ফারজানা মাহবুবা। মাওলানা আবু তাহের ভাইয়ের মেয়ে। তাহের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি। বিয়ে করেছিলেন তৎকালীন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী মিতু আপাকে।

ফারজানার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। তিনি ভালো লিখেন। নারী অধিকার ও পারিবারিক ব্যবস্থা নিয়ে মোস্টলি। যতটুকু আমি দেখেছি। আমার এক কাছের মানুষের কাছ হতে মাঝে মাঝে উনার লেখার লিংক পাই। সে রকম একটা লেখা আজ পড়লাম। তাতে তাহের ভাই সম্পর্কে উনার মেয়ে লিখেছেন,

সারাজীবন নিজের ভিতর নিজে কত কমপ্লেক্সে ভুগেছি আব্বু আম্মুর সম্পর্ক নিয়ে, আব্বুম্মুর সাথে আমাদের ভাইবোনদের সম্পর্ক নিয়ে, আমাদের পরিবারের ধরন নিয়ে। নিজেকে নিজে কতবার প্রশ্ন করতে করতে আহত করেছি, আমরা ভাই বোনরা কী আব্বুম্মুর রাজনৈতিক জীবনের বাই-প্রোডাক্টস মাত্র? আব্বুম্মুর সংসার কী আসলে একটা পরিবার ছিলো কখনো? নাকি রাজনীতিই ছিলো আমাদের পরিবার?

আমি অনবরতঃ, বড় হতে হতে ক্ষনে ক্ষনে বুঝতে চেয়েছি, আমি কি আদৌ কারো ভালবাসার ফসল? নাকি আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির জাষ্ট একটা বাই প্রোডাক্ট মাত্র? প্রশ্নটা কত সহজে লিখে ফেললাম এখানে। অথচ ছোট থেকে বড় হতে হতে এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হওয়া মোটেও সহজ ছিলো না। কেউ দেখতে পেতো না বাইরে থেকে, ভিতরে ভিতরে প্রশ্নগুলোর খোঁচায় কেমন রক্তাক্ত হতাম সারাক্ষন।

একটা মানুষ যে কিনা আর্ট বা সাহিত্যের একশ’ মাইলের ভিতরেও নেই, একটা মানুষ যে সেলফ মেইড, চরম আদর্শবাদী, সম্পূর্ণ রসকষহীন স্রেফ সাদা পাঞ্জাবী, সাদা পায়জামা আর সাদা টুপি পড়ে জীবন কাটানো একটা মানুষ, সেই মানুষ, যার বউ একসময় কবিতা লিখতো, …নিজের ভিতর সাহিত্যের স-ও না থাকার পরেও নিজের আট/নয় বছরের মেয়েকে নিয়ে ছড়া লিখতে চেষ্টা করে মানুষটা!

একটা মানুষ কত তীব্রভাবে তার লেখিকা স্ত্রীকে ভালবাসার কথা বলছিলো ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই দেখো, আমাকে বিয়ে করে সংসার আর রাজনীতি নিয়ে তুমি আর লেখালেখি করতে পারো না, তোমাকে আমি আর সে সময় সুযোগ করে দিতে পারিনাকিন্তু দেখো, তোমার আর আমারই তো রক্ত, আমাদের মেয়ের লেখা ছেপেছে পত্রিকায়! তুমি পারোনি, আমি তোমাকে পারতে দিতে পারিনি, কিন্তু আমাদের মেয়ে পারবে! দেখো, ও একদিন লেখিকা হবে।

যত বিদেশে গিয়েছে সফরে, হাতে করে নিয়ে এসেছে দেশ বিদেশের বই। দেশে নিষিদ্ধ হতো এই সেই বই। রাজনীতির মানুষ, নিষিদ্ধ বই’র কপি দেখতাম আব্বুর হাতে। আব্বুকে পড়তে হতো জানার জন্য। আর আব্বু একটু ন্যাপ নিলেই কোনোরকমে চারশ চল্লিশ মাইল বেগে পড়ে ফেলতাম সেসব নিষিদ্ধ বই’র যত পৃষ্ঠা পারি!

এখন পিছন ফিরে তাকালে দেখি, আব্বু কোনো সাধারন বাবা ছিলেন না। কোনো সাধারন বাবা তার মেয়ে চুরি করে এডাল্টদের নিষিদ্ধ বই পড়বে তা সহ্য করবে না। সে বইয়ে হুমায়ুন আজাদের লেখার ভাষা পর্ণ বইয়ের ভাষার চে’ও জঘন্য ছিলো।

অথচ এই মানুষটাই, এই আব্বুই আরো ছোটবেলায় একবার যে পুতুল কিনেছিলাম, সে পুতুলকে দা দিয়ে এক কোপে দুই ভাগ করে ফেলেছিলো আমার সামনেই। যে মানুষ তার ধর্মীয় কারনে পুতুল দেয় না তার বাচ্চা মেয়েকে, কেনো যেন পড়ালেখা আর বই পড়ার ক্ষেত্রে সেই মানুষটাই হয়ে যেতো পৃথিবীর সবচে’ লিবারাল বাবা।

যে বাবা পুরো পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে তার … ইয়াং … মেয়েকে বিদেশে হোষ্টেলে রেখে আসে একলা। আব্বুর রাজনীতির বিশাল জবাবদিহীতার কারন মনে হয় আমিই ছিলাম।

জীবনে প্রথম বই ছাপানোর তালও আব্বুই তুলেছিলো। নিজের থেকেই দিস্তা কাগজ এনে দিয়েছিলো। পড়ার টেবিলে বসে গুট গুট হাতের লেখায় সে দিস্তা কাগজে লিখে দিয়েছিলাম নিজের গল্পগুলো। … সে বই বের হয়েছিলো।”

মাওলানা আবু তাহের ভাই সম্পর্কে আমার যে ধারণা তার সাথে উনার মেয়ের এই স্মৃতিচারণমূলক লেখা মিলে যায়।

তাহের ভাইকে আমরা পেয়েছি চট্টগ্রাম মহানগরীর জামায়াতের আমীর হিসেবে। আমি ছিলাম ‘বিশেষ কমিটি’র মেম্বার। আসলে ‘বিশেষ কমিটি’ বলে কোনো কমিটি ছিল না কখনো। কিন্তু একটা কমিটি যার কোনো বিশেষ নাম ছিল না, কীভাবে যেন তা সংশ্লিষ্ট মহলে ‘বিশেষ কমিটি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যায়।

জামায়াতের রীতি অনুসারে সংগঠন পরিচালিত হবে আমীর বা সভাপতির নেতৃত্বে। তাকে সহযোগিতা করবে মজলিশে শুরা বা পরামর্শ সভা। তো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন, মানে আমরা টিচার হওয়ার সময়কার কথা, ১৯৯৪ সাল হতে এর শুরু বলা যায়, আমীর ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষক হাবিবুর রহমান স্যার। তিনি চবি কলেজে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তাই উনাকে আমি স্যার ডাকতাম।

তখনকার সময়ে, খুব সম্ভবত এখনো চবি জামায়াতের অধিকাংশ রোকন ছিলেন মসজিদের ইমাম। দু’একজন অফিসার ও কয়েকজন গৃহবধূও রোকন ছিলেন। শিক্ষক পর্যায়ে রোকন ছিলেন অল্প কয়েকজন। তাদের মধ্যে মেরিন সায়েন্সের জাফর ভাই ছাড়া কারোরই আন্দোলন সংগ্রাম করার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না।

অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় মানেই আপনারা জানেন, আন্দোলন সংগ্রাম নানা ধরনের জটিল পরিস্থিতি। ভিসি, সিনেট, সিন্ডিকেট, হলুদ-গোলাপী-নীল-সাদা দল, সতত পরিবর্তনশীল জাতীয় পরিস্থিতি, এসব প্রপারলি হ্যান্ডেল করার জন্য তখন আমরা যারা শিবিরের সদস্য ছিলাম, সদ্য টিচার হয়েছি, তারা, রোকন মানের শিক্ষক যে কয়জন ছিলেন তারা এবং চবি শিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারী, এই কম্পোজিশন নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে কমিটি করা হয়; যারা টাইম-টু-টাইম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সামগ্রিক কার্যক্রমসহ জামায়াতের সংগঠন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। পদাধিকার বলে চট্টগ্রাম মহানগরী জামায়াতের আমীর ছিলেন এর প্রধান। আমি ছিলাম এই কমিটির অন্যতম সক্রিয় সদস্য।

২.

বিশেষ কমিটির মিটিংয়ে তাহের ভাইকে আমি সেভাবেই দেখেছি, তাহের ভাইয়ের যে ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা উনার মেয়ে লিখেছেন।

একবার কোনো একটা প্রসঙ্গে উনি বললেন, ‘সিদ্দীকুল্লাহ ভাই আপত্তি না করলে এই ইস্যুতে ছাত্রী সংস্থার মেয়েদেরকে দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আমি একটা মিছিল করাইয়ে দেই। আপনারা কী বলেন?’ সাংগঠনিক পরিবেশে পর্দা নিয়ে যে বাড়াবাড়ি, দৃশ্যত তিনি সেটারও বিরোধী ছিলেন। ‘বিদেশে নারী-পুরুষ পাশাপাশি সারিতে বসে টিসি-টিএস করে। এখানে করতে অসুবিধা কী?’ এমন ধরনের কথাবার্তাও তিনি কখনো কখনো বলেছেন। আসলে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার অধিকারী। এখনকার ভাষায় একজন সংস্কারবাদী। আমার হিসেব অনুযায়ী তাহের ভাই ছিলেন রিফর্ম ফ্রম উইদিন বলতে যে ধারা, সেটার অনুসারী।

যুগোপযোগী ইসলামী আন্দোলন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে গড়ে তোলার জন্য যারা জামায়াতের প্রয়োজনীয় সংস্কার চান, কিন্তু তাদের মতে এটি অতি অবশ্যই হতে হবে সংগঠনের ভেতর থেকে। সংগঠনের মৌলিক কাঠামোকে অক্ষুন্ন রেখে। জামায়াত যদি সংস্কার না করে, অথবা গৃহীত সংস্কার যদি পর্যাপ্ত না হয়, তাতে তারা অর্থাৎ রিফর্ম ফ্রম উইদিন ধারার অনুসারীরা আপত্তি করবে, কিন্তু দিনশেষে তারা আমৃত্যু জামায়াতই থেকে যাবে। জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা জামায়াতে ইসলামী ছেড়ে দেয়াকে ইসলামের রজ্জু গলা হতে খুলে ফেলার সামিল বলে মনে করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমি এই ধরনের চিন্তাভাবনাকে ভুল মনে করি। আমি মনে করি, যা সঠিক তা করতেই হবে। কেউ না করলে আমিই সেটি করবো বা করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আমার দৃষ্টিতে ইসলামই বড়। জামায়াতে ইসলামী নয়। মাওলানা আবু তাহের ভাইসহ জামায়াতের মধ্যকার প্রগতিশীল চিন্তাধারার লোকেরা ইসলাম ও জামায়াত, দু’টাকেই কার্যত সমগুরুত্বের বলে অন্ততপক্ষে অবচেতনে বিশ্বাস করতেন।

আপনারা জানেন, ২০০১ সালের নভেম্বরের দিকে আমি ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (Centre for Social and Cultural Studies) তথা সিএসসিএস-এর কাজ শুরু করি। তখন আমি এই প্লাটফরম হতে নিয়মিতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতাম। তখনকার সময়ে সেগুলো বেশ ইমপ্যাক্ট ফেলছিলো। সে সময়ে একবার শিক্ষকদের একটা সমাবেশে তাহের ভাই এসছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জামায়াতের কাজ প্রচলিত ধারায় করতে গিয়ে যেসব সমস্যা হচ্ছিল সেগুলো নিয়ে উপস্থিত শিক্ষকগণ জোরালো বক্তব্য দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে এরাবিকের কাদের স্যার খুব জোরালোভাবে সিএসসিএস-এর কাজকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করে বক্তব্য রেখেছিলেন। তখন তাহের ভাই যা বলেছিলেন তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

তিনি বললেন, (ভাষাটা বেশ-কম হতে পারে) ‘আপনারা যদি বলেন, আপনারা ব্যক্তিগত রিপোর্ট লিখবেন না, সেটা আমরা মানবো না। কিন্তু চাইলে আপনারা নিজেদের মতো করে রিপোর্ট বই ছাপিয়ে নিতে পারেন। আমরা সেটাকে কাউন্ট করবো। আপনাদের কাছ হতে আমরা তিনটা কাজ চাইবো:

(১) ব্যক্তিগত রিপোর্ট সংরক্ষণ।
(২) বায়তুল মালে চাঁদা দেয়া, জামায়াতের পরিভাষায় এয়ানত প্রদান।
(৩) সম্পাদিত সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাসিক রিপোর্ট উর্ধ্বতন সংগঠনকে জমা দেয়া।

ন্যূনতম এই তিনটি কাজ করা সাপেক্ষে আপনাদের ময়দানের উপযোগী যে কোনো ধরনের কাজকে আমরা জামায়াতের কাজ হিসেবে গণ্য করবো।’

একটি কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। এই মাসখানেকের মধ্যে একজনের সাথে মৃদু ঝগড়াও করেছি আমি, এ বিষয়ে।

বিষয়টি হলো, যারা মনে করে, জামায়াতের সংস্কার না হওয়ার জন্য শুধুমাত্র জামায়াতের সংগঠনবাদী গোয়ার-গোবিন্দ রক্ষণশীল দায়িত্বশীলরাই দায়ী, আমার মতে তাদের ধারণা ভুল।

জামায়াতের সংস্কার না হওয়ার জন্য উর্ধ্বতন বা কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের সাথে সাথে জামায়াতপন্থী বুদ্ধিজীবীরাও কম দায়ী নন। আমার জানা মতে, কখনো তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদেরকে কিছু বলে নাই। নিজেরাও এসব নিয়ে কখনো সিরিয়াসলি আলাপ-আলোচনা করে নাই। ধূর্ত শেয়াল কর্তৃক কুমিরের এক ছানা সাত বার দেখানোর মতো ‘স্যার’ হিসেবে তাদেরকে শো করা হয়েছে। তারাও পেশাগত প্রত্যয়নকারীদের মতো বুদ্ধিজীবিতার সিল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে নিজেদেরকে ধন্য বলে মনে করেছে।

অন্তত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমি দায়-দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে পারি, সেটি আপনারা জানেন।

সেদিন মাওলানা আবু তাহের ভাই আমাদেরকে যে কাইন্ড অব ওপেন লাইসেন্স দিয়েছিলেন, নিজেদের অযোগ্যতার কারণে আমরা তা কাজে লাগাতে পারিনি। এবং আমার মতে, তাহের ভাইয়ের মতো লোক হওয়ার কারণেই এমন একটা সুযোগ আমরা তখন পেয়েছিলাম। অন্য কোনো দায়িত্বশীল হলে এমন উদার, সুস্পষ্ট ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারতেন না, খুব সম্ভবত।

৩.

হেলাল হুমায়ুন ভাই ছিলেন দৈনিক সংগ্রামের চট্টগ্রাম ব্যুরো চীফ। ভিসি আলমগীর মোঃ সিরাজুদ্দীন বিরোধী আন্দোলনের কাজে উনার সাথে আমার বিশেষ খাতিরের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কোনো এক সময় হেলাল হুমায়ুন ভাই আমার কাছে তাহের ভাই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বললেন। হেলাল হুমায়ুন ভাই এখন নাই হয়ে আছেন। তাহের ভাই থেকেও নাই।

তখনও আমি ছিলাম সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিমনা। আলাপ-সালাপে বুঝতে পারতাম, হুমায়ুন ভাই আমার এই দিকটাকে বেশ পছন্দ করেন। তাহের ভাইও যে সে রকম মন-মানসিকতা পোষণ করেন সেটার প্রমাণ দিতে গিয়ে তিনি একটা ঘটনার উল্লেখ করলেন। ঘটনা যখন তিনি আমাকে বলেছেন তখন আমি অলরেডি শিক্ষক।

একবার তাহের ভাই হুমায়ুন ভাইকে উনাদের, মানে হুমায়ুন ভাইদের, গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সে মোতাবেক কোনো এক সুবিধাজনক সময়ে তারা দু’জন গিয়েছিলেন। সাথে আর কেউ ছিল না। প্রোগ্রামটা এভাবে সাজানো ছিল। পথে তারা ক্যাসেট প্লেয়ার দিয়ে পছন্দ মোতাবেক বাংলা গান শুনবেন। বাড়ির পুকুর হতে জাল দিয়ে মাছ ধরা হবে। সেই মাছের তরকারি দিয়ে ক্ষেতের আতপ চালের ভাত খাওয়া হবে। এরপর পাটি বিছিয়ে ভাত-ঘুম দিবেন। সারাদিন গ্রামে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর শহরে ফিরে আসবেন। যেভাবে প্ল্যান করা হয়েছিল সে মোতাবেক ট্যুরটা হয়েছিল।

এই ঘটনাটার মাধ্যমে আমরা এক ভিন্ন তাহের ভাইকে দেখতে পাই। যিনি বাহ্যত যতটা সাংগঠনিক, অন্তর্গতভাবে তিনি তার চেয়েও বেশি মানবিক।

বাবাকে নিয়ে ফারজানা মাহবুবার স্মৃতিচারণের এই অংশে যেসব বিষয় ফুটে উঠেছে তা হলো উনার বাবা রাজনীতি করতেন। আসলে উনার বাবা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর একজন ফুলটাইমার দায়িত্বশীল। ফুলটাইমার হচ্ছে সংগঠনকে চাকরি হিসেবে নেয়ার ব্যবস্থা। সংগঠনের দায়িত্ব পালন ছাড়া ফুলটাইমাররা আয়-উপার্জনের জন্য কিছু করে না। সংগঠন থেকে তারা নিয়মিত ভাতা পান। এভাবেই তাদের সংসার চলে।

একটু ব্যাকে গিয়ে বলি।

আমরা যারা শিবির-জামায়াত করে জীবন কাটিয়েছি, আমরা কখনো ‘পার্টি’ কথাটা ব্যবহার করতাম না। আমরা সব সময় ‘সংগঠন’ শব্দটি ব্যবহার করতাম। আমরা ভাবতাম, এটি একটা আন্দোলন। সামগ্রিক আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন হিসেবে আমরা একে ভাবতাম। বলতাম।

রাজনীতি এর একটা অংশমাত্র। নিজেদেরকে কখনো আমরা একটা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী-অনুসারী হিসেবে ভাবতাম না। অন্যদের কেউ আমাদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বললে আমরা ভীষণ মাইন্ড করতাম। রাজনৈতিক দলের নয়, বরং ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে নিজেদের আমরা ভাবতাম। পরিচয় দিতাম।

ভুল তাত্ত্বিক কাঠামোর কারণে কালক্রমে শিবির-জামায়াত আজ নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দেয়, রাজনৈতিক দল হিসেবে। বলে, ‘আমি রাজনীতি করি’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জরুরী বিষয়কে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী বিষয়গুলোর সাথে একত্রিত করার কারণে, স্বাভাবিকভাবেই জরুরী বিষয়টাই সব সময় অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং কালক্রমে সেটাই কোর অব আইডেন্টিটি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যাহোক, নিছক বা মূলত রাজনৈতিক দল যদি হতো, সেভাবে যদি আমাদের বলা হতো, সেভাবে যদি আমরা জানতাম, বুঝতাম, তাহলে আমি খুব সম্ভবত এই দলে জয়েন করতাম না। আমার জানা মতে, অনেকেরই মনোভাব ও অভিজ্ঞতা একই ধরনের।

কেউ হয়তো বলতে পারেন, ভুলিয়ে ভালিয়ে আপনাদেরকে ইসলামের পথে আনা হয়েছে।

ব্যাপার হলো, ভুলিয়ে ভালিয়ে আদর্শের আবহ তৈরি করা যায়। মেকি কথা দিয়ে সত্যিকারের আদর্শ কায়েম করা অসম্ভব। এক সময় তা ভেঙ্গে পড়ে। যতটুকু টিকে থাকে তা মৌলিক অসঙ্গতি বা কন্ট্রাডিকশান নিয়েই টিকে থাকে। এই ইনার-কন্ট্রাডিকশান উক্ত আদর্শপন্থী দলের বিকাশ ও উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ বা ডিলিমিট করে। জামায়াতে ইসলামীর ক্ষেত্রে যা হয়েছে।

ফারজানা মাহবুবার কথা থেকেও বুঝা গেছে, এ ধরনের আরো ছেলেমেয়েদের কথা থেকে বুঝা গেছে, জামায়াতের ফুলটাইমার দায়িত্বশীলদের ফ্যামিলির সন্তানেরা তাদের বাপের পেশা নিয়ে সব সময় বিব্রত ছিল। হয়তোবা এখনো আছে। এমনকি, এই ফুলটাইমাররা নিজেরাও আর্থিকভাবে সংগঠন-নির্ভরতার এই ব্যাপারটি নিয়ে বিব্রত ছিলেন। খুব সম্ভবত, এখনো আছেন।

সৌদি আরব নিবাসী ফটিকছড়ির কামাল ভাইয়ের কাছ হতে শুনেছি, মোল্লা ভাই উনাকে বলেছেন, ‘কামাল, আমাদের কথা বাদ দাও। আমাদেরকে দিয়ে কিছু (মানে, সংগঠনের সংস্কার কার্য) হবে না। আমরা সংগঠনের ভাতায় চলি। আমাদের পক্ষে কোনো শক্ত অবস্থান নেয়া সম্ভব নয়।’

‍জামায়াতের দৃষ্টিতে, ফুলটাইমার সিস্টেম ও ক্যাডার সিস্টেম হলো জামায়াত শিবিরের টিকে থাকা ও সাংগঠনিক মজবুতির কারণ। কথাটা এক অর্থে সঠিক হলেও আমার দৃষ্টিতে, এই ধরনের আল্ট্রা কনজারভেটিভ এন্ড রেজিমেন্টেড সিস্টেমের কারণে জামায়াত কখনো জনগণের সংগঠন হয়ে উঠেনি। ভবিষ্যতেও তা হয়ে উঠবে না। বেশি দূর তারা কখনোই আগাতে পারেনি। ভবিষ্যতেও পারবে না। সমাজের মধ্যে তারা কিছু গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। দিনশেষে তারা কিছু মধ্যম মানের ভালো মানুষ তৈরি করেছে।

জামায়াত ও এর হালনাগাদ স্বীকার করে নেয়া অঙ্গসংগঠনসমূহ হলো মধ্যম মানের লোকজনের সংগঠন। মিডিওকারদের সংগঠন।

এখানে যারা মেধাবী তারা একপর্যায়ে ছিটকে পড়বে, অথবা মাওলানা আবু তাহের ভাইসহ আরো অনেকের মতো এক ধরনের বৈপরীত্য নিয়ে জীবন কাটাবে। গতিশীল মননের অধিকারী হয়েও একটা স্থবির ব্যবস্থার ধ্বজাধারী হিসেবে জীবন কাটানো তো এক ধরনের বৈপরিত্যের মধ্যে বসবাসের সামিল। তাই না?

জামায়াতসহ বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের প্রধান তাত্ত্বিক হিসেবে যিনি অগ্রগণ্য তিনি হলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। বিংশ শতাব্দীতে গড়ে উঠা ‘পলিটিক্যাল ইসলামে’র এই ধারার কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি বা বিজয় না হওয়া অর্থে এর পতনের কারণও কিন্তু তিনি, তাঁর ভুল সাংগঠনিক তত্ত্ব ও তাঁর কনট্রাডিক্টরি ইনিশিয়েটিভস।

একদিকে তিনি চেয়েছেন, সব সময় সবকিছুতে প্রো-পিপল হতে। অপরদিকে, চিন্তা চেতনায় সাইয়েদ কুতুবের মতো তিনিও এক ধরনের সফট তাকফিরি মনোভাব (যারা ‘শুদ্ধ’ মুসলমান নয় তাদেরকে কাফের মনে করা) পোষণ করেছেন। কিছু কিছু দিক থেকে তিনি ছিলেন, উদারমনা। কিছু কিছু দিক থেকে তিনি ছিলেন কট্টরবাদী। উনার এই ইনার কন্ট্রাডিকশনের জায়গাগুলো দেখিয়ে দেয়া এই লেখায় সম্ভব নয়। এই লেখাটা চট্টগ্রাম জামায়াতে ইসলামীর দীর্ঘদিনের দায়িত্বশীল মাওলানা আবু তাহের ভাইকে নিয়ে। মাওলানা মওদূদীর ভুল-শুদ্ধ নিয়ে নয়। মাওলানা মওদূদীর কথা এখানে এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে।

তাহের ভাই ছিলেন একজন ফুলটাইমার। আমি বরাবরই ফুলটাইমার সিস্টেমকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছি। সারাদিন অনুগত সাংগঠনিক লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার কারণে ফুলটাইমারদের অবস্থা হয় সারাদিন ঘরে বসে থাকা লোকদের মতো। সূর্যালোক হতে বঞ্চিত এসব লোক আদতে শ্যামলা হলেও একসময় কেমন যেন বেশ ফর্সা হয়ে উঠে। দেখতে তাদেরকে অধিকতর সুন্দর মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তারা মারাত্মকভাবে ভিটামিন-ডি’র স্বল্পতাসহ নানা ধরনের সমস্যায় ভোগে। যদিও তারা সেটি কখনো বুঝতে পারে না। বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠা বা ট্রেডমিলের ওপর দৌড়ানোর মতো উন্নয়ন ও অগ্রগতির এক প্রকাণ্ড ভুলের ওপর তারা জীবন কাটিয়ে দেয়।

তাদের জীবনে পিউর সাংগঠনিক নীতিবাদী ধারা বনাম স্বাভাবিক মানবীয় ধারা, এই দুই ধারার একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। নানাভাবে তারা এই দ্বন্দ্বকে মিটানোর বা এর মধ্যে সমন্বয় করার চেষ্টা করে। করাই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনশেষে তাদের সে চেষ্টা খুব একটা সফল হয় না।

একজন মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল ব্যক্তিকে কার্যত সমাজ বিচ্ছিন্ন করে একটা ‘সাংগঠনিক বেলুনের’ মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য করাকে আমি জুলুম বলে মনে করি। এ ধরনের জুলুম স্বীয় নেতাকর্মীদের ওপর করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের থেকে এটি শিখেছে জামায়াতে ইসলামী। উভয় ধারা এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার বেশ খানিকটা সুফল পেয়েছে। একইসাথে বেশ খানিকটা কুফলও তারা পেয়েছে। এবং পাচ্ছে।

পারবে কি তারা এই জুলুমতন্ত্র হতে বের হতে?

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *