প্যারাডাইম কথাটা বিজ্ঞানের দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানে বেশি ব্যবহৃত হয়। মানুষ যে আবহে চিন্তা করে অর্থাৎ চিন্তার যে সামগ্রিক ধরন বা কাঠামোর মধ্যে চিন্তাশীল ব্যক্তি কাজকারবার করে সেই আবহ, মেজাজ, ধরন বা কাঠামোকে প্যারাডাইম অব থট বলা যায়। একে চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তির আকার বা ভিত্তিমূল হিসাবে বলা যায়। অন্যকথায় একে বিশ্বদৃষ্টি বা জীবনদৃষ্টিও বলা যায়। প্রতিটা মানুষেরই এক একটি প্যারাডাইম আছে। থাকতে বাধ্য।
মানুষের চিন্তায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটে। বিবর্তন ঘটে। চিন্তা-ভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তির এই স্বতঃপরিবর্তন ও বিবর্তনের একটা পরিণত পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবন-দৃষ্টি বা বিশ্ব-দৃষ্টি গড়ে উঠে। চিন্তাগত উন্নয়ন বা অধোগতি মানেই কিন্তু প্যারাডাইম শিফট না। মানুষের জীবনে প্যারাডাইম শিফট তাই ক্বদাচিৎ ঘটে। প্যারাডাইম সম্পর্কে এটুকু বলার পর এই বিষয়ে নোট লেখার প্রসংগকে খোলাসা করা যাক।
প্যারাডাইম অব থট এবং ডেভেলপমেন্ট অব থটের পার্থক্য –
কয়দিন আগে আমি ‘কেন আমি জামায়াতের সংস্কারবাদী নই’ শিরোনামে চার পর্বের একটা নোট ফেইসবুকে প্রকাশ করি। সেখানে আমি সংস্কারবাদীদের ছয়টা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করি যেগুলোর প্রত্যেকটিকে আমি ভুল মনে করি। তার মধ্যে তৃতীয় পয়েন্টটা ছিলো ‘মজহার পন্থা’। উক্ত নোটে গতকাল একজন বিজ্ঞ পাঠক কিছু মন্তব্য করেছেন। আমার স্বভাববিরুদ্ধ হলেও বৃহত্তর পরিসরে ভুল বুঝাবুঝি এড়ানোর জন্য কথাগুলোকে উদ্ধৃত করে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
পাঠক বলেছেন, “কিছু মানুষ বনসাই গাছের মত বয়সে বাড়ে কিন্তু মানসিকভাবে যেখানে ছিল সেখানেই থেকে যায়। জামায়াত-শিবিরের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের অধিকাংশ কর্মির তুলনা চলে বনসাই গাছের সাথে। কিন্তু কিছু মানুষ আগায়, সামনে বাড়ে, বুদ্ধিবৃত্তিক ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যায়…আজীবন…মৃত্যু পর্যন্ত”। … “ফরহাদ মজহার একটা “নিজস্ব ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে” এই লাইনেই তাকে ব্যাখ্যা করা যায়”।
ফ্যালাসি অব একজামপল বা উদাহরণের অনুপপত্তি নামে একটা ফ্যালাসি হতে পারে। এটি হলো সমধর্মী উদাহরণ দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়কে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভাব্যতা। যেমন এখানে বনসাই গাছের কথা বলা হয়েছে। যে গাছ বাড়েনা তাকে বনসাই বলে। ‘বাড়ে’ বলতে কতটুকু বাড়ার কথা বুঝানো হয়? নিশ্চয়ই ওই গাছটা নরমালি যতটুকু বাড়ার কথা ততটুকু বাড়ার কথা বুঝানো হয়। ‘বাড়ে শব্দটাকে তাই আক্ষরিকভাবে বুঝার সুযোগ নাই। না হলে তো এক একটা গাছ আকাশকেও ছাড়িয়ে যেতো। ক্রমাগত বাড়তেই থাকতো …!
গাছের বৃদ্ধির সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক ট্রান্সফরমেশনের তুলনা করা যায়। বুদ্ধিবৃত্তিক ট্রান্সফরমেশন যদি নির্দিষ্ট একটা প্যারাডাইম অব থটকে বেছে নেয়া এবং সেটির মধ্যে থেকে ক্রমাগত নিজেকে এডাপ্ট অর্থাৎ ডেভেলপ করা বুঝায় তাহলে তা সমর্থনযোগ্য। সঠিক। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ট্রান্সফরমেশন মানে যদি হয় “…আজীবন…মৃত্যু পর্যন্ত” তাহলে তো এটি ভারি বিপদের কথা। কোনো সুস্থ চিন্তার মানুষই জীবনভর বারে বারে প্যারাডাইম চেঞ্জ করে না। এটি অবাস্তব। মানুষ আজীবন নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে উন্নত করবে, যথাসম্ভব পরিশুদ্ধ ও বাস্তবানুগ করার চেষ্টা করবে। এটি স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে মানুষ ক্ষণে ক্ষণে নিজের চিন্তার ছক বা ধরন, যাকে আমি প্যারাডাইম বলছি, তা বদল করবে বা করে – এমন নয়। এহেন দাবি অবাস্তব। প্যারাডাইম অব থট এবং ডেভেলপমেন্ট অব থটের পার্থক্য না বুঝার কারণে কারো মধ্যে কোনো বিষয়ে এ ধরনের বিভ্রান্তি হতে পারে।
ফরহাদ মজহারের প্যারাডাইম অব থট কী?
আমার নোটের সম্মানিত পাঠকই তার মন্তব্যে ফরহাদ মজহারের প্যারাডাইম অব থট, সংক্ষেপে প্যারাডাইম, সম্পর্কে বলেছেন, “তিনি সব সময়ই লাউডলি এন্ড ক্লিয়ারলি বলেছেন তিনি মার্কসিষ্ট,সেটাতো তিনি গোপন রাখেন নি’’। আমিও তো তাই বলি। যা আমার সংশ্লিষ্ট নোটে উল্লেখ করেছি। অতএব, ফরহাদ মজহারের চিন্তাধারা ক্লিয়ার নয় – এমন উদ্ভট দাবি আমি কেন কেউ করার কথা না। ফরহাদ মজহার যে মার্ক্সবাদের প্রিজম দিয়ে সবকিছুকে দেখেন অথবা নিজের মনের প্রিজম দিয়ে মার্ক্সবাদ ও সংশ্লিষ্ট সবকিছুকে রঙিন করে চিত্রিত করেন, দেখে থাকেন তা স্পষ্ট।
আমার আপত্তি ফরহাদ মজহারের কোনো কিছু নিয়ে নয়। বরং জামায়াতের সংগঠনবাদী ও সংস্কারবাদী উভয় ধারার লোকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ‘মজহার-তত্ত্ব’ না বুঝা সত্বেও উনাকে ‘নিজেদের’ লোক হিসাবে ‘আপন’ মনে করাই আমার আপত্তির জায়গা। এটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তাদের এই অবুঝ মনোভাব আমার কাছে তাদের অবস্থানের দিক হতে স্ববিরোধী বলে মনে হয়েছে। আমি প্রমাণ দেখিয়েছি, ভেটেরান জামায়াত কিন্তু মজহারের সাথে যোগাযোগ রাখেন এমন লোকেরা নিছক কৌশলগত রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে তার ভাবাদর্শকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রমোট করেন। এমনকি কিছু কিছু সাপোর্টও করেন। জামায়াত করেন এমন লোকদের যারা উনাকে ‘ফরহাদ ভাই’ সম্বোধন করেন তাদের অনেকেরই বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতা ও হীনমন্যতাবোধ প্রকট। এমন নয় যে, উনারা কম মেধাবী। আসলে বুদ্ধিবৃত্তি তো স্বাধীন ও নিয়মিত চর্চার বিষয়। তাই না?
আর কেউ যদি বিভিন্ন ব্যক্তি, গ্রুপ ও দলের প্যারাডাইমগত ভিন্নতার বিষয়টাকে অস্বীকার করেন কিংবা ইসলাম ও মার্ক্সইজমের প্যারাডাইমগত মৌলিক পার্থক্যের বিষয়টিকে অস্বীকার করেন, তাহলে আমার আর কিছু বলার নাই। কেননা, কোরআন শরীফে বলা হয়েছে, তোমরা যখন জাহেলদের মুখোমুখি হবে তখন ‘সালাম’ বলে এড়িয়ে যাবে।
কাউন্টার প্যারাডাইমের সাথে ইন্টারেকশান –
উক্ত সম্মানিত পাঠক “আপনি কি এরকম একটা উল্টো জার্ণি করতে পারতেন? Can you reach out to your ideological opponent for greater interest?’’ – এই মন্তব্যটা কী বুঝে করেছেন, তা তিনিই ভালো জানেন। মনে হয় তিনি বিকল্প প্যারাডাইমের অনুসারীদের সাথে ইন্টেলেকচুয়্যাল ইন্টারেকশানকে দিনে-রাতে প্যারাডাইম পরিবর্তনের অবাস্তবতার সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। অথবা, আমার প্যারাডাইম সম্পর্কে উনার অস্পষ্টতা রয়েছে। বিষয়টা অতীব বিস্ময়কর! কারণ, আমার meta-reality বলুন, absolute ideology বলুন, বা ontology বলুন, বা epistemology বলুন, তা হলো ইসলাম। যদি তাই হয়, আমার ‘উল্টো জার্নি’ থাকবে কেন? বুঝতে পারছি না। সংশ্লিষ্ট সম্মানিত পাঠকের মতে, “ফরহাদ মজহারের অনন্ত (সম্ভবত এটি বানান ভুল। তারমানে অনন্ত না হয়ে এটি অন্তত হবে) এমন একটা কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ আছে।তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, কৃষিবিদ, ভাববাদী এবং এক্টিভিষ্ট”। ফরহাদ মজহারের ‘কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ’ থাকায় অসুবিধা না থাকলে আমার বা যে কারো তার নিজের মতো করে ‘কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ’ থাকলে বা তা কেউ নিজের মতো করে তৈরি ও ব্যাখ্যা করলে সমস্যা কী?
হ্যাঁ, আমার ‘কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ’ হচ্ছে ইসলাম। যেমন করে আল্লাহর রাসূল (স.) বলেছেন, ‘… যে আল্লাহকে রব হিসাবে, ইসলামকে জীবনাদর্শ হিসাবে এবং মুহাম্মদকে রাসূল হিসাবে সন্তুষ্ট চিত্তে মেনে নিয়েছে’, আমি তেমনই একজন। ফরহাদ মজহারের সহজিয়া-সাম্যবাদী ‘কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ’কে যে কেউ সমর্থন করতে পারে। আমি ‘ইসলাম বহির্ভূত অপরাপর দ্বীন বা জীবনাদর্শে’র মধ্যে একে গণ্য করি। অতএব বিরোধিতা করি। ইসলাম থেকে ভিন্ন – এমন যে কোনো কিছুকে স্পষ্টতই বিরোধিতা করা আমার ইসলাম চেতনার দাবি। প্রায়োগিক সকল বিষয়ে ইসলাম কম-বেশি সহনীয় মনোভাবের (inclusive) হলেও আক্বীদাগত (philosophical) দিক থেকে এটি হ্যাঁ/না ধরনের বাইনারিতে বিশ্বাসী।
ফরহাদ মজহারের সহজিয়া-সাম্যবাদ কোনো সাময়িক রাজনৈতিক কৌশলের বিষয় নয়। ইসলামের দিক থেকে এটি অন্যতম বাতিল জীবনদৃষ্টি বা মতবাদ। ইসলামপন্থী সরলমনা লোকজনেরা এই দিকটা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়। একজন ইসলামপন্থী হিসাবে এটি স্বভাবতই আমার কাছে উৎকণ্ঠার বিষয়। ইসলামপন্থার সাথে এ দেশে বামপন্থার অসম যুদ্ধকে তিনি বামপন্থার পক্ষে পুনর্বিন্যাস করতে চান। আমি এর প্রতিবাদ করি। ইসলামপন্থীদেরকে সতর্ক করাই আমার উদ্দেশ্য।
আমার মজহারবিরোধিতাকে একজন ‘মজহার ফোবিয়া’ বলেছেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের উক্ত প্রাক্তন কেন্দ্রিয় কার্যকরী পরিষদ সদস্য যেভাবে ফরহাদ মজহারের পেছনে হাঁটাহাঁটি করেন তাকে কেউ ‘মজহার ম্যানিয়া’ও বলতে পারে। মজহার আমার কনসার্ন নন, আমার কনসার্ন হলো ইসলামপন্থীদের মধ্যকার অবুঝদের আত্মপ্রতারণা ও অন্তর্বিরোধকে দৃশ্যমান করা। যার মন্তব্যের সূত্রে এই দীর্ঘ প্রতিমন্তব্য সেই পাঠকের সংশ্লিষ্ট মন্তব্যের এই অংশের সাথে আমি শতভাগ একমত: “ইসলামপন্থীরা যদি রাজনীতির ডিকবাজিতে তার কাছে যায় তাহলে তার সমস্যা কি? তার উপর, এটাতো ফরহাদ মজহারের ক্রেডিট যে তিনি সম্পুর্ণ ভিন্ন ধারার হয়েও ইসলামপন্থিদের কাছে পৌঁছুতে পেরেছেন”।
ফরহাদ মজহার তার চিন্তা ও কাজে মোর কনসিসটেন্ট। ফরহাদ মজহারের কোনো ‘উল্টো জার্নি’ নাই। কেউ কেউ মনে করছেন, যেমন আলোচ্য পাঠক মন্তব্যের এক পর্যায়ে বলছেন, “তিনি এখন ইসলামপন্থিদের সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করেছেন, বুঝার চেষ্টা করেছেন এবং আমরা দেখেছি এরফলে তার চিন্তায় ইসলামপন্থীদের ওসওয়াসাও পড়েছে। হয়ত তার জীবনে এই অংশের বুঝটাই মিসিং ছিল”। মজহারকে যারা সঠিকভাবে পাঠ করতে পারেন নাই, যারা চিন্তাধারা বা প্যারাডাইমকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, আমার দৃষ্টিতে, কেবলমাত্র তারই এমন গ্রস মন্তব্য করতে পারে। তিনি ‘তবু কমিউনিজমের কথাই বলতে হবে …’ এমন আর্টিকেল লেখার পরও, বারে বারে নিজেকে মার্ক্সসিস্ট দাবি করার পরও, জামায়াত-শিবিরের অনেকেই কেন তার মধ্যে (ইসলামের দিক হতে ইতিবাচক) ‘পরিবর্তন’ দেখে, তা আমার বুঝে আসে না।
এ দেশীয় বামপন্থায় রেডিকেল রিফর্মিস্ট এবং এ কারণে নিজ পেরিফেরি হতে ‘সমাজচ্যুত’ ফরহাদ মজহার তার ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তরের’ ফর্মুলা অনুসারে ইসলামপন্থীদেরকে ব্যবহার করতে চান। আক্বীদাগত যে ইসলাম, যাতে শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার টেক্সটচুয়্যাল ব্যাপারটাকে কোনো মতেই, বিন্দুমাত্রও কম্প্রোমাইজ করা যায় না, সম্ভব না, সেই ইসলামে উনার কোনো আগ্রহ নাই। থাকার কারণও নাই। উনার লেখা পড়ে বা কথাবার্তা শুনে আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। হ্যাঁ, স্বীকার করি, ফরহাদ মজহারের ‘জার্নি’ আছে। তবে সেটি স্বীয় মতের নির্মাণ নয়। বরং তা হলো বাস্তবায়নের, পদ্ধতি নির্ণয়ের ও সম্পর্ক-বলয় সৃষ্টির জার্নি। ‘সহজিয়া-সাম্যবাদে’র বড়ি কতো সফিসটিকেটেড উপায়ে গিলানো যায় সেই পদ্ধতি বের করার জার্নি ব্যতিরেকে মজহারের মধ্যে আর কোনো জার্নি তো দেখি না।
ফরহাদ মজহার কি দার্শনিক?
হ্যাঁ, ফরহাদ মজহার একজন দার্শনিক বটে। অন্তত কন্টিনেন্টাল ফিলোসফার দেরিদা’র সাহাবীতুল্য দার্শনিক তিনি। তার ‘দার্শনিক বিরাটত্ব’ প্রমাণের জন্য তিনি দেরিদা’র সাথে কথা বলেছেন, তার অনুসারীদের এমন আবেগপ্রবণ কথা গদগদ হয়ে বলতে শুনেছি। যাহোক, আমার সাথে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শন আলোচনায় এসেছেন এমন সবাই এটি জানেন ও মানেন যে, আমার দৃষ্টিতে মানুষ মাত্রই এক একজন স্বভাবগত দার্শনিক। whenever a person takes any decision, he/she makes a choice. Whenever someone claims something, he or she must attach any favourable argument. whereas, making choice or putting argument is nothing but doing philosophy. এই দৃষ্টিতে দর্শনের কলাপসকে যারা ক্লেইম করেন তারা আদতে দর্শনই চর্চা করেন। সবাই যখন দার্শনিক, নিঃসন্দেহে সুলেখক, কবি, কৃষিবিদ, এনজিওবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লালনভক্ত ফরহাদ মজহারও একজন দার্শনিক। তুলনামূলকভাবে খানিকটা উঁচু মানের দার্শনিক।
তিনি তাঁর পাঠচক্রে দর্শন নিয়ে কাজ করেন। মহাদেশীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে তিনি প্রায়শঃই এনগেজ হোন। তা হলো phenomenology। ফেনোমেনোলজি হলো দার্শনিক উত্তরাধুনিকতাবাদের একটা প্রকরণ। দার্শনিক উত্তরাধুনিকতাবাদের মূলকথা হলো চিরন্তন সত্য বলে কিছু নাই। সব সত্যই নির্মিত সত্য। সব বাস্তবতাই লোকাল। গ্লোবাল রিয়েলিটি বলে কিছু নাই। দার্শনিক উত্তরাধুনিকতার সাথে সাংস্কৃতিক উত্তরাধুনিকতাবাদের পার্থক্যকে স্মরণে রাখতে হবে। যাহোক, ফেনোমেনোলজি কন্টিনেন্টাল ফিলোসফিতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যারা ফিলোসফি পড়েন নাই, তারা না জানলেও দর্শনের যে কোনো ছাত্রই জানে, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ কনটেমপরেরি টপিক অন্তত কয়েক ডজন আছে। যারা ফিলোসফির কিছু বুঝে না, তারা এক লাফে কীভাবে ফেনোমেনোলজি বুঝা শুরু করে দ্যায়, তা আমার কাণ্ডজ্ঞানে ধরে না। তিনি কান্ট ও হেগেল নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন। এর কারণ স্পষ্ট। যে কেউ মার্ক্সবাদ পাঠ করতে গেলে কান টানলে মাথা আসার মতো মার্ক্স-এর সরাসরি শিক্ষক ফ্রেডারিক হেগেলের প্রসঙ্গ আসবেই। কারণ, মার্ক্সের একটা পরিচিতি হচ্ছে তিনি ‘হেগেলিয় বাম’ ধারার অনুসারী। এটি বলা বাহুল্য, ইমানুয়েল কান্ট হলেন হেগেলের পূর্বসূরী। এক অর্থে, হেগেলের দর্শন হচ্ছে কান্টের পর্যালোচনা। ফরহাদ মজহারের সাথে আমি সমকালীন পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে এনগেজ হতে চেয়েছিলাম। এ লক্ষ্যে উনার বিশ্বাস ব্যবস্থা সংক্রান্ত নোটের প্রথম দিকে আমি কিছু তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্যও করেছিলাম। তিনি এড়িয়ে গেছেন।
যাহোক, বিজ্ঞ মন্তব্যকারীর “দর্শনতো অনেকেই পড়ে, আপনিতো পড়ানও কিন্তু সবাই কি দার্শনিক হয়?” – এ কথার তাৎপর্য কী হতে পারে তা ভেবে উপরের এই কথাগুলো বলা। বুঝতে পারছি না, ‘সবাই কি দার্শনিক হয়’ বলতে উনি আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন। হয়তো বলতে চেয়েছেন, আপনি দর্শন পড়ালেও দার্শনিক হতে পারেন নাই। কথাটা ঘুরিয়ে বললে, ফরহাদ মজহার দর্শনের শিক্ষক না হলেও তিনি দার্শনিক বটে। এটি ঠিক যে, যাদের তত্ত্ব ও বই সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করে পড়ানো হয়, আমি তেমন কেউ নই। ফরহাদ মজহারও কি তেমন কেউ? অবশ্য যে দেশে আরজ আলী মাতুব্বরের ‘লোক-বুদ্ধিবৃত্তি’ (folk-intellectuality) নির্ভর পপুলার রাইটআপকে সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করে পড়ানো হয় সে দেশে এক সময়ে মজহার তত্ত্বও কোনো না কোনো খানে পড়ানো হবে, এমনটা ভাবতে অসুবিধা নাই।
কাকে ডিফেন্ড করা, কাকে অফেন্ড করা, কার কতোটুকু দায় কিংবা অক্ষমতা-
আলোচ্য মন্তব্যকারী সুহৃদ এক পর্যায়ে বলছেন, “ফরহাদ মজহারকে ডিফেন্ড করার কোন খায়েশ আমার নাই কিন্তু কেউ নিজের অক্ষমতার জন্য অন্যকে অফেন্ড করলে তাকে সুধরানোর চেষ্টা করা নৈতিক দায়’’। আমার মূল নোটের একটা পয়েন্ট ছিলো ফরহাদ মজহার তাঁর লেখা ও কথাবার্তায় এক ধরনের মাল্টিলেয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেন। প্রতিটা লেখায় তিনি নানা রকমের কথাবার্তার একটা ধোঁয়াশা তৈরি করেন। কয়েকটা দৃশ্যত নির্দোষ কথার ফাঁকে উনার ককটেল মতবাদ সহজিয়া-সাম্যবাদের দাওয়াই সেট করে দেন। এ ধরনের কাজ-কারবার বুদ্ধিবৃত্তিক অসততাও বটে। যারা সবসময়ে ‘তর্ক’ তুলে বাতচিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তাদের কাছে এ ধরনের নেতিবাচক পদ্ধতি মুখরোচক হতে পারে। আমার বুঝজ্ঞান মোতাবেক ইসলাম অতিগুরুত্বপূর্ণ ও বুনিয়াদি বিষয়গুলোকে তো বটেই, সব নৈমত্তিক কথাবার্তাকেও যথাসম্ভব স্পষ্ট করে বলতে বলে।
তাই ফরহাদ মজহারকে অফেন্ড বা ডিফেন্ড করার কোনো ইচ্ছা আমার কখনো ছিলো না, এখনও নাই। ভবিষ্যতেও হবে না। উনার অবস্থানটা আমার কাছে ক্লিয়ার। আর, আমার অবস্থানও উনার কাছে ক্লিয়ার না থাকার কথা নয়। উনার সাথে সরাসরি কথা না বললেও উনার ‘খলিফা’দের শীর্ষস্থানীয়দের সাথে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছি। সেসবের অডিও রেকর্ডও আমার কাছে আছে। হ্যাঁ, উনাদের কাছ হতে আমি অনেক কিছু শিখেছি। যার অন্যতম হলো বেহাত বিপ্লব, ইতিহাসের শ্রেণীসংগ্রাম সংক্রান্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও বস্তুবাদী মন-মনাসিকতার গভীরতা, বিস্তৃতি ও বহিঃপ্রকাশ। যার কিছু অংশ আমার নোটে ‘কাকের বাসায় কোকিলের ডিম’ শিরোনামে সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করেছি।
কোনো অনুষ্ঠানে বা ওয়ান-টু-ওয়ান কথা বলার জন্য মজহারের কাছে আমার কখনো যাওয়া হয় নাই। তারমানে এই নয় যে, বাংলাদেশে মজহার একজনই আছেন। ফরহাদ মজহার একটা ধারা। অনুরূপ লেভেলের ও ব্র্যান্ডের লোক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে। আমার ড্রয়িং রুম, রিসার্চ সেন্টার ও লাইব্রেরিতে এখনও শুঁকলে উনাদের কারো কারো সিগারেটের ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। আমি ইন্টারেকশানের বিরোধী নই। বরং নিয়মিত চর্চাকারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন কিংবা আছেন এমন ফুল, সেমি ও কোয়ার্টার মজহারীদের সবার সাথেই আমার খায়-খাতির ছিলো। এবং আছে। আমার এই ধরনের যোগাযোগ রক্ষার উদ্দেশ্য হলো, কী বিশ্বাস নিয়ে তারা তাড়িত, তা উপলব্ধি করা। তাদের যুক্তিগুলো শোনা।
বামপন্থীদের মধ্যে যারা মজহার বিরোধী, আমার সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে যাদের কাউকে কাউকে আমি ‘ঈমানদার-কমিউনিস্ট’ হিসাবে কখনো কখনো ঠাট্টা করে সম্বোধন করি, তাদের সাথে আমার নিয়মিত কথাবার্তা হয়। যারা আমার সমবয়সী বা বয়োজেষ্ঠ তাদের সাথে এমন ইন্টারেকশান বেশি হয়। সলিমুল্লাহ খানের সাথে কখনো কখনো সেমিনার ইত্যাদিতে সারাদিন ছিলাম। সময় ও সুযোগ মতো তাদের সাথে মেলামিশা করার চেষ্টা করেছি। ফুল-নাস্তিক, সেমিনাস্তিক বা ছুপা নাস্তিকদের পালস ও বুদ্ধিবৃত্তির দৌড় কতটুকু তা বুঝার চেষ্টা করেছি। সব সময়ে দেখেছি, তারা সমালোচনাতে যত উস্তাদ, করণীয় বিষয়ে ও ইতিবাচক তত্ত্ব-প্রস্তাবনায় ততটাই পলায়নপর, অনিচ্ছুক ও ইনকনসিসটেন্ট। কিছু যদি নিতান্তই বলতে হয়, তা ওই যে বললাম, মাল্টিলেয়ারে ও পর্যাপ্ত ভ্যাগনেস সহ বলে। ওসবে আামার আর অতটা ইন্টারেস্ট নাই।
সারারাত রামায়ন পড়ে সকালে বলে, সীতা কার বাপ?
আমার ‘মজহার পন্থা’র সমালোচনা করে বিজ্ঞ পাঠক এমনও মন্তব্য করেছেন, “যেই প্রিজম দিয়ে সমাজ দেখেন সেইটাতো সামগ্রিক না ভাই। জাতীয় রাজনীতি, জাতীয় অর্থনীতি, কালচার, সাহিত্য, ইতিহাস, কনফ্লিক্টিং আদর্শের কম্প্রিহেন্সিভ বুঝ এবং সমাধান পেশ করতে না পারলে শুধু ধর্মতত্ত্বের সিংগেল প্রিজম দিয়ে সমসাময়িক মানব, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যার সমাধান হয়না।” এ যেন ‘সারারাত রামায়ন পড়ে সকালে ‘সীতা কার বাপ’ – এমন প্রশ্ন করা! আশ্চর্য! আমি উক্ত পাঠকের অন্য একটা মন্তব্য পড়ে ভাবছিলাম, তিনি আমার লেখালেখির সাথে পরিচিত। দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো।
আমি তো ইসলামের ধর্মবাদী ব্যাখ্যাকে ভুল মনে করি। আবার ইসলামকে জামায়াতের মতো রাজনীতির লক্ষ্যে পরিচালিত ধর্ম মনে করি না। ধর্ম ও রাজনীতির অভিন্নতা কিংবা পারষ্পরিক বিরোধিতার দাবিকে সমভাবে তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি বলে মনে করি। আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে ইসলাম এমন একটা ব্রড বাউন্ডারি, যার মধ্যে রয়েছে মানবজীবনের সব দিক সম্পর্কে মৌলিক নীতিগত নির্দেশনা। ধর্মও তার একটি। যদিও ধর্মীয় বিষয়গুলোতে ইসলাম অধিকতর সুনির্দিষ্ট, কাঠামোগত ও প্রায়োগিক নির্দেশনা প্রদান করে।
তাই, সবকিছুকে আমি ধর্মতত্ত্বের প্রিজম দিয়ে দেখি – এটি সঠিক নয়। অন্য সবার মতোই আমার বিশেষ এক বিশ্বদৃষ্টি বা প্যারাডাইম আছে। তাকে যদি প্রিজম বলা হয় তাহলে বলতে হয়, হ্যাঁ, অবশ্যই সবকিছুকে আমি তাওহীদের প্রিজম দিয়ে দেখি। অতএব, বলুন, প্রিজম ছাড়া কে দেখে, কী দেখে? দেখা-দেখির বিষয়টা তো চোখ দিয়েই ঘটে? অথবা, মন দিয়ে? আচ্ছা, জ্ঞানগত দেখাদেখি না হয় জ্ঞানের আধার হিসাবে মন দিয়েই ঘটে। তো এই চোখ বা মন, যা দিয়ে আমরা দেখি, তা কার? কেন সেটি তেমনই দেখায়? যা দেখা যায়, তা কি সব সময়ে তা-ই? আমরা কার চোখ দিয়ে দেখি? কার মন দিয়ে ভাবি? প্রত্যেকেরটা তো প্রত্যেকেরই। নাকি? আমাদের চোখ বা মন কি এক একটা প্রিজম-সদৃশ নয়? তা যদি না হয়, তাহলে একই জগতের এতো ভিন্ন ভিন্ন পাঠ ও জ্ঞান কেন?
সমস্যা হলো, ইসলামের আন্ডারস্টেন্ডিংয়ের। কিছু মাজারকেন্দ্রিক ভ্রান্ত মতানুসারী ছাড়া বৃহত্তর পরিসরে মুসলমানদের ইসলামী আক্বীদা সহীহ হলেও কীভাবে সমকালীন বাস্তবতায় ইসলামকে কায়েম করতে হবে, ইসলাম কায়েম বলতে আসলে কী বুঝায়, এর ধাপগুলো কী হবে এবং কীভাবে সেগুলো পার হওয়া যাবে – এসব নিয়ে এমনকি ইসলামী আন্দোলনপন্থীদেরও মৌলিক তত্ত্বগত গলদ রয়েছে। এতো গেলো ভিতর দিক থেকে সমস্যা। ইসলামের বাহির থেকে যারা ইসলামিস্টদের পর্যবেক্ষণ করেন ও নানা মতলবে তাদেরকে ব্যবহার করতে চান অথবা ইসলামপন্থীদেরকে যে কোনো প্রকারে ঠেকাতে চান, তারা এ নিয়ে দুই ধরনের সমস্যার মধ্যে আছে। (১) হিস্টোরিকেল এনালাইসিস নির্ভরতার পরিবর্তে থিমেটিক এপ্রোচে অর্থাৎ ভিতর দিক থেকে জীবনাদর্শ হিসাবে বুঝার সমস্যা। এবং (২) ইসলামপন্থীরা কী করতে চায় তা উপলব্ধি করার সমস্যা। অবশ্য, এই দ্বিতীয় সমস্যাটা, এক অর্থে, কমন প্রবলেম। বোথ ইসলামপন্থী, সুযোগসন্ধানী ও বিরোধী পক্ষের। যে কারণে অর্থাৎ ইসলামকে মূলত ধর্ম মনে করার কারণে আমি ইসলামপন্থীদের সব সময়ে সমালোচনা করি, আমার উপরে সেটিই বিজ্ঞ মন্তব্যকারী আরোপ করেছেন। উনার বিশেষ প্রিজমের আলোকে উনি এমনটা দেখছেন। এ ছাড়া এ ধরনের উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা কেন তা বুঝতে পারছি না।
বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃক্তিক জনপরিমণ্ডলে জামায়াত হলো একটা ট্যাবু
বিজ্ঞ মন্তব্যকারীর ভাষাটা দেখুন। তিনি বলছেন, “আপনি কিছু জামায়াতী ওনা-পানা করলেন যেটা খুব ভাল ঠেকেনি। কিশোরসুলভ হয়ে গেল মনে হয়েছে’’। আমার এলাকায় আমি এক সময়ে শিবিরের নেতা ছিলাম। কর্মজীবনের বৃহদাংশে সেখানকার জামায়াত নেতা ছিলাম। এখন আমি জামায়াত-শিবিরকে ডিজওন করে নিজের মতো কাজ করছি। জামায়াতের সমালোচনা করে আমি ২০১০ সাল হতে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা লিখেছি তা সংকলন করলে কয়েকশত পৃষ্ঠার একটা গ্রন্থ হবে। এমন একটা গ্রন্থ প্রকাশের চিন্তাভাবনাও আমি করছি। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায় আগামী দিনের উপযোগী ইসলামী আন্দোলনের রূপরেখা, কর্মপদ্ধতি ও তাত্ত্বিক ভিত্তি কেমন হওয়া উচিত, সেসব নিয়ে আমার লেখাগুলোর সংকলন করা হলে তাও কয়েক শত পৃষ্ঠার আরেকটা গ্রন্থ হবে। দলনিরপেক্ষ সমমনাদের নিয়ে আমার এ কর্মপ্রয়াসকে যাতে জামায়াতের সংস্কার প্রচেষ্টা মনে করা না হয় তার জন্য আমি দীর্ঘ নোট লিখেছি। অথচ একে সম্মানিত মন্তব্যকারী ‘জামায়াতী ওনা-পানা’ হিসাবে বিবেচনা করলেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। কারণ, জামায়াত হলো বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জনপরিমণ্ডলে (public intellectual sphere) একটা নিষিদ্ধ জিনিস বা ট্যাবু।
জামায়াত প্রসংগে লিখবেন? কিছু বলবেন? আপনাকে সর্বাংশে জামায়াতের বিরোধিতাই করতে হবে। একে সদাসর্বদা ভিলেন হিসাবে দেখাতে হবে। কোনোক্রমেই জামায়াতের পক্ষে যায় এমন কোনো কথা বলতে পারবেন না। বললে আপনি নিঃসন্দেহে জামায়াত, অন্ততপক্ষে ছুপা-জামায়াত। যদ্দুর জানি, তাবৎ জামায়তাবিরোধীরা আমাকে জামায়াত হিসাবেই বিবেচনা করে। কারণ আমি জামায়াতের ইতিবাচক দিকগুলোকে স্ট্রংলি এক্সপোজ করি। ‘কেন আমি জামায়াতের সংস্কারবাদী নই’ শীর্ষক নোটের শেষের দিকে আমি এ দেশে জামায়াতের লেজিটেমিসির দিকটার ওপর মন্তব্য করেছি।
শুধু আমি কেন, অপরাপর বামপন্থীদের দৃষ্টিতে ফরহাদ মজহারও জামায়াত। ওই যে, জামায়াত-ট্যাবু! জামায়াতকে যে ধুয়েমুছে দিবে না, সে আদতে জামায়াত! এক দৃষ্টিতে অনেক ব্যর্থতার মাঝে এটি জামায়াতের অন্যতম প্রধান অর্জন বৈকি (?)। কেননা, যারাই ইসলামের সামাজিক ও বৃহত্তর প্রয়োগযোগ্যতার কথা বলেছে তারা সবাই ‘প্রগতিশীল’দের দৃষ্টিতে শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো পর্যায়ের জামায়াত।
নোট না পড়েই দীর্ঘ আক্রমণাত্মক বক্তব্য –
আলোচ্য ‘সহৃদয়’ পাঠক শেষ পর্যন্ত নিজের মন্তব্যে নিজেই প্রমাণ করলেন যে, তিনি আমার নোটটা ভালো করে পড়েন নাই। পড়লে উনি “আপনার যদি ফরহাদ সাহেবের কোন মতামতের বা দর্শনের সুনির্দিষ্ট সমালোচনা, পর্যালোচনা থাকে তাহলে জানালে উপকৃত হতাম” – এমন মন্তব্য করতেন না।
‘কেন আমি জামায়াতের সংস্কারবাদী নই’ শীর্ষক নোটের ১ম পর্বে উক্ত পাঠক মন্তব্য করেছেন, “…সমস্যার ‘কি’ নিয়ে আলোচনা এগুলো কিন্তু ‘কেন’ এর কোন চিহ্ন পাওয়া গেলনা।আপনার আগের লেখাগুলোরই পুনরাবৃত্তি দেখলাম”। তাতে মনে হলো তিনি আমার লেখালেখির সাথে পরিচিত। অথচ আমি যে প্রথম থেকেই ফরহদা মজহারের সাথে কোনো প্রকার বাহাসে লিপ্ত হতে অনিচ্ছুক তা কীভাবে তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলো? মজহার পন্থা নিয়ে আমার উক্ত নোট লেখার কারণ হলো জামায়াতের লোকদের বুদ্ধিবৃত্তিক হীনমন্যতাবোধকে উন্মোচিত করা এবং উনার সাথে যারা আমাকে বসাতে চান তাদের কাছে ফরহাদ মজহার ও আমার বেসিক লাইন অব থট বা প্যারাডাইমগত ভিন্নতার বিষয়টা ক্লিয়ার করা। জামায়াতের এই মজহারভক্ত সংস্কারবাদীরা আমাকে বারম্বার অনুরোধ করে বাধ্য করেছেন উনার লন্ডন বক্তৃতার ওপর কিছু পর্যালোচনামূলক লেখা লিখতে। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও আমি (১) ‘ইসলামের দার্শনিক ব্যাখ্যার সমস্যা ও ইসলামে দর্শনের পরিসর‘, (২) ‘ব্যক্তি ও সমাজের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা বনাম ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি‘, (৩) ‘সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাই কি ইসলামের লক্ষ্য?‘ ও (৪) ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিতে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার‘ শীর্ষক চারটি বড় প্রবন্ধ লিখেছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমার ধারণায় উক্ত জামায়াত ঘরানার মজহার ভক্তবৃন্দ এগুলোর কোনোটাই ভালোমতো পড়েন নাই।
দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য মন্তব্যকারীও এই লিংকগুলোতে ভিজিট করেন নাই। অথবা, মজহার ভক্তকূলের মতো একটু নজর বুলিয়েই ‘কারজাভীর ইসলাম এমন’, ‘মওদূদীর ইসলাম তেমন’ ধরনের গ্রস মন্তব্য করছেন। আগে পড়ুন। বিশেষ করে প্রথম তিনটি লেখা মৌলিক। ভালো করে পড়ুন। এরপর মন্তব্য করুন।