যখন নিয়মিত ক্যাম্পাস ক্লাবে যেতাম তখনকার ঘটনা। একদিন অরুন কুমার দেব স্যার (চবি পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর) বললেন– ও মোজাম্মেল, ফইতথেক বছর রোজা আইলে, তোয়ারার মুসলমান অলর মইদ্দি, চাঁন দেখন লইয়েরে, এত গোলমাল খা অয়? আইজখাইল সাইন্সর যুগত, তোয়ারা ইয়িন, হিসাব গরি এরে, বাইর গরিত, ন ফাইততা লাইগগু যে না?
ঘোরতর আওয়ামী লীগ করা অরুণ স্যার আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি ছিলেন স্পষ্টভাষী একাডেমিশিয়ান শিক্ষক। স্যারের ওয়াইফ ছিলেন রাশিয়ান। মাঝে মাঝে বেড়াতে এসে কোনোমতে শাড়ি পরে মহাআনন্দে ঘুরে বেড়াতেন। স্যারের কাছ হতে আমি পদার্থবিদ্যার গল্প শুনতাম। মনোযোগী শ্রোতা হিসাবে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। স্যারের মুখেই প্রথম, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের everything out of nothing-এর কাহিনী শুনেছিলাম। স্যার চেয়ারম্যান থাকতে একবার ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের একটা একাডেমিক সেমিনারে আমাকে শ্রোতা হিসাবে অংশগ্রহণের দাওয়াতও দিয়েছিলেন। আমি গেছিলাম।
যাহোক, চাঁদ দেখা নিয়ে মুসলমানদের মতভেদ নিয়ে স্যারের করা প্রশ্ন ও পরামর্শের প্রেক্ষিতে আমি উনাকে বলেছিলাম, ‘ধর্মীয় বিধান হলো খালি চোখে চাঁদ দেখতে হবে। নচেৎ মাস পুরা করতে হবে।’ মনে আছে, আমার কথা শুনে স্যার বললেন, ও তাই। বিষয়টা আমার কাছে এখন ক্লিয়ার হলো।
আফসোস, ধার্মিক একজন অমুসলিম যা তৎক্ষণাৎ বুঝেছেন তা দেখছি কিছু পণ্ডিত মুসলিম বুঝতে পারছেন না। “কেন আমি … নই” নোটটাতে বলেছিলাম, রাজনৈতিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে বেকার মাঠকর্মীদের মনে হতাশার ফলশ্রুতিতে নানা ধরনের অতিশুদ্ধবাদিতা, অতিরিক্ত আধ্যাত্মিক প্রবণতা, উগ্র আদর্শবাদিতা ও মতাদর্শগত চরমপন্থার উদ্ভব ঘটে। যুগে যুগে এটি হয়েছে। বাংলাদেশেও এর লক্ষণ স্পষ্ট।
‘ধর্মপন্থী বিজ্ঞানবাদিতা’ – এমন একটা টার্মও চালু করতে হবে, ভাবছি।
ইনারা বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম চর্চা করতে চান। শেষ পর্যন্ত ইনারা বোধ হয় অজু-গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করাটাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসাবে প্রত্যাখান করবেন। অন্ততপক্ষে পা মাসেহ করার সময় পায়ের উপরের পরিবর্তে তলা মোছা শুরু করবেন। সফরে কষ্ট না থাকায় নামাজ সংক্ষিপ্ত করা বাদ দিবেন। হেলিকপ্টারে তওয়াফ করবেন।
হতে পারে, এক সময়ে উনাদের কাছে মনে হবে, মক্কার ইমামতিতে এখানে এক্তেদা করায় অসুবিধা নাই। যেমন করে কাদিয়ানীরা লন্ডনে অবস্থিত ইমাম কর্তৃক দেয়া খুতবা লাইভ শুনে এখানে এক্তেদা করে জুমা-ঈদের নামাজ পড়ে। খুব শীঘ্রই ইনারা প্রচলিত সাক্ষ্য আইনকে অগ্রাহ্য করে ল্যাব রিপোর্টের ভিত্তিতে ফয়সালা দেয়ার কথা বলবেন। ব্যক্তিগত এতমিনান তথা মানসিক স্থিরতার পরিবর্তে ঋতুবতী নারীদের জন্য পাক-পবিত্র হওয়ার ক্ষণ নির্ণয়ের জন্য প্যাথলজিকেল টেস্ট চালু করবেন। আরো কতো কী যে আল্লাহ পাক দেখাবেন, জানি না।
বাই দ্য ওয়ে, বিজ্ঞানবাদিতার জন্য আমার প্রস্তাবিত পরিভাষা হলো sciencism। সে হিসাবে বিজ্ঞানবাদী বুঝানোর জন্য লিখতে ও বলতে হবে sciencist। আমরা জানি, বৈজ্ঞানিক হলো scientist। বর্তমানে বিজ্ঞানবাদিতা বুঝানোর জন্য scientism নামে যে টার্মটা ব্যবহার করা হয় তা ত্রুটিপূর্ণ। কেননা সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানবাদীর জন্য বলতে হবে scientist। অথচ, scientist বললে বৈজ্ঞানিককে বুঝায়। বুঝতেই পারছেন, শেষ পর্যন্ত কিছু কিছু টার্মেরও প্রচলনকারী হলাম…। হা-হা-হা…।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য–প্রতিমন্তব্য
Mubin Sma: সৌদি আরবে চাঁদ দেখে এখানে রোজা রাখা অতি বৈজ্ঞানিক নয় কি? এটাকে কি গ্লোবালাইজেশন বলা যায়!!!
Mohammad Mozammel Hoque: সৌদিতে চাঁদ দেখে বিশ্বব্যাপী রোজা রাখার এই ভাবনা বাহ্যত বিশ্বায়নের ফল মনে হলেও আদতে তা অবৈজ্ঞানিক সমতল বিশ্ব (flat earth) ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে। গ্লোবাল ওয়ার্ল্ডে কোনো তারিখই বিশ্বব্যাপী একই হতে পারে না।
Mazharul Islam: সৌদি আরব এবং বাংলাদেশে একই দিনে চাঁদ ওঠে স্যার। পেরু এবং ইকুয়েডর এই দুই দেশে শনিবার সন্ধ্যায় চাঁদ উঠেছে। সৌদিরা পেরুর চাঁদ অনুসরণ করেছে। লোকাল চাঁদ নয়।
Mohammad Mozammel Hoque: সৌদিরা কি সেটা বলেছে?
Mubin Sma: কী বলেন Mazharul Islam সাহেব?? গতকাল তো তারা সাওয়াল মাসের চাঁদ দেখেছে, আমরা তো দেখিনি।
Mazharul Islam: প্রতি মাসেই চিলি, ইকুয়েডর, পেরু এসব দেশে আগের দিন চাঁদ ওঠে। মদীনা এবং আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, ওআইসি ইত্যাদি থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে “যে কোনো স্থানে চাঁদ দেখা গেলেই মাস গণনা শুরু” হবে। লোকাল মুন নয়।
Mohammad Mozammel Hoque: চাঁদ উঠেছে, ওমুক জায়গায় দেখা গেছে – এমন ঘোষণা বা দাবি কেউ করেছে? Any specific claim or information for this Eid?
Mazharul Islam: yes. please see www.moonsighting.com
Mazharul Islam: Mubin Sma, BD & KSA এই দুই দেশে একই দিনে চাঁদ ওঠে। ম্যাপ দেখুন, লিংক দিয়েছি।
Mohammad Mozammel Hoque: Is the question answered? “চাঁদ উঠেছে, ওমুক জায়গায় দেখা গেছে – এমন ঘোষণা বা দাবি কেউ করেছে? Any specific claim or information for this Eid?”
Mazharul Islam: জ্বি স্যার। পেরু এবং ইকুয়েডর থেকে দেখা গেছে খালি চোখে, যন্ত্র দিয়ে নয়।
Mohammad Mozammel Hoque: “পেরু এবং ইকুয়েডর থেকে দেখা গেছে খালি চোখে” – এর ভিত্তিতে সৌদিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে? আপনি নিশ্চিত?
Mazharul Islam: yes I am.
Abu Zafar: জানতে চাইতেসি, সৌদির চাঁদ দেখা কর্তৃপক্ষ পেরুর চাঁদ দেখাটা স্বীকৃতি দিয়ে স্টেটমেন্ট দিসে কিনা?
Masud Karim Chowdhury: চাঁদ দেখা যেতে হয় ঐ জোনে যেখানে ঈদ বা সংশ্লিষ্ট ইসলামী রীতি পালিত হবে। সৌদী আরব বা অন্য কোনো এলাকায় চাঁদ দেখা গেলেই আমরা বা জোনের বাইরের এলাকা তা অনুসরণ করতে পারি না। আরবের সাথে আমাদের পার্থক্য ৩ ঘন্টার। এ সময়টুকু অনেক।
Mazharul Islam: সৌদি আরব প্রতি মাসেই দক্ষিণ আমেরিকান চাঁদ অনুসরণ করে। লোকাল চাঁদ নয়। বস্তুত লোকাল চাঁদের কোনো সংজ্ঞা নেই। কত মাইল পর্যন্ত লোকাল রূপে গণ্য করবেন? হাদিসে বলা নেই। তাই সৌদি সিদ্ধান্ত হলো, দুনিয়ার যে কোনো স্থানে চাঁদ উঠলেই নতুন মাস শুরু হবে। দেখা গেছে প্রায় প্রতি মাসেই দক্ষিণ আমেরিকায় আগে ওঠে, এর পরদিন ওঠে আরবে এবং বাংলায়।
Mubin Sma: আমার মতে নিজ এলাকায় চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করে সবকিছু। বিশেষ করে রমজান মাসের চাঁদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চাঁদ দেখেই রোজা রাখা, আর চাঁদ দেখেই রমজান মাসের সমাপ্তি হওয়া উচিৎ।
Mazharul Islam: “নিজ এলাকা”র ডেফিনিশন খুজছিলাম।
Mohammad Mozammel Hoque: হাদীসে এলাকা বুঝানোর জন্য “বিলাদ” শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে।
Rashed Mustafa: আমার সহকর্মী মসজিদুল হারামে এবার ইতিকাফ করেছেন। উনারা সবাই মসজিদুল হারাম থেকে ২৪ জুন শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখেছেন। www.moonsighting.com কেন একথা বলছে আমার জানা নেই। নিচের সোর্সগুলি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। এখানে সৌদি আরবে চাঁদ দেখা গেছে বলা হয়েছে।
www.samaa.tv/international/2017/06/shawwal-moon-sighting-in-saudi-arabia-today
http://ummid.com/news/2017/June/24.06.2017/eid-2017-moon-sighting-news-from-saudi-arab-uae.html
Mubin Sma: আমার এক ভাইপুত ওমান থেকে বলল, তারা ৩০ রোজা পালন করেছে চাঁদ দেখে।
Mazharul Islam: আমার বন্ধু ওমান থাকে। ওমান ফলো করে লোকাল মুন থিওরি।
Khondoker Zakaria Ahmed: শাওয়াল মাসের ১ তারিখ ঈদ। বিজ্ঞান যদি যন্ত্রের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পারে চাঁদ উঠেছে তাহলে ঈদ পালন করতে অসুবিধা কি? বিজ্ঞান অন্তত মিথ্যা বলে না।
Mohammad Mozammel Hoque: বিজ্ঞান যদি হিসাব-নিকাশ করে সঠিকভাবে পূর্বানুমান করে, তাতে অসুবিধা নাই। সে ক্ষেত্রে তা খালি চোখে দেখতে না পাওয়ার কথা না। চাঁদ উদিত হওয়া আর উদিত চাঁদ খালি চোখে দেখতে পাওয়া, দুটো আলাদা ব্যাপার। বিজ্ঞানের দৃষ্টি বা হিসাবেও এ দুটো আলাদা ফেনোমেনা। এবাদতের ব্যাপারে হুবহু পুরো কথাটাকে মানতে হবে। যাকারিয়া ভাই, এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পেতে হলে জনাব Salamat Ullah’র লেখাগুলো ফলো করেন।
Khondoker Zakaria Ahmed: শর্ত কি চাঁদ উদিত হওয়া, না দেখা?
Mohammad Mozammel Hoque: আশেপাশের কেউ না কেউ দেখা।
Khondoker Zakaria Ahmed: যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা কী দেখা নয়?
Mohammad Mozammel Hoque: দেখা। তবে ভিত্তি হবে মানুষের স্বাভাবিক দেখা। শরীয়াহ যেভাবে প্রবর্তিত হয়েছে সেভাবেই তা মানতে হবে।
Md. Alauddin Majumder: আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে?
Mohammad Mozammel Hoque: মাস পূর্ণ করবে।
Amimul Ehshan Santo: অনেক ভালো লাগলো। থ্যাংক ইউ স্যার।
Mohammad Mozammel Hoque: এক সুহৃদ এক শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞজনের বোগাস একটা স্ট্যাটাসের লিংক ইনবক্স করেছেন। উনাকে রিপ্লাই দিতে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই লেখা।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ….
ঈদ মোবারক!!
আপনি বলেছেন-
‘’ধর্মীয় বিধান হলো খালি চোখে চাঁদ দেখতে হবে। নচেৎ মাস পুরা করতে হবে’’।
বিষয়টি নিয়ে আমার যতটুকু জানা আছে তাতে সমস্যাটি “দেখা” নিয়ে নয়, বরং “দেখা” কার্যকর হওয়ার সীমানা(এলাকা)র বিস্তৃতি নিয়ে!
অর্থাৎ-
কোন এক এলাকায় চাঁদ দেখা গেলে তার কার্যকারিতা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং কার্যকর করতে পারার সুবিধা/অসুবিধা ও সম্ভাব্যতা কতখানি এবং কিভাবে তা কার্যকর করা হবে!
এ বিযয়ে আরো বিস্তৃত আলোকপাত করলে ভালো হয়!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।