যিনি ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্ব পালন করেছেন, বৃহত্তর ইসলামী সংগঠনের বিভিন্ন বিষয়ে যার নীতিগত ও কৌশলগত আপত্তি আছে, ব্লগে যেসব সমালোচনামূলক লেখা আসে সেসব পড়ে মনে করেন ঠিকই লিখেছে; তিনি বা তার মতো কেউ যখন জানতে চান ‘আমি এখন কোনদিকে যাবো? বা আমরা এখন কী করবো?’ তার বা তাদের জন্য এই লেখা। আজ দুপুরে এক ভাইকে মেইল করেছি এই বক্তব্য দিয়ে–
খেলাফতের দায়িত্ব:
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষই আল্লাহর খলিফা। তাই ইসলামী হুকুমত কায়েম হবার আগে প্রত্যেকের উপর ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব ফরজে আইন, আর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবার পর ফরজে কেফায়াহ। তাহলে বুঝতে পারছেন, কোথাও যাবার দরকার নাই। কারণ, আপনি ঠিক পথেই আছেন।
প্রতিটি মুমিন ইসলামের একেকটি দুর্গ, একেকটি দল, একেকটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান অজেয়, যতক্ষণ সেই ব্যক্তি ঈমানের উপর টিকে থাকেন। দল বা সংগঠন বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো এই ব্যক্তিক দল বা প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেডারেশন বা সমন্বয়। এই সমন্বয়ও আবার বৃহত্তর একাধিক দল বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বিত থাকে। যাকে বলে বৃহত্তর সংগঠন বা নেজাম। এভাবেই আরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও এলাকার সমন্বয়ে গড়ে উঠে উম্মাহ। একজন খলিফা হচ্ছেন এই উম্মাহ নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বশীল। এরই নাম খেলাফত। খলিফা হলেন সব খলিফার খলিফা। খেলাফতের এই ধারণা তা-ই, যা কোরআনে ‘ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদ্বি খলিফাহ’ হিসাবে বর্ণিত। খেলাফতের এই দায়িত্ব একাধারে ব্যক্তিক (ইনডিভিজ্যুয়াল), এলাকাগত (টেরিটোরিয়্যাল) ও বহুজাতিক (মাল্টিন্যাশনাল) বা বৈশ্বিক (গ্লোবাল)।
বিদ্যমান সংগঠনের ব্যাপারে আপত্তি ও এতায়াতের সম্পর্ক:
আমরা যখন নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যাই, তখন নিশ্চয় এই ইমাম সাহেব পারফেক্ট কি না, তা ভাবি না। এমনকি তার কোনো দোষত্রুটি জানা থাকা সত্ত্বেও তাকে এক্তেদা করতে আমরা পিছপা হই না। আবার, ইমাম সাহেবের পিছনে নামাজ পড়ি বলে তার দোষত্রুটি সম্পর্কে তাকে বলতে আমরা দ্বিধা করি না। এবং তিনি সেটি না মানলে সেসব সম্ভাব্য আপত্তির বিষয়ে অন্যদের কাছে বলতেও আমরা কসুর করি না। তাই না?
সুতরাং প্রচলিত ইসলামী আন্দোলনে আপনাকে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। যেসব কাজ নিঃসন্দেহে ভালো সেসবে সর্বোচ্চ পরিমাণে পার্টিসিপেট করতে হবে। কথায় আছে ‘পেটে দিলে পিঠে সয়’। আমি এত কথা বলি, তৎসত্ত্বেও এখানকার সংগঠন আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে ও আপন মনে করে। আর আমিও সংগঠনের ক্ষুদ্র স্বার্থেও যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে কখনো দ্বিধা করিনি, করবো না, ইনশাআল্লাহ।
তাই, সর্বদা কাজে থাকতে হবে। কর্মবিমুখতা যেন কখনো আমাদের গ্রাস করে না ফেলে। সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ (সিএসসিএস) নামে গত ১০ বছর হতে আমি বিভিন্ন ধরনের কাজ করে যাচ্ছি। সংগঠন এমনকি আমাকে চলচ্চিত্র উৎসবের মতো অনুষ্ঠানে (ইরাক যুদ্ধের সময়) পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। সংগঠনের মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট খুবই যৌক্তিক। তা হলো আপনি বিপরীত আদর্শের কোনো সংগঠনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। প্রচলিত ইসলামী সংগঠনের তাত্ত্বিক নীতি-আদর্শ তো খুবই ভালো। নেতৃবৃন্দের একাংশের কায়েমী স্বার্থবাদী মনোভাব ও অঘোষিত কিন্তু অতীব শক্তিশালী তথাকথিত কম্যুনিস্টিক সিস্টেম নিয়ে যত বিপত্তি। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু তাই বলে আমরা বসে থাকতে পারি না। তাই না?
ইকামতে দ্বীনের দায়িত্ব সম্ভবপরতার দিক থেকে সামষ্টিক, কিন্তু দায়বদ্ধতার দিক থেকে ব্যক্তিগত:
খেলাফত তথা ইকামতে দ্বীনের দায়িত্বকে নিজের ভাবতে হবে। মনে করুন, দুনিয়ার সব মানুষকে হেদায়াতের দিকে ডাকার, দ্বীনের উপরে রাখার দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনার! তাহলে অন্যদের ত্রুটিগুলোর জন্য মন খারাপ হলেও আপনি বসে থাকতে পারবেন না। প্রতিটা মুসলিম একটা ইসলামী দল, একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান, বিপ্লবের একেকটি সম্ভাবনা। বিশেষ করে আপনার-আমার মতো শিক্ষিত ও আন্দোলনের অভিজ্ঞতার অধিকারীরা।
আমার সাথে সংগঠনবাদীদের পার্থক্য:
আমি শুধু কাজে বিশ্বাসী নই। বলার পরে না হলেও ‘বলেছি তো’ এই সান্ত্বনা নিয়ে চুপ করে থাকার পক্ষপাতি নই। আমি ‘ওয়ামা আলাইনা ইল্লাল বালাগ’-এর সাথে সাথে ‘ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ’তেও সমবিশ্বাসী।
সুতরাং কাজ করতে থাকুন। ভালো কাজের অভাব নাই। তাই বলে খেদমতে দ্বীনের পথ ধরলে হবে না। ইকামতে দ্বীনের উপরেই থাকতে হবে। সেজন্য সংগঠনবিশেষই একমাত্র বিকল্প নয়। আমি নিশ্চিত, কী করবেন যখন ভাবছেন, তখন করণীয় পেয়ে যাবেন। চলার উপরেই থাকুন, পথ পেয়ে যাবেন। আসলে আপনি পথের উপরেই আছেন! যদি আপনি অলরেডি পথের তথা হেদায়াতের উপর না থাকতেন, তাহলে ‘আপনি কোনদিকে যাবেন’ তা কেন জানতে চাচ্ছেন? পথিকই পথ খোঁজে, ঘুমন্ত ব্যক্তি নয়। মুমিনই নেফাকের আশঙ্কায় ভোগে, মুনাফিক নয়।
এতায়াত সম্পর্কে ভুল ধারণা:
সংগঠনবাদীদের অন্যতম ভুল হলো এতায়াতের ব্যাপারে মনে করা ও দাবি করা যে, তাদের ধারায় যারা শপথ নেয়নি তারা এতায়াতের রিকোয়ারমেন্ট পূর্ণ করলো না। এটি এ জন্য ভুল যে, যখন ইসলামী হুকুমত কায়েম হয়ে যায় সে জনপদে তখন একজনই আমীর হবেন, যাকে বলা হবে আমীর বা খলিফা। তার বাইয়াতের বাহিরে থাকা হবে ইসলামের বাহিরে থাকা। তারা (সংগঠনবাদীরা) এটিকে হুকুমত কায়েমের প্রচেষ্টার সাথে গুলিয়ে ফেলেন। ইসলামী নেতৃত্ব এককেন্দ্রিক বটে, তবে তা হুকুমত কায়েম হওয়ার পরে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজ বা ধারা একটা জনপদে একাধিক হতে পারে। বরং হওয়াই উচিত। বিশেষ করে বিদ্যমান বিশ্ব বাস্তবতায়। এ নিয়ে বিস্তারিত কথা আপাতত আর নয়।
চিন্তা করবেন না। আপনি পথেই আছেন। সঠিক দিকেই চলছেন। সর্বদা হেদায়াতের জন্য দোয়া করুন। আর লেগে থাকুন আল্লাহর সাথে। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন তিনি তাকে পথ দেখান যে তাঁর সাথে লেগে থাকে (মান আ-নাবা ইলাইয়্যা)।
এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
অশ্বারোহী: কিন্তু আমার সমস্যা প্রচলিত গণতন্ত্র নিয়ে, কেননা একে অনেকে কুফুরি মতবাদ বলে আখ্যায়িত করেছেন, এমনকি ওস্তাদ আবুল আ’লা মওদূদীও (রহ)।
সুতরাং আমি কী করে প্রচলিত গণতন্ত্রপন্থীদের সমর্থন করবো? প্রচলিত গণতন্ত্র হারাম, এটা জানার পরও?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হারাম শব্দটা যত কম প্রয়োগ করা যায় তত ভালো। গণতন্ত্র লক্ষ্য (য়্যান্ড) হিসাবে অগ্রহণযোগ্য, অন্যতম উপায় হিসাবে গ্রহণযোগ্য। এটি আমার মত। ধন্যবাদ।
ইঞ্জিনিয়ার হাবিব: নবীজী (সা) তো পারতেন কাফির মুশরিকদের প্রপোজাল মেনে নিয়ে মক্কার নেতা হতে, এরপর তিনি তাঁর মতো ইসলাম একটু একটু করে ইমপ্লিমেন্ট করতে পারতেন। যেখানে নবীজী (সা) করেননি সেখানে আমরা কেন এটাকে উপায় হিসেবে বেছে নিব?
বলতে পারেন সময়ের দাবিতে। তাহলে নবীজীর (সা) জীবনযাপন, কথা ও কাজ আমাদের জন্য অনুসরণীয়, এই কথাটা কি আর খাটে না?
বিজ্ঞনের নিত্য নতুন বিষয় আমরা অবশ্যই গ্রহণ করব, যা নবীজীর (সা) জীবনীতে স্পষ্ট। কিন্তু ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো আদর্শ তিনি গ্রহণ করেননি। আর গণতন্ত্র এমন এক আদর্শ, যাতে সর্বময় ক্ষমতার অধীকারী একমাত্র মানুষ তথা জনগণ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: রাসূল যা করেননি তা কোনো মুসলমান করতে পারেন না। আর রাসূল যা করেছেন তা বাদ দেয়ার কোনো অধিকার কোনো মুসলিমের নেই। সহীহ কথা।
রাসূল মক্কায় সমঝোতা করেননি। কিন্তু কীসের ব্যাপারে? আকীদার ব্যাপারে। তাই, আকীদার ব্যাপারে কোনো ছাড় নাই। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। এমনসব বিষয়ে ক্রমধারা অবলম্বন করতে হবে যেসবের সোশ্যাল ইমপ্লিকেশন আছে। রাসূল (সা) এমনটি করেছেন। বলাবাহুল্য, আকীদা (যাকে আমি কনসেপ্ট বলছি) ছাড়া সকল মানবিক আচরণই সমাজ-সংশ্লিষ্ট এবং টেকসই পরিবর্তনের জন্য ক্রমধারায় বাস্তবায়নযোগ্য। কুরআন নাযিলের ধারাবাহিকতার পেছনে এটিই ব্যাপার। সে আলোচনার প্রসংগ ভিন্ন।
রাসূল (সা) না থাকায় আমরা সব বিধিবিধান একসাথে পেলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সামাজিক স্তরে রাসূল (সা) কী করেছেন– সেটি জানতে হবে ও সে অনুসারে কাজ করতে হবে। (এবং, আমার এ কথাটিও বার বার পড়ে ভালো করে বুঝতে হবে।) ধন্যবাদ।
তারাচাঁদ: ধন্যবাদ মোজাম্মেল ভাইকে চমৎকার একটি পোস্টের জন্য। “মুমিনই নেফাকের আশঙ্কায় ভোগে, মুনাফিক নয়।” অতি উত্তম কথা বলেছেন। সদররুদ্দিন ইসলাহী তার ‘মুনাফিকের হাকীকত’ বইয়ের ভূমিকায় এ কথাটিই বলেছেন।
আপনার এই লেখায় উচ্চশিক্ষিত কিন্তু অন্যের কাছে পরাজিত নয়, এমন একজন মানুষের মনের Mirror image পাওয়া গেল।
একটা অনুরোধ করছি: বর্তমান সমস্যা সংকুল পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পন এবং এরই সাথে অন্যের কাছে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাণী পৌছে দেবার কাজ অর্থাৎ খেলাফাতের দায়িত্ব যারা পালন করছেন, তাদের নিয়মিত পরামর্শ দিতে এবং উৎসাহ দিতে ভুলবেন না।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ধন্যবাদ।
এম এন হাসান: প্রত্যেক ব্যাক্তিই খলিফা ও খেলাফতের দায়িত্বপ্রাপ্ত– এই আইডিয়ার সাথে সহমত। প্রত্যেককেই একেকটি সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠতে হবে– এই বক্তব্যের সাথেও একমত। ট্রেনিংপ্রাপ্ত সৈনিকগণ লাইফটাইম একই কাজ করে না বা থাকে না ক্যান্টনমেন্টেও, তারাও অবসর নেয়। অবসরকৃত সেনারা যুদ্ধের সময় প্রয়োজন হলে ঠিকই এলাকায় এলাকায় ছোট ছোট গ্রুপকে ট্রেনিং দিয়ে গড়ে তুলতে পারে। সংগঠনকে আমি মনে করি একটা প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং সেন্টার।
পটিয়া মাদ্রাসাসহ অন্যান্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্রগণ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে একটা মিশন নিয়ে এলাকায় এলাকায়, মসজিদে মসজিদে, মাদ্রাসায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। তারা কিন্তু কেউ জিজ্ঞেস করে না, আপনি কি দায়িত্বশীলের অনুমতি নিয়েছেন? অথবা কেউ বলে না, আপনি কি বড় হুজুরের পরামর্শ নিয়েছেন? হুজুর যা বলার, যা শেখানোর তা শিখিয়েই পাগড়ি দিয়েছেন তার ছাত্রদের।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এই বুঝটুকু দরকার, সব সময় সবকিছুর জন্য সংগঠনের দিকে চেয়ে থাকার মানসিকতা পরিহার করে নিজের অ্যাবিলিটি অনুসারে কাজ করে যাওয়াই আন্দোলনের দেয়া ট্রেনিংয়ের স্পিরিট ও নিজেকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করার অন্যতম উপায়।
কী জবাব দেব যেদিন জিজ্ঞেস করা হবে জীবন-যৌবন কোন কাজে ব্যয় হয়েছে, কী জবাব দেব নিজের জানাটুকু কী কাজে লাগিয়েছি, অন্য কাউকে জানিয়েছি কিনা? তখন যদি বলি, যৌবনে শিবির করেছি, এরপর জামায়াতের সমস্যার কারণে কিছু করিনি, অথবা যদি বলি সংগঠন বলে নাই তাই করিনি; এভাবে যদি আল্লাহকে কেউ কনভিন্স করতে পারব বলে বিশ্বাস করি, তাহলে কিছু বলার নাই, আমি নিজেকে নিয়ে সবসময়ই ভীত থাকি, কারণ জবাব দেয়ার মতো কোনো কাজই করতে পারছি না।
দোয়া করবেন প্লিজ।
এই লেখাটাও ভালো হয়েছে, প্লাস দিলাম।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: খুবই চমৎকার কথা বলেছেন। ধন্যবাদ।