দুই ধরনের নাস্তিক আছে। প্রথমত, যারা বুদ্ধিসম্পন্ন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বড়জোর জ্ঞানসৌধের বারান্দা পর্যন্ত গেলেও সঠিক জ্ঞান হতে শেষ পর্যন্ত তারা বঞ্চিত রয়ে গেছে। দেখবেন, এরা কোনো না কোনোভাবে ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করে, কিন্তু পারসনাল গডে তাদের প্রবল অবিশ্বাস।
ঈশ্বর যদি বস্তুজগত সৃষ্টি ও পরিচালনা করতে পারে, মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন যদি এক ধরনের প্রাকৃতিক সত্তা হয়ে থাকে, তাহলে মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য ঈশ্বরের কোনো গাইডলাইন থাকবে না কেন?
মোটকথা হলো, ফিলোসফিক্যাল গডে বিশ্বাস করে পারসনাল গডে অবিশ্বাস করাটা নিতান্তই অযৌক্তিক চিন্তা।
আর এক ধরনের নাস্তিক আছে যারা স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলোকে মোকাবিলা করতে গিয়ে বিচিত্র ধরনের বুদ্ধি-বৈকল্যের পরিচয় দেয়। এদের কেউ কেউ ব্যক্তিজীবনে তথাকথিত প্রগতিশীল আদর্শের সাথে জড়িত। এরা না কম্যুনিজম বোঝে, না নাস্তিকতা বোঝে।
এদের চিন্তার গড়নে নানা ধরনের বৈপরিত্য বা ফ্যালাসির দগদগে ঘা। তাদের ভাগ্য ভালো, আস্তিকেরা তাদেরকে দার্শনিক যুক্তি দিয়ে কাউন্টার করে না।
এ দেশে কত যে নানা কিসিমের অবিশ্বাসী-অর্ধবিশ্বাসী আছে তা সাধারণত চোখে পড়ে না। পেশাগতভাবে বাংলাদেশের একজন প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের গতকালকে দেয়া একটা ফেইসবুক স্ট্যাটাস পড়লাম। তিনি লিখেছেন,
“মানুষ এখন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে ভাবে না। ভাবে সৃষ্টিকর্তা দেখতে কেমন।
– অতঃপর তারা কি আস্তিক হল নাকি নাস্তিক হল?”
একজন তাতে মন্তব্য করেছেন, “সব সৃষ্টি করলো যে জন / তাঁরে সৃষ্টি কে করেছে??? – ফকির লালন।”
উক্ত তরুণ বুদ্ধিজীবী এর উত্তরে লিখেছেন, “আমাকে সৃষ্টি করল যে জন, তাঁরে সৃষ্টি আমি করেছি।”
স্ট্যাটাসদাতা আমার পরিচিত। এক নামকরা মাওলানা ও হকপন্থী পীর সাহেবের নাতি। তিনি এতে বিব্রত হওয়ার আশংকা সত্ত্বেও এ বিষয়ে কারো কারো ভুল ধারণা অপনোদনের জন্য এই সংক্ষিপ্ত স্ট্যাটাস।
সৃষ্টিকর্তা দেখতে কেমন– এই ধরনের চিন্তা যে করে সে আদতে নাস্তিক। কেননা, ‘সৃষ্টিকর্তা দেখতে কেমন’ এই প্রশ্নের পূর্বানুমান বা প্রিসাপোজিশন হচ্ছে ‘সৃষ্টিকর্তা’ মানুষের দর্শনযোগ্য কিছু একটা। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে এ ধরনের অনুমান বা ধারণা হলো বিরোধপূর্ণ ও অযৌক্তিক। এটি নিছকই পোলাপাইন্যা টাইপের প্রশ্ন।
কেননা,
সৃষ্টিকর্তার ধারণা হলো জগতের অস্তিত্বের সম্ভাব্য কারণ। যারা এই সম্ভাব্য কারণকে নিশ্চিত হিসাবে গ্রহণ করে তাদেরকে স্রষ্টায় বিশ্বাসী হিসাবে গণ্য করা হয়। তো, স্রষ্টায় বিশ্বাসী হোন বা অবিশ্বাসী হোন বা সন্দেহবাদী হোন, সংজ্ঞানুসারে সৃষ্টিকর্তা বস্তু জাতীয় কিছু নন যে তাঁকে দেখা যাবে।
যিনি দর্শনযোগ্যই নন, তাঁর চেহারা বা আকার সম্পর্কে যে কোনো ধরনের ভাবনা, চিন্তা, কল্পনা, অনুমান বা বক্তব্য হলো যুক্তির দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য (fallacious) ও অসামঞ্জস্য (inconsistent)। এ ধরনের কথা ‘বর্গাকার বৃত্তের’ ধারণার মতো যুক্তিবিরোধী হিসাবে সরাসরি বাতিল।
এরপরে,
লালনের বরাতে উক্ত স্ট্যাটাসের মন্তব্যে যা বলা হয়েছে তাও ততধিক হাস্যকর ও অবৈধ যুক্তি। ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টেও লক্ষ করেছি এ ধরনের ফাউল কথা ক্লাসে স্যারেরা বলে থাকেন।
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যেসব যু্ক্তি নিয়ে ‘দর্শনের সমস্যাবলী’ ধরনের বইগুলোতে আলোচনা করা হয় তার অন্যতম হচ্ছে আদি কারণ বিষয়ক যুক্তি। এই যুক্তি মোতাবেক, আমরা জানি, সব কিছুর পেছনে কারণ আছে। জগত যেহেতু একটা কিছু। সুতরাং জগতেরও একটা কারণ থাকবে। ঈশ্বর হলেন সেই কারণ।
এই যুক্তির বিপক্ষে বেকুব মাস্টারেরা ততধিক বেকুব ছাত্রদেরকে বলে, ‘সব কিছুর কারণ থাকলে, ঈশ্বরেরও একটা কারণ থাকা উচিত।’
দেখেন তো কারবার …!
সব কিছুর কারণ আছে, কথাটার ভিত্তি হলো আমাদের অভিজ্ঞতা। এই ‘সবকিছু’ আর ‘অভিজ্ঞতা’র কারণ তথা ব্যাখ্যা হিসাবে কিছু না কিছু তো বলতে হবে। জগত যে সৃষ্ট তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান দিয়েও আমরা তা বুঝি। জগতের জটিলতা বা এনট্রপি ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারমানে, যত আগে তত ছোট ও সরল ছিল, যা শেষ পর্যন্ত নাই হয়ে যাওয়ার কথা।
তো, জগত সৃষ্ট-পূর্ব ‘অবস্থায়’ কী ছিলো? এই প্রশ্নের ‘বৈজ্ঞানিক’ উত্তর কী? শূন্যতা? তা যদি হয়, নাথিংনেস বা শূন্যতা কীভাবে সামথিং বা জগতের জন্ম দিলো? পূর্ব থেকে অস্তিত্বশীল নিয়মাবলীর কথা বলবেন? যে সময়ে জগতই নাই, সে ‘সময়ে’ জগতের নিয়মাবলীই বা থাকবে কেন?
যদি বলি, God is the embodiment of the natural laws, including the rules of physics, chemistry and biology – তাহলে নাস্তিক-সন্দেহবাদী অবস্থান থেকে কী বলা হবে, বুঝতে পারছি না।
ব্যাখ্যার কোনো ব্যাখ্যা লাগে না, যদি সেই ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট বিষয়টাকে যৌক্তিকভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে। An explanation needs no further explanation if it can explain conclusively.
ঈশ্বরকে জগতের কোনো কিছুর মতো কল্পনা করাটাই শেরেকি, ইসলাম যা আউটরাইট রিজেক্ট করে। ঈশ্বর-কল্পনা জগতের অস্তিত্ব ও পরিচালনা সংক্রান্ত চিন্তার ফসল। এর মানে এই নয়, ঈশ্বর আমাদের কষ্ট-কল্পনা মাত্র।
ঈশ্বরচিন্তা তথা গড-হাইপোথিসিসকে যারা বাস্তব সত্য হিসাবে মেনে নেয় তারা ঈমানদার।
জগতে কোনো কিছু থাকা বা না থাকার যেমন বস্তুগত প্রমাণ থাকে বা দরকার, ঈশ্বর সে রকম কোনো সত্তা নয় যে তাঁর অস্তিত্বের জন্য সে ধরনের কোনো প্রমাণ লাগবে। তিনি জগতের কারণ হিসাবে আমাদের কাছে অস্তিত্বশীল এবং জগতের অস্তিত্বের মাধ্যমে আমাদের কাছে জ্ঞাত।
আমাদের দিক থেকে তাঁর কিছু গুণাবলী সম্পর্কে আমরা নিতান্ত সীমিতভাবে জানতে পারি। কিন্তু সেগুলোর স্বরূপ সম্পর্কে আমরা সঠিক জানতে পারি না।
কেননা,
জগত ও ঈশ্বর ভিন্ন ক্যাটাগরি। জাগতিক বস্তুনিচয়ের পারস্পরিক সম্পর্কসূত্র, প্রমাণপদ্ধতি ও বৈশিষ্ট্য ঈশ্বরের ওপর প্রযোজ্য মনে করা হলে তা হবে সর্বেশ্বরবাদ বা pantheism।
মুসলমানের সন্তানেরাও তাওহীদ সম্পর্কে ততটা স্বচ্ছ ধারণা রাখে না। মানা ও প্রচার করা তো দূরের কথা। আফসোস…!
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Aminul Huda: Many honest atheists I know, are mostly deist when they are inquired about their belief about cosmology.
Nure Elahi Shafat: এ বিষয়ে এক সেশনমেটের সাথে আমার বিতর্ক বিতর্ক হইছিল। সে বলে মেরাজে নবী খোদাকে দেখছে, কথা বলছে। দ্যাট মিনস স্রষ্টার প্রাণ আছে। এখন আমরা জানি যার প্রাণ আছে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে, তাহলে দেখা যাচ্ছে গডকে তারা প্রাণীর সংজ্ঞায় ফেলে ইন্দ্রীয়জাগতিক চিন্তার মাধ্যমে কনফাইন্ড করে ফেলেছে। যেটাকে আমি বলি বুদ্ধিবৃত্তিক শের্ক। ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলবেন কি? আমি তাকে আমার পজিশান থেকে উত্তর দিয়েছি, নিজের কাছে যতটুক ইন্টেলেকচুয়াল ইক্যুইপমেন্টস ছিল তার সর্বস্ব প্রয়োগ করেছি। অর্থাৎ, সে গডকে বস্তুর মধ্যে ফালাইতে চায়! মুসলিম দর্শন ও চেতনা প্রবাহ বইয়ে ইমাম গায্যালী স্রষ্টাকে অবস্তু বলেন। স্যার…
Mohammad Mozammel Hoque: মেরাজে নবীজী জিবরাঈলকে (আ) স্বরূপে দেখেছেন, আল্লাহ তায়ালাকে নয়।
গড হলেন “জগত কেন?” এই প্রশ্নের উত্তর। উত্তরের কোনো ফারদার উত্তর হওয়া বা থাকার কথা না, যদি প্রদত্ত উত্তর সন্তোষজনক, যথাযথ বা যুথসই হয়। উত্তরের উত্তর দাবী করা, লজিক্যালি ইনকনসিসটেন্ট। যেমন করে, উত্তর মেরুতে গিয়ে ফারদার কোনো উত্তর দিক আছে কিনা জানতে চাওয়া হলো অযৌক্তিক প্রশ্ন। an explanation needs no further explanation when it explains the issue or question satisfactorily or conclusively.
Injamam Sayem: Atheist leader Richard Dawkins believe that life on earth is due to wisdom of an intelligent designer…
Because he and all the other evolutionists don’t have any definition for the origin of life except, the intelligent designer.
But due to their arrogance they deny to believe in real designer of life. (Allah SWT). instead they made a fake phenomenon (Aliens)
RealLight SD: কতটুকু জানলে ঈশ্বরকে পাবো? নাকি ঈশ্বর = বিশ্বাস! একটু বুঝিয়ে বললে ভালো হয় স্যার..
Mohammad Mozammel Hoque: আশপাশের অতি নগন্য কিছুকে নিয়েও যদি সিরিয়াসলি ভাবেন, ঈশ্বরকে পাবেন। আর, হ্যাঁ, ঈশ্বর নিছক বিশ্বাসের তথা উর্বর কল্পনার কোনো কিছু নয়। সে অর্থে ‘ঈশ্বর = বিশ্বাস’ ভুল। আবার ঈশ্বরকে আমরা বিশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করি। সে অর্থে ‘ঈশ্বর = বিশ্বাস’ কথাটা সঠিক।
আমরা সসীম। যা কিছু আশপাশে পাই তাও সসীম। সসীমতা তত্ত্বগতভাবে (ontologically) অসীমতাকে নির্দেশ করে। কিন্তু সসীম, অসীমকে ধারণ করতে পারে না। অসীমের জন্য উপযুক্ত প্রমাণ কেবলমাত্র অসীম সত্তার পক্ষেই প্রতিপাদনযোগ্য। তাই, অসীমের সাথে সসীমের সম্পর্ক প্রমাণের নয়, বিশ্বাসের। যদিও এই বিশ্বাস নানা ধরনের ভৌত ও জাগতিক প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত।
আমাদের অস্তিত্বই তো ‘একটা বিশেষ কিছু’ যে আছে, তার প্রমাণ। না হলে আমরা আসলাম কেন, কোত্থেকে ও কীভাবে?
প্রমাণ আর বিশ্বাস সাধারণ কথাবার্তায় পরস্পরের বিপরীত (mutually exclusive) হলেও জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনাতে কিন্তু সব জ্ঞানই মূলত বিশ্বাস। যদিও, বিশ্বাস মাত্রই জ্ঞান নয়। প্রচলিত সংজ্ঞা মোতাবেক জ্ঞান হলো যাচাইকৃত সত্য বিশ্বাস।