শাহবাগ আন্দোলন-উত্তর পরিস্থিতি ও মানবতাবিরোধী চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিশেষভাবে লাভবান হয়েছে। জামায়াতের ক্ষতি যা হবার তা হলো সাকুল্যে কিছু ফিজিক্যাল ক্যাজুয়্যালিটি। অন্তত দুইশত মানুষের প্রাণহানিসহ মামলা-হামলায় আহত-ক্ষতিগ্রস্তদের অবর্ণীয় সাফারিংস হিসাব করলে এটি নিঃসন্দেহে একটা মানবিক বিপর্যয়! এমনকি একজন নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুও অপূরণীয় বড় ক্ষতি, সন্দেহ নাই।

জামায়াতশিবির সৃষ্ট মোকাবিলার মিথ:

কিন্তু জামায়াতের সাংগঠনিক লাভ-ক্ষতির দিক থেকে দেখলে চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। ইসলামপন্থী দল হিসাবে পরিচিত এই দলটির সারাদেশে সব সেক্টরে রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে যে কোনো সময় প্রাণ বিসর্জনে প্রস্তুত। খোদা না করুক, প্রতিদিন দুইশত কর্মী নিহত হলেও এরা মাসের পর মাস আন্দোলন ও প্রতিরোধ চালিয়ে নিতে সক্ষম। জামায়াতের, বিশেষ করে একে সর্বাত্মকভাবে সমর্থনদানকারী ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাঠ পর্যায়ে মোকাবিলার সক্ষমতা-শক্তি বাংলাদেশে অলরেডি একটা মিথ তৈরি করেছে, যা অনেকাংশেই বাস্তব।

শাহবাগের গণ(?) আন্দোলন:

শাহবাগ আন্দোলনকে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ‘লঘু’ দণ্ডাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে যে গাল-গল্প ছড়ানো হচ্ছে তা মোটেও সঠিক নয়। খোদ ইন্ডিয়ান টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনেই দাবি করা হয়েছে, শাহবাগ আন্দোলনে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। ইদানীং টক শোগুলোতে বলা হচ্ছে, শাহবাগ আন্দোলন প্রথমে ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ হিসাবে গড়ে উঠলেও বিএনপি এতে যোগ না দেয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একে ‘ছিনতাই’ করেছে!? আদতেই কোনো ব্লগার না হয়েও অখ্যাত ইমরান কীভাবে প্রথম থেকেই এর নেতা হলেন? কারা তাকে নেতা বানিয়েছে? শাহবাগপন্থী ব্লগগুলোতে এই আন্দোলন গঠন ও এর নেতৃত্ব গঠন নিয়ে কোনো লেখা আমার নজরে পড়েনি। আমি সামুতে লিখেছি প্রায় তিন বৎসর।

আওয়ামী লীগ কর্তৃক শাহবাগ ছিনতাই:

যারা প্রথম থেকে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, শ্লোগান দিয়েছে, মিডিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে অংশগ্রহণ করেছে – তাঁরা সবাই ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্রলীগ ঘরানার প্রাক্তন ও বর্তমান নেতা-নেত্রী। তাদের মূল পরিচয়কে যথাসম্ভব আড়াল করে বিভিন্ন সামাজিক পরিচয়ে তারা আবির্ভূত হয়েছিলেন। শাহবাগ ছিলো আপাদমস্তক রাজনৈতিকদের একটা ‘অরাজনৈতিক’ সমাবেশ; সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতায় পরিচালিত ‘গণআন্দোলন’।

শাহবাগ আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই গণআন্দোলন:

এর মানে এই নয়, শাহবাগ আন্দোলন গণআন্দোলন ছিল না। আমার দৃষ্টিতে শাহবাগ আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ছিল একটা গণজাগরণ। গণআন্দোলন ও বিপ্লব সম্বন্ধে এমনকি শিক্ষিত লোকদের মধ্যেও তাত্ত্বিক অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। যে কোনো গণআন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লব কোনো না কোনো সুসংগঠিত শক্তির পরিকল্পিত অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত সম্ভব হয় নাই, হতে পারে না। সেটি বায়ান্নার ভাষা আন্দোলন বলুন, উনসত্তরের গণআন্দোলন বলুন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলুন, ৭ নভেম্বরের বিপ্লব বলুন, নব্বইয়ের গণআন্দোলন বলুন। প্রকাশ্য হোক বা গোপন হোক, একটা ক্ষুদ্র কিন্তু সংগঠিত শক্তি যখন নিজের ও প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির নিস্ক্রিয় সমর্থকদের স্বীয় দাবির সমর্থনে সক্রিয় করতে সক্ষম হয় তখন আমরা ভদ্র ভাষায় একে গণজাগরণ বা গণআন্দোলন ইত্যাদি বলি। এমতাবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি কোনঠাসা হয়ে এক পর্যায়ে রণেভঙ্গ দেয়। যাকে আমরা বিপ্লব বলি।

শাহবাগ আন্দোলন কীভাবে ব্যাকফায়ার করে:

শাহবাগ আন্দোলনের এই গণজাগরণের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা এক প্রকার সুদীর্ঘ গণবিচ্ছিন্নতার পরে হঠাৎ করে বসন্তের সুন্দর পরিবেশে এত লোকজন দেখে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভুল সমীকরণে পা বাড়ান। তারা জামায়াতকে সিঙ্গেল আউট করার কার্যকর পদক্ষেপের পরিবর্তে তাদের আরাধ্য ডি-ইসলামাইজেশন এজেন্ডাকে বিভিন্ন মাত্রা ও পরিচয়ে প্রকাশ্যে হাজির করে ফেলেন। রাজীবকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসাবে প্রতিকায়ন তাদের প্রথম বড় ধরনের ভুল পদক্ষেপ। পরিণতিতে ইসলাম কার্ড নিয়ে অগ্রসর হওয়া ইতোমধ্যে কোনঠাসা জামায়াতের লাভের পাল্লা দ্রুত ভারী হতে থাকে। সৃষ্টি হয় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির পক্ষে পাল্টা গণজাগরণের।

জামায়াতের অতি রাজনৈতিকতার রোগ:

এ দেশের আলেম সমাজ এক সময় রাজনীতিকে হারাম মনে করতেন। জামায়াতে ইসলামীর এটি এক নম্বর অবদান যে, তারা পুরো আলেম সমাজকে রাজনীতিতে টেনে আনার কাজে সক্ষম হয়েছে। ইসলাম ইজ এ কমপ্লিট কোড অফ লাইফ – এটি এখন বিশেষভাবে জনপ্রিয় শ্লোগান। পাগলকে ভালো করতে গিয়ে পাগল সুস্থ হয়েছে বটে, তবে সেবা-শুশ্রুষাকারী নিজেই বেশ খানিকটা পাগলে পরিণত হয়েছে! জামায়াতের অবস্থা হয়েছে অনেকটাই অনুরূপ। এ কথার তাৎপর্য হলো, জামায়াত তাত্ত্বিক ইসলামের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে নিজের অজান্তে ও অঘোষিতভাবে অতি রাজনৈতিকতার দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। মুখে বা নিজেদের সাহিত্যে যতই দাবি করুক, জামায়াত একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন, বাস্তবে জামায়াত নিজেকে ইসলামপন্থী একটা রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে দু’বছরের সেনা শাসনের সময় সকল রাজনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ করার পর জামায়াত কর্তৃক সকল ধরনের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখা এর অন্যতম প্রমাণ।

একদেশদর্শিতা হতে মুক্ত হওয়ার কাজে জামায়াতের ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি:

যা হোক, শাহবাগ আন্দোলনের ধাক্কায় এই চরম একদেশদর্শিতা হতে মুক্ত হওয়ার একটা সুযোগ জামায়াত, অন্তত জামায়াতের জনশক্তি অর্জন করেছে। তারা সেটি কাজেও লাগাচ্ছে। নারী অধিকার, বিনোদন সংস্কৃতি, বুদ্ধিবৃত্তি, প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমসহ গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সেক্টরকে কাজে লাগিয়ে বামধারা এ দেশে একটা সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টি করেছে এবং এর ধাক্কায় জাতীয় পতাকা লাগিয়ে সরকারী গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো জামায়াত নেতাদেরকে লাল দালানের বাসিন্দা করতে সক্ষম হয়েছে, অত্যন্ত কুৎসিতভাবে মিডিয়া ট্রায়াল সম্পন্ন করেছে। তৎসত্ত্বেও বামধারার থিংকট্যাঙ্কের বেহিসাবী অতি বিপ্লবী তোড়জোড়ের কারণে তা দ্রুততরভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শাহবাগ আন্দোলনের ধাক্কায় এসব অবহেলিত কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে জামায়াত কর্মীগণ ব্যক্তিগতভাবে হলেও ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করেছে। নিঃসন্দেহে এটি জামায়াতের মৌলিক লাভ।

জামায়াতের সংগঠনবাদিতার জোয়াল হতে নিষ্কৃতি প্রচেষ্টা:

আমার জানা মতে, জামায়াতের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতার চাকুরীতে নিয়োজিত সদা-সক্রিয় ও নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মী প্রশাসনিক তথা রাজনৈতিক ও নৈমত্তিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষক দায়িত্বশীলদেরকে বারম্বার বলাবলি করার পরও কোনো কাজ না হওয়ায় এক পর্যায়ে লিখিতভাবে প্রস্তাব ও অনুরোধ পেশ করেন। সেই ত্যাগী কর্মীর প্রস্তাবনা নিয়ে একটা মিটিং করার সময় ও গরজ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ অনুভব করেননি। সেই কর্মীর অনড় মনোভাবের কারণে অবশেষে দুজন দায়িত্বশীল তার সাথে ‘কন্টাক্ট’ করে বলেন, ‘এসব কাজ তো সংগঠনের করবার নয়। আপনি বা অমুক অমুক যারা এসব সীমিত আকারে করছেন, তাতে আমাদের সহযোগিতা আছে। আমরা নিয়মিত বৈঠকাদিই ঠিকমতো করতে পারি না, এসব কীভাবে করবো?!’

যেসব সংগঠনবাদী জামায়াত নেতাকর্মী পেশাগত দায়িত্বের বাহিরে পত্রিকা পড়া ছাড়া কম্পিউটার ব্যবহারকে সময়ের অপচয় মনে করেছেন, তারাই এখন ফেসবুকে একাউন্ট খুলছেন, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছেন। আইটি টিসি’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। শাহবাগ শুরু হওয়ার আগে যার ফেসবুক ফ্রেন্ড সংখ্যা ছিলো শ’তিনেক, মাস দেড়েকের মধ্যে তার ফ্রেন্ড সংখ্যা বারো শত ছাড়িয়ে গেছে।

শাহবাগ আন্দোলন জামায়াত-শিবিরের লিনিয়্যান্ট ও অল্টারনেটিভি পটেনশিয়্যালিটিগুলোকে ট্রিগারিং করেছে, ইগনাইট করেছে। শাহবাগীরা হোয়াইট হাউজে পিটিশন খোলার পর জামায়াতের লোকজনও একটা পাল্টা পিটিশন খুলে। দেখা গেল, নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই জামায়াতীদের পিটিশনে স্বাক্ষর সংখ্যা ৯৭ হাজারে পৌঁছে যখন শাহবাগীদের এ সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩৭ হাজার!

শাহবাগে কে কী পেল:

শাহবাগ আন্দোলনে তাদের নতুন কোনো লোক, শক্তি বা ক্ষেত্র সৃষ্টি হয় নাই। দশকের পর দশক ধরে এ দেশে বিভিন্ন অল্টারনেটিভ পেরিফেরিতে আশ্রয় নেয়া বামধারার সঞ্চিত সাংগঠনিক ও মিডিয়ানির্ভর সামাজিক শক্তি একটা পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছে। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে জামায়াত যা পেয়েছে, তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অভিনব। প্রযুক্তি ও গণমাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতির সাথে সাথে বিএনপিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বেশ আগেভাগে নামাতে সক্ষম হওয়া জামায়াতের অন্যতম প্রাপ্তি। ১৯৭০ ও ১৯৭১ সালের প্রথমাংশের পরে এবারই প্রথম ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরের বাহিরে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। দেশের যেসব জায়গায় এ পর্যন্ত ‘গণ্ডগোল’ তেমন হয় নাই, আসলে সেসব জায়গায় ক্রাকডাউন করে নতুন করে কোনো ফ্রন্ট খোলার ব্যাপারে সরকারের অনীহা ও ভীতির কারণেই সেসব অঞ্চল তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল বা আছে।

ইসলামী শক্তির ইন্টিগ্রেশনের ঐতিহাসিক সম্ভাবনা ও ঘটনা:

সম্প্রতি সরকারপন্থী আলেম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকার মতিঝিল চত্বরের কথিত মহাসমাবেশের মহাব্যর্থতার মাধ্যমে জামায়াত দেশের সকল ইসলামী শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে শাহবাগী-নাস্তিকদের বিরুদ্ধে ও পরোক্ষভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। জামায়াত যদি ভবিষ্যতে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো পাবলিক ফিগার তৈরি করতে পারে ও তাদেরকে জামায়াতের ‘সিল’ মেরে ‘নিরাপদ’ (নপুংসক!?) করার মতো হঠকারিতা না করে দেশের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তিকেন্দ্রসমূহের মধ্যে কাজ করার ও সমন্বয় করার দিকে মনোনিবেশ করে, তাহলে তা দেশ ও জনগণের জন্য বিরাট কল্যাণ বয়ে আনবে।

জামায়াত রিব্র্যান্ডিং:

শাহবাগ আন্দোলন জামায়াতকে পুনর্বিন্যস্ত হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। সরকার যদি জামায়াত নিষিদ্ধ করে তাহলে জামায়াতের লাভ সবচেয়ে বেশি। তাই সরকার সেটি করবে না, এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এক্ষেত্রে জামায়াতের উচিত স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেকে রিব্রান্ড করা। এক্ষেত্রে কামারুজ্জামান সাহেব জেল হতে যে প্রস্তাব দু’বছর আগে পাঠিয়েছিলেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই প্রস্তাবনা অনুসারে, জামায়াত থাকবে। এর পাশাপাশি জামায়াত আধুনিক শিক্ষিত ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের লোকদেরকে দিয়ে একটা মধ্যবর্তী দল তৈরি করবে। যারা জামায়াতের কোনো অপবাদ বহন করবে না। এরা আগামী দিনে এ দেশে তরুণ প্রজন্মকে ইসলামের আওতায় ফিরিয়ে আনার কাজে নিয়োজিত হবে।

রিব্র্যান্ড তথা এডাপ্টেশনে জামায়াতের সমস্যা:

পাকিস্তান-পূর্ব সময়ে প্রতিষ্ঠার দেড় দশকের মধ্যেই, ঐতিহাসিক মাছিগোট সম্মেলন পরবর্তী সময়ে বৈপ্লবিক আন্দোলন হিসাবে প্রত্যাশিত ও অপরিহার্য ন্যাচারাল এডাপ্টেশনের সাংগঠনিক-সক্ষমতা হারিয়ে ফেলা বর্তমানের রেজিমেন্টেড জামায়াতের পক্ষে গত দু’বছরে তা করা সম্ভব না হলেও শাহবাগ-উত্তর পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই সহজতর হয়েছে। কথা হলো, জামায়াত সে পথে এগুবে কিনা। জামায়াত এটি না করলেও শাহবাগ-সুনামি উত্তর জামায়াত পূর্ববৎ হবে না – অন্তত এতটুকু ধরে নেয়া যায়।

জামায়াতের ঐতিহাসিক অবদান:

জামায়াতের সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতের এই অবদানটুকু সবাই স্বীকার করবে যে, বাংলাদেশে অনৈসলামীকরণের মহাজোয়ারকে জামায়াত অনেকখানি রুখে দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের জাতিসত্তা গঠনে দুটি পরস্পর বিপরীত অবস্থানে অবস্থানকারী শক্তিকেও জামায়াত হয়তোবা একত্রিত করতে সক্ষম হবে।

বিবদমান পক্ষদ্বয় ও তাদের সাংঘর্ষিক (?) প্রস্তাবনা:

ভাবাদর্শগত দিক হতে এ দেশে একপক্ষে আছে কম্যুনিস্ট ভাবধারার লোকজন, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ দেশ হতে ইসলামকে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উচ্ছেদ করতে চায়। মূলত অর্থনৈতিক কারণে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধকে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ইসলামী ব্যক্তিবর্গের নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ার এটি গোপন লক্ষ্য। অন্যপক্ষে আছে, ইসলামী শক্তিকেন্দ্রসমূহ, যারা এ দেশকে, এ দেশের মূল পরিচয়কে, সোজা কথায় আমাদের বাঙালীত্বকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অবাস্তব ও কৃত্রিম এক ‘ইসলামী’ জাতিসত্তা নির্মাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। ব্যাপারটা নিছক সমঝোতার নয়, এটি ইসলামকে বোঝারও একটা সিরিয়াস বিষয়। আমরা মুসলমান, তাতে আমাদের বাঙালী হতে বাধা কোথায়?

বাঙালীত্ব কি মুসলমানিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক?

জামায়াতের নেতা হিসাবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যায়ের জনৈক কর্মী পহেলা বৈশাখের অনু্ষ্ঠানে যাওয়ায় তাঁর সহকর্মী জামায়াত-দায়িত্বশীল ও লোকজনেরা নিন্দা করেছে, আজেবাজে মন্তব্য করেছে। অথচ, মেলা হচ্ছে বাঙালীর সংস্কৃতি। চট্টগ্রামের লোক হিসাবে আমি দেখেছি, মেলা শুধু লালদীঘি আর মাইজভাণ্ডারেই হয়, তা নয়। চুনুতির সীরাত মাহফিলে মেলা বসে, যাতে বোরকা পড়া মেয়েরাও দলে দলে অংশগ্রহণ করে। হাটহাজারী-পটিয়া-চারিয়া-বাবুনগর-আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসাসহ সব মাদ্রাসার বার্ষিক সভার দিনে মেলা বসে। মেলাতে কী কী আইটেম থাকবে, তা ভিন্ন বিষয়। অথচ ইসলামপন্থীরা বলছে, মুসলমানদের দুই ঈদ ছাড়া কোনো জাতীয় উৎসব নাই!? তাহলে আমরা কি ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস পালন করবো না? সকল ধরনের খারাপ কাজ যে দুই ঈদের দিনেই এ দেশে সবচেয়ে বেশি হয়, তা কি সঠিক নয়? প্রধান খাদ্য হিসাবে আমরা রুটি খাই না, খেজুর খাই না, নুডুলস খাই না; ভাত খাই। এটি কি আমাদের ‘দোষ’? এখানে মুসলমানিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক কিছু কি আছে?

শেষ কথা:

জামায়াত যে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতাকে এতদিন পাত্তা দেয় নাই সেটি এখন হবে। শাহবাগ-উত্তর পরিস্থিতিতে এসব প্রশ্ন আসবে। এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবে। বাঙালীত্ব ও মুসলমানিত্বের সমন্বয়ে আমাদের জাতিসত্তা-সংকটের সুরাহা এবার হবে, আশা করা যায়। দল হিসাবে জামায়াতের যাবতীয় ব্যর্থতার মধ্যে এটি তাদের অন্যতম আদর্শিক সফলতা হিসাবে বিবেচিত হবে। যদি হয়। আমি আশাবাদী!

ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Khandoker Zakaria Ahmed: ধন্যবাদ, আপাতত একটি বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের জন্য। আমার মনে হয়, পরিপূর্ণ মূল্যায়নের সময় এখনো আসে নাই। তবে এটাকে আপনার প্রাথমিক মূল্যায়ন হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কারণ শাহবাগ কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো শেষ হয় নাই। সরকার এবং শাহবাগের পিছনের শক্তি আরো অনেক খেলা খেলবে। কতটুকু পারবে সেটি অন্য কথা। জামায়াত-শিবির কর্মীরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। জেল, পুলিশের নির্যাতন, মামলা ও বিরোধী পক্ষের আক্রমণের কারণে শিবিরের অসংখ্য ছাত্রের ছাত্রজীবন হুমকির মুখে পড়েছে এবং শারীরিকভাবে তারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। জামায়াত কর্মীদেরও একই অবস্থা। এই ক্ষতির প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী ও বিশাল, যা এখন অনুভব করা কষ্টকর। সারাদেশে, বিশেষ করে শহরগুলোতে হরতালের সময় যেভাবে গাড়ি বা দোকানপাট ভাংচুর করা হয়েছে তার ফলও ইতিবাচক হবে না। “শাহবাগ আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই গণআন্দোলন: এর মানে এই নয়, শাহবাগ আন্দোলন গণআন্দোলন ছিল না। আমার দৃষ্টিতে শাহবাগ আন্দোলন প্রকৃত অর্থেই ছিল একটা গণজাগরণ।” আপনার এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, শাহবাগ আন্দোলনকে আপনি গণআন্দোলন বা গণজাগরণ হিসেবে মেনে নিয়েছেন। আমি পুরোপুরি না মানলেও অস্বীকারও করতে পারছি না। যাই হোক, সাধারণ তরুণ প্রজন্মের একটি অংশের মধ্যে এর প্রভাব পড়েছে এবং তারা জামায়াত-শিবিরকে এ কারণে ঘৃণার চোখে দেখতে পারে। এটি কাটিয়ে উঠতে জামায়াত-শিবিরের অনেক সময় লাগবে। আপনি যে আশাবাদগুলো ব্যক্ত করেছেন, যেমন– জামায়াতের রিব্রান্ডিং, জনাব কামারুজ্জামানের প্রস্তাবের আলোকে সংগঠনকে সাজানো ইত্যাদি বিষয়গুলো জামায়াত কতটুকু মেনে নিবে তার উপর আপনার অধিকাংশ আশাবাদের বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। শেষ কথা হলো সার্বিক পরিস্থিতি এখনো অস্পষ্ট ও অসমাপ্ত। অনেক অ্যাক্টর এখানে জড়িত। সব মিলে কী হবে, এখনো তা বলার সময় আসে নাই।

Mohammad Mozammel Hoque: When no mass movement is of mass’s move but backed by some organised force, then Shabag is also undoubtedly a mass movement (backed by the leftists and government).

Shahidul Hoque: ইরানে কিন্তু নববর্ষসহ (নওরোজ) অন্যান্য জাতীয় উত্সব্গুলোকে ইসলামী উত্সব হিসেবেই দেখা হয়। কাতার, সৌদিসহ আরব দেশগুলোতে নববর্ষ নাই কিন্তু জাতীয় দিবস হিসেবে রাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের দিনকে ঘটা করে পালন করা হয়।

বাঙালিত্ব আর মুসলমানিত্বের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য জাতীয়, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠানিকতাকে সামনে এনে খাড়া করানোর মনোভাব পরিবর্তন দরকার। সমাজে পরিবর্তনের আরো অনেক মৌলিক ইস্যু আছে। বাংলাদেশের কমপক্ষে ৯০ ভাগ নারী এখনো ইসলামের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী সম্পদের ভাগ পান না। সম্পদে তাদের অধিকার নিশ্চিত করার ইস্যুকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করাটাও একটা মুখ্য চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত।

Mohammad Mozammel Hoque: Jamaat has mentioned every concerned thing in their writings and speech including apology for 1971. But they did not mean those except to keep records on! Jamaat has failed to raise any social movement on any vital issue like women’s right. The unIslamic inheritance law was challenged by the Qaomi madrasa leaders. Jamaat actually just extended support to them! Opposing the building of statue in front of airport was also stopped by the Qaomi madrasa olamas. The biggest Islamic force, Jamaat-e-Islami was in the backup!

Shahidul Hoque: Whether Jamaat plays in back-end or front-end, it’s not the major issue to the people. The people will see, we have a lot of important social problems in our surroundings that should be addressed by the people who declares themselves as God loving activists. But they are active in banning Pahela Baishakh, not promoting Islamic inheritance law that can empower at least half of the people in our society.

So, my point is that people don’t expect these issues should only be resolved by Jamaat, rather than all Islamic or secular parties who think there is actually something wrong in the ground.

Mohammad Mozammel Hoque: Overall, on social issues, the Islamic forces in BD are criticiser instead of be proactive. The first women right that has to materialise at once is their right to attend the daily prayers in the local mosques. Thanks for comment.

H Al Banna: আগে মুসলিম, আগে বাঙ্গালী, আগে বাংলাদেশী এইসব এবস্ট্রাক্ট অবস্থানগত বিষয়গুলোকে বেহুদা পায়ে পারা দিয়ে ঝগড়া করার মতো দাঁড় করিয়েছিলেন আমাদের আগের প্রজন্ম। এমনকি একজন জনপ্রিয় আলেমে দ্বীনের ওয়াজেও এইসব কথা খুবই এগ্রেসিভলি আছে। কিন্তু আমার মনে হয় তাদের সেই প্যান-ইসলামিজমের ধারায় দাঁড়িয়ে যাওয়া মুসলিম জাতীয়তাবাদী এপ্রোচই এইখানে আরেকটা জাতীয়তার সাথে গায়ে পড়ে ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিলো। হ্যাঁ, অবশ্য এই শতাব্দীতে এসে আমরা একটু ভিন্নভাবে সেক্যুলারিজম অথবা ইসলামিজমকে দেখার চেষ্টা করছি, অথবা বলা যায় অনেকটাই সবার সাংঘর্ষিক অবস্থান থেকে সরিয়ে সম্প্রীতির জায়গাটায় এনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু যে সকল মননে আগের কনসেপ্টটা দৃঢ়ভাবে স্টাবলিশড হয়ে আছে– সেটাকে কী করে আপগ্রেড করা সম্ভব?

Abdul Mannan: কথাটা হয়ত ঠিক। কিন্তু বলতে বড় ভয় লাগে।

Mohammad Mozammel Hoque: Banna, we must come out of the traditional mindset. I must say that our nation-identity is plural. By religion we are Muslims, by nationality we are Bangladeshi, by ethnicity we are Bengalees. These things are not new, but as Islamists we must own and proclaim all these ones loudly. This is not apologicity, not a compromise, but accepting the core reality. We should not attempt to deny this any more, I think.

H Al Banna: আপনারা বললে তো তবুও লোকজন শোনে, কিংবা তারিক রমাদান বললেও ভাবে, ‘ও আচ্ছা’। কিন্তু আমি বললেই ‘বেয়াদব’। আলেমে দ্বীনের চেয়ে বেশি বুঝে দিনে দিনে আলেমে দুনিয়াই বোধহয় হয়ে যাচ্ছি! তাদের কথা শুনে অন্তত এটাই ঠাওরাই নিজের বিষয়ে।

Mohammad Mozammel Hoque: The neo wave of pro-Islamic movement in BD will find you as the cultural sector commander, inshaAllah! So, do not care the organizationalist-traditionalists so much, but care Allah as much as possible. Just keep stirring the society. Creative persons are like blind eye carete fighters.

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *