ইসলামী সংগঠনগুলোর মধ্যে একটা কমন প্রবলেম আমাদের এখানে দেখা যায়। সেটা হচ্ছে, নিজেদের লোকদের বাইরে তারা কারো কথা শুনতে চায় না। কেউ মনে করতে পারি, এটা একটা বিশেষ ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের সমস্যা। কিন্তু, না। আমি দেখেছি, এটা বিশেষ কোনো সংগঠনের সমস্যা না।
ইসলামী সংগঠনগুলো এই সমস্যাকে ইনহেরিট করেছে মাদ্রাসা কিংবা এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী যে সকল ইসলামী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো থেকে। সেখানে মনে করা হয়, কোনো একজন ব্যক্তির মধ্যে যদি ফাসেকী থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে কোনো কিছু শেখা যাবে না। কারণ, তার কাছ থেকে এলেম অর্জন করতে গেলে সে শিক্ষার্থীর ঈমানের মধ্যে সমস্যা তৈরি করে দিতে পারে।
ইসলামপন্থীদের এই যে সমস্যা, এটা এখনকার সমস্যা নয়। এটাকে ঐতিহ্যবাহী একটা সমস্যা বলা যায়। কারণ, সমস্যাটা হাজার বছর ধরেই চলে আসছে। এ বিষয়ে আমার বক্তব্যটা একটু ভিন্ন।
আমার কাছে মনে হয়, ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্সট্রাকটর, টিচার এবং মেন্টর– এ তিনটি জিনিসকে একসাথে গুলিয়ে ফেলছে।
আমি কারো কাছ থেকে কম্পিউটার শিখবো, বিভিন্ন স্কিল শিখবো, যেমন– কীভাবে একটি ওয়েবসাইট ডেভেলপ করতে হয়, কীভাবে কম্যুনিকেটিভ স্কিল ডেভেলপ করা যায়, সেগুলো শিখবো। এগুলো হচ্ছে এমন ধরনের শিক্ষা যার সাথে ভ্যালুর তেমন কোনো সম্পর্ক নাই। এবং এ ধরনের শিক্ষা যারা দেয় তাদেরকে আমরা বড়জোর ইন্সট্রাকটর বলতে পারি।
আবার, আরেক ধরনের শিক্ষা হচ্ছে, কেউ আমার কাছ থেকে ফিলোসফি শিখবে, কারো কাছ থেকে কেউ লিটারেচার শিখবে, কারো কাছ থেকে কেউ ফিজিক্স বা বায়োলজি শিখবে। এই শিক্ষাগুলো, যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্লাসরুমে শিক্ষা দেওয়া হয়, এর সাথে ভ্যালুর কিছুটা সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু যে কোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি নিজের ভ্যালুজগুলোকে ঠিক রেখে এগুলো শিখতে পারে। প্রয়োজনে একজন শিক্ষার্থী ‘ক্ষতিকর মূল্যবোধকে’ এক্সক্লুড করে কোনো শিক্ষকের কাছ হতে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো শিখে নিতে পারে।
আরেক ধরনের শিক্ষা আছে যেটাকে আমরা বলতে পারি গাইডেন্স বা মুরশিদ টাইপের ব্যাপার। জীবন ও জগত পরিচালনা সংক্রান্ত মৌলিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে এমন ব্যক্তিকে আমরা বলতে পারি মেন্টর। স্পষ্টতই, মেন্টর, টিচার এবং ইন্সট্রাকটর– এই তিনটি জিনিস হচ্ছে আলাদা।
কিন্তু ইসলামী ট্রেডিশনগুলোতে এ তিনটাকে একাকার করে ফেলা হয়েছে। প্রচলিত ইসলামী ধারায় মনে করা হয়, যিনি মোটামুটি লেভেলের ভালো মানুষ নন, তার কাছ থেকে কোনো কিছু শেখা যাবে না। এটা করতে গিয়ে ইসলামপন্থীদের অবস্থা হয়েছে সেই লোকের মতো খাবার নিয়ে যার অনেক এলার্জি। সে এটা খেতে পারে না, ওটা খেতে পারে না, এ রকম। কিংবা এমন ব্যক্তির মতো যে কিনা বিভিন্ন মত-পথ নিয়ে এমন একটা বিভ্রান্তি বা প্যারানয়ার মধ্যে আছে, যার ফলে কোনো পথেই এগিয়ে যেতে পারে না।
ইসলামপন্থীরা আজকাল জ্ঞান অর্জন করে নিজেকে সমৃদ্ধ করা, সচেতন ও সক্ষম করে তোলা প্রভৃতি বিষয়ে বাস্তব চাহিদা অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারে না। কারণ তার একটা পিছুটান থাকে এই কথা ভেবে যে, যার কাছ থেকে সে জ্ঞান অর্জন করছে সে লোকটি আসলে ভালো কিনা…। এজন্য দেখা যায়, ইসলামপন্থীরা কোনো একজন ব্যক্তির যেসব অনস্বীকার্য ভালো দিক রয়েছে সেটাকে বা সেগুলোতে ফোকাস করার চেয়ে বরং তার মধ্যে বিদেশষ কোনো সমস্যা আছে কিনা, সেটাকে বেশি হাইলাইট করে।
অমুক ব্যক্তির এই সমস্যা, তমুক ব্যক্তির ওই সমস্যা– এ ধরনের নেতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে তারা অনেক বেশি এনগেইজড। কারণ তারা শিক্ষা পাওয়ার জন্য একটা বিশুদ্ধ উৎসের সন্ধান করে। অথচ, সঠিক শিক্ষা লাভের জন্য পয়লা নম্বরের বিশুদ্ধ উৎস হচ্ছে আমাদের বিবেক, যেটার বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলে দিয়েছেন, ‘ফাআল হামাহা ফুজুওরাহা ওয়া তাকওয়াহা’। বিবেক সব সময় আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। বিবেক যদি কাজ না করে, তাহলে কোনো শিক্ষাই আমাদেরকে সঠিক পথে নিতে পারে না।
আর একটা কথা, প্রফেট মোহাম্মদকে (সা) আমরা প্রফেট হিসেবে মানি এ কারণে যে, নবী হিসেবে তাঁর সবগুলো কথাই যথাযথভাবে অনুসরণযোগ্য। তিনি ছাড়া কোনো ব্যক্তি এমন হতে পারেন না, যার কথা আমরা হুবহু মেনে চলতে পারি। সেজন্য কোনো একজন ব্যক্তির আগাগোড়া সবকিছু ঠিক হবার প্রয়োজন নাই। এমনকি বর্তমান সময়ে আগের পিউরিটানিক গুরুবাদী সিস্টেমটা খুব একটা ওয়ার্কেইবল নয়। আর, এমন কোনো মেন্টরও এখন হতে পারে না, যিনি এককভাবে কাউকে সুপথে পরিচালিত করতে সক্ষম।
আগে মানুষ বাইয়াত গ্রহণ করতো একজন পীরসাহেবের কাছ থেকে কিংবা কোনো সাংগঠনিক সিস্টেমে। এরপর সে মনে করতো, এখন তাহলে আমি সঠিক পথে চলতে পারবো। তবে, এখনকার এই একবিংশ শতাব্দীতে বিষয়গুলো অনেক জটিল। আর, নানামুখী জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের জন্য এতো জরুরি হয়ে পড়েছে এবং এর শাখাগুলো এতো বেশি সম্প্রসারিত হয়েছে যে, এখন আসলে এই ধরনের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক শুচিবায়ুতা’ দিয়ে আর চলবে না।
এর পাশাপাশি, বাছবিছারহীনভাবে কোনো কিছু গ্রহণ করে নেওয়াও কিন্তু এর বিকল্প নয়। বরং, হেদায়েত লাভের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত হিসাবে নিজের বিবেকবুদ্ধি ঠিক রেখে আমি বিভিন্নজনের কাছে শিখবো। কারো কাছ আমি কোনো একটা স্কিল শিখবো, কারো কাছ থেকে এমন একটা বিষয় নিয়ে জানবো যেটা নিয়ে পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক কথা আছে, এবং কারো কাছ থেকে আমি একটা গাইডেন্স নিবো। আর, গাইডেন্স নেবার ক্ষেত্রে যথাসম্ভব নিজের বিবেকের উপরই নির্ভর করবো।
শিক্ষক বলতে সাধারণত আমরা ঐ সেকেন্ড ক্যাটাগরির ব্যক্তিকেই বুঝাই। মেন্টর বলে যে জিনিসটা আছে, সেটা থাকাটা খুব বেশি জরুরি নয়। উপযুক্ত মেন্টর যেমন রহমত স্বরূপ, অনপযুক্ত ও ধান্ধাবাজ বোগাস মেন্টর তেমনি গজব স্বরূপ।
আর, মেন্টরের ক্ষেত্রে আরেকটা সমস্যা রয়েছে। যেমনটা, মাজহাব চর্চার ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ ধরনের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি বা একটা স্কুল অব থটকে মেনে চলার বিষয়টি চলে আসে। কোরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তারা (ইহুদী এবং খ্রীষ্টান ধর্মের অনুসারীরা) আল্লাহর পরিবর্তে পাদ্রী এবং রাব্বীদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে।” তারা যা বলতো তখন মানুষ সেটাই মানতো এবং যেটা তারা নিষেধ করতো, লোকেরা সেটা থেকে বিরত থাকতো। এভাবে কারো ওপর ডগম্যাটিক ফেইথ রাখা বা কাউকে বিনাবাক্যে মেন্টর হিসেবে ফলো করা খুবই রিস্কি ব্যাপার।
তারপরও আমি মনে করি, আ গ্রুপ অব মেন্টরস থাকা ভালো। কিন্তু এককভাবে কোনো মেন্টরের অধীনে থাকা, অথবা যিনি টিচার হবেন তার সবকিছুই ঠিক হতে হবে, এসব জরুরি নয়। বরং আমরা হাদীসের ভাষায় বলতে পারি, জ্ঞান হচ্ছে ঈমানদারের হারানো সম্পদ। যেখানেই সেটা পাওয়া যাবে, সেখান থেকেই সে তা অর্জন করে নেবে।
এ বিষয়ে আমার অনুরূপ কথাবার্তা শুনতে চাইলে ইউটিউবে আমার ‘সামাজিক আন্দোলন‘ চ্যানেল হতে ১৫ মিটিট ৯ সেকেন্ডের এই ভিডিও বক্তব্যটা শুনতে পারেন:
ফেসবুকে প্রদ্ত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Sabuj Kabir: অনেকে ধর্মীয় বিষয়ে আপত্তি করেন যে একক অনুসরণ না করলে মানুষ সেই মতটাই গ্রহণ করবে দলিলগুলি বিবেচনা না করে যেটা তার জন্য সুবিধা। আমি একবার জবাব দিয়েছিলাম– দ্বীন তো আমাদের জন্য সহজ করে দেওয়া হয়েছে বলে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, তাহলে সহজপন্থা অনুসরণ আমার দোষ হবে কেন যদি তা তওহীদের বিপরীত না হয়। আমার উত্তরটা ঠিক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে অবশ্য আমি নিজেও একটু কনফিউজড।
Mohammad Mozammel Hoque: মাযহাবপন্থীদের দাবি হলো প্রত্যেককে একটা বিশেষ মাযহাব মেনে চলতে হবে। আর মাযহাব বিরোধীদের দাবি হলো প্রত্যেকে সরাসরি কোরআন হাদিস থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই দুইটা দাবি প্রান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। অবাস্তব।
বাস্তবতা হলো প্রত্যেককে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করতে হয়। কোনো ব্যক্তি এমন হতে পারে না যিনি সবকিছু জানেন বা জানতে পারেন। একই সাথে কোনো ব্যক্তিকে ইসলাম এটি অনুমোদন করে না যে, সে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কারো কাছে বন্ধক রাখবে।।
আখেরাতের বিচার প্রত্যেকের ব্যক্তিগত জবাবদিহিতার ভিত্তিতেই হবে। সেজন্য যার কাছ থেকে যেটা নেয়ার, যেটা শিখার, সেটা নিতে হবে। কিন্তু দিন শেষে নিজেকেই ঠিক করতে হবে যে সে কী করবে।
ভুল-বুঝাবুঝি না হওয়ার জন্য আবার বলছি, কেউ যখন কোনো বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ মতকে অনুসরণ করে, তখনও সে ন্যূনতম মানে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগায়। যেমন করে মানুষ ভালো ডাক্তারকে বেছে নিয়ে উক্ত নির্ভরযোগ্য ডাক্তারের পরামর্শ চোখ বুজে মেনে চলে।
Iqbal Hossain: Religion is not a matter of materialistic proof. Religious narrations were conveyed orally at the outset. So contradictory narrations exist. How will they be of same opinion? Moreover, a vast majority are very little educated & irrational. So, forming a little group under particular opinion in the name of religion and becoming a group leader is very easy. Human psychology needs to be understood to understand group politics.
ভালো লেগেছে .
সালাম।
একজন পূর্ণতাপ্রাপ্ত বিশুদ্ধ মানব (ইনসানে কামেল) এর চাহিদাটা সম্ভবতঃ মানুষের মাঝে বৈশিষ্ট্যগত। যেকারণেই যুগে যুগে নবী-রাসুলগণের থেকে মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করেছে, নবী-রাসুলগণের অনুসরণ করেছে।
কিন্তু পীর/মুর্শিদ/ওলি-আউলিয়াগণ তো নবী-রাসুল নন। অতএব, তাদের মাইনর ভুল থাকতে পারে, এই চান্স মাথায় রেখে চলা ভালো। আলটিমেটলি সেই পারফেক্ট মেন্টরকেই অনুসরণ করছি, কিন্তু পীর/হুজুরের মাধ্যমে যেহেতু, সেহেতু এই দ্বিতীয় স্তরের ব্যক্তির ভুল-ভ্রান্তির সম্ভাবনাটা মাথায় রেখে চলাই বেটার।
গুরুবাদী সিস্টেমটা খুবই ভালো, সাহাবীগণ সেভাবেই চলতেন, সরাসরি গুরুর কাছে যেতেন।
আমাদেরকে কেবল গুরুর স্তরভেদে তার প্রতি রুজু করার ধরণটা বুঝতে হবে, এই আরকি।