কোনো না কোনো প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস হলো স্রষ্টার উপর বিশ্বাসের অনিবার্য পরিণতি।

বিশ্ব জগতের একজন স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তাকে যারা মানেন, তারা কখনো কখনো নবী-রাসূলদের মানতে চান না। তারা বলেন, “আমি প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস করি না। কিন্তু বিশ্বাস করি, এ বিশ্ব জগতের একজন স্রষ্টা আছেন এবং তিনি এ জগতকে সুচারুরূপে পরিচালনা করছেন।”

প্রশ্ন হলো, একজন স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন, তিনি যদি এ বিশ্বজগতকে সৃষ্টি এবং সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে তিনি আমাদের জীবন, সমাজ আর আমাদের সাথে জগতের সম্পর্কের মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো নিয়ম-কানুন দিবেন না, তা কী করে হতে পারে?

আমার শরীর যেহেতু প্রকৃতির নিয়মে চলে, আমার জীবন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ অথচ ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতেও তো প্রকৃতিসম্মত নিয়ম-কানুন-বিধি বা জীবনপদ্ধতি থাকার কথা। এ জন্যই দেখা যায়, মানব রচিত সব আইনের ভিত্তি হলো প্রকৃতির রাজ্য বা প্রাকৃতিক আইন।

আমরা জানি, প্রকৃতির নিয়মগুলো বস্তুগত ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হলেও ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য প্রাকৃতিক নিয়মগুলো সে রকম প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর হয় না। বরং আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ দিয়ে প্রকৃতিসঙ্গত নিয়মগুলোকে আমাদের বাছাই করে নিতে হয়। ইচ্ছার স্বাধীনতা হলো সেই জিনিস, যা প্রাকৃতিক আইন এবং সামাজিক আইনের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে। আবার এই ইচ্ছার স্বাধীনতা বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমেই প্রাকৃতিক আইনের সাথে মানুষ নিজেদের সামাজিক আইনের সামঞ্জস্য বিধান করে থাকে।

ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে আমরা প্রকৃতির যেসব নিয়ম বাস্তবায়ন করবো, সেগুলোকে বাছাই করে নেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে সৃষ্টিকর্তা কি বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে তাঁর বাণীবাহক হিসাবে মনোনীত করেছেন? মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাঁর বাণীবাহক হিসাবে নিজেকে পয়গম্বর দাবিকারী ব্যক্তিটি আসলেই ঐশীবাণী বা প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন কিনা, তা আমরা কীভাবে বুঝবো?

কেউ সত্যিকারের নবী বা রাসূল কি না তা বুঝার পদ্ধতি হচ্ছে সেই ব্যক্তিটির বক্তব্য আমার বিবেকের কাছে সত্য ও সঠিক মনে হচ্ছে কিনা, সেইটা যাচাই করা। আল্লাহর রাসূল হিসাবে নিজেকে দাবি করা লোকটি যেসব কথাবার্তা বলে থাকেন, সেগুলোর বিষয়বস্তু, তার ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, সততা, বুদ্ধিমত্তা, মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতাকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনায় নিলে আমরা বুঝতে পারি, তিনি সত্যিই আল্লাহর রাসূল কি-না।

এ কাজে গাইডিং প্রিন্সিপাল হচ্ছে আমাদের যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেক। অর্থাৎ আমাদের যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেক যদি আমাদের এ কথা বলে, প্রথমত: বিশ্বের একজন সৃষ্টিকর্তা থাকাই যুক্তিসংগত; দ্বিতীয়ত: একজন সৃষ্টিকর্তা যদি থেকেই থাকেন তাহলে তিনি খুব সম্ভবত আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্যও কিছু করণীয়, নীতি, নির্দেশনা ও নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করে থাকবেন; এবং তৃতীয়ত: এক্ষেত্রে সেইসব নিয়মকানুনের যৌক্তিকতা আমরা নিজেদের স্বচ্ছ বিবেক, কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারার কথা।

বিশ্বাসীদের, বিশেষ করে যারা ধর্মবিশ্বাসী তাদের ব্যাপারটা হচ্ছে, তারা নিজেদের কাণ্ডজ্ঞান ও যুক্তিবুদ্ধির ওপর এককভাবে নির্ভর না করে এর সাথে নবী-রাসূলদের বাণী ও ঐশী নির্দেশনাগুলোকে সমন্বয় করেন। এর মাধ্যমে একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি পরিপূর্ণ হেদায়েত বা পথনির্দেশনা পেয়ে থাকেন। তাই, বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে নবী-রাসূলগণ হলেন আমাদের ব্যক্তিগত যুক্তি-বুদ্ধির সমন্বিত মূর্তপ্রতীক। অথবা, বলা যায়, তারা হলেন আমাদের সামাজিক ও সামষ্টিক র‍্যাশনালিটির এমবডিমেন্ট বা মূর্তপ্রতীক।

যারা মনে করে, মানুষ একা একা তার জীবন চলার পথ এবং সঠিক নির্দেশনা লাভ করতে সক্ষম, তারা আসলে ভুল করছেন। ভাষার মতো মানুষের জ্ঞানও পারস্পরিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। এই জ্ঞানগত নির্ভরশীলতাকে বুঝতে হবে মিউচুয়েল কো-অপারেশন ও গাইডেন্স অর্থে।

ধর্মবিশ্বাসীরা নবী ও রাসূলদের কথাকে নিছক এজন্য মানে না যে তারা ঈশ্বর প্রেরিত নবী ও রাসূল। বরং নবী ও রাসূলগণ যেসব কথাবার্তা বলেন তা তাদের কাছে সত্য, সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। তারা মনে করে, ঈশ্বর আছেন। তিনি মানুষের মধ্যে সত্যকে চিনে নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন। মানুষের সত্যানুসন্ধান প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে, মানুষের বিবেকের কথাগুলোকে যথাযথভাবে বাঙময় করে তোলার জন্য ও তা প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ঈশ্বর স্বীয় দূত হিসাবে নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। তাই বিশ্বাসীরা নবুয়তের দাবিদার ব্যক্তিটিকে যাচাই করে সত্য ও সঠিক মনে হলে তাকে মহান স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নেন।

বলাবাহুল্য, কাউকে যখন আপনি কোনো বিষয়ে সত্যিকারের প্রতিনিধি বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে মেনে নিবেন, তখন পরবর্তীতে স্বভাবতই আপনি তার সকল কথা ও নির্দেশনাকে অকপটে গ্রহণ করবেন; যেমন করে আমরা অসুস্থ হলে উপযুক্ত চিকিৎসকের অনুসন্ধান করি। এরপর সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার পরামর্শ দেয় সেটাকে আমরা মেনে চলি। কিংবা,  কোথাও যাওয়ার জন্য আমরা প্রথমে গাড়ি ঠিক করি। এরপর টিকেট কেটে গাড়িতে চড়ে বসি। দৃশ্যত আমরা ড্রাইভারের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে নিশ্চিতভাবে বসে থাকি। এটাই নিয়ম।

We must believe to live, no matter what we believe. Belief is a must in our life. But any belief that we rely on, must be true and justified.

অতএব, বুঝতেই পারছেন, যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস থাকার কথা বলেন অথচ ধর্মের বিরোধিতা করেন, তারা আসলে ভুল করছেন। স্রষ্টা-বিশ্বাসের সাথে প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস থাকাটাই সুসংগত বা consistent। প্রচলিত ধর্মের কোনটি ঠিক, তা ভিন্ন প্রশ্ন। এখানে শুধু এতটুকু বলে রাখি, ধর্মের দাবিগুলো নানা ধরনের এবং ধর্মগুলো পরস্পর স্বতন্ত্র ও বিপরীত হওয়া  সত্ত্বেও আমাদের মানতে হবে এর কোনো একটি অন্তত সঠিক।

আমরা জানি, সত্যতার বিভিন্ন দাবি থাকার মানে এই নয় যে স্বয়ং সত্যতা ব্যাপারটিই নাই। বরং, অন্টোলজি এবং এপিস্টেমোলজি আমাদেরকে এটাই বলে, যেখানে সম্ভাব্যতা আছে, সেখানে কোথাও না কোথাও তেমন নিশ্চয়তাও আছে। জীবন ও জগতের বৃহত্তর সত্যগুলো, আমাদের অভিজ্ঞতায় পাওয়া যায়, এমন ভালগার বস্তুজগতের মতো ডেমনেসট্রেটিভলি আমাদের কাছে ধরা দেবে না। আমাদের কর্তব্য হলো সেগুলোকে খুঁজে নেয়া। গলতি থেকে খাঁটিকে বের করে নেয়া। যদি আমরা সত্যিই সত্যের প্রতি কমিটেড হই।

সংক্ষেপে বললে, এই আলোচনার মূল কথা হলো:

১. রিসালাতের প্রথম প্রমাণ হলো তাওহীদ। তাই যিনি তাওহীদ-বিশ্বাসকে নিতে পারবেন না, তিনি কোনোক্রমেই রিসালাতকেও যৌক্তিক মনে করবেন না। এটাই স্বাভাবিক।

২. রিসালাতের দ্বিতীয় প্রমাণ হলো প্রকৃতি বা ন্যাচার। প্রাকৃতিক জগত থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা ও যুক্তি-বুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে আমরা যা পেয়ে থাকি বা পাই তা রাসূলের আনা ঐশী বাণীর সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, বুদ্ধি ও প্রত্যাদেশের সামঞ্জস্যশীলতা বা কনসিসটেন্সি হলো রিসালাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।

৩. রিসালাতের তৃতীয় প্রমাণ হলো রাসূল স্বয়ং। তার মানসিক ভারসাম্য, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র।

৪. এ ছাড়াও রিসালাতের গৌণ প্রমাণ হলো ঐশীবাণীতে উল্লেখিত ভবিষ্যতবাণী ফলে যাওয়া ও রাসূলের অলৌকিক ক্ষমতা।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *