[আমাদের সমাজে মৃত্যু উপলক্ষে যেসব সামাজিক ও ধর্মীয় অপকর্ম হয়ে থাকে, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে এবং সেগুলোকে রোধ করার জন্য, আমার মৃত্যুর পরে কীভাবে কী করা হবে, সেটার জন্য আমি একটা ওসিয়তনামা লিখবো বলে ভাবছি। এই লেখাটি ‘আমার মৃত্যুর পরে’ শিরোনামে আমার সেই লিখিতব্য লেখাটির পরবর্তী পর্ব।]
নাহ, একদিন নয়, ছিলাম বহুদিন, তোমাদের সুন্দর পৃথিবীতে। অনেক ভালোভাবে, সেখানে ছিলাম বহু বছর। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে, বার্ধক্যের সময়টুকু অতিক্রম করেছি, অনেক ভালোভাবে। মোটের ওপর ছিলাম আনন্দ আর সুখে। সামগ্রিকভাবে তৃপ্তিতে ভরপুর ছিল আমার দুনিয়াবী জীবন।
জন্মেছিলাম ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবোধসম্পন্ন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বেড়ে উঠেছিলাম একটি স্বাধীন দেশে। সমৃদ্ধতর সময়ে। শিক্ষাজীবনে পেয়েছিলাম জীবন ও জগতকে জানার এক অনন্য সুযোগ। পেয়েছিলাম জীবনের ব্যতিক্রমী সব অভিজ্ঞতা। জীবনকে উপভোগ করেছি সুখের সময়ের পাশাপাশি দুঃখের সময়েও।
বেঁচেছিলাম নিরোগ, সুস্থ দেহের এক প্রবল পুরুষ হিসেবে। স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা, এসব পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে অনেক বেশি করে। পেয়েছি জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আর মানুষকে ভালোবাসতে পারার মতো প্রশস্ত অন্তর।
সহজেই সবকিছুকে আপন করে নিতে পেরেছিলাম। সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো-মন্দকে দেখতে পেয়েছিলাম একেবারে ভিতর থেকে। আবার ঈগলের দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলাম বাস্তবতাকে, সামগ্রিকভাবে। জেনেছিলাম স্বচ্ছ-সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে, জীবন ও জগতকে। জ্ঞানের চেয়ে বড় সম্পদ পৃথিবীতে নাই। সেটাই চেয়েছিলাম। পেয়েছিলামও অনেক বেশি করে।
সংগ্রাম করেছি আমৃত্যু। সত্য ও ন্যায়ের জন্য হয়েছিলাম জীবনপণ। আমার জীবনে ছিল যত অপরাধ, অন্যায়, ত্রুটি-বিচ্যুতি ছোট-বড়, তা সব গোপন করেছেন তিনি। সেই মহান সত্তা, যার অনুগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে অস্তিত্বশীল এই সমগ্র বিশ্বজগৎ। যা চেয়েছি তার অনেক কিছুই পেয়েছি। যা পাইনি, শেষ পর্যন্ত বুঝেছি, তা ছিল না পাওয়ার। না পাওয়াগুলো ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত। যা চেয়েছি তা সবই যদি পেতাম, তাহলে শেষ পর্যন্ত যা কিছু পেয়েছি, তা আর হতো না পাওয়া।
ছিলাম আশৈশব জীবনবাদী। মানুষের ব্যাপারে আশাবাদী। বাস্তববাদী। সৃজনশীলতায় ছিলাম উৎসাহী, আস্থাশীল। জেনে, বুঝে, জ্ঞানত কোনো মিথ্যা কিংবা অন্যায়কে সমর্থন করিনি কখনো। আপন আলোয় চলেছি জীবনের পথটুকু, শেষ পর্যন্ত। যখন ভুলের ওপরে ছিলাম, তখনও। যখন সত্য পথে ফিরেছিলাম, তখনও।
তোমাদের অজানা মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের এই নতুন বাস্তবতায়, মহান আল্লাহর দরবারে আজ আমার ফরিয়াদ, যেন কবুল করেন তিনি, এই বান্দার সব সুকৃতিকে। বিশেষ এক দায়িত্ব পালনের জন্যে যিনি পাঠিয়েছিলেন যাকে, তোমাদের পৃথিবীতে।
হ্যাঁ, এই পৃথিবী এখন তোমাদের। যেমন করে এটি এক সময় ছিল আমাদের। আমরা যখন ছিলাম, তখন তোমরা ছিলে না। এখন তোমরা আছো। আমরা নাই হয়ে আছি, একান্ত প্রিয় কিছু জনের স্মৃতিতে শুধু। তারাও হারিয়ে যাবে অচিরে।
এভাবে সব নতুনেরা একে একে আসবে, আর মনে করবে, ‘এ তো আমারই জায়গা। আমি ছিলাম এখানে সবসময়।’ বোকার মতো ভাববে, ‘আমরা তো এখান থেকে যাবো না কোনো কালে। থেকে যাবো শেষ পর্যন্ত।’ আমাদের জীবনকালেও আমাদের আশেপাশে কিছু কিছু নির্বোধকে দেখেছি এমন করে ভাবতে।
তোমরা দুনিয়াতে এসেছ, সুনির্দিষ্ট বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে। তোমার আছে এক্সক্লুসিভ কিছু করণীয়। কোনো কিছুকেই তিনি অনর্থক রূপে ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি।
তাই, নিজেকে তুমি যতই নগণ্য কিছু মনে করো না কেন, জীবন তোমার কাছে যতই উদ্দেশ্যহীন মনে হোক না কেন, আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি, আমার যাপিত জীবনের ব্যাপক ও বিস্তৃত অভিজ্ঞতা আর গভীর অনুভব থেকে বলছি, দুনিয়াতে তোমার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব আর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। তোমার মর্যাদা অনেক উঁচুতে, যদি তুমি তা বুঝতে পারো। তোমার সৃষ্টির পিছনে রয়েছে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য। যা শুধুমাত্র তোমার দ্বারাই হতে পারে সম্পন্ন। এ বিশ্বাসটুকু রাখো মনে। আমিও বিশ্বাস করতাম এমনই। তাই তো আমি শেষ পর্যন্ত আজ সফলতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত।
আমি ছিলাম বিশ্বাসী। অপরিমেয় প্রত্যয়ী। তোমাদের দুনিয়ায় আমার যাপিত জীবনের উদ্দেশ্য, আমার সেই বিশেষ দায়িত্বটুকু, আমি ঠিকই খুঁজে নিতে পেরেছিলাম আমার প্রথম যৌবনে। তোমার জীবনের যে উদ্দেশ্য, তোমার যা দায়িত্ব, তা খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব কিন্তু তোমারই। সেই দায়িত্ব সম্পন্ন করার যে দায়িত্ব, সেটাও তোমার একান্ত।
তোমার আত্মার কাছে, তোমার বিবেকের কাছে, তোমার মনের কাছে, নিজ সত্তার কাছে নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করো। সামাজিক রীতিনীতির গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে, নিজের অস্তিত্বকে ভুলে গিয়ে, ভুল সুখে জীবন পার করার পরিবর্তে, নিজেই নিজেকে মোকাবেলা করো।
সাহসী হও। শেষ পর্যন্ত কী আছে, কী ছিল একেবারে শুরুতে, শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে পারে, তা জেনে নেয়ার চেষ্টা করো। এ দুনিয়াতে কী তোমার কাজ? কেন তুমি এখানে এসেছ? জেনে নাও সঠিক, এইসব অতি জরুরী জীবন-মরণ প্রশ্নের উত্তর। সাথে এটিও বুঝার চেষ্টা করো, আসল সফলতা কোনটি? জীবনের রহস্য বা নিহিতার্থ কী?
অস্তিত্ববাদী এসব মৌলিক প্রশ্নকে কখনো উপেক্ষা করবে না। এসব প্রশ্নের যে উত্তরই তুমি খুঁজে পাও না কেন, সেটাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলো দুর্নিবার। হয়তোবা, অবশেষে সফল হবে তুমি। যেভাবে মৃত্যুহীন এই বিচারপূর্ব জীবনে, নিরন্তর সফলতার প্রত্যাশায় আমি আজ অপেক্ষমান। আশাবাদী।
ভালো থাকো, পৃথিবী নামক বিশ্বজগতের এক ব্যতিক্রমী গ্রহে এখনকার অধিবাসীগণ। ভালো থাকো নতুন প্রজন্ম, আমাদের যোগ্য উত্তরসূরীগণ। যাপন করো অবসরহীন নৈতিক জীবন। শুদ্ধ নৈতিক জীবনই হলো সত্যিকারের মানবিক জীবন।
অবুঝের মতো অবিশ্বাসের বিষ পান করে হয়ো না অকাল আত্মবিনাশী। দুর্বল অপযুক্তি আর ভুল বিশ্বাসের মোহগ্রস্ততায় নষ্ট করো না আত্মগঠনের, লাভবান হওয়ার, অন্তহীন সুখে বেঁচে থাকার অমূল্য এই একটিমাত্র সুযোগ।
দুনিয়ার জীবন একটাই, তা যদি মানো, তাহলে স্থির মনে ভেবে দেখো, কেন এই জীবন? তোমার অন্তর কি বলে এসব কিছু অর্থহীন? অর্থহীনতাও তো ‘অর্থপূর্ণ’ হয়ে ওঠে না জীবন ও জগতের কোনো স্বগত নিহিত অর্থপূর্ণতা ব্যতিরেকে।
চিন্তার চেয়ে বড় কোনো সৎকর্ম নাই। তাই, আর যা কিছু হও বা না হও, চিন্তাশীল হও। নিজের মতো করে ভাবো। যাই করো, জেনেবুঝেই করো। অনুকরণকারী হয়ো না। হয়ো না অন্ধ অনুসারী কারো। সমাজকে কাজে লাগাও। কিন্তু, সামাজিকতার দাসে পরিণত হয়ো না। জ্ঞানের সব উপাদানকে কাজে লাগাও।
সমগ্র পৃথিবীর দিকে তাকাবে মিত্রের দৃষ্টি দিয়ে। দেখবে, তারা তোমার নিকটাত্মীয়। যেন একান্ত আপন। যেমন করে তুমি তাদেরই একজন। প্রিয়জন। যদি একাত্মতাবোধ করতে পারো মাটি ও মানুষের সাথে, ভূ-প্রকৃতি, সবকিছুর সাথে, দেখবে, ভালো লাগবে সবকিছু। আনন্দ, দুঃখ, বিজয় কিংবা সাময়িক পরাজয়, কোনোটাই তোমার জীবন চলার গতিকে পারবে না স্তিমিত-স্তব্ধ করে দিতে।
বেঁচে থাকতে একটা কবিতা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল, ‘পরাজয়ের প্রথম কয়েক রাউন্ডেই / জীবনের খেলা শেষ হয়ে যায় না’। সেটি খুঁজে নিয়ে পড়তে পারো। ভালো লাগবে আশা করি। আসুক সাময়িক পরাজয়। তাতে ক্ষতি নেই বিশেষ। শেষ পর্যন্ত যাতে জয়ী হতে পারো, সেজন্য হও আপ্রাণ, সচেষ্ট।
আশা করি, আমার মতোই একজন জীবনবাদী সমাজকর্মী হিসেবে জীবনকে গড়ে তুলবে তুমি, তোমার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। আশা করা যায়, তাতে করে সফল হবে তুমি। সার্থক হবে তোমার জীবন। আমার জীবন যেভাবে হয়েছে আপাত সফল ও ঈর্ষণীয় সুন্দর।
আমার জন্য দোয়া করো। তোমাদের জন্যও রইল সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা। একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার ধারাবাহিক যে সংগ্রাম আমরা পেয়েছিলাম উত্তরাধিকার সূত্রে, যে সংগ্রামে আমরা করেছি জীবন পার, সত্য আর মিথ্যার সেই ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ময়দানে তোমরাই আজ অগ্রগামী, অকুতোভয়, বীর সেনানী। তোমরা এগিয়ে যাও আগামীর পথে। সূর্যের মতো জ্বলে ওঠো। অনুভবের বিস্ফোরণে অবিরত ছড়াও আলো। জীবনের অপার সম্ভাবনার রূপায়ণে, অদম্য ইচ্ছার অমিত উত্তাপে, সত্য হোক তোমাদের সব সুপ্ত, সৃজনশীল স্বপ্ন।
৭ এপ্রিল ২০১৯, রাত ৯টা
১৫ নং বাসা, দক্ষিণ ক্যাম্পাস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।