(১) সাংগঠনিক দিক থেকে জামায়াতের অবস্থান সঠিক ছিলো
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন হিসাবে ইসলামী ছাত্রশিবির গঠন করা হয়। শিবিরকে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংগঠন হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। জিয়াউর রহমানের সময়কালে এক গণভোটে শিবির, জামায়াতের বিপক্ষে ভূমিকাপালন করে। জামায়াতের আদর্শ ও তত্ত্ব নিয়েও জামায়াতের সাংগঠনিক প্রভাবমুক্ত থাকার কারণে শিবির ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। একপর্যায়ে জামায়াত নেতৃত্ব, ছাত্র শিবিরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জামায়াতের প্রভাবমুক্ত হয়ে ছাত্রশিবিরকে পরিচালনার পক্ষে যারা ছিলেন এক পর্যায়ে তারা আউট হয়ে যান। জামায়াতের সাংগঠনিক স্বার্থের নিরিখে তাদের এই অবস্থান সঠিক ছিলো। এ যেন বছর শেষে প্রাপ্ত লভ্যাংশে তুষ্ট না হয়ে বা পুজিঁ মার যাওয়ার আশংকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিজের শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা নিজ হাতে নিয়ে নেয়া।
(২) আদর্শগত দিক থেকে জামায়াতের অবস্থান ভুল ছিলো
১৯৭১ সালে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য কোনঠাসা জামায়াতকে না নিয়ে শিবিরের মতো একটা আনকোরা এপ্রোচে ইসলামী মতাদর্শ বা রাজনীতিকে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় দেশের আপামর জনগণের মধ্যে এই নতুন ধারা, অর্থাৎ ইসলামী ছাত্রশিবির দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শিবির জামায়াতের অংগসংগঠন হিসাবে ট্যাগড না হলে, আমার ধারণায়, অন্ততপক্ষে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবির একাধিপত্য লাভ করতো। ইসলামী মতাদর্শের এই উদীয়মান সম্ভাবণাকে গিলোটিন করাটা আদর্শগত দিক থেকে জামায়াতের মোটেও ঠিক হয় নাই।
(৩) যুবশিবিরের যা কিছু ভুল
তৎকালীন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্বেও স্বাধীন ও শক্তভাবে কিছু না করে জামায়াতের আমীরকে সালিশ মানা, সালিশের রায়কে মেনে নেয়া সত্বেও পরবর্তীতে একতরফাভাবে যুব শিবির গঠন করা, তারওপরে যুব শিবিরের অধীনে (পাল্টা) ছাত্র শিবির গঠন করা, জামায়াত বিরোধিতাকে কাজের মূল এপ্রোচ হিসাবে কার্যত: গ্রহণ করা ও সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের সাথে মারামারিতে লিপ্ত হওয়া, ইরানপন্থী নীতি গ্রহণ করা – আমার দৃষ্টিতে যুব শিবিরের এসব কার্যক্রম ছিলো ভুল।
(৪) যুবশিবিরপন্থীদের যা করা উচিত ছিলো
যুবশিবিরপন্থীদের উচিত ছিলো যেকোনো সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিকে এড়িয়ে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এবং ‘এখনি ডমিনেট করা’র (শিবিরসুলভ) মানসিকতাকে পরিহার করে ইসলামী মতাদর্শের ইতিবাচক সমন্বয়মূলক বক্তব্য নিয়ে ময়দানে টিকে থাকা। এবং বিপুল সংখ্যক মেধাবী ছাত্রদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত করা। তাতে করে এতদিনে বাংলাদেশে গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, বুদ্ধিবৃত্তি ও দ্বীনি মহলে ডমিন্যান্ট বাম-সেকুলার ধারার একটা শক্ত বিকল্প গড়ে উঠতো। তারা যদি ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বে নিরপক্ষে থাকতেন তাহলে অনেকটাই আন্তর্জাতিক চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারতেন।
(৫) জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের ঐতিহাসিক দূর্দশা
জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের বড় দূর্বলতা হচ্ছে, জামায়াতও এটি ভালো করে জানে, তারা সবাই মিলে is a big zero …! কথাটা খুব রূঢ় শোনালেও এটি বাস্তব। ইনাদের জামায়াত বিরোধিতার বেসিক ক্যারেকটার হলো বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ছোট বোনের রাগ-গোস্বা বা অভিমানের মতো। দিনশেষে তারা সবাই জামায়াত। সংস্কারপন্থী শ্রদ্ধেয়দের সব যুক্তি-দাবী কোরআন-হাদীস-সীরাতের বিভিন্ন রেফারেন্স, আদর্শবাদীতা ও ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবতার দোহাই দিয়ে “… করা উচিত” বলা পর্যন্তই শেষ! জামায়াতকে দিয়েই তারা ইসলামের সবকাজ করাতে চান। পরোক্ষভাবে এটিও [জামায়াতে ইসলাম = ইসলাম] – এই একদেশদর্শী জামায়াত-মাইন্ডসেটআপের বহিঃপ্রকাশ। ইন্টারেস্টিংলি সংস্কার ইত্যাদি সম্পর্কে অলস বুদ্ধিজীবিদের প্রতি টিপিক্যাল জামায়াত রেসপন্স হলো, “পারলে আপনারাও একটা কিছু করে দেখান …।” এ যেন হুলো বিড়ালের বিরুদ্ধে সব (….) ইঁদুরের দরবার …!
(৬) কেন আমি জামায়াতের সমালোচনামূলক লেখা লিখি?
আমি কী করতে চাই? এটি একটা কমন প্রশ্ন। সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’র সাইটে, cscsbd.com , এ প্রশ্নের উত্তর পাবেন, বিস্তারিতভাবে। সংক্ষেপে বললে: বাংলাদেশ, ইসলাম ও বিশ্ব – এই তিনের মধ্যে নিজেকে সবসময়ে কল্পনা করি। এগুলোকে বাস্তবে অবিচ্ছেদ্য মনে করি। এই দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ইসলাম আমার তাত্ত্বিক আগ্রহ ও বাস্তব কর্মের বিষয়। জামায়াতে ইসলামী এর অন্যতম অনস্বীকার্য অনুষঙ্গ। স্বভাবত:ই জামায়াত নিয়ে from an outsider’s or academic point-of-view থেকে লেখালেখি করি। সেসব লেখা নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠ। এসব লেখা দিয়ে জামায়াতকে সংস্কারে বাধ্য করা বা কোনো ডিগ্রী অর্জন বা নাম কুড়ানো আমার লক্ষ্য নয়। তৃতীয় ব্যক্তিবর্গ জামায়াতকে কীভাবে দেখে, আমি সেটি খেয়াল করি। আমিই প্রথম ব্যক্তি যিনি জামায়াতের টেকসই অর্থে reform from within কে অসম্ভব হিসাবে বহু আগেই বলেছি।
(৭) জামায়াত ছাড়া অন্যান্য ইসলামপন্থীদের সম্পর্কে আমি লিখি না কেন?
এর কারণ নানাবিধ:
(ক) আমি নিজে জামায়াত ব্যাকগ্রাউন্ড হতে উঠে আসা।
(খ) অন্যান্যরা এতটাই পিছিয়ে যে, তারা সমালোচনার পাত্র হওয়ার যোগ্যতা এখনো অর্জন করে নাই।
(গ) জামায়াত এমন এক জিনিসের পাইওনিয়ার-ডিস্ট্রিবিউটার যেটিকে বর্তমান পাশ্চাত্য-শক্তি প্রধান ভায়াবল চ্যালেঞ্জ মনে করে। একাডেমিক ভাষায় এর নাম ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। ইনসাইডারস ভিউ-পয়েন্ট থেকে এটিকে ‘ইসলামী আন্দোলন’ বলা হয়। ইসলামের able-presentation যারা এ পর্যন্ত করেছে, ইখওয়ান-জামায়াত হলো তার মুল স্টেকহোল্ডারস।
(ঘ) যাদের সমালোচনা এখনো তেমন করা হয় নাই, এর মানে নয় যে, তাদের সমালোচনা নাই বা করা হবে না। যেমন, গণতন্ত্রবিরোধিদেরকে নিয়ে আমার বেশকিছু লেখা আছে। তাবলীগের মৌলিক ধারণাগত ভুলগুলো সম্পর্কেও আমার লেখা আছে। ওরা সোশ্যাল মিডিয়াতে সেভাবে একটিভ না বলে সেসব বিতর্ক ও লেখা সেভাবে প্রচারিত হয় নাই, বা সাধারণত হয় না।
(৮) বিকল্প সামাজিক আন্দোলনের “ফোকাস-পিপল” কারা?
আমার ধারণায় ক্বাওমী, তাবলীগি, সুন্নী, জামায়াতে ইসলামী, আহলে হাদীস, সালাফিপন্থী, হিযবুত তাওহীদ, একিউ – সব ধারার ইসলামই এ দেশে কনটিনিউ করবে। বরং ফ্লারিশ করবে। কারণ, লোকের ও লোকদের হুজুগের তো অভাব নাই। প্রত্যেককে প্রত্যেকের জায়গায় রেখে বা থাকতে দিয়ে দেশের আপাত নিরপেক্ষ, পর্যবেক্ষকের ভূমিকাতে থাকা গড়পরতা ১৫ ভাগ লোক হলো আমার target people। এই ১৫% এর মধ্যে ২০ থেকে অনূর্ধ ৩৫ বৎসর বয়সের ছেলে-মেয়েরাই আমার বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট উদ্দীষ্ট-লোকসমষ্টি। যারা যেখানে যেভাবে যুক্ত তারা সেখানেই যুক্ত ও সক্রিয় থাকুন। এটি আমার প্রাথমিক বক্তব্য। কোনো ধারায় সম্পৃক্ত কাউকে কনভিন্স করার ইনিশিয়েটিভ নেয়ার চেয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে ইতিবাচক ও মৌলিক বক্তব্য নিয়ে কাজ করাকেই আমি বেশি ফলদায়ক মনে করি। মেইনস্ট্রিমের এই তরুণ জনগোষ্ঠীর কোনো কোয়ারির উত্তরে যে কোনো বিদ্যমান ধারার বা কারো বস্তুনিষ্ঠ ও প্রাসঙ্গিক সমালোচনা ও পর্যালোচনা করার বিষয়ে তাই আমি দ্বিধাহীন। কোনো ধারায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা নেতৃত্ব দেয়ার চেয়ে মূলধারা তৈরীর কাজে সহযোগিতা করাকে আমার দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করেছি। বলতে পারেন, এটি আত্মউপলব্ধিমূলক অবস্থান।
(৯) wide garden model
সবাইকে এক ধারাতে অন্তর্ভূক্ত করার দৃশ্যমান নির্দোষ মানসিকতা ও চেষ্টাকে আমি বড়ধরনের বোকামী মনে করি। শক্তিশালী কেন্দ্রভিত্তিক সংগঠন-ব্যবস্থার পরিবর্তে বিকেন্দ্রীকৃত ও ব্যক্তিউদ্যোগনির্ভর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সংগঠন ব্যবস্থাকে মতাদর্শগত দিক থেকে অধিকতর উপযোগী মনে করি। এক একটি বটবৃক্ষের পরিবর্তে আমি ছোট-বড় বাগান তৈরীকে অধিকতর বাস্তবসম্মত মনে করি। যার কারণে জামায়াতকে হিরো বা জিরো মনে করার প্রান্তিকতা হতে নিজেকে সবসময়ে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি। আমি যা চাচ্ছি, তার সার কথা হলো, ইসলামকে একটা বেইজ বা ফাউন্ডেশান হিসাবে, একটা thought-paradigm হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। তাই, unity within diversity কে আমি আন্তরিকভাবেই mean করি। প্রশাসনিক দিক থেকে সংগঠন ব্যবস্থা ও মতাদর্শগত দিক থেকে সংগঠন ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে ভিন্ন ও পরষ্পর বিরোধী মেজাজের মনে করি। যার যার ক্ষেত্রে দুটোরই দরকার আছে। মতাদর্শগত সাংগঠনিক কাঠামোকে যে কোনো ধরনের প্রশাসনিক কাঠামো হতে অনেক বেশি মুক্ত, নমনীয় ও এডাপটিভ ন্যাচারের হতে হবে।
(১০) বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটই মূল সমস্যা
আক্বীদাগত দিক থেকে ইসলামকে অনেকেই সঠিকভাবে জানে। কিন্তু ইসলামকে কীভাবে বর্তমান সমাজে incorporate করা হবে, বা যাবে, তা নিয়ে স্মার্ট ইসলামিস্টদেরও তেমন কোনো চিন্তাভাবনা নাই। ভাবখানা এমন, যেন সব সমস্যা মূলত: বাস্তবায়নের সমস্যা, implementation problem। ‘বর্তমান’এ বসবাস করে, এর সকল সুবিধা গ্রহণ করেও অনেকে চিন্তাচেতনায় খুবই স্থুল, অপরিপক্ক ও পশ্চাতপদ। blame game এবং conspiracy theory ই এ ধরনের ‘কমিটেড’ লোকদের শেষ ভরসা, universal argument ! সত্যি বলতে, “ইসলামী আন্দোলন” ধারণাকে যারা লালন করেন, তাদের মতো করে পালন করেন, অন্যদেরকেও তাদের মতাবলম্বী বানাতে চান তাদের মূল অংশটি এখনো এ সংক্রান্ত pros & cons নিয়ে নিজেদের চিন্তাগত শৈশবাবস্থা (adolescent period) অতিক্রম করতে পারে নাই। বুদ্ধিবৃত্তিতো একটা উন্মুক্ত ও অব্যাহত চর্চার বিষয়। জ্ঞান অর্জনের বিষয়, গ্রহণ হলো অগত্যা।
আমার ধারণায়, বর্তমানের সমস্যা, বাস্তবায়নের সমস্যামাত্র নয়, শুধুমাত্র নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার সমস্যা নয়। দেশ ও জাতি গঠনে, বিশ্ব-সভ্যতায় নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে ইসলাম-অনুসারীদের বর্তমান সমস্যার শিকড় তাদের সর্বব্যাপী চিন্তাগত দীনতা ও প্রবল যুক্তিবিমুখ ধর্মবাদিতায় প্রোথিত। তাই আমি চিন্তাগত সংকট ও বৈপরিত্য মিটানোর কাজকে প্রচলিত অর্থে aim in life হিসাবে যা বলা হয় সেরকমভাবে গ্রহণ করেছি। আমার মতো করে। আমার আওতার মধ্যে। আমার অনতিক্রম্য সব সীমাবদ্ধতা সত্বেও। পেশাগতভাবে একজন শিক্ষক হিসাবে, এই প্রায়-পঞ্চাশ বছর বয়সে এ ছাড়া আমার কী ই বা করার আছে?