এই প্রথম অনুভব করলাম এই পৃথিবীতে আমি একা। নিজেকে এতটা নিঃসঙ্গ আর কখনো অনুভব করিনি। মনে হচ্ছে আমার একান্ত যে ব্যক্তি সত্তা, তা সবার কাছে পরিত্যক্ত অথবা অজ্ঞাত। প্রত্যেকে আমার কাছ থেকে চায়, সুনির্দিষ্ট বিশেষ কিছু, যা তাদের দরকার, তাদের ধারণায়, যা আমি দিতে পারি, যা দিয়েছি অলরেডি, অথবা যা আমার দেয়া উচিত।

না চাইতেই অযাচিতভাবে কেউ বলেনি আমাকে, ‘ভালোবাসি! তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। তুমি আমার প্রিয়তম।’

ভালোবাসা নিবেদন করেছি যে ক’জনকে, একে একে, প্রত্যেকে ভেবেছে, ভালোবাসা পাওয়াটা তাদের নিতান্ত অধিকার। তারা তো চেয়ে নেই নাই আমার কাছ থেকে ভালোবাসার প্রস্তাব। অযাচিতভাবে আমি নিবেদন করেছি ভালোবাসা। তাতে তারা হয়েছে পুলকিত, মুগ্ধ। এর বিপরীতে, দেখলাম, আমার জন্যে সত্যিকারের ভালোবাসা গড়ে ওঠেনি তাদের হৃদয়ে।

সত্যিকারের ভালোবাসা যদি গড়ে ওঠে কারো হৃদয়ে কখনো কারো জন্যে, থাকবে না তার লোকলজ্জার ভয়, থাকবে না কোনো অসুবিধার কথা মনে। ভালোবাসা বেড়ে ওঠে গোপনে, অজান্তে। প্রকাশিত হয় অনিবার্য হিসেবে। যেমন করে নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠে ভ্রুণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে, হয়ে ওঠে একটা মানব শিশু। এরপর বের হয়ে পড়ে যথাসময়ে বিনা অনুমতিতে। সুচিৎকারে জানিয়ে দেয় নিজের উপস্থিতি।

ভালোবাসা যদি হয় সত্যিকারের, সেটি প্রকাশ হয়ে পড়বেই। সত্যিকারের ভালোবাসা গোপন করে রাখা যায় না। বাদ দিয়ে দেয়া যায়, অনায়াসে অস্বীকার করা যায়, সম্পর্ক না রাখার দুনিয়ার সব অজুহাত জরুরী হিসেবে হাজির করা যায়, এমন সম্পর্কে যে সম্পর্ক ছিল মূলত সময় কাটানোর বিকল্প উপায়। গোপন করা যায় সহজাত আকর্ষণ, মুগ্ধতা কিংবা নৈমিত্তিক ভালোলাগা। যাদেরকে বলেছি ভালোবাসার কথা অযাচিতভাবে, কখনো তারা ভাবেনি, তাদেরও আছে বা থাকতে পারে ভালোবাসার দায়। সামাজিক সম্পর্কের বাইরে এসে কখনো তারা দাঁড়ায়নি আমার পাশে। অন্তর্গত আবেগে বলেনি কখনো, ‘ভালোবাসি তোমাকে! পাশে আছি সুখে-দুখে, জীবনের পথ চলায়।’

ভালোবাসার প্রতিদানে ভালোবাসা আশা করা যায়, দাবি করা যায় না। সে আমি জানি। তবুও এই নিঃসঙ্গ রাতের নির্ঘুম প্রহরে মনে মনে কাকে যেন খুঁজে ফিরছি আমি ব্যাকুল হৃদয়ে। কোনো এক অজানা ক্ষণে কে যেন হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। কে যেন ছিল, কোনো না জানা ভুলে, কীভাবে কখন যেন সে হারিয়ে গেছে। কোথায়, জানি না। অথবা, আমার এই যে ভাবনা, কেউ যেন ছিল, এটাই হয়তোবা আমার গোড়ার ভুল। কিছুই বুঝতে পারছি না, নিশ্চিতভাবে।

২.

বাবা মাকে হারিয়েছি অনেক আগে। আছে স্ত্রী-পরিজন, ভাইবোন, আত্মীয়-স্বজন। আছে শুভানুধ্যায়ী কত সমর্থক আপনজন। নানাভাবে তারা আমার কাছের মানুষ। মনের মানুষ কেউ নেই। মন খুলে বলা যায় কথা; লুকিয়ে রাখা ব্যথা, অব্যক্ত অভিমান, কীভাবে যেন সে সহসাই বুঝে যায়; এমন কেউ নেই আমার জীবনে। আমাকে শাসন করবে, আমাকে পরাজিত করবে স্নেহ মায়া মমতার নিবিড় স্পর্শ দিয়ে, ভালোবাসার উত্তাপ দিয়ে জড়িয়ে নিবে আমাকে আমার বিপন্ন সময়ে, যার ব্যক্তিগত উপস্থিতি আচ্ছন্ন করে রাখবে আমাকে জীবনের এই সংগ্রাম মুখর ময়দানে, এমন কেউ নেই।

আমি একা। নিঃসঙ্গ। জনারণ্যে এক নিভৃতচারী।

একাকিত্বের এই যন্ত্রণা, আমার সবচেয়ে বড় কষ্টের। আমার মননের গঠন এমন, আমার চাই আবেগের এক নির্ভুল ঠিকানা। আমি চাই এমন বন্ধুজন, যার কাছে আমার করতে হয় না কিছু গোপন। চাই আমার আবেগের সঙ্গী হবে এমন একজন যার কাছে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায়; দিনে এবং রাতে আমি হতে পারবো নিঃসঙ্কোচ, অকপট, নির্ভার, নিশ্চিন্ত, নিরাপদ।

এমন বন্ধুজন ভেবেছি যাদের, তারা দেখি, ওই যে বললাম, আমার গুণের সমঝদার, আমার কন্ট্রিবিউশনের সাবস্ক্রাইবার। তারা আমার অকৃত্রিম শুভাকাঙক্ষী। আমার ব্যক্তিগত আবেগের বোঝা বইবার ইচ্ছা বা সামর্থ্য তাদের নাই। আমার খুব কাছের মানুষেরা আমার অনিরুদ্ধ এই বিপুল আবেগের কারণে, ধারনা করি, তারা আমার ওপর অনেক বিরক্ত। আমার সর্বংসহা একান্তজন হওয়ার ইচ্ছে তাদের নাই। সেটাই বরং স্বাভাবিক। আমার এই নিঃসঙ্গবোধের জন্যে তাই আসলে আমি নিজেই দায়ী। এমন উদ্বায়ী মন, এত আবেগ, এতটা নির্ভরশীলতা, এতকিছুর ভার কেউ বইবে অকারণে, এমনটি আশা করাটাই ভুল।

যদি হিসেবি হতে পারতাম, যদি পারতাম সংযমী হতে, যদি আত্মসংবরণ করতে পারতাম খানিকটা, যদি পারতাম আগেভাগে একতরফা আবেগ প্রকাশের নির্বুদ্ধিতা হতে নিজেকে বাঁচাতে, যদি পারতাম কিছুটা চৌকষ কৌশলী হতে, তাহলে হয়তোবা আমাকে বরণ করতে হত না এমন শোচনীয় পরিণতি।

৩.

জগত সংসারের হে প্রভু, অন্তরের পরিবর্তনকারী হে প্রভু, সময়ের পরিবর্তনকারী হে প্রভু, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অধিপতি হে প্রভু, এমন শক্তি দাও মনে, এমন প্রেরণা দাও হৃদয়ে, যাতে করে ঘুরে দাঁড়াতে পারি জীবনে। যাতে করে তোমাকে পেতে পারি একান্ত আপন বন্ধুজন হিসেবে। তুমি আমার সর্বসহায়। তুমি ছাড়া নাই কোনো উপায়। তোমার ভালোবাসা ছাড়া জীবন আমার অসম্ভব, অর্থহীন। তাই, চাই তোমার ভালোবাসায় সমর্পিত হতে।

শুধু এই প্রার্থনা করি, হে প্রভু দয়াময়, তুমি কবুল করো আমাকে। দাও তোমার অকৃপণ ভালোবাসা। দাও দৃঢ়চিত্ত হওয়ার অফুরান শক্তি। তুমি ছাড়া কেউ নেই আমার। তুমি ছাড়া আমি অসহায়, নগণ্য, দুর্বল। তোমার ভালবাসায় যেন সদা থাকি উজ্জীবিত প্রবল। হে খোদা দয়াময়, আমাকে দাও সঙ্গ সুখের রহমত। যদি চাও আমি কষ্ট পাই এমনি করে, তাহলে দাও ধৈর্য অপরিসীম। যেন হতে পারি পর্বতের মতো বিপুল, পাথরের মতো কঠিন, কাঁচের মতো স্বচ্ছ। জানি না, কীভাবে কী চাইতে হবে তোমার কাছে।

হে প্রভু, কেন তুমি দিয়েছো জীবন, সে তুমি ভালো জানো। কেন তুমি দিয়েছো এত জ্ঞান-বুদ্ধি, এত অভিজ্ঞতা, বুঝবার এত ক্ষমতা, কেন তুমি দিয়েছো এত আবেগ, দিয়েছো সুস্থ নিরোগ শরীর, এতকিছু কেন একসাথে, সে তুমি ভালো জানো। আজিকে এই নিশীথ কালে, এই বন্ধুহীন সময়ে জানাই তোমাকে আমার মনের আকুতি। ভুলিয়ে দাও প্রভু নিঃসঙ্গতার এই যন্ত্রণা। হে প্রভু পরওয়ারদিগার, মুছে দাও আমার মনের সব বেদনা।

৪.

চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে পরম মমতায় আমাকে সান্তনা দিবে, থাকবে পাশে নিরাপদ আশ্রয় হয়ে, এমন কোনো মানুষ যেন আমি খুঁজে পাই জীবনের অবশিষ্ট সময়ে। এইটুকু শুধু চাই। হোক সে নারী কিংবা পুরুষ, আত্মীয় কিবা অনাত্মীয়, পরিচিত অথবা নতুন কেউ। শুধু চাই কারো অপরিসীম ভালোবাসার মানুষ হয়ে থাকতে। শুধু চাই কারো পরম বন্ধু হয়ে থাকতে। যেন আশ্রয় পাই কারো কাছে অবারিতভাবে। থাকুক সে আমার কাছে কিংবা দূরে।

Similar Posts

One Comment

  1. লেখাটা পড়ে আমি confused। আমার বয়স হয়তো আপনার অর্ধেকেরও কম, কিন্তু confusion এর জায়গা হচ্ছে, আমি কি একজন বড় মানুষের মতো চিন্তা করছি না কি আপনি ছোট মানুষের মতো চিন্তা করছেন??!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *