ছোট কিন্তু আর্দ্শবাদী দল যদি ক্ষমতাপন্থী বড় দলের সাথে দীর্ঘ মেয়াদী ঐক্য করে তার পরিণতিতে ছোট দলটির বৈপ্লবিক সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া অনিবার্য। তার মানে এই নয় যে ছোট কোনো দল, বড় কোনো দলের সাথে ইস্যুভিত্তিক কোনো ঐক্য করবে না। হ্যাঁ, করবে। তবে, ওই যে বললাম ‘ইস্যুভিত্তিক’ ঐক্য করবে।
কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে ঐক্য তা হবে সাময়িক। এ ধরনের কোনো “মাঠের ঐক্য” যে কোনো আন্দোলন বা সুনির্দিষ্ট কোনো ইস্যুতে হতে পারে। গড়পরতা এর মেয়াদ হওয়া উচিত বড়জোর এক বৎসর। এটি আমার দৃঢ় অভিমত।
বছরের পর বছর ধরে যে ঐক্য, নামে যা-ই হোক না কেন, তা আসলে ইস্যুভিত্তিক ঐক্য নয়, বরং আদর্শগত ঐক্য। বিভিন্ন বিষয়ে অভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে যা প্রকাশ পায়। আদর্শ হলো কাঁচা মাটির মতো। নির্দিষ্ট ছাঁচে মেয়াদ পূর্তি ব্যতিরেকে আদর্শ গড়ে উঠে না। উঠলেও তা টেকসই হয় না। তাই আদর্শ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার গঠন পর্বে ক্ষমতার আঁচ, এসব মৌলিক গুণাবলী বিকাশের জন্য ক্ষতিকর।
দীর্ঘমেয়াদী ঐক্য হতে পারে সমআদর্শের দলগুলোর মধ্যে। ভাগে কোরবানী দেয়ার ক্ষেত্রে শরীকদার একজনেরও কোরবানীর অর্থ যদি অবৈধ হয়, তাহলে, হুজুরেরা বলে, বাকী কারো কোরবানী ক্ববুল হবে না। এই ফতোয়ার অথেনটিসিটি সম্পর্কে বলতে পারবো না। তবে, দলগত ঐক্যের ক্ষেত্রে এটি যে পুরোপুরি সত্য তা অভিজ্ঞতা হতে বুঝতে পারি। জোটের মধ্যে আদর্শের ব্যাপারে গাফেল একটা শরীক দল পুরো জোটকে নীতিগত দিক থেকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
আদর্শ ও ক্ষমতা একটি অপরটির চেয়ে চরিত্রগতভাবে ভিন্ন। আদর্শের জন্য ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে হয়। তাই বলে ক্ষমতার জন্য কেউ আদর্শকে ব্যবহার করা শুরু করলে তা সংশ্লিষ্ট আদর্শবাদী দলের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
পাওয়ার পলিটিক্স যারা করে তাদের জন্যও এটি খানিকটা সত্য। হতে পারে কারো আদর্শবোধ সংকীর্ণ ও কঠোর, কারো আদর্শবোধ প্রশস্ত ও উদার। আদর্শবোধ কঠোর-উদার যা-ই হোক না কেন, আদর্শকে ক্ষমতার অনুগামী করা নিঃসন্দেহে বিপদজনক প্রবণতা। এ ধরনেরই সমাজবিরোধী রাজনৈতিক অপধারাকে যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। ক্ষমতাকে বরং আদর্শ বাস্তবায়নের চালিকা শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
এগুলো কোনো মাস্টার মশাইয়ের নিছক নীতিকথা মাত্র নয়। এ ধরনের কথাগুলো হচ্ছে নাগরিক মর্যাদা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র।
ছাত্রজীবনে আমি ইসলামী আদর্শের অনুসারী একটা দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তখন আমাদের সিনিয়ররা বলতেন, “দেখেন, ক্ষমতাপন্থী, মানে পাওয়ার পলিটিক্স করে এমন দলের সাথে কোনো প্রকারের ঐক্য করা যাবে না। এমনকি নির্বাচনের মতো ইস্যুতেও না। যদি তা করা হয়, তাহলে আদর্শ নৈতিকতা ইত্যাদি মাঠে মারা যাবে।” আওয়ামী লীগের সাথে বামপন্থীদের ঐক্য করার পরিণতিকে উনারা উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরতেন।
বলা বাহুল্য, ‘মৌলবাদ’ নির্মূলের কৌশল হিসাবে এ দেশের কম্যুনিস্টরা আওয়ামী লীগের ঘাড়ে ছওয়ার হয়েছিলো। এ দেশের সাম্যবাদীদের দুর্ভাগ্য, আজ পর্যন্তও তারা বাঘের পিঠ হতে নামার সুযোগ পাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত রাজনীতির ময়দানে বি-টিম হিসাবেই তাদের ‘অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ চালিয়ে নিতে হবে।
ঘোলা জলে মাছ শিকার করার এই অতি-চালাকির কী করুণ পরিণতি…!
যাহোক, ছাত্রজীবনে যারা আমাদের এসব প্রপজিশন বা নীতিবাক্য শিখাতেন তাদেরই একজন এখন একটা প্রভাবশালী ইসলামী দলের কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি ব্যক্তিগতভাবে আমার শ্রদ্ধেয়। আমার ইচ্ছা করে, উনাকে জিজ্ঞাসা করি, “তখন ঐক্য না করে আপনারা কি ভুল করেছিলেন? নাকি, এখন বুঝেও অবুঝের মতো ঐক্য-ঐক্য খেলছেন?” জানি, উনাকে এই প্রশ্ন করা হবে না। অথবা, এর কোনো সদুত্তর উনার কাছে নাই। ওসব নিয়ে আমি তেমন একটা আর ভাবিও না। ব্যক্তিগতভাবে খারাপ লাগার জন্য এই লেখা, এমনও নয়।
অতীতে যারা ভুল করেছে, এখনো যারা ভুল করে যাচ্ছে তারা যা করার করুক। তাতে আমার খুব একটা মাথা ব্যাথা নাই। একই ভুল যাতে ভবিষ্যতের পথিকেরাও না করে, এ ব্যাপারে যাতে তারা সতর্ক থাকে সে জন্য এই ধরনের লেখালেখি।
আদর্শবাদী দলের নেতা-কর্মীরা যখন ক্ষমতার ভাগ পায় তখন তারা শিকারী প্রাণীর মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। নীতি-আদর্শ বা ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সম্ভাবনা বা সমস্যা – এক কথায় কোনো কিছুই তাদেরকে ক্ষমতার পানে ছোটা হতে বিরত রাখতে পারে না।
ক্ষমতার স্বাদের মধ্যে এমন মাদকতা আছে যা দুর্নিবার। সওয়াব, আখেরাতের লাভ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি ইত্যাদি ধরনের চিন্তা ছাড়াই শুধু আর একবার ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য সেকুলার-ক্ষমতাপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও তো কতো জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে।
তাই, নির্যাতিত হওয়াই কারো সঠিক হওয়ার প্রমাণ নয়। যদিও হকপন্থী হলে নির্যাতিত হওয়া অনিবার্য।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Ajijul Hasan Nayeem: আমাদের কি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই? যদি প্রয়োজন হয় তাহলে কিভাবে এগুতে হবে?
Mohammad Mozammel Hoque: আদর্শের ব্যাপারে আপস করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেয়ে আদর্শকে অটুট রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ক্ষমতার জন্য আদর্শ, আর আদর্শের জন্য ক্ষমতা – দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন তরীকা।
Engr Md Atikur Rahman: আপনি বলতে চাচ্ছেন, আদর্শকে অটুট রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি একমত। ধরুন, আদর্শকে অটুট রেখে চেষ্টা করা হলো এবং ক্ষমতা পাওয়া গেল। সেক্ষেত্রেও আদর্শবাদীরা ক্ষিপ্ত শিকারী হয়ে উঠবে কি না?
Mohammad Mozammel Hoque: কেউ কেউ তো করবেই। অতীতেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। সাহাবী-তাবেয়ীদের মধ্যেও হয়েছে।
Engr Md Atikur Rahman: সামারীটা এমন হতে পারে – আদর্শকে অটুট রেখে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বাস্তবে কাজ করতে যেয়ে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে যেতে পারে-তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেতে হবে। টার্গেট থাকবে – Tend to Zero defect (যদিও বাস্তবে তা সম্ভব না)। আদর্শকে কখনই ছাড় দেয়া যাবে না। ধন্যবাদ।