(১) দলীয় ব্যবস্থাপনা কর্তৃত্বধর্মী। বুদ্ধিবৃত্তি তো বাই ডিফল্ট স্বাধীন। শুধুমাত্র যুক্তি ও মৌলিক সূত্রের অধীন।
(২) দল ও আদর্শ – দুটোরই দরকার আছে। একই ব্যক্তির মধ্যে এ দু’টি আপাত:বিরোধী সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। বরং থাকা উচিত বটে । যেমন নামাজ পড়া, সফর, জিহাদ ইত্যাদিতে একজন মুসলমানকে অনুগামী হওয়াটা যতটা বাঞ্ছনীয় অন্যান্য কাজে তেমনটা নয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে এর বিপরীত।
(৩) কাজের কথা হলো, বুদ্ধিবৃত্তি দলীয় সংশ্লিষ্টতার সাথে একাত্ম বা এর অধীনস্ত হবে কিনা, তা নির্ণয় করা। আমার মতে, সুসংগঠিতভাবে কাজ করা স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিরই দাবী। বুদ্ধিবৃত্তিকে বাদ দিয়ে দল-চেতনা-সংশ্লিষ্টতা হতে পারে না।
(৪) অথচ, দলীয় মজবুতীর নামে চারিদিকে চলছে দলান্ধতার মহোৎসব। বিশেষ করে ‘ইসলামী আন্দোলনপন্থী’ ইসলামিস্টদের মধ্যে। আনফরচুনেটলি, তারা নিরংকুশ দলীয়বৃত্তির পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে গণহারে কোরান-হাদীসের অপপ্রয়োগ করছেন। অন্যদের যে কারণে তারা অভিযুক্ত করেন, দুঃখজনকভাবে তারা নিজেরাই প্রেক্ষিতবিবেচনা ছাড়াই রেফারেন্স ব্যবহারের এই ভুলকাজটি করেন। এবং প্রবলভাবে এর পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন।
(৫) আর একটা কথা হলো, স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জন্য দল-সংশ্লিষ্টতা বাদ দিতে হবে, এটি আবশ্যিক নয়। মাওলানা মওদূদী জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমীর নির্বাচিত হওয়ার পর যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে এর সুরটি ভেসে উঠে। জামায়াতে ইসলামীর কার্যবিবরণী নামক বইয়ে এর বিস্তারিত বর্ণনা আছে। অথচ, উনার অনুসারীরাই যে কোনো স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাকে সওয়াবের নিয়তে গিলোটিন (হত্যা) করার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত …!!
(৬) সমালোচকদের ভাষ্যমোতাবেক, জামায়াতের এই লেনিনবাদী কঠোর সাংগঠনিকতাবাদকে ফর্ম এন্ড এনফোর্স করেছেন মাওলানা মওদূদী স্বয়ং। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, কট্টর বামপন্থী যেমন কমিউনিষ্ট পার্টি, এবং কট্টর ডানপন্থী, যেমন জামায়াতে ইসলামী, এই উভয় পক্ষই নিজ নিজ দলীয় ব্যবস্থাপনা ও সংগঠন পদ্ধতিকে “বৈজ্ঞানিক” হিসাবে দাবী করে থাকে।
(৭) ১৯৩০-৪০ এর দশকে কল্পিত-নির্মিত মুক্তির দিশারী অখণ্ড “ইসলামী আন্দোলন” হিসাবে এই দলটি আর কনিটিনিউ করছে না। ইতোমধ্যেই এর অনুসারী নেতা-কর্মীরা নানাদিকে সেট হয়ে গেছে, যাচ্ছে ও যাবে। নো ডাউট। অন্যদিকে, নিষিদ্ধ হোক বা সিদ্ধ থাকুক, দৃশ্যত: শক্তিশালী ধারা হিসাবে জামায়াতে ইসলামী টিকে যাবে, থাকবে, আপনার আমার আশেপাশেই। কারণ,
(৮) যে কেউ এদেশে কিছু একটা নিয়ে দাড়াবে, কোনো না কোনো মাত্রায়, আজকে হোক আগামীকাল হোক তিনি বা তারা কম-বেশি সফল হবেনই। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, বাংলাদেশের কোনো “ইসলাম-প্রকল্প”, কোনো ত্বরীকা এ পর্যন্ত ফেইল করে নাই, কর্মী-শুন্য থাকে নাই। খালি একনাগাড়ে ময়দানে হাজির থাকতে পারলেই হলো। কেননা, পলি মাটির এ জমিন যথেষ্ট “উর্বর”।
(৯) বাহ্যত: কনসলিডেটেড মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত জামায়াতের লোকেরা ধীরে ধীরে ধর্মীয় দিক থেকে সালাফী, রাজনৈতিক দিক থেকে বিএনপি, সামাজিক দিক থেকে আপোষকামী-বাঙালী, সাংস্কৃতিক দিক থেকে জগাখিচুড়ি (হেজিমোনিক অর্থে), অর্থনৈতিক দিক থেকে “হালাল পুঁজিবাদী”, বুদ্ধিবৃত্তিগত দিক থেকে আস্তিকতা, বামপন্থা ও প্রগতিশীলতার মিশ্রধারানুসারী, পারিবারিক দিক থেকে আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদীতাকে ঢাকার জন্য অবচেতনে ও কার্যত: উত্তরাধুনিকতাবাদী হিসাবে লোকেইটেড হবে। সচেতনভাবে সম্মত হয়ে এ রকম হওয়ার পরিবর্তে তাদের এই ক্রমবিবর্তন বা পরিণতি situationally-fixed বা বলা যায়, অনিবার্য। অদূর ভবিষ্যতে তাদের মধ্যকার এই কন্ট্রাডিকটরি ট্রেণ্ডগুলো অধিকতর ষ্পস্টভাবে দৃশ্যমান হবে।
(১০) আমি দলীয় ব্যবস্থাপনা মানা ও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা – দুটারই পক্ষে। প্রয়োজনে ও ক্ষেত্রবিশেষে “সাংগঠনিক” বলতে যা বুঝায় তা লংঘিতও হতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিকে বাদ দিয়ে দলচর্চা কাম্য হতে পারে না। ইসলামে সবকিছুর জন্য ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী থাকেন। নচেৎ, সুরা তাওবার ৩১নং আয়াতটি (নাউজুবিল্লাহ) অর্থহীন হয়ে দাড়ায়।
(১১) সাধারণত: অধিকতর প্রায়োগিক ও সাময়িক বিষয়াদিতে কালেটিভ অপিনিয়ন তথা সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বেশি। অপরদিকে নীতিগত, তাত্ত্বিক ও সার্বজনীন বিষয়াদিতে স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার গুরুত্ব বেশি।
(১২) সাংগঠনিক যে কোনো কাঠামো হলো hierarchical তথা ক্রমসোপানমূলক। আদেশ ও আনুগত্যের ভারসাম্য যেখানে মৌলিক শর্ত। এর বিপরীতে মতাদর্শিক যে কোনো কিছুই horizontal তথা সম-অবস্থানের। ইসলামের দিক থেকে “হক্বে”র মোকাবিলায় যে কোনো কোয়ানটিটি বা অথরিটি সিম্পলি নন-এক্সিজটেন্ট বা বাতিল।
(১৩) জামায়াত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভের মাধ্যমে দেশ গঠন করতে চায়। কিন্তু তার আগে সমাজ গঠনের জন্য যা কিছু করা দরকার তা করার উদ্যোগ গ্রহণ বা তা করার ব্যাপারে উৎসাহ দান ইত্যকার বিষয়ে কার্যত: নির্লিপ্ত, ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক ভূমিকাপালন করে। এ দেশের সূফীবাদী ইসলামের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ইসলামের একটা মডেল তৈরী করেছে। ইসলাম – কে একটা স্বয়ং ব্র্যান্ড হিসাবে স্টাবলিশড করার ব্যাপারে জামায়াতের ভূমিকা ও কার্যক্রম স্ববিরোধপূর্ণ।
(১৪) জামায়াত আদর্শিক শুদ্ধতার চেয়ে স্বীয় সাংগঠনিক ঐতিহ্যকে অধিকতর গুরুত্ব দ্যায়। আমরা জানি, যে কোনো কাল্ট-সিস্টেম পিউরিটানিক চরিত্রের হতে বাধ্য। অপরদিকে কম্যুনিটির ভিত্তি ও বৈশিষ্ট্য হলো ইন্টারেকটিভ। ইসলাম কম্যুনিটি গড়ার কথা বলে। অথচ, ইসলাম-অনুসারী দলসমূহ ক্রমান্বয়ে এক একটি cult হিসাবে গড়ে উঠে। শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, এদেশের প্রত্যেকটি “ইসলামী প্রতিষ্ঠান, ধারা ও দল” কম্যুনিটি হিসাবে গড়ে না উঠে এক একটি কাল্ট হিসাবে গড়ে উঠেছে যেখানে “অনুসরণ”ই প্রশংসিত হওয়ার একমাত্র উপাদান।
(১৫) জামায়াতকে যারা ধ্বংসের চেষ্টা করছে তারা সফল হবে না। আভ্যন্তরীণভাবে জামায়াত আদর্শ ও সংগঠনের মধ্যে একটা ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে বটে। এতদসত্বেও জামায়াতের সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যতটা সম্ভব, জামায়াতের আদর্শ তথা “জামায়াত-মাইন্ড”কে ধুয়ে-মুছে ফেলা ততটাই অসম্ভব। অন্যভাবে বললে, জামায়াতকে প্রতিষ্ঠার যে সাংগঠনিক প্রচেষ্টা তা শেষ পর্যন্ত একটা ফ্যান্টাসী হিসাবেই থেকে যাবে, কখনো সফল হবে না। এর পাশাপাশি, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ রূপায়ণে যারা ভূমিকা রাখবে তাদের গড়ে উঠার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে অবদান রাখার জন্য, প্রভাব ফেলার জন্য জামায়াতে ইসলামীর নাম ইতিহাসে ঠাঁই পাবে। যদিও, ইসলাম-অনুপ্রাণিত ভবিষ্যত শক্তি(সমূহ) সম্ভাবণাকে কাজে লাগানোর পথে না হাটার জন্য জামায়াতের ব্যাপারে ক্ষুব্ধ থাকবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলবে।
একজন তরুণ ইসলামিস্ট নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে উনার লেখায় ট্যাগ করেন। যার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কিছু অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই সিনোপটিক মন্তব্য-নোট।
“একজন দল-উর্ধ স্বাধীন দ্বীনী জ্ঞানগবেষক ও মুজতাহিদ যখন তাঁর মত প্রকাশ করেন তখন কে তা গ্রহণ করবে ও কে করবে না এবং কে তার নিন্দা বা সমালোচনা করবে তাতে কিছুই আসে-যায় না, তাই তিনি নির্দ্বিধায় তা প্রকাশ করতে পারেন। এমনকি তিনি তাঁর নিজের অতীত মতকে ভুল বলে স্বীকার করেও নতুন মত পেশ করতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনো দলের নেতা বা সদস্য হলে তাঁর মতের সমালোচনা ও নিন্দা দলের ওপর আপতিত হবে এবং এর ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে দেখা যায় যে, দলের মধ্যে উপযুক্ত দ্বীনী জ্ঞানগবেষক থাকলেও তিনি কেবল দলের মতামতকেই নতুন আঙ্গিকে পেশ করার চেষ্টা করেন ও দলের ভুল মতগুলোকেও সঠিক প্রমাণের জন্য ভ্রমাত্মক যুক্তি ও দলীল উপস্থাপন করেন এবং নতুন কোনো সত্যে উপনীত হলেও দলের স্বার্থে তা চেপে যান। ফলে দলের মধ্যে দ্বীনী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কেবল স্থবিরতাই সৃষ্টি হয় না, বরং গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব দৃঢ়মূল হয়ে বসে। এর বিপরীতে কেউ দলের মতের সাথে সাংঘর্ষিক মত ব্যক্ত করলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার ও গোমরাহ্ বলে অভিহিত করাও হতে পারে, তা তিনি যতো বড় ইসলামী চিন্তাবিদ, দ্বীনী জ্ঞানগবেষক বা মুজতাহিদ হন না কেন।”