মিতুল ম্যাডামকে কখনো শাড়ি পরতে দেখি নাই। বিয়ের পর থেকে মাঝে মাঝে তিনি শাড়ি চুরি হওয়ার অভিযোগ করেছেন। যতবারই এ রকম শুনেছি, আলহামদুলিল্লাহ বলেছি। কেউ না কেউ তো পড়বে। তেলাপোকায় কাটার চেয়ে তো ভালো। একবার আমাদের এক ছাত্র শফিকুল ইসলাম বাদলের সহযোগিতায় পার্শ্ববর্তী গ্রাম হতে ছুটা কাজের বুয়ার চুরি করে বিক্রি করে দেয়া শাড়ি উদ্ধার করে এনেছিলাম।
কখনো আমি তার জন্য এমনকি পাঁচ হাজার টাকা দামের কোনো জিনিসও কিনি নাই। কোনো শাড়িও কিনি নাই। সে নিজে কখনো কিনেছে কিনা জানি না। তৎসত্ত্বেও আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া অনেক শাড়ি একটা নির্দিষ্ট আলমিরাতে বছরের পর বছর ধরে ভাঁজ করা থাকে, দেখেছি। নিজে না পরলে চুরি হওয়াটাও একদিক থেকে ভালো। কোনো না কোনোভাবে তো কাজে লাগলো।
বাঙালী নারীরা শাড়িকে অনেকটা বলা যায় নারীত্বের-মাতৃত্বের প্রতীক মনে করে। তাই তো দেখি যিনি শাড়ি পরেন না তার আলমিরা-ওয়ারড্রোবেও অনেক শাড়ি জমা থাকে। যারা শাড়ি পরেন, তাদের তো কথাই নাই। একজনের কয়টা শাড়ি লাগে, আল্লাহ মালুম। কিছু কিছু শাড়ি তারা কখনোই পড়েন না, বা পড়লেও ক্বদাচিৎ পড়েন, কিন্তু পরম যত্নে রেখে দেন। যেমন, ‘বিয়ের শাড়ি’। যাদের নামের সাথে আমরা ‘রাদিয়াল্লাহু আনহা’ পড়ি তাদের কারো কাছে কোনো বিয়ের পোশাক জমা ছিল কিনা জানি না। ‘নারীত্বে’র ব্যাপারে নারীরা পুরোই বাংগালী। হোক তারা ইসলামী বা অনৈসলামী, বা সেমি-ইসলামী।
যাহোক, সামসুন নাহার মিতুল ম্যাডামকে গত পরশু রাতে এক পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে শাড়ি পরা দেখে ভালোই লাগলো। বাইশ বছর আগে উনার সাথে আমার ‘সম্পর্ক’ তৈরি হওয়ার পর থেকে আমি কখনো তাকে পোশাকের ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেই নাই। কেবলমাত্র আটোসাঁটো হাতাওয়ালা বা বডিফিট বোরকা না বানানোর জন্য ও না পরার জন্য বলেছি। আসলে পোশাকের মধ্যে নৈতিকতা বা ‘মান’ নাই, যদিও নৈতিকতার দাবি পূরণ করতে গিয়ে আমরা নানা রকমের পোশাক পড়ে থাকি।
মিতুলকে যেমন কেউ কখনো শাড়ি পরতে দেখে নাই, আমাকেও গত বিশ বছরের মধ্যে কেউ কখনো লুঙ্গী পরতে দেখে নাই। বড় মেয়ে মাহজুবাহকে লালন-পালন করতে গিয়ে আমার লুঙ্গী পরার অভ্যাস চলে গেছে…! ভাবছি, সেলফির এই জমানায় একদিন লুঙ্গী পরে ছবি তুলে ফেসবুকে দিবো। সবার, বিশেষ করে বয়স্ক লোকদের ফেসবুকে ছবি পোস্টানোর হাস্যকর প্রবণতার ধারায় আমিও নিজেকে হাস্যস্পদ করে তোলা ঠিক হবে না, এটাও ভাবছি।
হ্যাঁ, শিরোনামে যেমনটা বলেছি, মিতুল ম্যাডামই প্রথম নারী যার সাথে আমি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলি। একচুয়েলি, ‘মিতুল আপা’ আমাদের ক্লাসমেট ছিলেন। উনি নেক্বাবধারী ছিলেন। ইসলামী ছাত্রীসংস্থা করতেন। আমি শিবিরের নেতা। আমাদের সময়ে ‘ইসলামী প্রেম’ বা ‘সাংগঠনিক প্রেম’ ততটা বিস্তার লাভ করে নাই। এটলিস্ট আমি ওসবের সন্ধান পাই নাই। তেমন সবকও কেউ দেয় নাই। এখন আফসোস লাগে…! আমানত হল আর ‘লেডিস হল’ তো খালি পাহাড়ের এপাশ-ওপাশ, বেশি তো দূরে না…! উল্লেখ্য, আমাদের ছাত্রজীবনে শামসুন্নাহার হলই ছিলো চিটাগং য়্যুনিভার্সিটির একমাত্র লেডিস হল। সেখানে গিয়ে ‘কল দেয়ার’ সিস্টেম আমার মতো অনেক ‘না-লায়েকের’ই রপ্ত হয়ে উঠে নাই! ভিসি হিলের গোড়া হতে লেডিস হলের গেইট, মনে হতো, অনেক দূর…! সে সময় তো এমন সাশ্রয়ী রেটের ‘মোবাইল ফোনও’ ছিলো না, অবাধ ‘বন্ধুত্বের’ এই ফেইসবুকও ছিলো না।
আমি সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত উনার নাম সঠিকভাবে জানতাম না। মনে করতাম, উনার নাম ‘লাইলি’। মিতুল আপার ধারণা ছিলো, মোজাম্মেল ভাইদের বাড়ি ঢাকার আশেপাশে। আমার কথায় আঞ্চলিক টান তেমন স্পষ্ট ছিলো না। উনি টিচার হয়ে যাওয়ার পরে আমাদের ঘরের লোকেরা খবর পেল যে, একটা (উনাদের ভাষায়) ‘শিবিরের মেয়ে’ও টিচার হয়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবার ইত্যাদি সব মিলে যায়। ব্যস, আমাকে না জানিয়েই আমার বড়বোন উনাদের ফ্যামিলির কাছে ‘প্রস্তাব’ পাঠিয়ে দেন।
১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর আমরা জয়েন করার পরদিন হতেই ইউনিভার্সিটি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উনি তখন বাসায়। অর্থাৎ মাদারীপুরে। চিঠি পেয়ে উনার বড়বোন উনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে। এটি যে বিয়ের প্রস্তাব সম্পর্কিত তা না জেনেই উনি সাহসী-মেধাবী-সুদর্শন শীর্ষ ছাত্রনেতা ‘মোজাম্মেল ভাই’ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত সব মন্তব্য করলেন। যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে আমার ফ্যামিলি উনাকে আংটি পরিয়ে দিলেন। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নাটকীয়ভাবে বিয়ে কনফার্ম হওয়ার পরে একুশ তারিখ পর্যন্ত আমাদের পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে প্রেমপর্ব চলেছে। মাঝে একবার জামাল নজরুল ইসলাম স্যারের RCMPS-এর কনফারেন্স সেশন ফাঁকি দিয়ে পার্শ্ববর্তী বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরে আসা।
ছোটবেলা থেকে পণ করেছিলাম বন্ধুর ছোট বোন, কাজিন, ক্লাসমেট ও প্রতিবেশী – এই চার ক্যাটাগরির কোনো মেয়ের সাথে প্রেম করবো না। ফলে উচ্ছ্বল স্বভাবের হলেও আমার কপালে প্রেম করা আর জোটে নাই। যদিও সত্যিকথা হলো, তারুণ্যের উত্তাপ অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অতএব, আমিও যে একেবারে নিষ্কলুষ ছিলাম, এমন নয়। ওসব বিষয় নিয়ে আজকালকার ছেলেমেয়েরা ‘কনফেশান’ ইত্যাদি রকমের যেসব বিকৃতি চর্চা করে, তেমনটা করার কোনো উপযোগিতাও নাই, প্রসঙ্গও নাই। তাই মোটের ওপর বলা যায়, তিনি তুলনামূলকভাবে আনকোরা কাউকেই পেয়েছেন। এই অর্থে তিনি আমার প্রথম নারী।
সম্পর্কের বাইশ বছর পরে কাউকে শাড়ি-সন্তানের মাঝে পেয়ে ভালোই লাগলো। শাড়ির সাথে যেন বাঙালী নারীদের নাড়ির সম্পর্ক…।