শক্তিশালী বড় দুটি পদার্থ যখন একটি অপরটিকে আঘাত করে তখন তারা পরস্পরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সাথে সাথে পরস্পরের সাথে ইতিবাচক অর্থে মিথস্ক্রিয়াও করে। এমনকি বৃহৎ শক্তিবর্গ যখন পরস্পরকে ধ্বংস করে তখন এক অর্থে তারা পরস্পরকে পুননির্মাণও করে। সমাজবিজ্ঞানের আলোচনায় বস্তুজগতের মতো ‘negation of negation’এই সূত্র বৃহৎ শক্তিবর্গের ঘাত-প্রতিঘাতের ওপরও সমভাবে প্রযোজ্য। হালাকু খানের চেঙ্গিস সেনাদল তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের রাজধানী বাগদাদকে ধ্বংস করলেও এ সম্পর্কে বলা হয়, মুসলমানেরা পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম বিজয়ী হয়েছে। কারণ, ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, কুখ্যাত হালাকু খানের বংশধরেরা ইসলাম কবুল করে পরবর্তীতে ইসলামী সভ্যতার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রেখেছে। আওয়ামী লীগের লোকজনেরা শীঘ্রই জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করবে – আমি এটি মনে করি না। মিডিয়া ট্রায়ালের বাহ্যিক সফলতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ‘জামায়াতকে ধ্বংস করার’ নীতি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে চলমান যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে উপকৃত হয়েছে। এই বিরাট জোয়ার বা ঢেউয়ের ধাক্কায় তলিয়ে না গিয়ে জামায়াত, এক অর্থে, পুনর্জীবন লাভ করেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জামায়াত ছিল আওয়ামীলীগের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। জামায়াতের পল্টনের জনসভায় যখন আওয়ামী লীগ সর্বাত্মকভাবে হামলা করে তখন তো ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যু’ ছিল না। তাই না? অতএব, লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, জামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের বিরোধ ঐতিহাসিক। এই বিরোধ মূলত আদর্শিক। এ দেশে জামায়াতের মূল মতাদর্শগত শত্রু ‘কম্যুনিস্টরা’ বরাবরই আওয়ামী লীগের সেক্যুলার প্লাটফরমকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যকার শীর্ষ জাতীয়তাবাদী ও নন-সেক্যুলার নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং। সে আলোচনা পরে হবে। এটি জামায়াতের বিরাট ব্যর্থতা যে, একটি মতাদর্শগত বিরোধকে তার বিরোধীরা ‘লোকাল কনফ্লিক্ট’ হিসাবে চালিয়ে দিতে পেরেছে। ‘ইসলামী আন্দোলনে’ এ দেশে জামায়াতের সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে ধরাও এই নোটের বিবেচ্য নয়। জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শগত এজেন্ডা বাস্তবায়নে ও এর সাংগঠনিক অগ্রগতিতে আওয়ামী লীগের যে মৌলিক অবদান, সে সম্পর্কে এখানে খানিকটা আলোচনা করছি–
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কয়েকশত জার্মান যুদ্ধবিমান এক রাতে লন্ডন শহরের উপর টনে টনে বোমা ফেলে। মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপক ধ্বংস লীলার মাঝেও পরদিন ভোরে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর সদস্যরা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে! কারণ,তারা এন্টি এয়ারক্রাফট গান ব্যবহার করে ও নিজস্ব বিমানের ডগ ফাইটিংয়ের মাধ্যমে অধিকাংশ জার্মান বিমানকে ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়। তারা জানতো, এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরে জার্মানরা কখনো আর হামলা করতে পারবে না! ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার’ মামলায় জামায়াতের নেতাদেরকে গ্রেফতার করে শুরু করা যুদ্ধাপরাধ মামলা একটা পরিণতির দিকে এগুনোর এই সময়কালে এটি স্পষ্ট যে, জামায়াতের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটি ব্যবহার করে ফেলেছে, অথচ তা অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছে! এরপরে আওয়ামী লীগের হাতে ‘তেমন’ আর কোনো ইস্যু নাই; যদিও জামায়াতের হাতে (১)ভারতবিরোধী ‘নিরাপত্তা ইস্যু’ ও (২) ইসলামের মতো দুটি অব্যর্থ ইস্যু বা অস্ত্র রয়ে গেছে।
১. জামায়াতের রাজনৈতিক লাভ:
(১) গণপ্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন: বামপন্থীদের ‘জামায়াতকে ধ্বংস করো’ নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর ঢালাওভাবে দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। এর ফলশ্রুতিতে ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে দেখা গেল, ক্ষমতা লাভকে নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে ধরনের পেশী শক্তির প্রয়োজন তা বিএনপির ন্যূনতম পরিমাণেও নাই। এর পাশাপাশি জামায়াতের জনশক্তি এক ধরনের ‘ইমিউনিটি’ তথা প্রতিরোধশক্তি অর্জন করেছে। যেসব এলাকায় জামায়াত বর্তমানে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সেখানে পুলিশ তো বটেই, র্যাব-বিজিবি যেতেও হিসাব করে যায়। সেসব এলাকায় জামায়াত আগে থেকেই শক্তিশালী ছিল– এমন নয়। বরং সেসব এলাকায় জামায়াতকে দমন করতে গিয়ে এ ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ‘লীগ ঠেকানোর’ লক্ষ্যে এই গণপ্রতিরোধ হলো এর পরিণতি! অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যারা মার খায় তারা হয়তো চরমভাবে ভীতু হয়ে পড়ে অথবা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠে। জামায়াতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই ঘটেছে।
(২) বিএনপির জামায়াত-নির্ভরতা: রাজনৈতিকভাবে অসহায় হয়ে পড়া মিডিয়ানির্ভর বাম তাত্ত্বিকদের সব আস্ফালনকে উপেক্ষা করে জাতীয়তাবাদী, শ্রদ্ধেয় আবদুল হাই সিকদারের ভাষায় ‘বাংলাদেশপন্থী’ ও ইসলামপন্থী মূল ‘ভোটিং কনস্টিটিউয়্যানসিকে’ হাতে রাখতে গিয়ে ময়দানের শক্তি হিসাবে বিএনপি জ্যামিতিক হারে জামায়াত-নির্ভর হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ যদি শুধুমাত্র জামায়াতকে টার্গেট করতো ও বিএনপিকে পরবর্তী ক্ষমতাসীন দল হিসাবে মেনে নিয়ে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের মাধ্যমে চলতো, তাহলে জামায়াত অস্তিত্বহীন না হলেও বিএনপির বর্তমান জামায়াত-নির্ভরতার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না।
২. আদর্শিক লাভ:
(১) কওমী ধারার সাথে সম্পর্ক: এই শিরোনামের সাথে কট্টর জামায়াত-শিবির ব্যতিরেকে যে কেউই তাৎক্ষণিকভাবে দ্বিমত পোষণ করবেন। তৎসত্ত্বেও এটিই সত্য! দেখুন, কওমী ধারার আলেমদের প্রবল মাত্রায় জামায়াত বিরোধিতার কারণে এক অর্থে জামায়াত এক ধরনের ‘লেজিটেমেসি ক্রাইসিসে’ ভুগতো। শাহবাগ আন্দোলনের মোকাবিলায় হেফাজতে ইসলামীর আবির্ভাব, উত্থান ও এর সর্বশেষ পরিস্থিতিতে জামায়াত এখন দারুণ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। এক সময় জামায়াতের তৎকালীন আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম কওমী ধারার আলেমদের সাথে ঐক্য স্থাপন করার জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির করেছিলেন। শীর্ষ নেতৃত্বের সেই কাংখিত ঐক্য তখন না হলেও সর্বস্তরে বিশেষ করে কর্মী ও মাঠ পর্যায়ে হেফাজতের ভিতরে কিম্বা সাথে জামায়াতের নেতা-কর্মীরা কাজ করছে। এক কথায়, জামায়াতের সাথে কওমী ধারার আলেমদের ব্যাপক সখ্য সৃষ্টি হয়েছে।
(২) তাবলীগ জামায়াতের সাথে সম্পর্ক: কওমী ধারার লোকজনেরা বিপুল সংখ্যায় তাবলীগ জামায়াতের সাথে কাজ করে। জামায়াতের সাথে তাবলীগ জামায়াতের যে দূরত্ব তা আওয়ামী লীগের ‘হেফাজত দমনের’ ক্যাম্পেইনের প্রতিক্রিয়ায় অনেকটা কমে এসেছে। সচেতন মহল এটি খেয়াল করে থাকবেন।
(৩) সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টি: প্রযুক্তিগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের গুরুত্ব অনুধাবনের সুযোগ পেয়েছে জামায়াতের প্রবীণ ও ‘প্রবীণ-মার্কা’ সংগঠনবাদী নেতৃবৃন্দ। মাত্র গত বছরও জনশক্তিকে ব্লগ-ফেসবুকের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করা হতো। অথচ, বর্তমানে জামায়াত-শিবিরের লোকজন এসব সামাজিক গণমাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হেফাজতের আন্দোলন দমন করার সময়ে সরকার ইউটিউব বন্ধ করে দিলেও মূলত ফেসবুকের ফজিলতে আওয়ামী লীগ পরিচালিত ‘শাপলা চত্বরের গণহত্যা’ এখন সারাদেশে একটি ‘প্রতিষ্ঠিত সত্য’।
বন্ধ হওয়ার আগে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে জামায়াত ও এর অফশুটগুলোর রক্ষণশীলদের তরফ হতে নাচ-গান তথা ‘অপসংস্কৃতি’ চর্চা ও ‘বাণিজ্যিকীকরণের’ অভিযোগ তোলা হতো। এবার কোনো অনুকূল সুযোগ পেলে ইসলামিস্টরা মিডিয়া গড়ে তোলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। কেননা, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নামক ‘বামপন্থী সাংস্কৃতিক হামলা’ জামায়াতবিরোধী ইসলামী শক্তিসমূহকে জামায়াতের পক্ষপুটে এনে দিয়ে এই উদিত সম্মিলিত শক্তির সুপ্ত সম্ভাবনার মূলে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। (In disguise of the war crime issue, the ’cultural attack of the leftist’ has pushed the anti-jamaat Islamists under the wings of Jamaat-e-Islami and has ignited the unnoticed potentialities of this newly emerged collective force.)
৩. সাংগঠনিক লাভ: আওয়ামী দমন-নিপীড়নের ফলে জামায়াত দ্বিমুখী সাংগঠনিক লাভের ভাগিদার হয়েছে! জামায়াতের সংস্কারবাদী ও সংগঠনবাদী– উভয় পক্ষই এই পরিস্থিতিতে স্ব স্ব অবস্থানের যৌক্তিকতা খুঁজে পেয়েছে!
(ক) সংস্কারবাদীদের লাভ: যদিও আভ্যন্তরীণ বিভক্তিকে জামায়াতের লোকজনেরা কখনো ফর্মালি স্বীকার করে না; তথাপি এটি অনস্বীকার্য– জামায়াতের মধ্যে প্রগতিশীল, প্রযুক্তিমনা ও উদার একটা ধারা রয়েছে, যাদেরকে আমরা আলোচনার সুবিধার্থে ‘সংস্কারবাদী’ হিসাবে বলতে পারি। তারা নারীদের ব্যাপারে নমনীয়, ৭১ ইস্যুসহ বিভিন্ন জাতীয় ও সাংগঠনিক ইস্যুতে খোলামেলা আলোচনার পক্ষপাতি, দেশজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি নমনীয় এবং ছাত্র সংগঠনকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণের বিরোধী। এই ‘বুদ্ধিজীবী শ্রেণীটি’ জামায়াতের মধ্যে বরাবরই কোনঠাসা অবস্থায় ছিল। ‘মৃত’ ’৭১ ইস্যুটি হঠাৎ করে জ্যান্ত হয়ে সংগঠনকে গিলে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াতে সংস্কারবাদীরা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে জোরালো যুক্তি খুঁজে পেয়েছে। বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় তারা তুলনামূলকভাবে অধিকতর উচ্চকণ্ঠ।
(খ) সংগঠনবাদীদের লাভ: জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর হতে শুরু করে এ পর্যন্ত সবাই গণহারে যে জিনিসটিকে কোরআন-হাদীসের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের বরাতে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, তা হলো, আনুগত্য। ধারণাটি এমন– জামায়াতে ইসলামী এ দেশে একমাত্র ‘সত্যিকারের ইসলামী আন্দোলন’। অপরাপর ইসলাপন্থীরা হলো ইনফেরিয়র ‘খেদমতে দ্বীনের’ আওতাভুক্ত। অতএব, জামায়াতের আনুগত্যই হলো ইসলামের তরফে গ্যারান্টিযুক্ত আনুগত্য। এই চেতনার ফলে এমন মনমানসিকতার সৃষ্টি হয় যে, সংগঠন যাহা কিছু করে তাহা সবই ঠিক। এমনকি কোনো কার্যক্রমকে ভুল মনে করলেও জনসম্মুখে তাহা সঠিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করাই ‘ঈমানের দাবি’ বলে মনে করা হয়। এই অবস্থাকে আমি ’সংগঠনবাদিতা’ হিসাবে বলে থাকি।
জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনে চলমান আওয়ামী ক্র্যাকডাউন অনেকখানি ব্যর্থ হয়েছে। ফরহাদ মজহারের ভাষায়, ‘বাংগালী ফ্যাসিস্টরা’ ছাড়া দেশে-বিদেশে কেউই বিশ্বাস করে না যে, এটি একটি নিরপেক্ষ বিচার। এক্ষণে জামায়াতের সংগঠনবাদীদের এটি মনে করা ও দাবি করার সুযোগ এসেছে যে, জামায়াত সঠিক পথেই ছিল এবং আছে। নচেৎ জামায়াতের পক্ষে এতবড় একটা বিপদ কী করে ‘কাটানো গেল’! এবার বলুন, এটি জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহাসিক সাংগঠনিক ’লাভ’ নয় কি?
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Tanvir M H Arif: Critical analysis. এত শিক্ষার মাঝেও যে শিক্ষা অনুপস্থিত তা হলো নামের পূজা করা। পুরনো এবং অন্ধ নব্য অনুসারীদের এটা বুঝানো খুবই মুশকিল যে, নামটি ছাড়াও মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতি করা সম্ভব।
Ashik Rahman: শেষ দুটা পয়েন্টের বিশ্লেষণের সাথে একমত নই। এভাবে ধারা চলতে পারে না। দুটার সমন্বয়েই সংগঠন এবং সেটা মেনেই সাংগঠনিক ।
আর লাভ বলতে… হ্যাঁ, যাদের মধ্যে সামান্য দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল, তারাও সব ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। অথবা পরিস্থিতিই তাদেরকে বুঝতে সহায়তা করেছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: জামায়াত সংস্কারবাদী বা সনাতনী – এ ধরনের বিভাজনকে একসেপ্ট না করা সত্ত্বেও এটি ছিল, আছে। অতীতে এতটা প্রকাশ পায় নাই। তখন তো আর ফেসবুক/ব্লগ ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতির end result বা কনসিকোয়েন্স হিসাবে এতদুভয় ’গ্রুপ’ই যার যার অবস্থানের পক্ষে ’যথেষ্ট’ যুক্তি খুঁজে পেয়েছেন। quantitative দিক থেকে ’সনাতনী’রা (আমার ভাষায় ’সংগঠনবাদী’) সঠিক, আর qualitative দিক থেকে ’সংস্কারবাদী’রাই সঠিক। হতে পারে, এ দুটোই সঠিক।
Abdullah Russel: স্যার, আপনি জামায়াতের যে ধারাটিকে ‘সংস্কারবাদী’ বলছেন, আদতে এই ধরনের ধারা বিএনপি বা আওয়ামী লীগের সংস্কারবাদীদের মতো নয় কিন্তু। একজন সদস্য হিসেবে এবং মোটামুটি অভিজ্ঞতা থেকে আমি শুধু এতটুকু অবলোকন করেছি– জামায়াতের মধ্যে তিন ক্যাটাগরির কর্মী আছেন। প্রথম ক্যাটাগরির কর্মীরা হচ্ছেন যারা শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই এক্সপেরিয়েন্সড। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরির কর্মীরা ধর্মীয় দিকের চেয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনীতির মারপ্যাঁচ সম্বন্ধে এক্সপেরিয়েন্সড। আর তৃতীয় ক্যাটাগরির কর্মীরা ধর্মীয় এবং একই সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, বর্তমান রাজনীতিসহ প্রায় সবদিক দিয়েই এক্সপেরিয়েন্সড। কিন্তু এই তৃতীয় ক্যাটাগরির কর্মীদের সংখ্যা খুবই কম। অথচ বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশে ইসলাম কায়েমের জন্য তৃতীয় ক্যাটাগরির কর্মীদেরই বেশি প্রয়োজন। আমি মনে করি, একটি ইসলামী দলে সব ক্যাটাগরির কর্মী থাকা আবশ্যক। তাই কাউকে ‘সংস্কারবাদী’ অথবা কাউকে ‘ব্যাকডেটেড’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত বলে আমি মনে করি না। নানা চিন্তাধারার কর্মী নিয়ে একটি ব্যাল্যান্সড দলই নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও টিকে থাকতে পারে। জামায়াতকে এই ২০১৩ সালে অনেকটুকু ব্যাল্যান্সড ইসলামী সংগঠন বলা যায়, ব্যাল্যান্সড না হলে অনেক আগেই উড়ে যেত। আল্লাহ যদি সামনে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেন, তাহলে তৃতীয় ক্যাটাগরির কর্মীদের প্রডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে।
বেশ কয়েকদিন আগে আমি এই বিষয়ে একটি পোস্ট লিখেছিলাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: বিভিন্ন রকমের লোকদেরকে নিয়ে একটি দল থাকাটা ভালো। তারচেয়ে বেশি ভালো বিভিন্ন রকমের লোকদেরকে নিয়ে একই আদর্শের আওতায় ভিন্ন ভিন্ন দল থাকা। এ ধরনের হকপন্থী দলগুলোর মধ্যে সময়ে সময়ে ফেয়ার ফাইটও হতে পারে, ইস্যুভিত্তিক ঐক্যও হতে পারে। সব ইসলামপন্থী দলগুলোর ঐক্য গড়ে তুলে ’ক্ষমতায় যাওয়ার’ বিষয়ে আমি একমত নই। যেমনটা মিশরে হয়েছে। ইরানের উদাহরণটা ভিন্ন। ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।
Khomenee Ehsan: আমার পর্যবেক্ষণ হলো দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াতের প্রতি সবাই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। তবে দলটি এই আগ্রহকে কাজে লাগাতে পারেনি। দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচি সাধারণ নাগরিকদের দূরের কথা, নিজ দলের নেতাদেরও নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। দলটি তার ইতিহাসে যে সুযোগ পেয়েছে তা ধারণ করতে পারেনি। কাজেই এই দলকে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আগ্রহ থাকবে না।