনৈতিক ভুলগুলো থেকে তওবা করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে গড়ে’ তোলার কথা…! হাফেজ্জী হুজুরের তাওবার রাজনীতির মূল দাবী ছিল রাজনীতি হারাম মনে করা হতে তাওবা করা। অনৈসলামী রাজনীতি হতে তাওবা করে ইসলামী রাজনীতির চর্চা করা।

আচ্ছা, ‘বর্তমান যুগে রাষ্ট্র এমন একটা নিপীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, যার সঙ্গে কোনো ধর্মই যায় না’ – এই কথা দিয়ে তিনি, মানে সাক্ষাৎকার দাতা, একচুয়েলি কী বোঝাতে চেয়েছেন? তিনি খেলাফত চান, এমনটি? অথবা, হোয়াট?

বাকচতুরতা আর মাল্টিলেয়ারে ব্যাখ্যাযোগ্য কথা বলা, এটি সকল মজহারির কমন বৈশিষ্ট্য।

মজহারীয় ইসলাম প্রকল্প

একই ধাঁচের গোলমেলে কথা দিয়ে উনার পরবর্তী প্রশ্ন-উত্তরটি ভর্তি। এ’সব বিষয়ে আমার বই আর আর্টিকেল আছে। ফরহাদ মজহারের ইসলাম-প্রকল্প এখানে পুরোমাত্রায় হাজির, দেখতে পাচ্ছি। কথাগুলো যেন স্বয়ং মজহারই বলছেন,

‘সমাজ, সংস্কৃতি, আচার আর অভ্যাস হলো ধর্মের পরিসর। ধর্ম থেকে রাষ্ট্রে কেবল একটা বিষয়ই আসতে পারে, সেটা নৈতিকতা। তবে ইসলাম এমন একটা ধর্ম, যার রাজনৈতিক প্রস্তাবনা আছে। …

কিন্তু রাষ্ট্র যদি ইসলামকে জায়গা করে দিতে চায়, তাহলে তো ইসলামই সীমিত ও নিপীড়নের অনুষঙ্গ হয়ে যাবে। ইসলামি উম্মাহর ধারণা তো বিশ্বজনীন। জাতিরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। বিদ্যমান জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোয় ইসলাম বা শরিয়াহ বাস্তবায়ন অসম্ভব। …

যদি পুরোপুরি শরিয়াহর প্রশ্ন আসে, তাহলে শরিয়াহও পাওয়া যাবে না, রাষ্ট্রও না। … রাষ্ট্রের ভেতরে ধর্মের মীমাংসা সেরে ফেলা উচিত।’

এখানে তিনি ধর্ম, ইসলাম, রাজনীতি, খেলাফত ব্যবস্থা, সব কিছুকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ইসলামের একটা মডার্ন এপলোজেটিক ভার্শান এবং আন্ডারস্ট্যান্ডিংকে তুলে ধরেছেন।

‘শরিয়াহ মুখ্য নয়, প্রয়োজন হলো মাকাসিদ-উশ শরিয়াহ’ বলে ফলস বাইনারি করেছেন। ‘(মাকাসিদ-উশ শরিয়াহ) যার মূল কথা জীবন-মালের হেফাজত করা’ – বলে জ্বাজ্বল্যমান মিথ্যা কথা বলেছেন। ঈমান হলো দ্বীনে হকের ফিলসফিক্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। ইসলাম হলো এর প্রাকটিক্যাল আসপেক্ট বা লাইফস্টাইল। এই দৃষ্টিতে কার্যত শরিয়াহ-ই মুখ্য। মাকাসিদ-উশ শরিয়াহ হলো শরীয়াহ বাস্তবায়নের ক্রমধারা তথা পদ্ধতি। মাকাসিদুশ শরিয়াহ’র মূল শর্তটাই হলো দ্বীন তথা ধর্ম রক্ষা করা।

কয়দিন আগে আমি একটা সেমিনার করেছিলাম। সেখানে আমার পেপারের টাইটেল ছিল, ‘একজন মুসলমান হিসেবে কেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আপনার জন্য অপরিহার্য’। আমার সাইটে আর ওয়ালে সেটি পাবেন। এক্সপ্লোর করে দেখতে পারেন।

রাষ্ট্রের নৈতিকতা প্রশ্ন

আমাদের অতিসুশীল সমন্বয়কদের নেপথ্য সমন্বয়ক বলছেন,

‘রাষ্ট্রের নৈতিকতার প্রশ্নেও বৈষম্যমূলক কোনো ধারা থাকা যাবে না। … প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব যেসব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রকাশ রয়েছে, তাতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না।’

আমি শুরুতেই বলেছি, বয়স যাই হোক, পজিশনের কারণে আমরা সাক্ষাৎকারদানকারীর কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি। তাই কারো কোনো গড়পরতা কথাকে যেভাবে বেনেফিট অব ডাউটের সুবিধা দেয়া যায় বা দেয়া হয়, এখানে তা হবে না।

তিনি যদি মনে করেন, রাষ্ট্রের নৈতিকতা থাকবে না, বা সবার জন্য তা সমান হবে, তা কী করে গ্রহণযোগ্য হয়? লিবারেলিজমও তো একটা আদর্শ যা জোর করে ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর চাপানো হয়। সাংঘর্ষিক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক আবহে তো কোনো আদর্শ কন্টিনিউ করতে পারে না। মারা পড়ে।

পাপ ও অপরাধের তথাকথিত পার্থক্য নিয়ে আমার একটা দীর্ঘ আলাপ আছে। এটি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘চিন্তার স্বাধীনতা ও ইসলাম’ গ্রন্থে সংকলিত আছে। এখানে আমি শুধু একটা প্রশ্ন তুলবো, কথার কথা হিসেবে, কোনো সম্প্রদায়ে যদি নরবলি দেয়ার বিধান থাকে, ‘ভিক্টিম’ যদি স্বেচ্ছায় বলি হতে রাজি থাকে, তাহলে খানে খানানের মতো সমন্বয়কদের সমন্বয়ক মহোদয়ের দল কিম্বা সরকার কোন অধিকারে তাতে বাধা দিবে?

কথাটা এজন্য বললাম, রাষ্ট্র হলো বেসিক্যালি দ্যা হাইয়েস্ট লিগ্যাল অথরিটি। ইটস ট্রু, রাষ্ট্র কোনো সুপ্রিম মোরাল অথরিটি না। এর বিপরীতে, নৈতিকতার সাথে রাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক নাই, ব্যাপারটা ঠিক এমনও না। মূল সম্পর্ক কিংবা বিরোধটা হলো আইন ও নৈতিকতার পারষ্পরিক সম্পর্ক কিংবা পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে। এ’সব নিয়ে বিস্তারিত কথা অন্যত্র বলা যাবে। এখানে শুধু এ’টুকু বলতে চাই, মুখস্ত কথা বলে দেয়া কিংবা কোনো একপাক্ষিক কথাকে সামগ্রিক অর্থে চালিয়ে দেয়া, এ’গুলো ঠিক না।

অযাচিতভাবে নারীর শৃংখলমুক্তির প্রসঙ্গ

প্রথম আলোর প্রতিনিধির ভাষায় প্রশ্নটা ছিল এ’রকম, ‘১৯৪৭, ১৯৭১, ২০২৪—ইতিহাসের এই পর্বগুলোকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন?’

উত্তরে অপ্রাসঙ্গিকভাবে নারীমুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে এসে বলা হলো,

‘১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় এক শ বছর নানা লড়াই করেছে, নানা প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছে—ভাষার, সংস্কৃতির, সমাজের। সংগীতকে, নাট্যকলাকে, নৃত্যকলাকে, নারীকে কীভাবে দেখবে, সেসব প্রশ্নেরও।

বেগম রোকেয়ারও আগে মির্জা দেলোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি ইসলাম থেকেই যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, নারীর শৃঙ্খলমুক্তি প্রয়োজন। মুতাজিলা নামে লেখালেখি করতেন বলে তাঁকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।

এসব কারণে ১৯৪৭ সালকে আমি দেখি বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মুক্তির জায়গা থেকে।’

দেখেন, টিপিক্যাল লেফটিস্ট ফেনোমেনা এন্ড ন্যারেটিভ। সংগীত, নাট্য ও নৃত্যকলা, নারী, নারীর ‘শৃঙ্খলমুক্তি’ ইত্যাদি।

’৪৭, ’৭১ ও ’২৪ – এগুলো প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ঘটনা। দুনিয়াটাই এমন, প্রত্যেক কিছুর সাথে বাদবাকী সবকিছুর কোনো না কোনো ধরনের যোগাযোগ থাকে। একটা কিছু বাদবাকী সবকিছুকে নানা মাত্রায় প্রভাবিত করে। রাজনীতিমুক্ত কোনো ধর্ম বা অর্থনীতি নাই। অর্থনীতির প্রভাবমুক্ত কোনো ধর্ম বা রাজনীতি নাই। আবার ধর্মের প্রভাবমুক্ত কোনো রাজনীতি বা অর্থনীতি জগতে আসেনি। তাই বলে রাজনীতিকে আমরা অর্থনীতির কিংবা ধর্মের সমার্থক বলে মনে করি না। তালেগোলে যারা গোল দিতে চায় তারা একটার সাথে আরেটা গুলিয়ে ফেলে এ’ধরনের ভজঘট পাকায়।

নারীমুক্তির ধারনা একেক জায়গায় একেক রকম। এখানে নারীবাদের আলোচনা অতীব প্রাসঙ্গিক হলেও এখানে তা করার সুযোগ নাই। সাক্ষাৎকারদানকারীর উত্তরটা যে অগোছালো, এবং সেখানে নারীর শৃঙ্খল মুক্তির প্রসঙ্গ যে অযাচিতভাবে এসেছে, আপাতত শুধু এ’টুকু বলছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বামপন্থী প্রগতিশীলগণ যেভাবে বেগম রোকেয়াকে চিত্রিত করে, তা খণ্ডিত। ইসলামের পক্ষে বেগম রোকেয়ার যে শক্ত অবস্থান, তা তারা বেমালুম চেপে যান। ইচ্ছা আছে, এ’বিষয়ে একটা স্বতন্ত্র সংকলনগ্রন্থ প্রকাশের।

আর একটা কথা, মুতাজিলাগণ যুক্তির সীমাবদ্ধতাকে যেভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন, তাও যে অযৌক্তিক ছিল, তা বোঝার মতো বুদ্ধিগত সক্ষমতা আমাদের আলোচিত সাক্ষাৎকারদানকারীর আছে কিনা সন্দেহ। ভেরি ব্রিফলি, মুতাজিলাদের প্রশ্নগুলো ছিল মোটাদাগে যৌক্তিক। তাদের উত্তর বা উপসংহারগুলো ছিল ভুল ও অযৌক্তিক।

বাংলার ইসলাম বলে কিছু কি আছে?

বলা হয়েছে,

‘১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের দুটি বোঝাপড়া থেকে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে শুরু করল, বাংলার ইসলাম পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে যায় না, এমনকি উত্তর ভারতের ইসলামের সঙ্গেও নয়। ফলে তারা পাকিস্তানি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়াল।’

যে কোনো লেংথে গিয়ে অভিনব কথা বলা, অহেতুক বাগাড়ম্বর করা, এটি কমন বামপন্থী ফেনোমেনা। মাদ্রাসায় পড়ে যারা বাম হয় তারা আরেক কাঠি সরেস। কথা বলার সময়ে তাদের কোনো হুঁশজ্ঞান কাজ করে না।

ইসলাম তো একটাই। ইসলামের মধ্যে আছে বিভিন্ন মাযহাব বা স্কুল অব থট। আছে বিভিন্ন এলাকার মুসলমান। ইসলাম স্বীয় অনুসারীদেরকে স্থানীয় সংস্কৃতিকে মাত্রাভেদে গ্রহণ করার যে সুযোগ দিয়েছে সে কারণে বিভিন্ন এলাকার মুসলমানদের মধ্যে আছে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈচিত্র।

১৯৬৬ সালে আমার জন্ম। ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার জ্ঞান আলোচিত সাক্ষাৎকার দানকারীর চেয়ে আমার বেশি। আমি বারে বারে বলেছি, এখনো বলছি, সেভেনটি ওয়ানের যুদ্ধ ছিল নিছকই ইয়াহিয়া-ভুট্টোর হঠকারিতার ফসল। জনগণের বিরুদ্ধে লড়াই। এই চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধকে মানুষ গত্যন্তরবিহীন অবস্থায় চালিয়ে নিয়ে গেছে সাধ্যমতো এবং আল্লাহর মেহেরবানীতে নানা আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টরের আনুকূল্যে শেষ পর্যন্ত তারা বিজয় লাভ করেছে।

‘৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সাথে আদর্শবিশেষের জয়ী হওয়া বা পরাজিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক নাই। ‘৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সাথে আদর্শবিশেষের জয়ী হওয়া বা পরাজিত হওয়ার দাবী আরোপিত। সংঘবদ্ধভাবে গড়ে তোলা ফলস-ন্যারেটিভ।

সুশীল এনজিওবাদীদের বিএনপি-ভীতি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতি

সাক্ষাৎকারের পরবর্তী অংশে যা বলা হয়েছে তা চর্বিত চর্বণ। সরকারে যাওয়া ছাত্র সমন্বয়করা, মনে হচ্ছে তারা আসলে কিংস পার্টি হতে চায়। বিএনপির সাংগঠনিক মজবুতি ও জনসমর্থনকে তারা ভয় পায়। তাই ‘মানুষ চায়, বিএনপি পরিশুদ্ধ হয়ে আসুক’ – মানুষ বলতে তারা ‘প্রথম আলো’র আলোয় আলোকিতজনদেরকেই বোঝে। সাধারণ মানুষ তো চায়, বাংলাদেশপন্থী দল ক্ষমতায় আসুক। বিএনপি হলো বাংলাদেশপন্থী রাজনীতির পাইওনিয়ার।

বিগত আমলে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে নির্বাচন করে সংসদীয় বিরোধী দলের আসনে বসেছিল। রওশন এরশাদ ছিল বিরোধীদলীয় নেত্রী। তেমন করে সরকারে অংশ নিলেও এরা মূলত ইনকামবেন্ট কিংস পার্টি। তারা ক্ষমতার লোভ সামলাতে পারেনি। এনজিও সরকারও তাদেরকে ক্ষমতায় নিয়েছে সতীনের ছেলেকে দিয়ে সাপ ধরার পুরনো কৌশলে।

কাজ করানোর জন্য সরাসরি ক্ষমতায় যাওয়ার দরকার পড়ে না। নিজেদের পাওয়ার কনসলিডেইট করতে পারলে ক্ষমতাসীনেরা এমনিতে এসে ‘দোয়া’ নিয়ে যায়। কাজ করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, এই সরকারের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার মিলিটারিরা কিন্তু ক্ষমতার প্রত্যক্ষ ভাগ নেয় নাই। অংশত বা পুরো ক্ষমতা তারা চাইলে নিতে পারতো। না নেয়াতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় নাই।

‘একক কোনো দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ভয় সবার মধ্যে জেঁকে বসেছে। না জানি বিজয়ী দল আবার আওয়ামী লীগের মতোই হয়ে ওঠে’, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কথিত নেপথ্য নায়ক কর্তৃক সাক্ষাৎকারে দেয়া এই কথা থেকে বোঝা যায় তারা বিএনপিভীতিতে ভুগছেন। বিএনপিবিরোধী প্রপাগাণ্ডায় ইন্ধন দিচ্ছে জামায়াত। তারা জানে, পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে ক্ষমতায় আসবে। খুব সম্ভবত ব্রুট মেজরিটি নিয়ে। জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট থাকবে বিরোধী দলের আসনে।

বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি স্ট্রংলি করতে পারবে সেন্টার-রাইট পলিটিক্স করা দল বিএনপি। ‘প্রথম আলো মার্কা’ এনজিওবাদী সুশীল প্রগতিশীলেরা উঠতি ইসলামপন্থীদের মতো চিকন কথায় যতটা পারঙ্গম, শক্তভাবে দল ও দেশ পরিচালনায় ততটাই দুর্বল। একটা উন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য রাজনীতির হালচাল কখনোই উন্নয়নশীল দেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। উন্নয়নশীল দেশে শক্তিশালী দল ও শক্তিশালী ফিগারের রাজনীতি ভাল করে। বোথ, দলের ও দেশের।

আওয়ামী লীগের হাতে এই সুযোগ ছিল। তারা তাদের এই সক্ষমতাকে প্রপারলি কাজে লাগায় নাই। অপব্যবহার করেছে। লীগের প্যারালালে শক্তিশালী দল ও শক্তিশালী ফিগারের এই সুবিধা আছে বিএনপির। অতীতেও তারা এর সদ্ব্যবহার করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।

বাংলাদেশের রাজনীতির সকল ভবিষ্যত সেন্টার-রাইট পলিটিক্সে। সেন্টার-রাইট ফোর্সই ক্ষমতায় থাকবে আগামী অন্তত দেড় দশক। পাওয়ার পলিটিক্সে সেন্টার-রাইটকে লিড দেয়ার ক্ষেত্রে আপাতত বিএনপি’র কোনো বিকল্প নাই।

দেখা যাক, কী হয়।


১২ অক্টোবর ২০২৪,
এসই-১৫, চবি।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *