দেশে এবং বিদেশে ইসলাম চর্চার প্রচলিত প্রধান ধারাসমূহের মধ্যে রয়েছে–
(১) রাজনৈতিক ইসলামপন্থা অনুসারীদের ধারা, যারা নিজেদেরকে ইসলামী আন্দোলন হিসাবে পরিচয় দেয়।
(২) এছাড়াও রয়েছে অরাজনৈতিক এবং মূলত ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধিনির্ভর ধারা, যারা নিজেদেরকে ঈমানী আন্দোলন হিসাবে পরিচয় দেয়।
(৩) রয়েছে প্রচণ্ডভাবে আকীদা-সংবেদনশীল পিউরিটানিক ধারা, যারা নিজেদেরকে সালফে সালেহীনদের অনুসারী হিসাবে দাবি করে।
(৪) রয়েছে সুশীল একাডেমিক ধারা, যারা ইসলামের মধ্যে নানা রকমের পটেনশিয়ালিটিজ দেখতে পায়। তারা চায় ইসলাম বিজয়ী হোক। এজন্য যারা কাজ করছে বা করবে, তারা মনে করেন, তাদের কাজ হচ্ছে তাদেরকে অর্থাৎ ময়দানের লোকদেরকে মূলত সমালোচনার মাধ্যমে গাইড করা।
এই চতুর্বিধ ধারার কোনোটার সাথে একাত্ম না হয়ে, কোনোটাকে ওউন অথবা ডিজওউন না করেই ইসলামের জন্য যারা কাজ করছেন, ভাই নোমান আলী খান তাদেরই একজন।
যারা মনে করে, “আমরা এগুতে পারছি না; কারণ, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে, আমাদেরকে লেভেল প্লেইং ফিল্ড দেয়া হচ্ছে না, ইত্যাদি…” তাদের এই ষড়যন্ত্রতত্ত্ববাদী ও সর্বদা অভিযোগ করার মানসিকতার বিরুদ্ধে নোমান আলী খানের কার্যক্রম এক অর্থে একটি শক্ত প্রতিবাদ। যে কোনো অবস্থাতেই কাজে নামা যায়, সেটি তিনি প্রমাণ করেছেন। তেমনভাবে উল্লেখযোগ্য ও মৌলিক কোনো কিছু করতে হলে দল বা সংগঠনব্যবস্থা যে অপরিহার্য পূর্বশর্ত নয়, তা তিনি আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
ড. ইউসুফ কারজাভী, ড. তারিক সোয়াইদান, ড. তারিক রমাদান, ড. ইয়াসির ক্বাদীর মতো আল্লামা ও প্রফেসর না হয়েও মাত্র এক দশকের মধ্যে যে উস্তাদের চেয়ে বড় উস্তাদ হিসাবে গড়ে উঠা যায়, উস্তাদ নোমান আলী খান তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ইসলামী সাহিত্য নয়, সরাসরি কোরআনই যে ইসলামের জন্য কাজ করার সবচেয়ে কার্যকরী এপ্রোচ, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন। ইসলামী চেতনা, আধুনিক জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও ইতিবাচক ধারণা এবং সর্বশেষ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার তাঁর বৈশিষ্ট্য। একতরফা কনফ্লিক্ট থিওরিতে যারা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন তাদের কাছে নোমান আলী খানদের কাজকর্ম নিছক দাওয়াতী কাজ নিয়ে পড়ে থাকা ‘খেদমতে দ্বীন’ মাত্র!
ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশের প্রচলিত ইসলামী সংগঠনগুলো তাদের মনমানসিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিসহ পাঠ্য ও কর্মসূচিতে এখনো মূলত অফলাইন-এনালগ! প্রতিষ্ঠানের একটা ওয়েবসাইট থাকা অনলাইন-আপডেট হওয়া বুঝায় না। অধিকাংশ ইসলামিস্ট গ্রুপ, সংগঠন ও ‘আন্দোলন’ যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির এই গণজোয়ারকে গ্রহণ করতে পারে নাই। একশ-হাজার বছর আগের ‘গুরুবাদ’কেই তারা সানন্দে মেনে চলেন, রক্ষা করা চেষ্টা করেন..!
ব্লগিং করার জন্য সতর্ক করা হয়েছে, ফেইসবুক আইডিকে জোরপূর্বক ডিঅ্যাক্টিভেট করানো হয়েছে, এসব বেশিদিন আগের কথা নয়। হয়তো তারা মনে করেন, ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ড হলো unreal world। অতএব বাস্তবে এসবের কোনো গুরুত্ব নাই (?)। ট্রেড মিলের ওপর দৌড়ানোর মতো দিনরাত মোকাবিলা করতে করতে হয়রান হয়ে যাওয়া এসব মুহতারামগণের অবস্থা হলো দিনের আলোতে চাঁদনী রাতের কমনীয়তায় আচ্ছন্ন হয়ে চোখ বুঁজে থাকার অতি সরল কোনো লোকের মতো। যুগের অগ্রগামী মতাদর্শ অনুসারীদের বাস্তবে দেখা যায় প্রতিক্রিয়াশীল ও যুগের বহুদূর পশ্চাদ অনুসারী হিসাবে। হাও ফানি এন্ড ট্র্যাজিক…!
একজন মাওলানা মওদূদী, মাওলানা ইলিয়াস, সাইয়েদ কুতুব, বা বিশেষ কোনো বুজুর্গ-আল্লামাকে পুঙ্খানোপুংখভাবে অনুসরণ করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন যারা ইসলামের জন্য কাজ করবে তাদের উচিত কোরআন-হাদীস হতে যথাসম্ভব সরাসরি নির্দেশনা লাভের চেষ্টা করা। এ কাজে সহায়ক হিসাবে a group of mentors-কে মোটাদাগে ফলো করা। এটি শুধু ঈমানের দাবি এমন নয়। মুক্তজ্ঞান চর্চার এই ধারা বিশেষ করে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও টেকসই কর্মপন্থা।
‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ কর্তৃক সমকালীন উল্লেখযোগ্য ইসলামী ব্যক্তিত্বদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার এই উদ্যোগকে (একজন নোমান আলী খান হয়ে ওঠার গল্প) সাধুবাদ ও স্বাগত জানাই।