প্রবল রাজনৈতিক আবেগ, হিংসা, উত্তেজনা, বিশেষ বিশেষ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বলদর্পী হুমকি ও ইন্টারনেট-ল্যাপটপ ইত্যাদির আড়াল থেকে শাহবাগের প্রকৃত স্বরূপ বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের একদল মিডিয়া শাহবাগকে নিয়ে আবেগের উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক প্রদর্শনী করলেও আসল কথাটি ফাঁস করে দিল একটি বিদেশী পত্রিকা। লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা গার্ডিয়ানের সাংবাদিক-কলামিস্ট নিক কোহেন গত রোববার লিখেছেন– ‘শাহবাগে জেগে উঠেছে ধর্মনিরপেক্ষতা’। এ দেশেরও কিছু ‘ঈমানদার-দেশপ্রেমিক’ মিডিয়ায় শাহবাগ নেতৃত্বের চরিত্র বিশ্লেষণ করে তাদের চিন্তাভাবনা, কাজকর্ম, জীবনাচার সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশ করছে, তাতে কেবল ধর্মনিরপেক্ষতাই নয়, ধর্মহীনতা ও ইসলাম বিরোধিতার বিবরণ সুস্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে দেশের ইসলামপন্থী দল, ওলামা মাশায়েখ ও ঈমানদার জনতা স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। সকলেই রাজনৈতিক আন্দোলনের ছদ্মাবরণে ইসলাম, মুসলমান, রাসূল (সা) এবং বাংলাদেশের ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও বিষোদগারে উদ্বিগ্ন, চিন্তিত ও প্রতিবাদমুখর।
প্রথমেই প্রশ্ন উঠেছিল, শাহবাগের জমায়েত কার বিরুদ্ধে? রায় না মেনে তারা দৃশ্যত সরকারের বিরুদ্ধেই ছিল বলে মনে হয়েছিল। এবং সরকারকে নিজেদের মতো রায় ও বিচার প্রদানের দাবি মেনে নিতে চাপ দিচ্ছিল। সরকার সেটা মেনে নিয়েছে। তাদের সার্বিক সহযোগিতা করছে। তাদের খুন হওয়া নেতার বাসায় খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ একাধিক মন্ত্রী গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনকারীরা যখন রাস্তায় দাঁড়াতে পারছে না; বুলেট, টিয়ার গ্যাসে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছেন; তখন শাহবাগকে আদর-আপ্যায়ন, খাওয়া-দাওয়া ও নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। অতএব, সরকারের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরিষ্কার। এদের আন্দোলন যে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, সেটা স্পষ্ট।
তাহলে এদের আন্দোলন ও ক্ষোভ কাদের বিরুদ্ধে? অল্প সময়ে সেটাও প্রকাশ পেল। নিক কোহেন তার লেখায় এবং অন্যান্য ‘দেশপ্রেমিক’ সংবাদপত্র সেটা বলে দিচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতার তীব্র আবেগে তারা এখন ইসলামী দল, ইসলামী রাজনীতি, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ইসলামী প্রতিষ্ঠান নির্মূল করতে চাচ্ছে। এ কাজে প্রতিদিন তাদেরকে কারা এসে সমর্থন করছে, তাদের বিশ্বাস ও আচরণ বিশ্লেষণ করলেই শাহবাগ অঙ্কের যোগফল যে কারো পক্ষে মিলানো সম্ভব। এক পর্যায়ে দেখা গেছে, সুদূর কলকাতা থেকে গান লিখে এবং সশরীরে এসে হাজির হয়ে এদের সঙ্গে সহমর্মিতা ও সমর্থন জ্ঞাপন করা হচ্ছে। অতএব এরা কারা, সেটা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক উত্তেজক পরিস্থিতিতে পুরো উদ্যোগটির পর্যালোচনা করা দরকার। আমরা ঐতিহাসিকভাবেই লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশে ধর্ম এবং ধর্মহীনতার একটি সুপ্ত লড়াই চলে আসছে। সর্বত্র সেই লড়াই বিদ্যমান। নীতি থেকে শুরু করে মিডিয়া পর্যন্ত ইসলাম ও তাগুতের লড়াই দেখা যাচ্ছে। বামপন্থী-সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, দল, গ্রুপ সব সময়ই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক ক্ষমতা ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে ধর্মকে নস্যাৎ করতে উদ্যত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাঁধে চেপে এরা বর্তমান সময়ে ব্যাপক শক্তি সঞ্চয় করেছে। এমনকি, প্রকাশ্য সমাবেশ করে ইসলামের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। এই দ্বন্দ্বে আশি ভাগ মুসলমানের দেশে শেষ পর্যন্ত ইসলামই বিজয়ী হবে, এ কথা জেনেও তারা পিছপা হচ্ছে না। তারা জানে, একদিনে এ দেশ থেকে ইসলামকে মুছে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা আনা যাবে না। তারা ক্রমে ক্রমে ইসলামকে চাপের মধ্যে রাখতে এবং তরুণ প্রজন্মকে ইসলামবিরোধী করতে ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। ইসলামী চিন্তা, দল, নেতৃত্ব, দর্শন, চেতনা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সময় নিয়ে কাজ করছে তারা। পৌত্তলিক ও সেক্যুলার সাংস্কৃতিক আদর্শ চাপিয়ে দিচ্ছে। অগ্নি ও আলপনা হয়ে উঠেছে তাদের মহান প্রতীক। এই আগুন ও আলপনার সঙ্গে পৌত্তলিকতার সম্পর্ক নতুন করে বলার বিষয় নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, সকলেই কি সজ্ঞানে এসব করছেন? সন্দেহ নেই, একটি সমাবেশে বিভিন্ন ধর্ম, গোষ্ঠী ও চিন্তার লোক সমবেত হয়। কিন্তু কেবল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আচার, আচরণকে মানতে বাধ্য করা সর্বজনীনতার লক্ষণ নয়। কারা এইসবকে ঘিরে তীব্র উন্মাদনায় ফেটে পড়ছে, তারা কারা, সেটা চিহ্নিত করলেও এই আন্দোলনের স্বরূপ আরও খোলাসা হবে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে বলে রিপোর্ট ছেপেছে। এখন বিদেশী ও দেশী পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও ফ্যাসিবাদের যুগ্ম পদধ্বনি সম্পর্কিত রিপোর্ট পড়লে সকলেই বুঝবেন যে, ইসলাম ও গণতন্ত্রের জন্য কী বিরাট বিপদ পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এ অবস্থায় মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের লাখ লাখ মসজিদ-মাদরাসার কোটি কোটি মানুষ ঈমান ও গণতন্ত্র রক্ষায় তৌহিদের বুলন্দ স্লোগান নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছেন।
বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের রাজনৈতিক অতীতে আমরা সাম্প্রদায়িকতার কথা শুনেছি। রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার ঘৃণ্য রূপও দেখেছি। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষুদ্রতাকে ভর করে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে বৃহত্তর ইসলামপন্থী ধর্মগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক মনোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘটনা এবারই প্রথম দেখা গেল। ইসলাম ও মুসলমানদের এত নির্মমভাবে আঘাত করার জন্য তারা কিছু উত্তেজক ইস্যু সামনে এনেছে বটে। কিন্তু মূল বিবেচনায় তারা যে আসলে ফ্যাসিবাদী কায়দায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতাকে বিজয়ী করতে চায়, সেটা বিলাতের গার্ডিয়ান পত্রিকা সোজাসুজি বলে দিয়েছে। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাও বলছে। টিভিতে, পত্রিকায় মানুষ স্বচক্ষে দেখছে। এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে।
এখন সামনে অনেক প্রশ্ন। এই আন্দোলন কোন পথে চলেছে? একদিন-দুইদিন করে তারা বেশ কিছুদিন হলো বসে আছে। কিছু তরুণ তাদের ল্যাপটপ-কম্পিউটার থেকে ক’দিন পর পরই নতুন নতুন কর্মসূচি দিচ্ছে। কাউকে শাসাচ্ছে। কাউকে ধমকাচ্ছে। কাউকে কাউকে নির্মূল করতে চাচ্ছে। ফ্যাসিবাদের মতো নিজেরা ছাড়া অন্য কাউকেই তারা স্বীকার করছে না। সমাজে যে নানা মতের চর্চা হয়, সেটাও তারা মানছে না। বিশেষ করে, ইসলামী দর্শন, রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, নেতৃত্ব, শিক্ষা ইত্যাদিকে তারা সহ্যই করতে পারছে না। এই অসহিষ্ণুতা এই আন্দোলনকে বিরূপ সমালোচনার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দিনে দিনে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আওয়াজ উঠছে। মজার ব্যাপার হলো, একমাত্র সরকার ও তাদের বশংবদ বামরা ছাড়া বিশেষ আর কেউ সেখানে যাচ্ছে না। বিএনপির এক নেতা বলেছেন, এরা গুম, খুন, হত্যা, দুর্নীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বললে এদের সমর্থন করার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু তারা সুশাসন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা নিয়ে কিছুই বলছে না। বলার কারণও নেই। সম্ভবত ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিজয়ী করার মূল লক্ষ্যের প্রতিই তাদের এখন যাবতীয় মনোযোগ ও নিষ্ঠা। অবশেষে বিএনপি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, ইসলাম ধর্ম ও নবীর (সা) বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ করতে।
যে কোনো ক্রিয়ার যেমন প্রতিক্রিয়া থাকে, শাহবাগের ব্যাপারেও সেটা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ এদের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে। ইতিমধ্যে বহু ধর্মীয় নেতা ও সংগঠন তাদের প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব ব্যক্ত করেছে। সরকারের কর্তব্য হলো, দেশের নীতি ও আদর্শ একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে না দিয়ে সকলের কথা শোনা। সকলকে নিয়ে চলার দায়িত্বই সরকারের মূল চেতনা। দল-গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করা নয়। সরকারের কার্যক্রমকে এ প্রসঙ্গে আরও জনমুখী করতে হবে। নইলে সরকার ও শাহবাগকে মানুষ এক করে চিহ্নিত করার সুযোগ পাবে। এটা সরকারকে ব্যাপক জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে নিয়ে যাবে। সরকার আসলে কী চায়, সেটাও সকলের সামনে স্পষ্ট করা দরকার। নইলে একটি রহস্যময় বিভ্রান্তি ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাবে। সরকার বিরোধীরা নানা কথা বলার সুযোগ পাবে।
শাহবাগ নেতৃত্বকেও তাদের ব্যাপারে দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় যা লেখা হচ্ছে, সেটার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিতে হবে। জনগণের মূল অংশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও স্পষ্ট করতে হবে। দেশের তরুণ সমাজ জাতির গর্ব ও সম্পদ। এরা কোনো স্বার্থান্বেষী চক্রের খপ্পরে পতিত হবে, এমনটি কেউ কামনা করে না। কিংবা এদেরকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে কেউ ধর্মহীনতার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করবে বা নিজের কুশাসন ও পাপ আড়াল করবে, সেটাও হয় না। এমন পরিস্থিতিতে পুরো বিষয়ে জনগণকে বিশেষভাবে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো আরোপিত আবেগ ও আন্দোলন দিয়ে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মানুষের চিরায়ত ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা শুভ ফল বয়ে আনবে না। গণতন্ত্র, বহুমত, ধর্মীয় স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ধারার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা/ধর্মহীনতা এবং একদলীয়/ফ্যাসিবাদী চক্র অতীতের মতো বর্তমান আর ভবিষ্যতেও পরাজিত হতে বাধ্য হবে।