আস্তিকতা-নাস্তিকতা বিষয়ে একটা লেখায় এক অবুঝ পাঠক মন্তব্য করেছেন, “কার্যকারণ তত্ত্বের আলোচনা সমালোচনায় আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছেন সে আলোচনা আসবেই, সেটারও খণ্ডন করে মাস্টারদের বুঝাতে হবে। আল্লাহ একেবারেই দর্শনযোগ্য নয়, কিংবা তিনি নিরাকার হয়েও আকার ধারণ করতে পারবেন না– এমন ধারণা ধর্ম কিংবা সব দার্শনিকরা বলেন?”
এ ধরনের বেবুঝ কথাবার্তা কতটা অযৌক্তিক তা একটুখানি খতিয়ে দেখা যাক।
কার্যকারণ তত্ত্ব হলো জগতের বস্তুসমূহের পারস্পরিক অগ্র-পশ্চাত সম্পর্কের তত্ত্ব। আল্লাহকে এ জগতের ঊর্ধ্বে জগতের কারণ হিসাবে কেউ মানবে কিনা, সেটি যার যার নিজস্ব বিবেচনা। মানেন বা না মানেন, ঈশ্বরতত্ত্বের প্রস্তাবনা এসেছে কার্যকারণের অন্তহীন ধারাবাহিকতা সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর হিসাবে।
কারণের অসীমতাকে স্বীকার করলেও ‘অসীমতা’র ধারণা চলে আসে। স্বয়ম্ভূ অর্থে অসীমতা যেহেতু একমাত্র ঈশ্বরেরই বৈশিষ্ট্য, সে অর্থে কারণের অসীমতা দিয়েও ঈশ্বরের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
আবার কারণের অসীমতাকে রোধ করতে চাইলে, এই অনিবার্য কারণ-শৃংখলের বাইরে কোনো স্বাধীন সত্তাকে স্বীকার করতে হয়, যিনি কার্যকারণের এই বিপুল ধারাবাহিকতার সূচনা ও পরিচালনাকারী।
সেক্ষেত্রে সসীম জগতের কারণ হিসাবে এক অসীম সত্তাকে অনুমান করা হয় ধর্মতত্ত্বে যাকে ঈশ্বর বলা হয়।
প্রশ্ন হলো, কার্যকারণের এই অনিবার্যতার সম্পর্ক জগত বনাম ঈশ্বরের উপরও প্রযোজ্য হবে কিনা?
না। কার্যকারণের অনিবার্যতার সম্পর্ক জগত ও ঈশ্বরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
কেননা,
কার্যকারণের অনিবার্যতার প্রমাণ আমরা পাই বস্তুগত অভিজ্ঞতায়। বস্তুগত অভিজ্ঞতায় তথা demonstratively আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ পাই না। যা পাই তা বড়জোর তাঁর অস্তিত্বের নিদর্শন বা hints or clue, not proof।
জগতের এই দৃশ্যমান অনিবার্য কারণ-সম্পর্কের ব্যাখ্যা হলো গড-হাইপোথিসিস।
গড হাইপোথিসিস অনুসারে গড হলেন জগতের অতিবর্তী সত্তা, যার সম্পর্কে আমরা শুধু এতটুকুন জানতে পারি, তিনি আছেন। এবং আমরা তাঁর সেইসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেই জানতে পারি যেগুলো জগতের দিক থেকে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব। এর বাইরে তাঁর সত্তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকার সুযোগ কারো নাই। তত্ত্বগতভাবে (ontologically) এটুকু আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি।
যেভাবে আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, কোনো জগতেই একটি বর্গক্ষেত্র একইসাথে বৃত্তাকার হবে না। একইভাবে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, বিবাহিত ব্যাচেলরের ধারণা স্ববিরোধী ও অসম্ভব। কোনো সম্ভাব্য জগতেও এমনটা হতে পারে না। কারণ, সংজ্ঞানুসারেই তা অসম্ভব।
যেভাবে অসম্ভব, ঈশ্বরের আত্মহত্যা করা।
বস্তুগত ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য বিজ্ঞানের falsificationism থিওরি প্রয়োগের সুযোগ না থাকলেও যুক্তি দিয়ে আমরা কিছু কিছু বিষয় নিশ্চিতভাবেই জানতে পারি। ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি মানুষকে এ রকম একটা বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে খাতির করেছে। কথাটা যেভাবে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই বলেন না কেন, সব দিক থেকে তা সমভাবে সত্য।
কিছু কিছু বেবুঝ আস্তিক নানা ধরনের বালখিল্যসুলভ (adolescent) হাস্যকর যুক্তি দিয়ে খোদার অস্তিত্বের ‘প্রমাণ’ দিতে চান। আমাদের ছাত্রজীবনে এ রকম একটা বই দেখেছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে, নামটা ছিলো ‘চল্লিশজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ’।
বিজ্ঞান দিয়ে দর্শনের কিছু প্রমাণ বা খণ্ডন করতে চাওয়ার উপমা হলো কেক কাটার ছুরি দিয়ে পানি বা বাতাস কেটে ভাগ করার মতো পণ্ডশ্রম তথা ক্যাটাগরি মিসটেক।
বিজ্ঞানবাদীরা বিজ্ঞান বনাম ধর্মের একটা false binary নিয়ে আসেন। বিজ্ঞান আর ধর্মের মাঝখানে যে দর্শনের বিশাল ক্ষেত্র রয়ে গেছে তা তারা স্বীকার করতে চান না। ধর্ম আর দর্শন বিজ্ঞানের তথ্য ও উপাত্তগুলোকে ব্যবহার করে স্ব স্ব ফিল্ডের নিয়মানুসারে থিওরি ডেভেলপ করে। প্রশ্ন হলো, আপনি ততটুকু গভীরে যেতে চান কিনা?
সে অন্য প্রসংগ।
বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে প্রমাণ করতে উদগ্র এসব ‘মোখলেছুর রহমান’দের মতো মানুষেরাই সাধারণ জনগণকে ‘হেদায়েতের পথে’ আনার জন্য এক সময় হাদীসও (ফযিলতের হাদীস) জাল করেছেন। ওয়াজ করতে গিয়ে হুজুরেরা কত রকমের যে বোম্বাস্টিক কথাবার্তা বলেন, কত ভয়াবহ রকমের অশ্লীল গল্প যে ফাঁদেন, তা তো আমরা দিনরাত দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি।
খোদা সর্বশক্তিমান, এটি প্রমাণ করতেও তারা একই ধরনের যুক্তিগত বিভ্রাটের আশ্রয় নেন। আমি নিশ্চিত তারা omnipotent paradox argument সম্পর্কে অবগত নন। অমনিপোটেন্ট প্যারাডক্স আর্গুমেন্ট একটা আস্তিকতাবিরোধী যুক্তি।
শুরুতে উদ্ধৃত এক পাঠকমন্তব্যের দ্বিতীয় অংশে দেখতে পাচ্ছি, উক্ত পাঠক এই অমনিপোটেন্ট প্যারাডক্স আর্গুমেন্টের ফাঁদে পড়েছেন।
পরবর্তী আলোচনা: অমনিপোটেন্ট প্যারাডক্স আর্গুমেন্ট।