তখন আমি চিটাগাং ক্যানটনমেন্ট স্কুলে পড়ি। সেটি ১৯৭৫, ৭৬, ৭৭, ৭৮-এর দিকে। মাঝে মাঝে পড়ন্ত দুপুরে মাথায় টুকরি (চট্টগ্রামের ভাষায় লাই) নিয়ে নতুনপাড়া সংলগ্ন হাটবাজারে যেতাম। বটতলী, আমানবাজার আর লালিয়ারহাটে। লোকাল উচ্চারণে লাইল্যার হাট। তখনও বালুছড়ায় বাজার বসা শুরু হয়নি।
লাইয়ের মধ্যে থাকতো, ছবিতে যেমনটা দেখছেন, ঠিক এমন কচি কচি লাউ। নিজেদের খাওয়ার জন্য আমাদের বাসার আশপাশে তখন আমরা শাকসবজি করতাম। সাধের লাউ হতো প্রচুর পরিমাণে। তারই উদ্বৃত্ত আমি বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম।
তখন ওই এলাকায় ছিল অনেক ব্রিকফিল্ড। সেখানকার শ্রমিকদের কমন তরকারী ছিল বাংলা কদু তথা সাধের লাউ।
ভাইজানের ছোট আমার ইমিডিয়েট বড় আমাদের মেজ ভাই খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। উনাকে হিসেবে না ধরলে আমরা পাঁচবোন চারভাই। মোট নয়জন।
আমরা কেউ কখনো লজিং থাকি নাই। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে থেকে আমাদেরকে লেখাপড়া করতে হয় নাই। আমাদের ভাইবোনদের কেউ কখনো টিউশনি করায় নাই। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
আমাদের পরিবারে বেহিসেবি খরচ করার কোনো সুযোগ ছিল না। আমার বাবার বেতনের টাকার সাথে যুক্ত হতো আমার মায়ের নানা ধরনের সাপ্লিমেন্টারি উপার্জন। আমরা গরু পালতাম। আমাদের অনেক হাঁস-মুরগী ছিল। আগেই বলেছি, বাসার আশপাশে সব ধরনের শাক-সবজির চাষ হতো।
আমাদের বাসার সামনে ছিল অড়ল (অড়হর, এক ধরনের সীম) গাছ আর খর গাছের (একধরনের টক ফল, লাল রংয়ের ডিজাইন করা) দৃষ্টিনন্দন ঘন ঝোপ। পুরো বাড়িটা ছিল একটা ফার্মহাউজ।
পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত স্টীল মিল ছিল তখনকার সময়ে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় স্টীল মিল। বাবা ছিলেন সেখানকার সিনিয়র স্টোরস অফিসার। অফিসের গাড়িতে তিনি শেষ বিকালে সন্ধ্যার আগে আগে বাজারে নামতেন। ততক্ষণে আমি সব লাউ বিক্রি করে ফেলেছি।
লাউ বিক্রির টাকা আব্বার হাতে দিতাম। আব্বা বাসার জন্য আমাকে বাজার করে দিতেন। যাওয়ার সময়ে কিছু একটা খাওয়ার জন্য দু’চার আনা দিতেন। তা দিয়ে আমি ফুলুডি ইত্যাদি কিছু খেতাম।
বেকারির সদ্যতৈরি তিনকোণা পেটিসও মাঝেমধ্যে খেতাম। মিষ্টি পেটিস ছিল আমার প্রিয়। এখনকার মত ভেজাল তেল দিয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরীর সামাজিক অপসংস্কৃতি তখন ছিল না।
আমানবাজারকে তখন আমরা বলতাম শিকারপুর। সেখানকার বেলা বিস্কুট ছিল সেরা। গণিবেকারির চেয়েও ভাল। অনেক বড় আকারের। দোকানের মধ্যে সাজানো থাকতো কাতি কাতি বিস্কুট। কাতি হলো একপাশে কাঁচ লাগানো অনেক বড় টিনের পাত্র।
বিস্কুট বলতে আপনারা যে কুকিজকে বোঝেন সেগুলোকে আমাদের ছোটবেলায় বলা হতো ‘পাউন্ড বিস্কুট’। বেলা বিস্কুট ছিল গরীবদের জন্য। আর পাউন্ড বিস্কুট ছিল ধনীদের খাওয়ার। মেহমানদের জন্য আমাদের বাসাতে পাউন্ড বিস্কুট রাখা হতো।
আই মাস্ট কনফেস, বাসার জিনিস চুরি করে খেয়ে ফেলায় আমি ছিলাম ওস্তাদ। নাম্বার ওয়ান এক্সপার্ট। একবার ঝুলানো কলার কাঁদি থেকে কলার খোসা ঠিক রেখে একপাশে লম্বালম্বি করে ছুরি/ব্লেড দিয়ে কেটে প্রায় সব কলা কৌশলে বের করে খেয়ে ফেলেছিলাম।
মুরগির তরকারী হতে আমি আর ভাইজান একবার চুরি করে খাওয়ার পরে ধরা পড়ি। হালকা মাইর দিয়ে মা রাগ করে বললেন, ‘নে, তোরা দুজনে মিলে বাকীগুলোও খেয়ে ফেল’। ভাইজান কাঁদতে থাকলেন। আর আমি কান্না থামিয়ে খাওয়া শুরু করেছিলাম। আমি ছিলাম সেই লেভেলের দুষ্টু। চট্টগ্রামের ভাষায় ’লোওদরা’। মানে, এমন ছোট বাচ্চা যে সবসময়ে খাইতে চায় এবং চান্স পাওয়ামাত্রই খেয়ে ফেলে।
এ’রকম লাইভর্তি বাংলা কদু দেখলে ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ে যায়। একদিন গাড়ি থামিয়ে বটতলী বাজারে ফয়সালকে নিয়ে হাটের সেই নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে গিয়েছিলাম। সেখানে তাকে আমার লাউ বিক্রির কাহিনী শুনিয়েছিলাম।
কথা প্রসঙ্গে একদিন চবি অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজারের রুমে উপস্থিত শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললাম,
‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক এসেছে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এখানে এসে তারা এমন ভাব দেখান যেন তারা তিনপুরুষের জমিদার।’
প্রসঙ্গটা মনে নাই। তবে এ’টুকু মনে আছে, ব্যাংকের ম্যানেজার ভদ্রলোক তাৎক্ষণিক বলেছিলেন, ‘স্যার, এ’রকম সত্য কথা সাধারণত শুনি না। আপনার কথাটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট।’
তখন মাসের প্রথম দিন বেতন তোলার জন্য ব্যাংকে চেক দিয়ে কর্মচারী পাঠাতে হতো, অথবা নিজেকেই যেতে হতো। অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম চালু হওয়ায় এখন মাসের এক তারিখে ব্যাংকে আগের মতো টিচারদের ভীড় হয় না। স্যালারির দিন শিক্ষকদেরকে ক্যাশের সামনে দাঁড়াতে হয় না। তখনও সে’রকম ব্যবস্থা চালু ছিল ম্যানেজারের রুমে ম্যানেজার সাহেব কিছু ক্যাশ রাখতেন। সেখান থেকে উপস্থিত শিক্ষকদেরকে পেমেন্ট দিতেন।
এনিওয়ে, আমার দাদা ছিলেন ফুলটাইম কৃষক। বৃটিশ শাসনের শুরুর দিকে সঙ্গত কারণেই মুসলমানরা ছিল বঞ্চিত। কিন্তু শেষের দিকে তারা এর একটা ক্ষতিপূরণ লাভ করে।
আমার বাবা যখন ছোট ছিলেন তখন ম্যাট্রিক পাশ করলেই মুসলমানের ছেলেরা একটা সরকারী চাকরী পেয়ে যেত। আমার বাবা, চাচারা, আমার শ্বশুর, তখনকার সময়ে স্বচ্ছল কৃষক পরিবারের প্রায় সব ছেলেসন্তান ছিল মেট্রিক পাশ।
আমার বাবা সদ্য প্রতিষ্ঠিত কাটিরহাট স্কুল থেকে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে একজন সৈনিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি চিটাগাং স্টীল মিলের সিনিয়র স্টোর্স অফিসার হিসেবে রিটায়ার করেন।
উনি শুধু ছেলেদেরকে ‘মানুষ’ করেছেন এমন নয়। তৎকালীন বিরুদ্ধ পরিবেশেও মেয়েদের প্রত্যেককে তিনি লেখাপড়া করিয়েছেন। প্রত্যেকে তারা পোস্টগ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছেন। কর্মজীবন ও সংসারজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আমার বড় তিন বোন ও বড়ভাই, তারা চারজনই অলরেডি অবসরপ্রাপ্ত। মেয়ের জামাই, ছেলের বউ, নাতি-নাতনী আর বেয়াই-বেয়াইন নিয়ে তারা দিনরাত ব্যস্ত।
যে কথা বলার জন্য এই লেখা এবার সেটায় আসি।
নিজের শেকড়কে অস্বীকার করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নাই। বরং নিজের অতীত স্ট্রাগলকে, নিজেদের অপ্রতিষ্ঠিত আত্মীয়স্বজনকে স্বীকার করে নেয়া হলো আত্মমর্যাদাবোধের দাবী।
নিজের ইনহেরিটেন্সকে কেউ বেছে নিতে পারে না। তাই কেউ সুস্থ আর সুন্দর হয়েছে, সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছে, এতে তার কৃতিত্ব নাই। কেউ ততটা সুস্থ আর সুন্দর হয় নাই, আর্লি লাইফে অনেক কষ্ট করেছে, এতে তার কোনো অসম্মান নাই।
কৃতিত্ব আর সম্মান হলো তা-ই যা কেউ নিজ চেষ্টায় অর্জন করে।
গতকাল ফ্যাকাল্টি হতে ফেরার পথে চবি পোস্ট অফিসের সামনে এই ছবিটা তোলা হয়েছে। আমার পাশে দাঁড়ানো এই তরকারিওয়ালাকে বলেছি, কেন আমি এখানে বসেছি আর এভাবে ছবি তুলছি।
আমাকে এ’ভাবে বসতে দেখে আশপাশের স্টুডেন্টরা কৌতুহলী হয়ে দেখছিল। তাদের প্রতি আমার অনুচ্চারিত কথা ছিল,
‘হ্যাঁ, তোমাদের স্যারও একসময়ে এমন লাউ বিক্রি করেছেন। স্কুল, কলেজ কিম্বা ইউনিভার্সিটি হতে বাড়ি গিয়ে তিনিও মাঝেমধ্যে বাড়ির আশপাশ হতে ঘরের গরুর জন্য ঘাস কেটে আনতেন। ছোটবেলায় শীতের শুরুতে মাঠ হতে নাড়া কেটে এনে বাড়ির আঙ্গিনায় স্তুপ করতেন। খড়ের পাড়া হতে টেনে টেনে খড় বের করে গরুকে খাওয়ার জন্য দিতেন।’
আলহামদুলিল্লাহ, আমার বাবা-মা পরিবার পরিকল্পনা করেননি। দু’একটা বাচ্চা নিয়ে নিজেরা নিজেরা সুখী থাকার চেষ্টা করেননি। যদি করতেন তাহলে তাদের বাচ্চাকাচ্চার সিরিয়াল ১০ নম্বর পর্যন্ত আসা তো দূরের কথা, ৬ নম্বর পর্যন্তও আসতো না।
আমার মা যদি এখনকার অর্থে নারীবাদী হতেন, আমার বাবা যদি এখনকার বাবাদের মতো মেন্দামার্কা হাফলেডিস absentee father হতেন, তাহলে আজ দেশ ও জাতি আমার মতো একজন ছোট বুদ্ধিজীবী (মানে, ছোট পরিসরে পরিচিত বুদ্ধিজীবী) হতে বঞ্চিত হতো।
আমার বাবা-মা সংগ্রামুমখর জীবনকে বেছে নিয়েছিলেন। ম্যানপাওয়ারকে তারা বিগ পাওয়ার মনে করেছিলেন, ছেলেমেয়ের স্ট্যাবলিশমেন্টকে তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ বলে মনে করেছিলেন। এর সুফল জাতি পেয়েছে। আমরা পাচ্ছি। তারাও পেয়েছেন বেশুমার।
আপদমস্তক একটা ভোগবাদী সমাজে তোমরা যারা delayed gratification-এ অনভ্যস্ত, তোমরা যারা নগদ সুখের মোহ ছাড়তে নারাজ, তোমরা শিক্ষিত হবে, মোর অর লেস প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু জমজমাট সংসার না হলে, অনেক বেশি ছেলেমেয়ে না থাকলে, আপনজনদের জন্য সেক্রিফাইস করা, কষ্ট করা, শেয়ারিং-কেয়ারিং ইত্যাদিতে অভ্যস্ত না হলে, আমি বাজি ধরতে পারি, তোমরা শেষ পর্যন্ত সুখী হতে পারবে না।
মানুষের সঙ্গসুখ পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় নেয়ামত। কথাটা মনে রাখো। বিশ্বাস করো। সুখী হবে জীবনে। ভাল থাকো।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Muhammad Tazammol Hoque: সত্যি স্যার! আমি বেত ও নারিকেল বিক্রি করেছি। আমাদেরও দুধের গাভি ছিল। ঘাস ও ফেনা কাটতে হতো। মাঠে রোয়া লাগানো, ঘাস বাছা ও উথার দেয়া, বাড়ির দেয়াল করার সময় যোগালির কাজ অনেক কিছু করতে হয়েছে।
বাবা মাদ্রাসার শিক্ষক। যা বেতন পেতেন আমাদের চার ভাই-বোনকে নিয়ে পারিবারিক আয়-ব্যয়ের মিটিং হতো প্রতি মাসে। আমাদের বাড়ির আশেপাশের জমিনে লাউ, কুমড়া আর আলুর শাক হতো। দাদাও ছিলেন ফাযিল পাশ মুন্সি। তবে কৃষি ও গৃহ (চন/খড়) নির্মাণের কাজে অভিজ্ঞ ছিলেন। দাদার আমলের জমিকে আমরা দাদার জমি বলি।
আমার পরদাদা এবং তার প্রপিতামহ শিক্ষিত ছিলেন। এলাকার বিচার-আচার করতেন।
সবমিলিয়ে আপনার সাথে অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। যেনো আমার কথাই লিখেছেন। আমরা নিজেদের সাধারণ ভাবতে পারলে জাতি উপকৃত হবে। শ্রদ্ধা জানবেন স্যার।
Md. Saiful Islam: আপনার পোস্ট থেকে শিক্ষা নিয়ে আমার ছাত্রছাত্রীদেরকে বললাম- তোমরা যত বড় হওনা কেন, যত বড় পজিশনে যাওনা কেন তোমার অতীত ভুলে যেওনা। অতীতের খারাপ সময়, সংগ্রামের কথা ভুলে যাবে না। ভালো সময়ে সেগুলো আলোচনা করলে তাতে কোনো হীনমন্যতা নেই।
Khoka Mohammad Chowdhury: স্যার খুব ভালো লাগলো, মানুষ এখন মন খুলে কিছু বলেও না, লেখেও না। ব্রেইন ড্রেইন শুনে ছাত্রজীবনে খারাপ লাগতো। নেশন ড্রেইনের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। একটা জাতির সমস্ত ইতিহাস, গৌরব, রীতি নীতি-নৈতিকতা সব ধ্বংসের পথে। যৌথপরিবার প্রথা বিলুপ্তির পথে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এখন সবচেয়ে লাভজনক বাণিজ্যিক পণ্য। সততা ও সরলতা হলো ব্যর্থতা ও দুর্বলতা। রাজনীতি আর সমাজসেবা হল টাকা ছাপানোর মেশিন। প্রজাতন্ত্রের মালিকরা এখন গোলাম।
Abu Hamid Mohammad Ashiqullah: আল্লাহ তা’আলা আপনার শ্রদ্ধেয় আব্বা আম্মার প্রতি রহম করুন। সত্যি তারা দু’আর যোগ্য। সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান পুরুষ ও নারী উভয়ের প্রতি আপনার সাহসী উচ্চারণের সাথে একমত। বিয়ের খুতবায় অধিক সন্তান নেয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস বলি। কাজের বেলায় বেশীরভাগ নাই।
Engr Enam: নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসে উচ্চবিত্তের ভাব নেওয়ার বিষয়টি ছাত্রদের মাঝেও বিরাজমান, বাস্তব ও জীবনধর্মী এমন গল্প বলার সৎ সাহস প্রয়োজন, ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের অংশটা না থাকলে আরো ভালো লাগতো।
Mohammad Mozammel Hoque: তথাকথিত ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিরুদ্ধে বলা আমার জন্মগত অধিকার। কারণ, আমি ফ্যামিলি প্ল্যানিং না করার সুবিধাভোগী। কেউ আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করার জন্যও তাকে মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতে হবে। মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্বই হতো না আমার মা যদি ফ্যামিলি প্লানিংয়ের বড়ি খেতেন।
Mohammed Fourkan: আমার বউকে ম্যানপাওয়ারের কথা বললে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে, যদিও খুব একটা রিয়েক্ট করে না। আসলেই মানুষের সঙ্গটা, বিশেষ করে নিজের মানুষদের সঙ্গটা, অনেক বড় নেয়ামত।
Mohammad Mozammel Hoque: মাতৃত্বের ব্যাপারে মেয়েদের মধ্যে দুইটা কন্ট্রাডিক্টরি বিষয় একসাথে কাজ করে:
১. প্রত্যেক মেয়ে মা হওয়ার কষ্টকে ভয় পায়। তাই মা হওয়ার ব্যাপারে তারা এক ধরনের ইন্ডিসিশনে ভোগে।
২. প্রত্যেক মেয়ের কাছে মাতৃত্ব ও সন্তান হলো সর্বোচ্চ মূল্য (value অর্থে)। The more, the better. Maternal instinct is the strongest instinct to a girl.
Rihad Islam: আপনি বললেন যে, আপনার মা আজকের মতো নারীবাদী হলে দেশ আপনার মতো বুদ্ধিজীবী পেতো না। অনেকের কাছে এই লাইনটা উদ্ভট মনে হবে। তবে এ ব্যাপারে একাত্ম পোষণ করছি। এ পর্যন্ত যত বিপ্লবী, কবি, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী এসেছেন তাদের অধিকাংশই ওই ট্রাডিশনাল পরিবারের সন্তান। হাজার বছর ধরে যেটা চলে এসেছে নারীবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা ভুল! এটাকে তারা শুধু সাংস্কৃতিক প্রভাব বলে কুল সাজে। অথচ যা সহস্র বছর ধরে চলে এসেছে সেটাকে শুধু সাংস্কৃতিক প্রভাব বলার সুযোগ থাকেনা। যাহোক, আপনার জন্য শুভকামনা। আপনার লেখাগুলো আমাদের খোড়াক যোগায়।
Mohammad Mozammel Hoque: আমার মা এখনকার নারীবাদীদের মত হলে উনার ১০জন ছেলেমেয়ে থাকতো না। উনার ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে দুনিয়াতে আমার আসাও হতো না।
Miah Towfique: মোজাম্মেল ভাই এর অনুভূতি সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। যদি কেউ এ থেকে আমরা শিক্ষাটুকু গ্রহণ করতে পারি।
Mohammad Mozammel Hoque: সামাজিক সংস্কৃতি অত্যন্ত শক্তিশালী জিনিস। মানুষ কোনোকিছুকে সঠিক মনে করলেই সেটা করে বা করতে পারে, ব্যাপারটা এমন নয়। সামাজিক প্রচলন তথা সংস্কৃতি যদি হয় বিপরীত, তখন ইচ্ছা করা সত্ত্বেও বা সঠিক মনে করা সত্ত্বেও কোনো একটা কাজ মানুষের করা হয়ে উঠে না। কারণ খুব কম লোকেরা স্রোতের বিপরীতে চলার হিম্মত রাখে। অধিকাংশ মানুষ ট্রেন্ড ফলো করে। ট্রেন্ডসেটার হয় খুব কম সংখ্যক মানুষ। তৌফিক ভাই, আশা করি বুঝতে পেরেছেন, হোয়াট আই ওয়ান্টেড টু মিন।
Umme Salma Jahan: আসসালামু আলাইকুম। স্যার, আমরাও ৫ বোন, ৪ ভাই। আমার বাবা পঞ্চম শ্রেণী পাস, আর মা-ও সেইম। আমার বাবা মানুষের বেকারিতে চাকরি করতো, মানুষের বাড়িতে কাজ করেছিল। এরপর বাবা নিজেই বেকারি দিয়েছিল। ৪৫ বছর নিজের বেকারি প্রতিষ্ঠান চালিয়েছিল। আমার বাবার কোনো অর্থ সম্পত্তি ছিল না, থাকার ঘর ছাড়া। আলহামদুলিল্লাহ আমরা প্রত্যেক ভাই-বোন-ই প্রতিষ্ঠিত, আর বাবা-মা রত্নগর্ভা। আপনার প্রত্যেক কথায় কেমন জানি নিজেদের উপলব্ধি করেছি। বাবার বেকারির চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে। আপনার কথাই ঠিক। পরিবারের সদস্য ছাড়া, সঙ্গ ছাড়া, সামষ্টিক সম্পর্ক ছাড়া, সুখ কখনো আসেনা। দিনশেষে পরিবার-পরিজনের সঙ্গ আর সম্পর্কই শ্রেষ্ঠ আর ভালোবাসাপূর্ণ।
Jabed Iqbal Chowdhury: মধ্যবিত্ত পরিবারের অতীত পারিবারিক ব্যবস্থাপনা তুলে ধরেছেন, যা আলাদা বিশেষ কিছু না। কিন্তু সমাজের মূল্যাবোধ, মূল্যায়নের মাপকাঠি সময়ের আবর্তনে ক্ষয়িঞ্চুরূপে এ স্বাভাবিক প্রকাশটা অতি অপ্রতুল। তথাকথিত আধুনিকতার অহংকার, অধিকাংশ মানব প্রাণ নিজেকে আভিজাত্যের খোলশাবৃত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, স্বীয় অতীত লুকানোর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়েছে। এটি আপনার লেখনি, যা আমার প্রথম পাঠ করা। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করছি! আপনার দীর্ঘায়ূ কামনা করছি, জীবন থেকে নেওয়া আরো লেখা পাঠ করব বলে আশা রাখছি।
Daud Khan Mahfuz: মাশাল্লাহ। বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে আমরা কতটা আহাম্মক হলে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করতে চাই। ভাব নিতে চাই যে আমার পুর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন। মুলত আমাদের (যারা ষাটোর্ধ্ব) চার পুরুষ আগেও আমরা ছিলাম একেবারেই খাঁটি চাষা বা কৃষক পরিবারের সন্তান। কিন্তু সেই পরিচয় দিতে আমরা লজ্জা বোধ করি। শার্টের হাতার নীচে ঘা লুকিয়ে রাখার মতো করেই আত্মপরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাই। ধন্যবাদ আপনাকে নির্মোহভাবে নিজেকে চিত্রায়িত করার জন্য। শুভকামনা অবিরাম।
Golam Azam: অনেক সুন্দর লাগলো আপনার কথাগুলো শুনে। ছোটবেলায় আপনার মতই আমার বেড়ে ওঠা। দুয়েকদিন ক্ষেতের বেগুন নিয়ে স্থানীয় হাটেও গিয়েছি। আমার দাদার বড় পরিবারে বড় হয়েছি। নিজেরাও ৭ ভাই-বোন। তো, জীবনে মোটামুটি প্রথম শ্রেনীর চাকরী দিয়েই শুরুটা, সাথীও নির্বাচন করেছি একজন উচ্চশিক্ষিত দেখেই, তবুও ভয় ছিল, তাই ২ জনেই থেমে গেলাম। অনেক ছেলেমেয়ে থেকে দূরে থেকেছি! বিয়ের পর স্ত্রীও চাকুরীজীবি, কিন্তু আজ আফসোস! কেন ৮/১০জন ছেলেমেয়ের জনক-জননী হলাম না! আশপাশে এখন কেউ নেই, সব বয়সের ছেলেমেয়ে যদি থাকতো, মনে হয় এই বয়সে জীবনটা উপভোগ্য হতো! এখন বলতে গেলে নি:সঙ্গ! কারো ডাকাডাকি নেই! পরিবার সীমিত রাখার ফল এখন ভোগ করছি!
এস এম আজম: স্যার, সালাম নিবেন। কোনো এক সূত্র হতে প্রায় বছরখানেক ধরে আমি আপনার ফ্যান এবং আপনার পোস্টের নিয়মিত পাঠক।
আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত (পরীক্ষা চলমান)। আমি এখনো জীবনে কিছুই হতে পারিনি, জীবন কেবল শুরু করেছি বোধ করি…। তবে আপনার ছাত্রকালীন জীবনের সাথে আমাদের চার ভাইয়ের জীবনের মিল পাওয়া যায়। তাই কমেন্টটা করা।
আমার দাদা এলাকার একজন উল্লেখযোগ্য কৃষক ছিলেন (২০২২ সালে প্রয়াত হন)। আমার আব্বা হচ্ছেন দাদার একমাত্র ছেলে সন্তান। তিনি ১৯৮৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ, শিক্ষকতাও করেছেন কিছুকাল। আমার মা একজন প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা। এখন বুঝি হয়তো তখন আব্বা জীবনের বাস্তবতা বুঝানোর জন্য মাঠে কাজ করতে আমাদের তিন ভাইকেই নিয়ে যেতেন (ছোট ভাইটা তখন অনেক ছোট)। বিকেলে মাঠে গরু চড়ানো, আব্বার সাথে জমিতে মই দেওয়া, জমিতে ধান লাগানোসহ সমস্ত কৃষি কাজ। আমি ২০০৮/১০/১২ সালের আগের কথা বলছি তখন প্রতি বছর একটা গাভী বাছুর জন্মাতো। তখন প্রতিদিন বিকেলে স্কুল থেকে এসেই গরুর জন্য ঘাস কাটতে যেতাম। এখনো ক্যাম্পাস ছুটিতে বাড়িতে গেলে আব্বার সাথে সমস্ত কৃষি কাজই করি। এসব কাজ করে বাড়তি একটা আনন্দ পাই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেকেই এ কাজগুলোকে অবজ্ঞার সুরে দেখে। আর অনেকেই এ কাজগুলো করলেও স্বীকার করতে লজ্জা বোধ করে। ধন্যবাদ স্যার, আপনার পোস্ট পড়ে অনেক অনুপ্রাণিত হলাম।
Md Raihan Uddin Shimul: স্যার, আমিও সবজি বিক্রেতা ছিলাম। গ্রামের বাড়িতে গেলে এখনো কাদায় নেমে ধান চাষের সমস্ত অ্যাক্টিভিটিজে অংশগ্রহণ করি। গত কয়েক বছর আগেও আম্মু আমাকে বাজারে পাঠিয়েছেন শাক বিক্রি করার জন্য। উল্লেখ্য, আমি বর্তমানে আপনার ডিপার্টমেন্টের ৩য় বর্ষের ছাত্র।
Mizanur Rahman: স্যার, আপনার লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো এই ভেবে যে আপনার মধ্যে শিকড়ের প্রতি যে অকৃত্রিম ভালোবাসা রয়েছে তা নির্মোহ চিত্তে উদারভাবে তুলে ধরেছেন। শিখরে উঠতে গিয়ে শেকড়কে অস্বীকার করে নয়, বরং শেকড়ের অন্বেষণে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে পাঁজরের হাড়ের সাথে তাকে আঁকড়ে রাখতে হবে। সুখের অন্বেষণে পরিবার ছোট রেখে সুখ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হতে অনেককে দেখেছি কিন্তু সুখ নামের সোনার হরিণ অধরাই রয়ে গেছে। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি, দেখেছি কত আদর-স্নেহ-ভালোবাসা।
আজ সুখের পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে হয়রান হয়ে অনেককে দেখেছি শেকড়ের সাথে সম্পর্কহীন। আমরা আজ চরম মানসিক অস্থিরতা নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমাদের পারিবারিক বন্ধন দিনকে দিন আলগা হয়ে যাচ্ছে। কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে, সবাইকে এড়িয়ে চলতে চায়। মানসিক দৈন্য আমাদেরকে অমানবিক করে ফেলছে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী তৈরি করে যাচ্ছি! নিজেকে আজ চরম অপরাধী মনে হয়।
প্রলয়রূপী সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আর উপরে ওঠার চরম প্রতিযোগিতা আমাদের বিবেককে জরাগ্রস্ত করে ফেলছে। আরো চাই -আরো চাই, আমার কেন আরো নাই, এ নির্লজ্জ মানসিকতা পরিহার করতে না পারলে আমরা আরো অতলে হারিয়ে যাব। আপনার মতো লেখায় আমি দক্ষ নই, তারপরও মনের পুঞ্জীভূত ব্যথা সামান্য প্রকাশ করতে পারলাম এই যা শান্তি। ভালো থাকবেন স্যার, দোয়া করি। আল্লাহ হাফেজ। রাত-৯:৪৫, ১৮/০১/২০২৪, ঢাকা।
Kohinoor Begum: ধন্যবাদ, আমাদেরও গল্প আছে, শ্রমের কষ্ট আছে, ৭১-এ স্কুল শেষ, বর্ডারের দিকে ভাই-বোনদের কোলে-কাঁধে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি আছে, বনবাদাড়ে স্টেন নিয়ে মুষল বৃষ্টিতে ভিজে রাত খরচের কাহিনী আছে, পায়ের পাতায় ১০১ টা জোঁক লাগার ভিমরি ভয়ের কারণ আছে, শহিদ ভাই-মামাদের লাশ না পাওয়ার বেদনা আছে, উপোস করার অভিজ্ঞতা আছে। দেশের প্রতি মায়া আছে।
Mohammad Mozammel Hoque: আহা জীবন! কত কষ্ট, সংগ্রাম আর বেদনার! মজার ব্যাপার হলো, যখন আমরা অতীতের দিকে ফিরে তাকাই তখন কষ্টগুলোও কেমন যেন মধুর হয়ে যায়। আমার ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। আপনার ক্ষেত্রে কেমন তা জানি না।
Nishat Akter: আমার বাবা যদি এখনকার বাবাদের মতো মেন্দামার্কা হাফলেডিস absentee father হতেন তাহলে আজ দেশ ও জাতি আমার মতো একজন ছোট বুদ্ধিজীবী (মানে, ছোট পরিসরে পরিচিত বুদ্ধিজীবী) হতে বঞ্চিত হতো। — এই লাইনটা ভালো লেগেছে বেশি।
Mohammad Mozammel Hoque: পুরুষকে পুরুষসুলভ শক্ত ভুমিকায় এবং নারীকে নারীসুলভ শক্তিশালী ভূমিকায় থাকতে হয়। এভাবে একটা পরিবার সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে। ট্রেডিশনাল জেন্ডার রোলকে ডিফাই করে কোনো ফ্যামিলি সাকসেসফুল হতে পারে না, বিশেষ করে কোনো নারী একজন মা হিসেবে সুখী হতে পারে না। নারীবাদীদের পরাজয় ঠিক এখানেই।
Ifratul Alam Pitu: স্যার, আপনি যে শিবিরের দালাল সেটা একটু লিখতেন।
Mohammad Mozammel Hoque: আমি শিবির করতাম। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থক ছিলাম, কর্মী ছিলাম। এক পর্যায়ে সদস্য হয়েছি এবং প্রায় চার বছর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
শিক্ষক হিসেবে ১৯৯৪ সালে কর্মজীবন শুরুর দিকে বিএনপি-জামাতের যে শিক্ষক ফোরাম ‘সাদা দল’, সেটার স্টিয়ারিং কমিটির মেম্বার ছিলাম। ২০১০ সালের দিকে আমি প্রকাশ্যে জামাত ত্যাগ করেছি।
কেন আমি জামাত ত্যাগ করেছি, সেটা নিয়ে আমার বই আছে। ভিডিও বক্তব্য আছে। বর্তমানে ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (সিএসসিএস) নামাক আমার এই প্লাটফর্মে কাজ করি। These all are facts, and I don’t regret my past. I never personally did any crime. So, my dear, আমি শিবির বা কারো দালালি করতে যাব কেন?
আমি কারো দালালি করি না। Instead, I like to speak my mind and perform according to my conscience.