বিশেষ করে জামায়াতপন্থী অনেকে বলে থাকেন, যুদ্ধাপরাধ ইস্যু নিয়ে বাড়াবাড়ি ও হেফাজত দমনসহ ইসলামপন্থী ও তাদের সহযোগী (যেমন, বিএনপি) শক্তিকে গুড়িয়ে দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগ যা কিছু করছে তাতে তারা ভুল করছে। তাতে তারা দ্রুতই জনসমর্থন হারাচ্ছে। কথাটি এক অর্থে সঠিক হলেও এর একটি বিপরীত তাৎপর্যও আছে।
বিরোধী পক্ষকে মোকাবিলার দুটি পদ্ধতি হতে পারে, (১) গণবিরোধী ভূমিকা পালন না করে যথাসম্ভব র্যাশনাল হিসাবে জনগণের সামনে হাজির থাকা, অথবা (২) স্বপক্ষের শক্তিকে সুসংগত ও উজ্জীবিত করে বিরোধীদেরকে মোকাবিলা করা। বলাবাহুল্য, আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছে। গণতন্ত্র চর্চাকারী বা গণতন্ত্রের ঢাল ব্যবহারকারী কোনো দলের জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতিটি আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে হলেও, এক অর্থে, এটিরও এক ধরনের যথার্থতা রয়েছে।
নিজস্ব শক্তিকে উন্মাদনার পর্যায়ে নিয়ে উজ্জীবিত করতে পারলে তারা বিরোধীদেরকে প্রবলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। জনগণ বলতে যে নিরীহদেরকে বুঝায়, কিছু মনে করবেন না, তারা হচ্ছে অপেক্ষমান receptive নারী প্রজাতির মতো সর্বদাই শক্তিমানের পক্ষে। অন্তত, ইতিহাস তা-ই বলে। স্রোতের মাঝে খুঁটি গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে এর আশপাশে ক্রমান্বয়ে ভাসমান অনেক কিছু জমাট বাঁধতে থাকে। গবেষণার যেমন অনেক পদ্ধতি হতে পারে যার সম্মিলিত নাম হচ্ছে গবেষণা পদ্ধতিতত্ত্ব (research methodology) তেমনি রাজনীতিরও বিভিন্ন পদ্ধতি হতে পারে। গাড়ির গিয়ার পরিবর্তনের মতো রাজনীতির বিভিন্ন পদ্ধতি অবস্থা বুঝে অনুসরণ করা সম্ভব। সঠিকভাবে করতে পারলে সেগুলো ফলপ্রসূ হয়। রাজনৈতিক কৌশল ও পদক্ষেপগুলো ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ পদ্ধতিতে গৃহীত হয় না। গেম থিওরির তত্ত্বানুযায়ী বহুমাত্রিকতা, জটিলতা ও স্ববিরোধিতার আসপেক্টগুলোকে সর্বদা বিবেচনায় রাখতে হবে।
জামায়াতকে আওয়ামী লীগের মতো হতে হবে?!। আওয়ামী লীগের ভুল রাজনৈতিক সমীকরণের ফাঁক দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উঠে আসা এবং সে হিসাবে দ্বিতীয় শক্তি হিসাবে আবির্ভূত জামায়াতে ইসলামীও সংগঠন ও রাজনীতির বিষয়ে নিজ শক্তি সুসংহতকরণের নীতিকেই এ যাবতকাল অনুসরণ করে এসেছে। যার কারণে তারা গণসংগঠন গড়ে না তুলে ‘ক্যাডার সিস্টেম’ চালু করেছে যা কম্যুনিজম চালু হওয়ার আগে ইসলামী নেজামে ‘অনাবিষ্কৃত’(!) ছিলো। যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে ‘দাওয়াত’ পৌঁছানোর চেয়ে রিক্রুটেডদেরকে সর্বোচ্চ মানে গড়ে তোলার দিকে নজর দিয়েছে।
আওয়ামী লীগকে বিট করে এ দেশে ‘ইসলাম কায়েম’ করতে হলে জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সদর্থক বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করতে হবে। জামায়াতকে ‘জামায়াত-ব্র্যান্ড’ হতে বেরিয়ে এসে জনমানুষের দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। দল-সমর্থিত মিডিয়াতে দলকে সমালোচনার অধিকার দিতে হবে। দেশীয় ঐতিহ্য ও প্রথাগুলো সম্বন্ধে ‘ইসলামী শুচিতা’ কমিয়ে এনে ষড়ভূজের মতো সংগঠনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। রাজনীতিনির্ভর সংগঠনব্যবস্থার পরিবর্তে (১) সংস্কৃতি, বিশেষ করে বিনোদন সংস্কৃতি (২) মিডিয়া ও প্রযুক্তি, (৩) ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা, (৪) সামাজিক পরিসেবা (social service), (৫) বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতা ও (৬) রাজনীতি – এই ছয়টি ধারায় কাজ করতে হবে। এলাকাভিত্তিক জনশক্তি বিন্যাসের পরিবর্তে যোগ্যতা ও মানসিক ঝোঁকপ্রবণতা বিবেচনাভিত্তিক সংগঠনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। একটি ষড়ভূজের যেমন সবগুলো বাহু ও কোন সমগুরুত্বের, তেমনই উপর্যুক্ত ছয়টি ধারার সবকটিকেই স্বতন্ত্রভাবে শক্তিশালী করে বিদ্যমান এককেন্দ্রিক সংগঠনব্যবস্থাকে ‘আমব্রেলা মডেলে’ সত্যিকার অর্থেই একটি আন্দোলন হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
বাস্তবতার আলোকে নিজেকে এডপ্ট করে নেয়া সম্ভব না হলে আরো ৪০ বছর পরেও জামায়াতে ইসলামী ‘সহায়ক শক্তি’ বা ব্যাল্যান্সিং পাওয়ার হিসাবেই রয়ে যাবে। দেশের নেতৃত্ব নয়, ঐতিহ্যই হবে সান্ত্বনা!!!
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Farid A Reza: সুন্দর আলোচনা। ভিন্নমত আছে। কিন্তু যাদের সামনে নিয়ে এ আলোচনা তাদের কি তা পড়ে দেখার সময় বা মানসিকতা আছে? ১৯২৮, ১৯২৪ এবং ১৯৪১ সাল নিয়ে আমরা ব্যস্ত। অথচ বিগত এক শ বছরে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে এবং বর্তমান (২১) শতকে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে অধিকতর দ্রুততার সাথে। কিন্তু আমরা এখনো আটকে আছি ১৮২৪ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে।
৬১০ থেকে ৬২৩ – এ সময়টা হচ্ছে আমাদের মডেল। আমাদের সেখানে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে হবে। এবং তা করতে হবে খুব দ্রুততার সাথে। সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করবে না। পৃথিবী এখন একটা গ্লোবাল ভিলেজ। তাই চট্টলার সমুদ্র সৈকতে একটা ঢিল পড়লেই তা আটলান্টিকের ওপারে গিয়ে আন্দোলিত হবে। আমার বিশ্বাস, অদেখা প্রিয় ভাই মোজাম্মেল তা করতে সক্ষম।