ইসলাম একটা মতাদর্শ। কোরআনে একে দ্বীন বলা হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে জীবনব্যবস্থা। এমন এক জীবনব্যবস্থা যার মধ্যে দর্শন, ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, রাজনীতি ও যুদ্ধ সংক্রান্ত মূলনীতিসহ রয়েছে মানবজীবনের সাথে সম্পর্কিত সব বিষয়।
ইসলামকে যারা সামগ্রিক অর্থে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসাবে দাবি করেন তারা মনে করেন ইসলাম এমন একটা ধর্ম যার মধ্যে আছে রাজনীতিসহ সবকিছু। আমি এ ধরনের অবাস্তব দাবির বিরোধিতা করি। এ নিয়ে আমার বিস্তারিত লেখা আছে। আজ আমি সংক্ষেপে অন্য একটা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করবো। সেটি হলো অন্যান্য মতবাদ ও আদর্শের সাথে ইসলামের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সম্পর্ক।
ইসলামপন্থীরা সাধারণত মনে করেন, ইসলাম এমন একটা ধর্ম বা আদর্শ যার সাথে অন্যান্য ধর্ম, মতবাদ ও আদর্শের কোনো মিল নাই। তাদের ধারণা, এই ধরনের নেতিবাচক তথা exclusionist অর্থেই ইসলাম অনন্য। ইসলামকে আমিও অনন্য মনে করি। তবে আমার ধারণা, অন্যান্য মত ও পথের সাথে এর কমবেশি মিল-অমিল দুটোই রয়েছে। অপরাপর প্রত্যেকটা মতবাদের রয়েছে কিছু সদর্থক দিক, কিছু নঞর্থক দিক। ইসলামের অনন্যতা এখানেই যে, সে অন্যান্য মতাদর্শের সদর্থক দিকগুলোকে যথাযথভাবে ধারণ করে। সাথে সাথে অনন্যসাধারণ ব্যঞ্জনায় সেসব মতবাদ ও আদর্শের অসামঞ্জস্য ও ত্রুটিসমূহকে সংশোধন করে। অর্থাৎ, নঞর্থক দিকগুলোকে খণ্ডন ও বর্জন করে। এ ধরনের গ্রহণ, সংশোধন ও বর্জনের অতিরিক্ত হিসেবে, এমন বিশেষ কিছু সদর্থক বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে যা অন্য কোনোটার মধ্যে পাওয়া যায় না। আমার বিবেচনায়, ইসলামের অনন্যতা এইখানে।
উপরের চিত্রে যেমনটা দেখছেন, প্রত্যেকটা বৃত্ত অপরাপর বৃত্তগুলোর ছোট-বড় বিভিন্ন অংশকে ধারণ করে আছে। আমরা জানি, দুটি বৃত্ত যখন একটি অপরটির উপর জড়িয়ে থাকে তখন সেই বৃত্ত দুটির কিছু অংশ হয় অভিন্ন। তেমনি কিছু স্বাতন্ত্র্যও থাকে। প্রতিক্রিয়াশীল মন-মানসিকতার লোকেরা যেমন অর্ধেক পানিভর্তি গ্লাসের খালি অংশটুকুই বেশি দেখে, তেমনি করে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন অনুসারীরা স্বীয় আদর্শের সাথে ‘অপর আদর্শের’ যেটুকু বেমিল, ততটুকু অংশকেই বেশি বেশি দেখে। যার ফলে অভিন্ন অংশের ভিত্তিতে পরষ্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক, অন্তত ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তোলার সম্ভাবনা তাদের কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। তাই ঐক্যের পরিবর্তে পরস্পরকে নির্মূলকরণকেই তারা একমাত্র কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করে। অগত্যা একসাথে থাকতে বাধ্য হলেও পরস্পরকে তারা ঘৃণা ও সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে।
‘অপরের’ প্রতি সন্দেহ ও ঘৃণার ভিত্তিমূলের উপর কোনো আদর্শের টেকসই সৌধ নির্মাণ অসম্ভব। সব মানুষের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালোবাসাই হলো যে কোনো মানবিক সমাজের ভিত্তি।
এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার এ কথাগুলো অংকের সূত্র বা জ্যামিতির আকারের মতো সত্য। যে কোনো আদর্শের দিক থেকে আপনি এই ‘মতাদর্শগত বৃত্ত-সূত্রকে’ মিলিয়ে দেখতে পারেন। আমারও ইচ্ছা আছে ইসলামের সাথে বর্তমান জমানায় প্রচলিত ধর্ম, মত ও আদর্শসমূহের তুলনামূলক বিশ্লেষণ তুলে ধরার, যাতে করে হাতেকলমে সবাই বিষয়টা ভালো করে বুঝে নিতে পারে। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও নেতিবাচক মানসিকতার কারণে বুদ্ধিবিকল, তাদের কথা ভেবে লাভ নাই। চিন্তাশীলদের জন্য এসব কথাবার্তা।
বছর চারেক আগে কয়েকজন শ্রোতার সম্মুখে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। সেটার অডিও রেকর্ড হতে একটা শ্রুতিলিখন আমাকে একজন সহকারী করে দিয়েছিলেন। এফোর সাইজের কাগজে ২২ পৃষ্টার টাইপ…।
‘ভালোভাবে’ লিখবো, এই ‘ফেতনার’ কবলে পড়ে এতদিনেও অত্যন্ত মৌলিক এই লেখাটা লেখা হয়ে ওঠে নাই। এ জন্য প্রায় সময়েই আফসোস হয়। ভাবলাম, যা-ই হোক, মূল কথাটুকু লিখে দেই। আসলে প্রত্যেকটা আদর্শের আছে একটা তাত্ত্বিক দিক। একটা কর্মপরিকল্পনার দিক। এর সাথে আছে এর অনুসারীগণ কর্তৃক একে বাস্তবায়নের ইতিহাস। এসব কিছু নিয়েই একটা আদর্শ। কোনো কোনো মতবাদ ও আদর্শের ক্ষেত্রে তত্ত্বটা এক নম্বর জিনিস। আবার কোনো কোনো আদর্শের ক্ষেত্রে কর্মপরিকল্পনাটাই মূখ্য। তত্ত্বটা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সংশ্লিষ্ট মতবাদ বা আদর্শটিকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এর অনুসারীদের হাতে ভালোমন্দ মিলিয়ে যে ইতিহাস ও বাস্তবতা তৈরী হয়েছে, আদর্শবিশেষকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রায়শই তার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। অবুঝ ও অত্যুৎসাহী অনুসারীদের হাতে আদর্শের অপব্যবহারের বিষয়টি সব আদর্শের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। আদর্শকে তত্ত্ব ও কর্মপরিকল্পনার মূল প্রস্তাবণার পরিবর্তে, অর্থাৎ এর তাত্ত্বিক সুসামঞ্জস্যতার পরিবর্তে নিছক ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলোকে মূল্যায়ন করার প্রচলিত প্র্যাকটিসটা আমার দৃষ্টিতে ভ্রান্ত ও বিভেদমূলক।
ইসলামের দিক থেকে যদি বলি, ইসলামের সাথে সব ‘মানব রচিত’ মত, পথ, তত্ত্ব ও আদর্শের রয়েছে অনস্বীকার্য কমন গ্রাউন্ড বা সাযুজ্যতা। সেটি তত্ত্ব ও কর্মপরিকল্পনা, উভয় ক্ষেত্রেই। একটা তত্ত্ব বা আদর্শ গড়ে উঠার প্রেক্ষাপট, পরিবেশ, উপাদান, পর্যায় ও যুক্তিধারার সাথে অন্য একটা পার্টিকুলার তত্ত্ব বা আদর্শ নির্মাণের প্রেক্ষাপট, পরিবেশ, উপাদান, পর্যায় ও যুক্তিধারার বেশ খানিকটা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আগানোর এক পর্যায়ে একটা একদিকে মোড় নিয়েছে, অন্যটা আর একদিকে বাঁক নিয়েছে। অবশ্য কোনো দুটি আদর্শ অভিন্ন প্রেক্ষাপট, পরিবেশ, উপাদান, পর্যায় ও যুক্তিধারা সম্পন্ন নয়। এসব ফ্যাক্টরের ভিন্নতার কারণে একই মতবাদ ও আদর্শেরও ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য গড়ে উঠে।
দুটি ভিন্ন উপসংহার মানে রচনা দুটি শুরু থেকে উপসংহারের আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, এমন নয়। এমনকি, উপসংহারের ভিন্নতা মানেও এই নয় যে, এর সব বিশেষ খণ্ডাংশগুলোও স্বতন্ত্র। এমনকি একই কথাবার্তা বা বাক্যাংশের ভিন্নতর এরেইন্জমেন্টের কারণে শেষ পর্যন্ত মর্মার্থ ভিন্নতরও হয়ে যেতে পারে।
এসব নিছকই তাত্ত্বিক কথা। ইসলামের সাথে এক একটা আদর্শের স্বতন্ত্র ও বিস্তারিত তুলনামূলক আলোচনা না করলে সব পাঠকের কাছে আমার এ কথাগুলো পুরোপুরি ক্লিয়ার হবে না। বুঝতে পারছি। তারপরও, কখন নাই হয়ে যাই, বলা তো যায় না। এই অনুভূতির ফলে বলে রাখার জন্যই এটুকু বলা। কেউ না বুঝলে স্পেসিফিক প্রশ্ন করতে পারেন। অতিসংক্ষেপে জওয়াব দেয়ার চেষ্টা করবো। এটি খসড়া রচনা। সম্ভাব্য কোনো ভুল বুঝাবুঝির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থাকুন। আমার জন্য দোয়া করতে ভুলবেন না যেন…।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য–প্রতিমন্তব্য
Arafat Alam: যদি এমনটাই হই, দেখলাম যে অন্য ধর্ম বা মতাদর্শে ইতিবাচক কিছু রয়েছে যা আমার ধর্মে বা মতাদর্শে নেই, তখন আমি কিংবা আমরা কি তা গ্রহণ করতে পারবো??
Mohammad Mozammel Hoque: everyone has got every right to choose or switch his or her ideology if he or she finds something better. One can’t belong two rival ideologies all at a time. What I have written is on the compatibility. Compatibility and proposal are two different phenomena. Islam is better than any other else in its totality of basic proposal and in its compatibility with other ideologies.