না হই বিজয়ী পক্ষ,
ক্ষতি নেই তাতে;
যদি না হই নৈতিকভাবে পরাজিত।

১. বাহ্যিক বিজয় বনাম নৈতিক বিজয়

যারা পরাজিত, বিজয়ী পক্ষ দ্বারা লিখিত ইতিহাসে তারা হয় দোষী সাব্যস্ত। অথচ, পরাজিত হওয়া মানেই কিন্তু তারা ভুল ছিল, এমন তো নয়। সত্য আর মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্য হয় বিজয়ী। সত্যের স্বপক্ষ শক্তি যদিও হতে পারে বাহ্যত পরাজিত।

বস্তুগত বিজয় মানেই নৈতিক বিজয় নয়। নৈতিকভাবে বিজয় লাভ করা সত্ত্বেও বাস্তবে কেউ হতে পারে বিজিত।

কোনো যুদ্ধ বা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে হতে পারে উভয় পক্ষই সঠিক, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে। কারো অবস্থান হতে পারে অধিকতর সঠিক, নৈতিকভাবে শক্তিশালী। বিপরীত পক্ষের তুলনায় কারো অবস্থান হতে পারে দুর্বলতর, আবেগী।

২. যুদ্ধ মানেই জিহাদ নয়

আলীর (রা) পজিশন ছিল হকের ওপর। তাই বলে আয়েশা (রা) কিংবা মুয়াবিয়া (রা) বাতিল পক্ষ ছিলেন, এমন তো নয়। তারা ন্যায্য দাবিতে একটি অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।

যুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ সবসময়ে সাদা-কালো বাইনারির মতো সরল সমীকরণের ব্যাপার নয়। নানা কারণে ও পরিস্থিতির জটিল সমীকরণ সহজে সমাধান করতে না পেরে কেউ ভুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।

তারমানে, নিছক ভুল বোঝাবুঝির কারণে কিংবা পরিস্থিতিকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে না পারার ফলে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পারে। এহেন পরিস্থিতিতে তাদেরকে বাতিল হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক হবে না।

ইসলামের দৃষ্টিতে, যুদ্ধ বা কিতাল মানেই জিহাদ নয়। অথবা, জিহাদ মানেই যুদ্ধ নয়। যদিও, কিতাল ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করা হচ্ছে জিহাদের মূল ফরমেট বা প্রকৃত রূপ।

বিশৃঙ্খলতা ও অরাজকতা বন্ধ করা, এক কথায় ফেতনা দূর করার জন্য যে লড়াই করা হয় তা নিছকই যুদ্ধ বা কেতাল। এই ধরনের যুদ্ধ, ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ না হওয়ার পক্ষে প্রমাণ হলো, এই ধরনের যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ গনিমত সংগ্রহের অধিকার লাভ করে না।

এই দৃষ্টিতে, হযরত আয়েশা (রা) ও মুয়াবিয়ার (রা) বিরুদ্ধে হযরত আলী (রা) যেসব যুদ্ধ করেছেন সেগুলো জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ছিল না।

সংঘর্ষের ব্যাপকতার জন্য এগুলোকে আমরা যুদ্ধ হিসেবে বললেও সেগুলো ছিল মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ব্যাপকভিত্তিক সামরিক অভিযান।

হযরত আলী (রা) কর্তৃক খারেজীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধকেও স্বয়ং আলী (রা) কিংবা তৎকালীন সাহাবীগণ ‘জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ হিসেবে গণ্য করেননি।

৩. জড়িয়ে পড়া যুদ্ধে মুসলিমদের উভয় পক্ষে নিহতগণ শহীদ হিসেবে গণ্য হতে পারে

রাজনীতি হচ্ছে এমন এক ব্যতিক্রমী এরিয়া যেখানে পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ধারণ করে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কিনা। এ যেন ভাগ্য নিয়ে এক ধরনের জুয়া খেলা। খেলার মতো এখানে পরিস্থিতি সদাসর্বদা পরিবর্তনশীল ও অনিশ্চিত। বহু পক্ষ এখানে প্রতি মুহূর্তে কন্ট্রিবিউট করে।

রাজনীতির অন্যতম অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতা হলো, বৃহত্তর পরিসরে একই আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও যুদ্ধ।

ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধমূলক কাজ না করা সাপেক্ষে বৃহত্তর মুসলিম রাষ্ট্রের অখণ্ডতাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য যারা লড়াই করেছে, যুদ্ধের ময়দানে নিহত হলে তারা শহীদ হিসেবে গণ্য হবেন।

অন্যদিকে, নিজেদের জাতিগত স্বকীয়তা বজায় রাখা, নিজেদের সহায়-সম্পদকে রক্ষা ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণে যারা আগ্রাসী জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা নিহত হয়েছেন, নিঃসন্দেহে তারাও শহীদ হিসেবে গণ্য হবেন।

তার মানে, বিশেষ পরিস্থিতিতে একটি যুদ্ধে উভয়পক্ষের লোকেরাই শহীদ হিসেবে গণ্য হতে পারেন।

রাজনীতি, যুদ্ধ ও জিহাদ সম্পর্কে মৌলিক এই কথাগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের আঞ্চলিক ইতিহাসকে যদি আপনি খোলা মন নিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন তাহলে অনেক ধাঁধা ও জটিলতার অবসান হবে বলে আশা করি।

৪. ভুল হতেই পারে, কিন্তু ঔদ্ধত্যের ক্ষমা নাই

অতীতে ও নিকট ইতিহাসে, ভুল বুঝে কিংবা ভিন্নতর যুক্তির ভিত্তিতে যারা যুদ্ধে জড়িয়েছে, তাদের জন্য রইল সমবেদনা। আজকের পরাজিত পক্ষ তখন ছিলেন যাদের পক্ষে, তারা যদি তখন বিজয়ী হতো তাহলে সহযোগী শক্তি হিসেবে ইনারাই হতেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও জাতীয় বীর।

ভাগ্যের বিরূপতা, নির্বুদ্ধিতা, দূরদৃষ্টিহীনতা, অনাকাঙ্ক্ষিত গোপনীয়তার নীতি ও ঔদ্ধত্যের কারণে তারা আজ হেয় প্রতিপন্ন। অকৃত দোষে অনেকের কাছে দোষী সাব্যস্ত। এমনকি নিজেদের লোকদের কাছেই তারা আজ কার্যত পরিত্যক্ত।

স্বীয় সহযোগী শহীদদের তারা কৌশলগত কারণে অস্বীকার করেছেন। ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়কে মুছে দিতে। চেষ্টা করেছেন আনুগত্যশীল জনশক্তির আত্মত্যাগকে বেমালুম ভুলে যেতে।

একইভাবে তারাও আজ অস্বীকারের মুখোমুখি; পরবর্তী প্রজন্মের ততোধিক কৌশলী নেতৃত্বের হাতে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস …!

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Mojibur Rahman Monju: এটা এমন এক নাজুক ইস্যু যা নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজের ঈমান, আকীদা, অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অথচ এর সাথে ঈমান আকীদার কোনো সংযোগই নেই। তবুও আমি অনেকের সাথে একমত যে সত্যটা ঝুঁকি নিয়ে বলতে হবে। আজ আপনাকে অপমান অপদস্ত করলেও এক সময় সত্যটা সামনে আসতে বাধ্য।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও দুটি পক্ষ। একপক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধ করেছে অন্য পক্ষ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গাদ্দার, বেঈমান, দালাল; আর তাদের সেনারা দেশপ্রেমিক যোদ্ধা। আমাদের বাংলাদেশীদের কাছে পাকিস্তানীরা হানাদার, রাজাকার, খুনী, অত্যাচারী; আর মুক্তিযাদ্ধারা শহীদ, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরোত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ইত্যাদি।

এখন প্রশ্ন হলো, যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে ছিল তাদের অনেকেই তখন মুক্তিযাদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তাদের এই নিহত নেতা-কর্মীরা তাদের দৃষ্টিতে কী শহীদ? তাঁরা কী তাদের শহীদ হিসেবে স্বীকার করেন?

আমরা দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সংগ্রামীরা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের শহীদ এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছেন। এটা খুব ভালো কথা ও ইতিবাচক দিক। কিন্তু তাদের কাছে সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠবে দু’পক্ষের নিহতদেরই কী তাঁরা তাহলে শহীদ মনে করেন? নাকি এখন তাঁরা তাদের শহীদদের অস্বীকার করছেন বা ভুল মনে করছেন? তাদের এই নতুন অবস্থান ও স্বীকৃতি কী সুবিধাবাদী কোনো বয়ান নাকি এটা তাদের প্রকৃত উপলব্ধি? এই বিষয়টি সবার আগে তাদের নিজের বিবেকের কাছেই পরিস্কার হওয়া উচিত।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ভাবছিলাম এই পোস্টে কোনোভাবেই কোনো মন্তব্যে এনগেইজ হবো না। কিন্তু আপনার এখানে একটি কথা না বললেই নয় বলে ভাবছি। সেটি হলো– মূল পোস্টে যেমনটা বলেছি, ঘটনাচক্রে একটা ভুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া মুসলমানদের উভয় পক্ষ থেকেই নিহতগণ শহীদ হিসেবে গণ্য হতে পারেন, যদি তারা ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধরনের যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত না হোন।

যুদ্ধ মানেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি। একটি অনিবার্য। Without atrocities, there cannot be any war. অতএব, যুদ্ধে জড়িয়ে কেউ যদি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চায়, তাদেরকে বোকা বলা ছাড়া আর কী বলা যায়, বুঝতে পারছি না।

আগ্রহীদেরকে যুদ্ধ, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, মানবতা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৮৯ সালে তৈরি করা সিনেমা The Iron Triangle দেখার অনুরোধ করছি।

Mojibur Rahman Monju: এটা একটা ব্যখ্যা এবং পজিশন হতে পারে। কিন্তু এই পজিশনটা তো এখন পর্যন্ত কেউ নেয় নাই। বরং পজিশন পরিবর্তনের আভাসই শুধু দেখা যাচ্ছে।

Mohammad Mozammel Hoque: আমার এই ব্যাখ্যা এবং পজিশনটি ইউনিক। এবং এটাই হলো একমাত্র সঠিক ব্যাখ্যা। আমার সেল্ফ-ব্র্যান্ডিং থিওরি অনুসারে নিজের সম্পর্কে আমি এ রকম একটি দাবি করতেই পারি।

Md Mahdi Hasan: একটি সম্পূরক প্রশ্ন। আলী (রা) এবং মুয়াবিয়ার (রা) সম্মুখযুদ্ধে দুই পক্ষের সাহাবীগণই নিহত হয়েছেন। (আলীর (রা) পক্ষটি ছিল হক এবং মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষটি ছিল ভুলের উপরে– এই ব্যাপারটি উহ্য রেখেই বলবেন প্লিজ) এখন কি পরস্পরবিরোধী এই দুই পক্ষের নিহত সাহাবীদেরকে আমরা একইসাথে শহীদ বলবো না?

Mohammad Mozammel Hoque: অবশ্যই। যদিও কোনো ব্যক্তির মৃত্যুকে আল্লাহ তায়ালা শহীদী মৃত্যু হিসেবে গ্রহণ করবেন কিনা সেটি নিছকই তাঁর বিবেচনার ব্যাপার। আমরা শুধু বাহ্যিক অবস্থা দেখে কাউকে শহীদ হিসেবে সাব্যস্ত করি। অতএব, কোনো অপরাধে লিপ্ত না থাকা অবস্থায় কোনো ঈমানদার ব্যক্তি নিহত হলে তাকে অবশ্যই আমরা শহীদ হিসেবে গণ্য করবো। কোন পক্ষ সঠিক, সেটি নির্ণয় করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ বেনিফিট অফ ডাউটের সুবিধা পাবে। এ ধরনের কনফিউজিং সিচুয়েশনে ইসলামী শরীয়াহ, আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান ও প্রচলিত আইন ব্যবস্থার বক্তব্য অভিন্ন।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *