[সিএসসিএসের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের সাথে প্রফেসর ড. হাসান মোহাম্মদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-এর সাক্ষাৎকার। উল্লেখ্য, ড. হাসান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উপর সর্বপ্রথম পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করেছেন।]

জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প একটা কিছু করা- আমার অবস্থান সেটা নয়। আমার ধারণায়, এই কাজের যে ব্যাকগ্রাউন্ড বা কনসেপ্চ্যুয়াল সাপোর্ট আছে, বেইজ আছে বা ইসলামিক আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের যে বিষয়গুলো আছে, ওইগুলোর তাত্ত্বিক যে ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো মেরামত করে ক্রমান্বয়ে একটা মুভমেন্ট গড়ে তোলা। আমরা নিজেরা বা আমি নিজে কোনো পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন বা পলিটিক্স রিলেটেড কিছু করবো না।

আমি একটা কনসেপ্ট দাঁড় করিয়েছি,যে সব বিষয় জরুরি, সে বিষয়গুলোকে নিয়ে একেক দিক থেকে একেকভাবে কাজ করা। মানে, রিলিজিয়াস স্পিরিচুয়ালিটি- এটা একটা দিক, কালচার আলাদা একটা দিক, ইন্টেলেকচুয়ালিটি আরেকটা আলাদা দিক। এভাবে একটা সংগঠন না করে, জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন জনে ক্লাস্টার অব অর্গানাইজেশনস করবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ থাকবে এবং এটার বেইজ হবে ইসলামিক আইডিওলজি ও বেসিক টেক্সটস। এটা হচ্ছে আমার চিন্তা।

তবে আমি বললেও জামায়াতে ইসলামী সেই আইডিয়েল সিচুয়েশনে এখন ব্যাক করতে পারবে না। আমার ধারণা, একেবারে তাত্ত্বিক জায়গা থেকে বর্তমানে তাদেরকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে অরণ্যে রোদন বা ইউটোপিয়ান চিন্তা ভাবনা। তারা যতটুকু সংস্কার করে নিজেদেরকে একটা অবস্থানে আনতে পারে, মানে তাদের পক্ষে যতটুকুসম্ভব, ততটুকু নিয়ে তাদেরকে একটা পরামর্শ দেওয়া। আর সাথে সাথে আমাদের মূল প্রস্তাবনাতাদের সামনে তুলে ধরা।

আমার ধারণা, জামায়াতের সাংগঠনিক পরিধির মধ্যে ওয়াজ-নসিহত করে আনুগত্যের বিষয়টাকে এতো বেশি বদ্ধমূল করে দেওয়া হয় যে, আল্টিমেটলি লোকেরা ওই পয়েন্টে এসে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। আর স্টাবলিশম্যান্ট ইত্যাদি তো আছেই।

ড. হাসান: কোনটা মুখ্য মনে হয়? বাইয়াত তথা শপথ, নাকি স্টাবলিশম্যান্ট?

কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটা, কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে আরেকটা। মানে দুটোকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।

ড. হাসান: বাইয়্যাত মানে কি? যে ফরম ফিলাপ করছে বা আমীরের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিয়েছে। তো এটা কি আল্লাহর আনুগত্যের চেয়ে বড় হয়ে গেছে? অথচ একই ব্যক্তি ইসলামের মৌলিক নির্দেশাবলী মাঝে মধ্যে লঙ্ঘন করছে। সবাই না, কেউ কেউ। ছেলে-মেয়েকে স্টাবলিশ করার জন্য বিভিন্ন রকমের জিগজ্যাগ পথ অনুসরণ করছে। আল্লাহর এইসব নির্দেশের চেয়ে কি আমীরের কাছে শপথ নেওয়া বড়হয়ে গেছে?

এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে, একটা প্রতিষ্ঠিত ধারায় কাজ করা যতটা সহজ, একটা ধারা তৈরি করার যে রিস্ক আছে, কমফোর্ট জোনের বাইরে যাওয়ার যে একটা…

ড. হাসান: আমি সেটাই বলছি। তার মানে তাদের শপথটা আছে, শপথটা কারো কারো কাছে বড় ব্যাপারও হতে পারে; কিন্তু তারা মুষ্টিমেয়। সবকিছুতো হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্টিমেটলি। পরকালে এবং ইহকালীন সুখের জন্য। তুমি ইহকালীন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাও চাচ্ছো পরকালীন মুক্তির জন্য। ইহকাল কিন্তু প্রধান বিষয় না। প্রধান বিষয় হলো পরকাল। বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করছেন আল্লাহর এই জমিনে আল্লাহর রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য। যদি তাই হয়ে থাকে, তার মানে আল্লাহর দুনিয়াতে যে রাষ্ট্র, সেটাও পরকালের মুক্তির জন্য। তো যে লোকদের কাছে পরকালীন মুক্তিরও কোনো কোনোবিষয় আপসযোগ্য- আমি শুধু জামায়াতের কথা বলছি না, অন্যন্য ইসলামিস্টদের কথাও বলছি, পীর-আলেম-ওলামাদেরও, তারা দুনিয়ার বহু প্রশ্নেই তো আপস করছে।

আর আনুগত্যের শপথটা বড় কি না? আমার মনে হয়, ব্যাপারটা শুধু জামায়াত নয়, যারা ফুল টাইম পলিটিক্স করে, রাজনীতি এক পর্যায়ে পেশা হয়ে যায়, রাজনীতির উপর এক পর্যায়ে যারা ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যায়, যাদের রুটি-রুটি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায়, তাদের জন্য আসলে এটা একটা সেল্ফ ইন্টারেস্টে পরিণত হয়। এটা আমি দীর্ঘদিন বামপন্থীদের অবজার্ভ করে দেখেছি। এমনকি বিএনপিতেও, আওয়ামীলীগে তো বহুলোক আছেই, যাদের আসলে মূল পেশা হয়ে যায় রাজনীতি। কিন্তু রাজনীতি থেকে তো বেতন পাওয়া যায় না। তাই তারা এই রাজনীতির নামে চাঁদা তোলে, এলাকায় মাস্তানি করে, জমি দখল করে টাকা নেয়। এইসব কিছুর বড় সমর্থনের ভিত্তি হলো রাজনৈতিক একটা সংগঠন।

আমি শুধু ওই প্রশ্নটা করছি, যারা আল্লাহর আনুগত্যের প্রশ্নে প্রয়োজনে আপস করতে পারে, তারা আমীরের আনুগত্যের প্রশ্নে আপস করতে পারবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য কিনা? এটা কতটা গ্রহণযোগ্য আমি জানি না।

দুইটা বিষয়ে আপনি যদি একটু বলতেন। একটা হলো, ইসলামের জন্য বাংলাদেশকে যদি বেইজ ধরে ইসলামি আইডিওলজি এখানে যদি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়, সেটা যে ফরম্যাটেই হোক না কেন, এটার জন্য কি করণীয়? এটা এক ধরনের আলোচনা। আরেকটা হলো, জামায়াতে ইসলামী যে অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তারা যদি এখন তাদের প্রথম অবস্থানের কাছাকাছি ফিরে যেতে চায়, তাহলে কোন কোন জায়গায় তাদেরকে রিফর্মগুলো করতে হবে?

ড. হাসান: এটা জামায়াতের পক্ষে-বিপক্ষে যাই হোক না কেন, মূল বিষয়ে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাইরে ধর্মীয় কারণ তথা বিশ্বাসগত কারণে চিন্তা করলে এক প্রকার সিদ্ধান্ত, এক ধরনের পদ্ধতিতে পথ চলতে হবে। অর্থাৎ যদি মনে করা হয় যে, আল্লাহর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা ধর্মীয় দায়িত্ব, আল্লাহ নির্দেশিত দায়িত্ব। এর বাইরেকোনো মুসলমান অন্য কিছু করতে পারবে না, তাহলে এক ধরনের হবে।

অপরদিকে যদি মনে করা হয় যে, এটি একটা বিচার্য বিষয়। শুধু ধর্ম হিসেবে তুমি ইসলামকে দেখবে, নাকি ইসলামকে প্রধানত রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে দেখবে? জামায়াতে ইসলামীর কর্মকান্ডে, মাওলানা মওদূদী সাহেবের লেখালেখি অথবা জামায়াতের লোকদের কর্মকান্ড বিচার করে আমার যেটা ধারণা,জামায়াতে ইসলামীর কাছে রাজনীতিটা তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাই মুখ্য বিষয়। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালনের চেয়েও আমার মনে হয় জামায়াতের কাছে মুখ্য হলো, আল্লাহর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যদি এটি মনে করা হয় যে, এর বাইরে যাওয়ার কোনোপথ নাই, তাহলে এক ধরনের কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে, সিদ্ধান্ত নিয়ে আগাতে হবে।

আর যদি আপনি মনে করেন যে, না, রাজনীতিটা হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য। রাষ্ট্রটা হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য। যেখানে যে ব্যবস্থাটা তুলনামূলকভাবে বেশি উপযোগী, সেটা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে মানুষের সেবা করাটাই হলো লক্ষ্য, তাহলে রাজনীতিতে আরেক রকম কর্মপ্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষের মন-মানসিকতা, মানুষের উপর দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক প্রভাব-এসবের আলোকে যদি বিচার করা হয় তাহলে ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম উর্বর ক্ষেত্র বাংলাদেশ’ – এই জাতীয় কথা মেনে নেয়া যায় না। বরং বাংলাদেশ হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিক থেকে অন্যান্য মুসলিম দেশের চেয়ে অনেক বেশি অনুর্বর।

কম সম্ভব কেন তা যদি বলতেন?

ড. হাসান: বাংলাদেশের চারদিকে ভারতের অবস্থান। ইচ্ছা করলে ভারত আমাদের জলসীমাও দখল করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশে হিন্দুসহ নন-মুসলিমদের যে ঐক্য তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিমরা যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু কালচারালি নন-মুসলিমরা অনেক বেশি প্রভাবশালী। রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রিক আমাদের যে মনোজগত গড়ে উঠেছে, এটার প্রভাব ইসলামপন্থীরা খুব বেশি বোধ করে না। কিন্তু যারা করে, তারা অসম্ভব বেশি বোধ করে। পাশ্চাত্য শিক্ষার যে প্রভাব, যত কথাই বলি না কেন, আলীগড় আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের লোকেরা তো সবাই পাশ্চাত্যমুখী। আলেমদের কয়টা সন্তান মাদ্রাসায়পড়ছে?

মাদ্রাসার পক্ষে যখন এখানে আন্দোলন হচ্ছে, অথচ আন্দোলনকারীরা নিজেদের ছেলে-মেয়দেরকেই তো মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে না। সুতরাং এই মাদ্রাসা টিকিয়ে রাখার জন্য তাদের যে আন্দোলন, এটা কি এক অর্থে হিপোক্র্যাসি নয়? গরিব মানুষদের জন্য মাদ্রাসা রাখতে হবে, এটা তো কোনো মানবিক বিষয় হতে পারে না। সেই জন্য আগে এইসব মৌলিক প্রশ্নে আগে ভাগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

কোন্ বিষয়ে আগে ভাগেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে?

ড. হাসান: ইসলামী রাষ্ট্রটা করতেই হবে বা ইসলামী রাষ্ট্র করাটাই হলো আল্লাহর চূড়ান্ত বিধান। এর বাইরে করলে ধর্ম পালন হবে না। যদি এ রকম বোধ থাকে, তাহলে কোনো না কোনোভাবে সংস্কার বা জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকমে ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’র দিকে যেতে হবে। আর যদি মনে করাহয় যে, রাষ্ট্র হচ্ছে হিলফুল ফুজুলের মতো একটা প্রতিষ্ঠান। যার দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের কল্যাণ করা। যদ্দুর পারা যায়। তাহলে সেটি হতে পারে।

হিলফুল ফুজুল, মানে জনকল্যাণই মূল লক্ষ্য? রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক বা না হোক?

ড. হাসান: রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক বা না হোক, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে থাকতে হবে- এটা যদি ধর্মীয় বিধান হয়ে থাকে, তাহলে তো এর বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নাই মুসলমানদের। আর যদি মনে করা হয় যে,না, রাষ্ট্র বা রাজনীতিটা হচ্ছে মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য একটা উপায়। তাহলে যখন যেখানে যেটা প্রয়োজন, যখন যে সময় যেটা উপযোগী, সেটা গ্রহণ করার অপশন থাকবে।

রাসূল (সা) মদিনায়, সেটাকে রাষ্ট্র বলি বা যা-ই বলি, একটা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তো স্থাপন করেছেন?

ড. হাসান: ঠিক আছে, করেছেন। সেটা ছাড়া যে ইসলাম হবে না, এ রকম কোনো কথা আছে নাকি? ধরলাম, সেটা একটা অপশন। করতে পারলে ভালো। তাহলে এখন পৃথিবীতে সবচেয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কোনটা? সবচেয়ে সম্ভাবণাময় হলো, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম প্রধান দেশসমূহ। তারা ওয়াহাবী আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়দিকগুলো গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়গুলো তো গ্রহণ করেনি। তার মানে বাস্তবতা তাদেরকে বলছে, আরব ভূমিতে আর আগের খেলাফত হবে না। বাস্তবতা তাদেরকে বলছে, আধুনিক যুগে সে ধরনের ইসলামী রাষ্ট্র এখন আর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের যে অবস্থা, সে অবস্থায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব?

না, এখন তো এটা নানা কারণেই ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে।

ড. হাসান: বাংলাদেশের কথায় আসি। যেমন নির্বাচন। নির্বাচন ছাড়া নেতৃত্ব বাছাইয়ের আসলে গ্রহণযোগ্য আর কোনো পথ নাই, এই পদ্ধতির মধ্যে যত দূর্বলতাই থাকুক না কেন। ইসলাম তো এ নির্বাচনটা সমর্থন করে না। ইসলাম হলো কোয়ালিটি সম্পন্ন লোকেরা কোয়ালিটি সম্পন্নদের মধ্য হতে নেতৃত্ব বাছাই করবে। যে লোকদের রাজনীতি, রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই; একেবারে অশিক্ষিত, অজ্ঞ, রিমোট এরিয়ার লোকজন, তারাও দেশের পার্লামেন্ট সদস্য বাছাই করবে- এটা কি ইসলাম অনুমোদনকরে?

ইসলাম তো আসলে একটা কোয়ালিটিটিভ জিনিস, কোয়ান্টিটি…

ড. হাসান: এখন মানুষের সচেতনতার যে মাত্রা, তাতে কি রিকশাওয়ালারা সেটা মানবে? নির্বাচন, হেড অব দ্যা গভর্মেন্ট, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিডিয়া, চলচ্চিত্র, অর্থব্যবস্থা- একদম পরিপূর্ণ ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? ইসলামী ব্যাংক কি ইসলামী অর্থনীতির মডেল?

আমার মনে হয়, ট্র্যাডিশনালী ইসলামকে যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তাতে তো এক ধরনের কন্ট্রাডিকশন, কনফ্লিক্ট দেখা যায়।

ড. হাসান: তো এতো কন্ট্রাডিকশন নিয়ে….। রাইট অর রং – একটা কিছুকে কনফার্ম করতে হবে। রাজনীতিতে মানুষ সেই জন্য এক জায়গায় গিয়ে ডিকটটরিয়াল হয়ে যায়। ফিলসফিক্যালি এটা হয়তো পরিপূর্ণভাবে শুদ্ধ না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বলতে হবে, এই সময়ের জন্য এটাই করতে হবে এবং এটাই সিদ্ধান্ত। দার্শনিক বিতর্ক হিসেবে হয়তো এটা শেষ হবে না। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা জায়গায় গিয়ে বলে দিতে হয় যে, এখানে যেতে হবে। যেমন, নির্বাচনের জন্য নির্বাচিত নেতৃত্ব- এটাহলো বেস্ট সল্যুশন। এরচেয়ে ভালো বিকল্প আর নাই।

তাহলে বলতে চাচ্ছেন, জামায়াতে ইসলামীকে যদি রাজনীতি করতে হয়, তাহলে তাকে এ বিষয়গুলোতে প্র্যাকটিক্যালি কম্প্রোমাইজ করতে হবে?

ড. হাসান: প্র্যাকটিক্যালি কম্প্রোমাইজ করতে হবে অথবা নিজেরা নিজেদের যুক্তিটা লজিক্যালি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যুক্তি দিয়ে বলতে হবে যে, আমরা এগুলো ওভারকাম করতে পারবো। ইনশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ বললে হবে না। জামায়াতে ইসলামী কোনোদিনই এগুলো ক্লিয়ার করেনি। যুক্তিসিদ্ধভাবে বলতে হবে যে, এটা আমরা পারবো।

মানে এটা বুঝা যেতে হবে যে, তারা পারবে।

ড. হাসান: হ্যাঁ, এটা তারা নিজেরা বুঝতে হবে। বেশিরভাগ মানুষকেও যে কোনোভাবেই হোক, বুঝাতে হবে। অন্তত সচেতন, শিক্ষিত মানুষদেরকে বুঝতে হবে। এসব বিষয়ে জামায়াতের কারান্তরীন শীর্ষ নেতাদেরকে অন্তত এক দশক আগে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে।

একেবারে ক্যাটাগরিক্যালি বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাশ্চাত্যশিক্ষিত মুসলমানদের, বিশেষ করে নারীদের মন থেকে ইসলামী রাষ্ট্র সম্পর্কে যে ভীতি রয়েছে,সেটা দূর করতে হবে। অমুসলিমদের মন থেকেও ভীতি দূর করা দরকার।

শ্রমজীবী মানুষ যারা আছে তাদের ব্যাপারে…

ড. হাসান: সেখানে তো জামায়াতের কোনো কাজই নেই। চিন্তা করে দেখুন, আপনি যে ড্রেস পরে এসেছেন, এর কোনোটাই ট্রাডিশনাল ইসলামিক ড্রেস কি না?

সনাতন অর্থে?

ড. হাসান: আমরা যে কায়দা কানুন করে এখানে বসে কথা বলছি, কোনোটা সনাতন কিনা? সনাতন নিয়মে তো নিচে বসে…ফরাস বিছিয়ে খাওয়া, পাশে চিলমছি রাখা…। এখনকার কোনোটাই কিন্তু আমাদের দেশীয় কৃষ্টিকালচারের নিরিখে ইসলামিক না।

এটা নন-ইসলামিক হবে কেন?

ড. হাসান: এটাকে নন-ইসলামিক মনে না করলে সেটা হবে আপস। তাহলে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও আপনি এই আপসটা করবেন কিনা? যেমন আপনি বলছেন যে, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর তা হারাম নয়; বরং সেটাই ইসলামিক।এই তত্ত্ব সর্বত্র প্রয়োগ করবেন কিনা? সেটা আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

আলেম-উলামারা যে ধরনের ওয়াজ করে,আর জামায়াতে ইসলামী যে ধরনের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে- এগুলো একাকার হয়ে জনগণের মধ্যে একটা ভীতি সৃষ্টি হয়েছে যে, এ ধরনের ইসলাম বাস্তবায়ন করা বা মেনে চলা সম্ভব না।

ড. হাসান: আপনি নির্মোহভাবে চিন্তা করে দেখেন, শাহবাগে যেসব ছেলেরা গেছে, তারমধ্যে কয়টা ছেলে নাস্তিক? অনেক মুসলামানেরা তো নামাজ পড়েই সেখানে গেছে। শাহবাগকে যদি এন্টি-ইসলামিক মুভমেন্টের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে, যারা গিয়েছে তারমধ্যে নাস্তিক দুইশো জনই না হয় হলো। কিন্তু মানুষ তো গেছে কমপক্ষে বিশ হাজার বা পঞ্চাশ হাজার। তার মানে বাকিরা সব…? আস্তিকরা প্রস্রাব করলেও তো নাস্তিকরা সব ভেসে বঙ্গোপসাগরে চলে যাবে, বাংলাদেশের যা অবস্থা। তাই না? তাহলে কেন তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য আসছে না? এমনকি বিএনপির লোকেরাওতো ইসলামের প্রতি সফট। আওয়ামীলীগেরও ৮০% লোক ইসলামের প্রতি সফট। এতদসত্বেও তারা ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে না কেন?

আমি খেয়াল করেছি, ইসলামের ব্যাপারে ততটা নেগেটিভ নয়। কিন্তু জামায়াতের ব্যাপারে খুব নেগেটিভ।

ড. হাসান: তো জামায়াতের প্রতি মানুষের কেন আকর্ষণ থাকবে? ১৯৪৭ সালে সব মানুষ, অর্থাৎ ভারতবর্ষ ব্যাপী মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে। অথচ জামায়াতে ইসলামী তার বিরোধিতা করেছে। ১৯৭১ সালে এক হাজার মাইল দূরের পাকিস্তান, যে পাকিস্তান ডেমোক্রেসির পক্ষে না, যে পাকিস্তানী আর্মি তাদের কোনো কথাই শোনে না, সে পাকিস্তানী আর্মির পক্ষে তারা যুদ্ধ করতে কেন গেলো?

অন্যান্য সব ইসলামী দলগুলোও তো পাকিস্তান অখন্ড রাখার চেষ্টা করেছে।

ড. হাসান: অন্য ইসলামিক দলগুলো তো ওইভাবে কোনো দল না আসলে। বাকিগুলো তো হলো…

যারা ইসলামিক পারসোনালিটি ছিলো, তৎকালীন সময়ের বড় আলেম…?

ড. হাসান: কারা তারা? একজন লোকের নাম বলেন? ওই সময়ের কথা বাদ দেন। বাংলাদেশে এখনও কি হেফাজতে ইসলামকে কোনো পার্টি বা আধুনিক দল বলবেন?

নেজামে ইসলামী পার্টি তো…

ড. হাসান: নেজামে ইসলামী ছিল চুপচাপ। ওরা ওই রকম অ্যাক্টিভ ও শক্তিশালী ছিল না।

ওরা তো পিস কমিটিতে ছিল।

ড. হাসান: ছিল। কিন্তু তারা কোনো অ্যাক্টিভ ভূমিকায় ছিল না।

কিন্তু নেজামে ইসলামীর লোকেরা তো মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য ছিল।

ড. হাসান: ছিল। কিন্তু মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য থাকা আর আলবদর বাহিনী, রাজাকার বাহিনী, শামস বাহিনী করা তো এক কথা নয়। ডা. মালেক তো বামপন্থী ছিল! মুসলিমলীগের বামপন্থী ঘরানার ছিল। শেখ সাহেবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ডা. মালেকের ব্যাপারে বহু কথা আছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামের জন্যই কি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর পক্ষে গিয়েছিল?

দৃশ্যত তাই।

ড. হাসান: পাকিস্তান বাহিনী কোনোদিন ইসলাম চর্চা করেছে?

অনেকে মনে করেছেন ইন্ডিয়ার সাথে…

ড. হাসান: এটা একটা যুক্তি যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে না, বাংলাদেশ ভারত ভূখন্ডের অধীনে চলে যাবে। তো তারা যুদ্ধ করে কি পাকিস্তান রক্ষা করতে পারবে মনে করেছিলো? যদি না হয়, তাহলে? এমন কিনা যে, ইসলামী রাষ্ট্র হোক বা না হোক, আমি কাজ করে যাবো? তেমন করে পাকিস্তান রক্ষা শেষ পর্যন্ত হোক বা না হোক; আমরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য কাজ করে যাবো?

জামায়াত-শিবির বর্তমানে যে অবস্থার মধ্যে আছে, তাতে তাদের পক্ষে থামা বা পেছনে যাওয়া- এটা কি প্র্যাকটিক্যালি সম্ভব?

ড. হাসান: না। আমার ধারণা, জামায়াতে ইসলামী বহু বহু ভুল করেছে। জামায়াতে ইসলামী জানে যে, বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদের প্রতীক হচ্ছে জামায়াত। আদতে সেটা হোক বা না হোক, প্রতীক হয়ে গেছে।পাশ্চাত্য কোনোদিনই, আর যাই করুক, আল-কায়েদার উত্থানের পর ইসলামী মৌলবাদকে সীমাতিরিক্ত বাড়তে দিবে না।

এইদেশে জঙ্গিবাদী যারা হয়েছে, তারা কোনো না কোনো পর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। তারা কোনো না কোনো পর্যায়ে মাওলানা মওদূদীর বই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। আমেরিকানরা আমাদের চেয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি, মুসলিম ওয়ার্ল্ডের রাজনীতি সম্পর্কে অধিকতর বোঝে, বেশি জানে। তারা কোনোদিনই জামায়াতে ইসলামীকে এমন সুযোগ দিবে না যে, জামায়াতে ইসলামী একটা বড় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হতে পারে। যার ফলে তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে যাবে। কারণ, তারা বুঝে, এটাতেই শেষ হবে না। তখন এটা একটা আন্তর্জাতিক আন্দোলনে রূপ নেবে এবং তখন এটি জঙ্গিবাদের দিকে মোড় নিতে পারে। ওই সশস্ত্র পর্যায়ে জামায়াতের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে কিছু লোক চলে যাবে। যেমন ধরেন, বামপন্থীদের সবাই কি নকশালাইড হয়েছে? কিন্তু একটা ইয়ং অংশ তো হয়েছে। এখনো মাওবাদী…

এরা নাকি সবাই উচ্চ শিক্ষিত। সিরাজ শিকদার নাকি বুয়েট থেকে পাশ করা?

ড. হাসান: হ্যাঁ। বাংলাদেশের কথা বাদেও, ভারতের নকশাল বাড়ি আন্দোলনে সব ইয়ং ও উচ্চ শিক্ষিতরা গিয়েছে। কেউ গেছে ডাকাতি করার জন্য, কেউ গেছে আদর্শের জন্য।

জামায়াতে ইসলামী কি করে আশা করছে, আমেরিকা তাদেরকে ক্ষমতা গ্রহনের পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাবে? ভারতের সাথেও তো পাকিস্তান আমলে জামায়াত যোগাযোগ রেখেছে। কিন্তু ভারত জানে যে, জামায়াতে ইসলামী এক সময় অখন্ড ভারত চাইলেও পাকিস্তানেও জামায়াতে ইসলামী কট্টর ভারত বিরোধী, বাংলাদেশেও ভারত বিরোধিতার প্রধান উদ্যোক্তা হলো জামায়াত।

ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে কোন কোন দিকে নজর দিতে হবে বলে মনে করেন?

ড. হাসান: জামায়াতে ইসলামী কোনোদিন বিএনপি হতে পারবে না। বিএনপি যে রকম আপসকামিতা করবে, জামায়াতে ইসলামী তা পারবে না। অন্তত পুরানো স্ট্রাকচারে যারা রিক্রুট হয়ে গেছে, তারা পারবে না। আমি মনে করি, জামায়াতে ইসলামী যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে রাজনীতি করে রাষ্ট্র ক্ষমতার পর্যায়ে যেতে চায়, নিজেরা দখল করুক, অথবা সহযোগীদের নিয়ে এলায়েন্স করে, তাহলে জামায়াতের ব্যাপারে প্রথম কথা হলো বাংলাদেশে সরাসরি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সুদূর পরাহত। এর অন্যতম কারণ হলো ভারত এটা কোনোদিন মানবে না, পাশ্চাত্য মানবে না।

তার মানে ইসলাম বায়াসড সিভিল ডেমোক্র্যাটিক স্টেট প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপনি এটি বলতে চাচ্ছেন?

ড. হাসান: হ্যাঁ, তাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত যে কতো বেশি শক্তিশালী তার নজির হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি। সারা পৃথিবী একদিকে, ভারত আরেক দিকে। তাই তো এরা বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পারছে। সারা পৃথিবীও ভারতকে চরমভাবে হোস্টাইল করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হ্স্তক্ষেপ করবে, আমার এমনটা মনে হয় না। সুতরাং বিএনপি বলো, জামায়াত বলো, জাতীয় পার্টি বলো, আওয়ামী লীগ বলো, ভারতের সাথে একেবারে বৈরি সম্পর্কের পর্যায়ে গিয়ে কেউ এখানে টিকে থাকতে পারবে না। মনে করুন, ভারত আর্মি মার্চ করিয়ে দিলো। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি সেটি রেসিস্ট করতে পারবে? এ ধরনের সম্ভাব্য পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে। অথচ এই দেশের ৯০% লোক হলো সুবিধাবাদী। এর সাম্প্রতিক নজির হলো ৯০% লোক কেয়ারটেকার গভর্নেন্ট চাইলেও তারা কিন্তু রাস্তায় নামছে না।

তারমানে ভারত যদি দখলও করে ফেলে, এর বিরুদ্ধে মুভমেন্ট দাঁড় করাতে বহু সময় লাগবে। ভারত যদি দখল করে পাকিস্তানের মতো না করে, ২৫ মার্চের ঘটনা যদি না ঘটায়, ভারত যদি শুধু স্ট্র্যাটেজিক জায়গাগুলো দখল করে রাখে এবং বলে যে, বাকি সব তোমাদের। ভারত কি এরশাদের মতো শাসক খুঁজে পাবে না, যারা ভারতকে সহযোগিতা করবে? ভারত এখানে সিকিমের মতো যদি না করে, তাহলে তারা দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে।

আমি মনে করি, ১৯৭১ সালেও আওয়ামী লীগকে ক্র্যাশ করে দিয়ে পাকিস্তান টিকে যেতে পারতো। যদি আওয়ামীলীগকে ব্যান্ড করে দিয়ে চুপ করে থাকতো, গণহত্যাটা না করতো। আমি নিজেই তো পাকিস্তানের বিরোধী হয়েছি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রে। এর আগেও আমি পাকিস্তান টিকে থাকার পক্ষেছিলাম, ভিতরে ভিতরে। যদিও আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম।

জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে শরনার্থী শিবিরে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মানুষ কেন গেছে? আমি নিজে ১৯৭১ সালে ৯ মাস ভয়ে ক্লাস করতে আসিনি। কারণ, বাঙালি মাত্রই একটা ভীতির মধ্যেছিল। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলুক, মুসলিম লীগ নেতারা বলুক, তাদের কোনো সুন্দরী মেয়ে ১০০% নিরাপদ ছিল কি না যে, পাকিস্তানী বাহিনী ধরে নিয়ে যাবে না? তারা বলুক। তাদেরও নিরাপত্তা ছিল না। এর মানে কি সব মেয়ে রেপড হয়েছে? তা না। কিন্তু সবার মনে ভীতিটাতো ছিল, আশংকা ছিল, আতঙ্ক ছিল। আওয়ামী লীগকে কত শতাংশ লোকে ভোট দিয়েছে? ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগকে৪২-৪৫ শতাংশের বেশি লোক ভোট দেয় নাই।

কিন্তু আওয়ামী লীগ তো তাদনীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব সিটই পেয়েছিলা …

ড. হাসান: পাঁচ ভাগ হয়ে ভোট হয়েছে, তার মধ্যে ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে। আওয়ামীলীগ ১৯৭০ সালেও ব্যাপক জাল ভোট দিয়েছে। যেহেতু বাকিরা সব দুর্বল ছিল। এটা আসলে সবারই চরিত্র। সুযোগ পেলে বিএনপি জামায়াতে ইসলামী সবাই জাল ভোট দেয়। দেয় না?

দেয় না, এটা বলা যাবে না।

ড. হাসান: মনোপলি হয়ে গেলে, সেন্টারের ৮০ শতাংশ লোক নিজেদের হয়ে গেলে বাকি ২০ শতাংশ লোক খালি রেখে লাভ কি? আমাদের দেশের লোকদের তো ওয়েস্টার্নদের মতো প্র্যাকটিস নাই। পুলিশ নাই, তারপরেও তারা লাল বাতি দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে…! দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিস করে পাশ্চাত্য এ ধরনের নৈতিক মান অর্জন করেছে।

সিকিউরিটি পলিসিতে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। যেমনটি তারা দাবী করে। … ‘ইসলাম রক্ষা’ ইস্যুও ছিল।

ড. হাসান: ‘ইসলাম রক্ষা’র একটা সেন্টিমেন্ট হয়তোবা তাদের ছিলো। পাকিস্তান আর্মির প্রতি তাদের এমন অন্ধ বিশ্বাস ছিল। মুসলমানরা গায়েবী মদদে বিশ্বাসকরে তো …। আফগানিস্তানে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতার আশা করছে না?

জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ক্যাডার সিস্টেম আছে। ক্যাডার ভিত্তিক আন্দোলনের ব্যাপারে আপনার অবজারভেশন সম্পর্কে বলুন!

ড. হাসান: জামায়াতে ইসলামী যদি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে চায় অথবা জনপ্রিয় পার্টি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায় তাহলে জামায়াতে ইসলামী তার বিদ্যমান কাঠামো দিয়ে কোনোদিন তা পারবে না। না পারার একটা বড় কারণ হচ্ছে, খুব মেধাবী, খুব ক্রিয়েটিভ কোনো লোকের পক্ষেই জামায়াতে ইসলামীতে জয়েন করা সম্ভব নয়। অতি মেধাবীদের ছাত্র শিবিরে জয়েন করার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে কম।

এর কারণ কি?

ড. হাসান: কারণ হলো, তাদের সংগঠন পদ্ধতি ও মতাদর্শ এতো রিজিড যে, তাদের সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে বলতে গেলে কোনো স্বাধীনতাই থাকে না। এ ধরনের চরম আনুগত্য নিজ সন্তানও পিতা-মাতার প্রতি করতে চায় না। সর্বাত্মকবাদের মতো চরম প্রান্তিক মতাদর্শ ব্যতিরেকে কোনো মতাদর্শ এমনকি থিওরিটিক্যালিও এটিকে এলাউ বা প্র্যাকটিস করে না।

এখন জামায়াত-শিবিরের পক্ষে এই স্ট্রাকচার চেঞ্জ করা কি সম্ভব বা বাস্তব সম্মত এমনকি যদি তারা চায়ও…?

ড. হাসান: না, পারবে না। একটা ব্যাপারে জামায়াতে ইসলামী ও কমিউনিস্ট পার্টিতে অনেক মিল আছে। লোকে বলে এবং আমার নিজেরও ধারণা, মাওলানা মওদূদী আসলে ইসলাম ও কমিউনিজমকে একত্রিত করেছেন- ইসলামী আদর্শ আর কমিউনিস্ট স্ট্রাকচার। মাওলানা মওদূদীর স্কলারশীপের উচ্চতা যা-ই হোক, জামায়াতের বাকি যারা আছেন, তারা প্রতিভা ও জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে আরো অনেক অনেক কম। তারা সব হলেন কার্যত, মাওলানা মওদূদীর দ্বারা প্রভাবিত, ফলোয়ার মাত্র।

ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন অফশ্যূটের মাধ্যমে জামায়াত যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, এখন সমাজের উচ্চস্তর থেকে শুরু করে সর্ব পর্যায়ে তাদের লোকজন আছে। যে ঘরে একজন বিএনপি করে, একজন আওয়ামী লীগ করে, সেখানে প্রায়ই দেখা যায় যে, কেউ একজন জামায়াতে ইসলামী সমর্থন করে বা ওই ঘরানার। তাহলে এরা এই উন্নতি করলো কিভাবে?

ড. হাসান: এর কারণ হচ্ছে ধর্ম। জামায়াতে আসলে তো স্বাধীন চিন্তা করার কোনো অবকাশ নাই। সে জন্য কোনো মেধাবী লোক এখানে টিকতে পারে না। আমি শীর্ষতম এক জামায়াত নেতাকে ১০/১২টা প্রশ্ন করেছিলাম। উনি সবগুলোতেই মৌন সম্মতি দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কথারই স্পষ্ট উত্তর দেননি। তারমানে, বলার স্বাধীনতা নাই। তাছাড়া, স্ট্রাকচারে থাকার কারনে তারা সংগঠন থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মোটাদাগে আর্থিক সুবিধা পান। নচেৎ দৃশ্যত কোনো ইনকাম না থাকা সত্বেও উন্নত লাইফ-স্টাইল মেনটেইন করে ছেলে-মেয়েদেরকে বিদেশে বা দেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ান কিভাবে? গাড়ি মেনটেইন করেন কিভাবে?

ওনাদের তো ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যও আছে….

ড. হাসান: ব্যবসা-বাণিজ্য করে, সেটাও তো নিজেদের সাংগঠনিক তথা রাজনৈতিক প্রভাব বলয়কে কাজে লাগিয়ে করে, ইসলামী ব্যাংকের লোন দিয়েই তো করে।

জামায়াতে ইসলামীর কন্ট্রাডিকশনটা হলো, তার পুরো স্ট্রাকচারটা হলো ক্যাডার পার্টির অথচ তারা পপুলার পার্টি হতে চায়।

ক্যাডার বেইজড হওয়া সত্বেও পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদিরা কিভাবে ক্ষমতায় গেলো? প্রায় ৩৪ বছর তারা তো ক্ষমতায় ছিলো?

ড. হাসান: মার্কসবাদ এবং ইসলাম কিন্তু এক কথা না। ইসলাম কায়েম করার চেয়ে মার্কসবাদ কায়েম করা অনেক সহজ। কারণ মার্কসবাদে ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুসরণ করার মতো কোনো ব্যাপার নাই। মার্কসবাদীরা বলে যে, এটা একটা সাইন্স। যুগোপযোগিতাই হলো মার্কসবাদ।

বদরুদ্দীন উমররা তো বলেন যে, মার্কসবাদ কখনো ফেইলিউর হবে না। কারণ রাশিয়াতে কমিউনিজম আসেই নাই, কী ফেইল করবে? ওরা বলে যে, রাশিয়াতে তো মার্কসের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। মার্কসবাদের যে সাম্যবাদী পর্যায়- সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটাকেও এখন তারা শেষ বলছে না। এরপরেও আবার বিবর্তন হতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নব নব উন্নতিতেনতুন নতুন সিচুয়েশন ফেস করবে মার্কসবাদ। আমরা যেটা দেখেছি, সেটা মার্কসবাদের একটা সাময়িকরূপ। এটা হলো মার্কসবাদের একটা ব্যাখ্যা।

দ্বিতীয় কথা হলো, মার্কসবাদ তো মানব রচিত মতবাদ। এটাকে আপনি ভাঙতে পারেন যে কোনো সময়। কিন্তু ইসলাম তো ওই রকম না। ইসলামকে তো ভাঙতে পারবেন না।

প্রশ্নটা ছিল, ক্যাডার পার্টি হলে পপুলার হতে পারবে না। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে সেটা কিভাবে সম্ভব হলো?

ড. হাসান: পশ্চিমবঙ্গে যখন যেটা দরকার, তারা সেটা করেছে। পশ্চিমবঙ্গে তো তারা আদি মার্কসবাদ কায়েম করে নাই কখনো। ওরা সেটা দাবিও করে নাই। ওরা বলে যে, একটা পুঁজিবাদী সমাজে যদ্দুর পারা যায় আমরা গরিব মানুষের কল্যাণ করার চেষ্টা করছি। ওরা এটাকে মার্কসবাদী রাষ্ট্র বলে না তো। তারা সর্বক্ষেত্রে আপস করেছে এবং সেটা তারা বলে-কয়েই করেছে। ওরা বলেছে যে, ভারতীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সারা ভারতের ক্ষমতা দখল না করে একটা অঞ্চলে মার্কসবাদ কায়েম করা সম্ভব নয়।তার মানে তাদেরকে ভারতের, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সংবিধান মেনে চলতে হয়েছে। ভারতীয় পুঁজিবাদী আর্মির ছত্রছায়ায় কাজ করতে হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন জারি হওয়ার ঝুঁকি রেখেই কাজকরতে হয়েছে।

তারা কি পরিমাণ আপস করেছে সেটি দেখেন। সিপিএম-এর আমলে ভারতের অন্য যে কোনো অঞ্চল থেকে শিল্প-কারখানাগড়ার জন্য ভারতীয় পুঁজিপতিরা পশ্চিমবঙ্গকে আগে বেছে নিতো। কারণ ট্রেড ইউনিয়ন সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে শ্রমিকরা কারখানা কন্ট্রোল করতে পারে না। ফলে তাদের কথিত মার্কসবাদ পুঁজিবাদকেই সহায়তা করেছে এক অর্থে। এমনকি সিপিএম-এর নেতারা স্বাধীনভাবে আমেরিকায় গিয়ে বাণিজ্যিক সফর করে পুঁজি আনার চেষ্টা করেছে।

দেশের আয় বাড়ানোর জন্য তারা এটা করেছে। সোজা কথায়, তারা অ্যাডাপ্ট করেছে।

ড. হাসান: ওরা তো সেখানে কমিউনিজম কায়েমের কথা বলেনি। নাকি বলেছে?

তাহলে জামায়াতে ইসলামী যদি ক্যাডার সিস্টেম বহাল রেখে অ্যাডাপ্ট করার দিকে অগ্রসর হয়…

ড. হাসান: না, পারবে না। কারণ অযোগ্য ‘রোকন’রা সব সময় যোগ্যদের উপর কর্তৃত্ব করবে। তাহলে যোগ্য লোকেরা সেখানে কেন কাজ করবে?

তো এখন জামায়াতের একাংশ যদি জামায়াতকে রেখেই কিছু একটা করে…

ড. হাসান: জামায়াতের উচিত ছিল ১৯৭১ সালের লিগ্যাসিকে চাপা দেওয়ার জন্য জামায়াতে ইসলামীর নামে একটা আন্ডারগ্রাউন্ডপার্টি করা। অথবা সেমি-আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি করা, যেটা ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট হিসেবে থাকবে। বাহ্যিকভাবে উচিত ছিল একটা mass party করা। যেখানে ইসলামবিদ্বেষী নয় এমন যেকেউ স্পেস ও প্রপার এপ্রিসিয়েশান পেতে পারে। যেমন, যখন ভারতে বিজেপি আরএসএস করে, হিন্দু মহাসভা করে দেখেছে যে, ইন্ডিয়ান হিন্দুদের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করা যাচ্ছে না, তখন তারা বিজেপি নামে আধা-সেক্যুলার পার্টি করেছে। যার ফলে তারা ৫/৭ বছরের মধ্যে ক্ষমতায় চলে গেছে।

জামায়াতে ইসলামী যদি ইসলামী ছাত্রশিবিরকে তাদের পার্ট না রাখতো, তারা কোনো ধরনের ভায়োলেন্সে আসতো না। তারা শুধু লোক রিক্রুট করে ওই পার্টিতে দিতো। সমস্ত জেলা কমিটিগুলো ওদের নিয়ন্ত্রণেথাকতো। সমস্ত কেন্দ্রীয় নেতারা ওদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো। কিন্তু কেউ এটাকে সাম্প্রদায়িক দল বলতে পারতো না। কেউ এটাকে ১৯৭১ সালের দল বলতে পারতো না। বিজেপি তো তাই করেছে। বিজেপি’র সব key পোস্টগুলো আরএসএস’এর দখলে না? তাহলে এই কন্ট্রাডিকশনটা হতো না।

কিন্তু উনারা এটা অতীতেও করেন নাই, নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বাধ্যগত পরিস্থিতি ব্যতিরেকে বর্তমান বা ভব্যিতেও করবেন না। জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের এসব শোনারও ধৈর্য নাই। উনারা মনে করেন যে, ইসলামের মনোপলী উনাদের হাতে। আসল কথা হচ্ছে এটা একটা vested স্বার্থ। উনারা ব্যবসা-বাণিজ্যনিয়ে ব্যস্ত আছেন। উনারা মনে করছেন যে, বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতেই হবে, এমন কোনো কথা নাই। তাদের দায়িত্ব হলো ইসলামের কথা বলে যাওয়া, প্রতিষ্ঠা করাটা আল্লাহর দায়িত্ব।

জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ব্যাপারে বলতে পারবো না। তবে মধ্যম পর্যায়ের অনেক নেতাসহ অনেক লোকজন আছে যারা একটা কিছু করার জন্য দৃশ্যত খুব সিরিয়াস। বর্তমান সংকটটা একটুখানি কেটে উঠলে বোধহয় একটাআউটবার্স্ট হবে। ইতোমধ্যেই জায়গায় জায়গায় বিভিন্নভাবে কিছু কিছু গ্রুপ বা পকেট সৃষ্টিহয়েছে।

ড. হাসান: আমি সবার আগ্রহ ও চেতনার প্রতি সিম্প্যাথি রেখেই বলছি, যদি কিছু করতেই হয়, তাহলে জামায়াতের সংস্কারের চেয়ে নতুন নাম দিয়ে করার চেয়ে কিছু করাটা সহজতর ও ফলপ্রশূ হবে। বাম ঘরানার অভিজ্ঞতাকে সামনে রাখলে দেখা যায় যে, এতকিছুর পরও কমিউনিজমের পতাকাকে কিছু লোক ছাড়ছেনা, ছাড়বে না। কমিউনিজমকে এখনো মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমরা কেন ধরে রেখেছে? যদিও তারা জানে যে, বাংলাদেশে কোনো দিন কমিউনিজম হবে না। এর পেছনে দুইটা কারণ।

একটা হলো, তারা ঐতিহ্যের ধারক হয়ে গেছে। মিডিয়াও তাদেরকে এক ধরনের সহযোগিতা করে টিকিয়ে রেখেছে, টকশোতে দাওয়াত করে, বামপন্থীদের তো কথা বলা সহজ। একটা আন্তর্জাতিক যোগাযোগও দূরতম ভাবে হয়তোবা আছে। এখনো WARSAWভুক্ত দেশগুলাতে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আসছে। এমনটা ভারতে আছে। সোশ্যালিস্টদের মধ্যেও কমিউনিস্টদের প্রতি এক ধরনের দূর্বলতা কাজ করে, যেমন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের মধ্যে কমিউনিস্টদের প্রতি এক ধরনের ন্যাচারাল দূর্বলতা আছে, তাই না? যদিও তারা কোনোদিন কমিউনিজম করবে না। কিন্তু তারা মনে করে যে, তারা থাকলে আমাদের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট জমজমাট থাকলো। এছাড়া কিছু সম্পত্তি আছে তাদের। সম্পত্তি নিয়ে মারপিট হয়েছে না সিপিবির সাথে, ওদের সাথে? এ কারণেই কিছুদিনপর পর বাসদ ভাঙছে।

আমি খারাপ অর্থে বলছি না, বামপন্থী দলগুলোর উদাহরণ দিলাম এজন্য যে, বামপন্থীরা যেখানে আছে সেখানে থাকলে কিছু সুবিধা ভোগ করে। জামায়াতে ইসলামীর এরচেয়ে বহু গুন বেশি সম্পত্তি আছে। বাংলাদেশে জামায়াত নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও বিদেশে জামায়াতের প্রচুর লোক থাকবে। সারা পৃথিবীতে। তারা আরো বেশি কমিটেড। তাদেরকে বোঝানো সম্ভব হবে না। সুতরাং এর সুযোগ নিয়েএখানে কিছু ঝান্ডাধারী থাকবে। কারণ তাদের সম্পত্তি আছে অনেক। এই সংগঠনের নেতা হিসেবে সৌদী আরব গেলে সেখানে এক মাস বিনা পয়সায় থাকতে পারছে, খেতে পারছে, কিছু দিরহাম পেয়ে যাচ্ছে …

আমার কাছে মনে হয়েছে, নিবাসী বাংলাদেশী জামায়াত নেতা-কর্মীদের চেয়েও অনিবাসী বাংলাদেশী জামায়াত নেতা-কর্মীরা অনেক বেশি কমিটেড….

ড. হাসান: এটা এ কারণে যে, তারা নিরাপদ। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এ রকম। বলা হয় যে,মনের দিক থেকে ইসরাইলে বসবাসকারী ইহুদীদের চেয়ে নন-ইসরাইলী ইহুদীরা আরো বেশি সিরিয়াস। তাই জামায়াতে ইসলামীর সব কিছু একেবারে অ্যাবুলিশ করে ফেলা বাস্তবে সম্ভব নয়। জামায়াত সদস্যদের মধ্যে একটা মানসিক ঐক্য তো গড়ে উঠছে। দশ জন একত্রিত হয়ে একটা বাড়ি করে ফেলেছে, দশ জন একত্রিত হয়ে একটা ফ্যাক্টরি করে ফেলছে, দশ জন একত্রিত হয়ে একটা প্রতিষ্ঠান করে ফেলেছ। জামায়াত-বিশ্বাস অনেক জামায়াত নেতা-কর্মীদের মধ্যে বলা যায় এক ধরনের ঈমানের মতো হয়ে গেছে। শুনতে খারাপ লাগলেও এটি সত্য। এর ফল হলো, যে যাই বলুক, দরকার হলে আমি মরে যাবো, তারপরও জামায়াতে ইসলামী ছাড়বো না।

দেখুন, রাজনৈতিক ভুল হতেই পারে। কিন্তু কত গোয়ার হলে জামায়াতে ইসলামী তার চরম রাজনৈতিক বিপর্যয় সত্ত্বেও গত ৪২ বছরে এটি পরিষ্কারভাবে স্বীকার করতে রাজি হয়নি যে, ১৯৭১ সালে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

শুনেছি, গোলাম আযম সাহেব নাগরিকত্ব পাওয়ার পরে বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেটে যে বক্তৃতা দিয়েছেন, সেখানে নাকি তিনি এ ব্যাপারে….

ড. হাসান: জামায়াতে ইসলামী একটা বুকলেট লিখে, একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি বললে কি গোনাহ হতো নাকি? শুনেছি, কোনো এক রোকন সম্মেলনে একজন শীর্ষনেতা এমনও বলেছেন যে, ১৯৭১ সাল আমাদের জন্য বিপদ না, আমাদের জন্য কোনো সমস্যা না। বরঞ্চ, যারা ৭১ সালকে জামায়াতের সমস্যা হিসেবে মনে করছে, তারাই আমাদের জন্য বড় বিপদ…!

যাহোক,আমার মতে আপনারা নতুন করে চিন্তাভাবনা করুন। একেবারে ফ্রেশভাবে। যারা আসার আসবে।

একেবারে ফ্রেশ সংগঠন দাঁড় করানোর সম্ভাবনা কতটুকু? জামায়াত কি তাদেরকে বিভিন্নভাবে oppose করা বা গিলোটিন করার চেষ্টা করবে না?

ড. হাসান: তাতো করবেই। সিপিএম যে ধরনের চরম নির্যাতন নকশালপন্থীদের উপর করেছে, অন্য কেউ হলে ততটুকু হয়তোবা হতো না। ডিভোর্সি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ পরষ্পরের সবচেয়ে বেশি শত্রু। তাই না?

নকশালপন্থীদের শেষ পর্যন্ত সাকসেসটা কি?

ড. হাসান: না, সাকসেস নাই। বিশ্ব প্রেক্ষাপটই তো পরিবর্তন হয়ে গেছে। আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে সময়েযে প্রেক্ষাপটে যেসব দেশে হয়েছে, ওই প্রেক্ষাপটই পাল্টে গেছে। পুঁজিবাদীরা ওয়েলফেয়ার মডেল সামনে এনে কৌশলে কমিউনিজম ঠেকিয়ে দিয়েছে। সর্বহারাই তো থাকছে না, সর্বহারার বিপ্লব কি জন্য হবে?

ইউরোপ কি করেছে? মার্কস তো আশা করেছে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে উন্নত শিল্পায়িত সমাজে, যেখানে have nots সৃষ্টি হবে। এখন have nots’ই নাই, পুঁজিবাদীরা new economy চালু করে শ্রমিকদের ফ্যান,ফ্রিজ, গাড়ি, চিকিৎসাসহ সব নাগরিক সুবিধা প্রায় নিশ্চিত করেছে। তারপরও মানুষ কেন বিপ্লব করবে? বাক স্বাধীনতা? সেটাও তারা অন্তত আমাদের বা অন্য যে কারো থেকে বেশি দিয়েছে। বড়জোরএটা হবে যে, এখন ৫০০ টাকা গ্র্যাচুয়িটি আছে, এটা ১০০০ টাকায় উন্নীত করার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করা, মাঝে মধ্যে ২/৩ দিন স্ট্রাইক করা। দরকার হলে মালিককে একটা পিটুনি দিলেও মেরে ফেলবে না। মেরে ফেললে গ্র্যাচুয়িটি বাড়াবে কে?

কমিউনিজম হলো একটা অস্বাভাবিক ব্যবস্থা, পুঁজিবাদ হলো একটা স্বাভাবিক ব্যবস্থা। সে জন্যই পুঁজিবাদ টিকে আছে। তাই কমিউনিজম সময়ে এসেছিলো, সময়ই তাকে রাষ্ট্র-চ্যূত করেছে। অথচ, পুঁজিবাদ কল্যাণ রাষ্ট্রে বিবর্তিত হয়ে টিকে আছে।

যেটা বলছিলাম, নতুন দলের সম্ভাবনা তাহলে কতটুকু?

ড. হাসান: নতুন দলের সম্ভাবনা বলতে যদি ক্ষমতা দখল করা হয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে এটা হবে না, দেরি হবে। বাংলাদেশে বিএনপি-আওয়ামীলীগের বাইরে কেউ পারছে না কেন? তারমানে আমাদের দেশের লোকজন রাজনৈতিকতার দিক থেকেও আদতে পীরবাদী। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদেরকে পীর মর্যাদায় অনুসারীরা মনে করে। এই অর্থে এক একটি দল যেন ধর্ম হয়ে গেছে তো। যারা আওয়ামীলীগ করে তারা মনে করে,ধর্ম চেঞ্জ করার মতো আওয়ামীলীগ চেঞ্জ করাটা অসম্ভব। আওয়ামীলীগ বিরোধিতাও এক ধরনের ধর্ম হয়ে গেছে। এইসব বাস্তবতার মধ্যেই কাজ করতে হবে।

আমার ধারণা, বিএনপির লোকজন ভালো প্লাটফরম পেলে সুইচ করবে। বিএনপির যে অবস্থা, নড়তে-চড়তে পারছে না…

ড. হাসান: নতুন দল হলে বিএনপির লোক পাওয়া যাবে, কিন্তু জামায়াতের লোক কম পাওয়া যাবে। অবশ্য সাধারণ মানুষ এক পর্যায়ে আসবে। রাজনীতি তো একদিনের জন্য নয়। পাঁচ বছর পরেই ক্ষমতায় যেতে হবে, এ রকম তো না। রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে…

আরেকটা ব্যাপার হলো, ইসলামকে আদর্শিকভাবে আন্ডারস্ট্যান্ড করার বিষয়গুলোর মধ্যে যে বেসিক প্রবলেমগুলো, মাদ্রাসা সিস্টেমের মধ্যেও, তাবলিগ জামায়াতের মধ্যে তো অবশ্যই, এমনকি জামায়াতে ইসলামীর মধ্যেও…। ইসলামকে রি-ইন্টারপ্রেট করার যে বিষয়টা, কনসেপ্চুয়াল অ্যাম্বিগুইটির যে বিষয়গুলো…

ড. হাসান: আমি মনে করি, নতুন রাজনৈতিক দলের ওইসব জটিলতায় যাওয়ার কোনো দরকার নাই। এগুলোর কোনোদিনই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে না। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে এসব ফিলসফিক্যাল প্রশ্নের পেছনে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোনোদিন এগুলোর মিমাংসা হয়নি, কোনোদিন হবেও না। এগুলো দার্শনিক বিতর্ক হিসেবে থাকুক। এগুলোকে সাংগঠনিক বিতর্ক হিসেবে আনার দরকার নাই।

তাহলে আমরা যদি বলি, নতুন ধারার রাজনীতি, তারা তো তাহলে তেমন কোনো আদর্শ নিয়ে কাজ করবে না। তারা শুধু জনকল্যাণের জন্য কাজ করবে।

ড. হাসান: রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিতর্কের কোনোদিন শেষ হবে না। রাষ্ট্রের প্রয়োজন আছে কিনা, এটা নিয়েও তো বিতর্ক আছে। রাজনীতি, সংগঠনের প্রয়োজন আছে কিনা। পৃথিবীতে এই আন্দোলনও তো আছে, আদিম অবস্থায় ফিরে যাও এবং সেখানেই শান্তি। আছে না? রুশো- এরাও তো বলেছেন, এসব তো যন্ত্র। রাষ্ট্র, সমাজ, আইন, পরিবার, বিবাহপ্রথা- এগুলো মানুষকে দাসত্বে আবদ্ধ করে ফেলে। মানুষজন্মগতভাবেই কেবল স্বাধীন, পরেই সে পরাধীন। এসব বিতর্ক তো কোনো দিন শেষ হবে না। এইসব ফিলসফিক্যাল বিতর্ক নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহ নাই। দরকার কি? ওগুলো ফিলসফির কাজ।

সমস্যা হলো, যারা এ ধরনের কিছু করার জন্য মিনিমাম কম্পিট্যান্ট, তারা তাদের কমফোর্ট জোনের বাইরে আসতে তো রাজি নয় ….

ড. হাসান: কোনোদিনও মতাদর্শিক আন্দোলনে, টোটালেটারিয়ান আন্দোলনে কখনো কোনো বেশি মেধার জন্ম হয় না। রুশ বিপ্লবের পরে আর একজনও ম্যাক্সিম গোর্কি আসেনি, একজন টলস্টয় আসেনি। ওয়েস্টবেঙ্গলেও নামকরা, খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক, এক সময় যারা বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত ছিল, সিপিএম-এর ২০ বছরের শাসনামলে তাদের ৯০ শতাংশ সিপিএম ছেড়ে দিয়েছে।

তারমানে তত্ত্বগতভাবে টোটালেটারিয়ানিজম এবং ক্রিয়েটিভিটেনিজম- দুইটা কন্ট্রাডিকটরি?

ড. হাসান: সিপিএম সারাজীবনে একটা আনন্দবাজার পত্রিকা বের করতে পারেনি, এতো বছর ক্ষমতায় থাকা সত্বেও। চট্টগ্রামে যখন কর্ণফুলি বের হয়, আল-মাহমুদ সাহেবের সভাপতিত্বে আমিও সেই মিটিংয়ে ছিলাম। সেখানে আমি বলেছিলাম যে, আপনারা কোনো অবস্থাতেই আরেকটা সংগ্রাম হতে দিয়েন না। কিন্তু এটা সংগ্রামের চেয়েও খারাপ হয়েছে। নয়াদিগন্ত এখন আমরা রাখি আরকি। নয়াদিগন্তে কিছু পড়ার আছে? আমরা দলীয় কারণে রাখি।

আমার কথা হচ্ছে, যদি ইন্টেলেকচুয়াল মুভমেন্ট করতে চান, সেটি হতে পারে। কিন্তু রাজনীতি করতে হলে প্র্যাগম্যাটিক হতে হবে। রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংগঠন করতে হলে ওইসব মিথ-এ যাওয়ার দরকার কি? একটা কল্যাণমূলক রাষ্ট্রই তো লক্ষ্য …

Conceptual যেসব ambiguity আছে, ওইগুলোকে eradicate না করে প্র্যাকটিকাল ফিল্ডে কিছু করতে গেলে, একটা পর্যায়ে, ৫/১০বছর পরে, থিওরিতে যে প্রবলেমগুলো আছে…

ড. হাসান: ইসলামী রাষ্ট্র করতে গেলে এই সমস্যাটা হবে।

যেমন, আমি খুব প্র্যাকটিকাল একটা উদাহরণ বলি। যদি মনে করা হয়, ইসলামী শরিয়াহর রেফারেন্সগুলো require করে মেয়েদের মুখ ঢাকতে হবে। তাহলে বর্তমানে যে ধরনের একটা হেজেমনি আছে, প্রবলেম হচ্ছে- সেটা হবে। আর যদি থিওরিটিক্যালি এটাকে সলভ করা যায় যে, এটা required না, অপশন আছে। এখন সলভ করা বলতে আমি মনে করি না যে, সহস্রাব্ধ প্রাচীন এ বিষয়গুলো একদম settle for ever হয়ে যাবে। কিন্তু একটা ডমিন্যান্ট আইডিয়া হিসেবে মডারেট চিন্তাগুলো যদি থিউরিটিক্যালি enrich করা যায়…

ড. হাসান: মুখ ঢাকার দরকার আছে কি নাই- এই বিষয়টার রাষ্ট্রের সম্পর্ক কী? এটা একটা সোশ্যাল ব্যাপার। সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্র ও পরিধি আলাদা।

কিন্তু সমস্যার সমাধান না হলেও, বাস্তবে যারা পলিটিক্যাল মুভমেন্ট পরিচালনা করবে, তাদের পক্ষে কিন্তু এক ধরনের ফিলসফিক্যাল সাপোর্ট লাগবেই।

ড. হাসান: আমি একটা কথা বলি, ইসলামী রাষ্ট্র হলেও, ইসলামী বিপ্লব করে রাষ্ট্র গঠিত হলেও জোর করেই টিকে থাকতে হবে, যদি সনাতনী ধারায় এক রকমের ইসলামী রাষ্ট্রের কথা বিবেচনা করা হয়। কমিউনিজমওএকইভাবে জোর করে টিকে ছিল বা আছে। সেক্ষেত্রে সেটি হবে এক ধরনের পুলিশি রাষ্ট্র যা কাম্য নয়। তাই বাস্তববাদী হয়ে যতটুকু সম্ভব জনগণের ইচ্ছার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতে হবে।

[লেখাটি ফেসবুকে  দুই পর্বে পাবলিশ করেছিলাম। এখানে একসাথে দিয়ে দিয়েছি। ফেসবুকের মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যগুলো পড়তে চাইলে ভিজিট করুন: প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব।]

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *