সেজো আপার ছোট ছেলে ডাক্তারী পাশ করে বাসায় এসেছে। এর আগে উনার বড় মেয়েও ডাক্তার হয়েছে। সে উপলক্ষে আয়োজিত পারিবারিক অনুষ্ঠানে মোনাজাত পরবর্তী বক্তব্যে আমি বরাবরের মতো ছিলাম আবেগঘন। ‘সৈনিক গৃহ’, আমাদের পারিবারিক এক্সক্লুসিভ গ্রুপে আপলোড করা কিছু ছবিতে দেখলাম আমাকে ও মেজো আপাকে কাঁদতে দেখা যাচ্ছে। তাতে করে আমাদের সন্তানদের কেউ কেউ আশ্চর্যবোধ করে মন্তব্য করেছে। তাদের প্রশ্ন, এখানে কান্নার কী আছে?

হ্যাঁ, এখানে কান্নার সব উপাদানই আছে। তোমাদের কচি মনের এন্টেনায় তা হয়তো ধরা পরে নাই। ডা. আবীর আহমেদ কতো ছোট ছিল। সেদিনই তো ওর জন্ম হলো। সেজো আপা বাসায় চলে যেতে চাইলে “আবীরের ড্রয়িং পরীক্ষা আছে নাকি” বলে উনাকে ক্ষেপাতাম। সেই আবীর ডাক্তারিতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে বাসায় ফিরেছে, তার বড় কাজিনদের মতো জীবনের সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে অনেকখানি এগিয়েছে, তা আমাদের কাছে কান্না চলে আসার মতো আনন্দের। সে তোমরা বুঝবা না।

তোমাদের-আমাদের ‘সৈনিক গৃহ’ সংশ্লিষ্ট পরিবারের সব সদস্যের এইসব সফলতার যারা ছিলো কারিগর, সেই মুরুব্বীরা আজ নাই। তাদের বংশধরদের গৌরব-কীর্তি দেখার সৌভাগ্য তাদের হয় নাই। অথচ তোমাদের বাবা-মাদের লালনপালনে তারা কত কষ্ট করেছে, তা তোমরা ভাবতেও পারো না।

এই আমি আমার বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, বড় মামা, নানী, বড় চাচীসহ পরিবারের নয়জন সদস্যকে নিজ হাতে কবর দিয়েছি। হয়তোবা শুনেছ, তোমাদের চেয়ে কিছুমাত্র কম ডানপিটে ছিলাম না। বড়দের কাছে শুনেছি, খুব জোরে চিমটি দিলে একটু করে কেঁদে উঠে আমি আবার হাসতে থাকতাম। খুব সম্ভবত তুচ্ছ কোনো কারণে। অথবা, স্বভাবগতভাবে, অনেকটাই বিনা কারণে।

আমাদের সন্তানেরা, যারা এখন হাসিখুশি আছো, নিজেদের বাবা-মার সাথে, কাছে থেকে কিংবা দূরে থেকে কথা বলো, ঝগড়া করো, অভিমান করো, সাক্ষাতে কিংবা স্কাইপে, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি তাদের, যারা মা-খালা-মামাদের কান্না দেখে কৌতুকবোধ করছো, জেনে রাখো, এক সময়ে এমন পিতামাতা, মান-অভিমান, রাগ-গোস্বা সবই ছিলো আমাদের। জীবনটা আমাদের কাছে তোমাদের মতো এখন এত সুখময় নয় শুধু। জীবনের রঙিন ফ্লিপ কাভারের ভিতরের দিকটা তোমাদের সামনে উন্মোচিত হয়নি এখনো। এতটুকু।

দুঃখবোধের অভিশাপ মানুষের জীবনে এতটাই অমোঘ যে, নির্ঘাত বলতে পারি, তোমরাও একদিন এমনি ‘বিনা কারণে’ বা ‘শুধু শুধু’ কাঁদবে। অবাধ্য অশ্রু তোমাদেরকেও আবেগের অতলে ডুবাবে একদিন। দুঃখবোধের অভিশাপ হতে, বিরহবোধের বিষজ্বালা হতে কোনো মানব সন্তানেরই মুক্তি নাই।

এখন যারা নাই তারাও ভাবতো, যেন তারা চিরদিনই এখানে ছিল। থাকবে চিরকাল।

তোমরা হয়তো জানো, যারা সিনিয়র তারা শুনে থাকবে, কেউ কেউ হয়তো দেখেছোও, আমি ১৯৯৪ সালের ২১ জানুয়ারি তারিখের বিকেল বেলায় খুব কেঁদেছিলাম। বড় আপার হিলভিউর বাসায়। সেদিন আমার বিয়ের আকদ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। পাত্রীপক্ষ খুব অবাক হয়েছিলো, ছেলে কেন এত কাঁদছে। বিয়েতে মেয়েরাই তো সাধারণত কান্নাকাটি করে। হ্যাঁ, সেদিন আমার ভীষণ কান্না পেয়েছিলো। আমার ভাইবোনেরা, অন্তত আমার মা বুঝতে পেরেছিলেন, ও ওর বাবার জন্য কাঁদছে।

শিবির করে আমি জীবন বরবাদ করেছি। আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। – এই ছিলো আমার সম্পর্কে বাবার অত্যন্ত সঙ্গত ধারণা। অথচ, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিয়ে করছি এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নারীকে। বাবা যদি দেখতেন, কত খুশি হতেন…! ৯ ছেলেমেয়ের লালনপালনে কত কষ্ট করেছেন উনারা, তা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। আমাদের সবার সামাজিক প্রতিষ্ঠা উনারা, বিশেষ করে আমাদের বাবা, দেখে যেতে পারেন নাই। তোমাদের এত সফলতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা তোমাদের নানী বা দাদী দেখে যেতে পারেন নাই।

তাদের কথা তোমাদের কতটুকু মনে পড়ে, জানি না। আমরা, উনাদের সন্তানেরা, কখনো তাঁদের এতটুকু ভুলতে পারি না। তোমাদের সন্তানদের প্রতি তোমাদের যতটুকু টান, তারচেয়ে কিছুমাত্র কম ছিলো না, আমাদের জন্য তাদের ভালোবাসা। শরীরি উপস্থিতিতে না থাকলেও তারা কিন্তু আছে আলবৎ। আমাদের মননে, স্মরণে, প্রতিটা দেহকোষ ও রক্ত কণিকায়।

তাদেরই মনে পড়ে অবিরত, নবাগতদের এই উচ্চকিত ভীড়ে, যারা চলে গেছে, কুয়াশার ওপারে, পেরিয়ে মৃত্যু-যবনিকা দ্বার। তোমাদের অনুভবের জগতে যারা অনুপস্থিত বা অস্পষ্ট স্মৃতি, আমাদের অনুভবে তারা সতত জাগ্রত। তারা এখনো আমাদের পাশে তাদের থাকার ঘরে যেন বিচরণশীল, আছেন। আমাদের এমনই মনে হয়। স্মৃতির এ অসহ্য বোঝা একদিন তোমাদেরও বইতে হবে। সেদিন বুঝবে, কেন এরা এত কাঁদে।

ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য

Tanisha Tahsin: স্যার, অনেক বাস্তব কথা, আপনি আমাদের থেকে আরো ভালোভাবে রিয়েলাইজ করবেন। বাট এতোটুকু বয়সেও কিছুটা রিয়েলাইজ করতে পারি। বিশেষ করে ভার্সিটিতে আসার পর। যখন মনে হয় যে এত কষ্ট করে বাবা-মা মানুষ করছে, তাদের পুরোপুরি ঋণ তো শোধ করতে পারবই না, যতটুক্তু করতে পারব আল্লাহ ততদিন তাদের দুনিয়ায় রাখবে তো…! মিতুল ম্যাডামের কথা তখন মনে পরে, ম্যাম একদিন আমাকে বলেছিলেন– “আমার বাবা-মা আমাকে এত কষ্ট করে মানুষ করেছে, কিন্তু তাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি, তোমরাও পারবা না দেখ, কিছু করার আগেই তারা চলে যাবে। ম্যামের এই কথা মনে হলে অনেক খারাপ লাগে। কিন্তু এইটাই বাস্তব। আসলে আমাদের তারাই মানুষ করে। আর মেয়েরা সেই বাবা-মার জন্য না করে আরেকজনের ঘর সাজানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরি।

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *