ফিলোসফিতে অ-আকারগত যুক্তিবিদ্যা (informal logic) বলে একটা পেপার আছে। এতে যেসব অনুপপত্তি (fallacy) নিয়ে আলোচনা করা হয় তারমধ্যে, মানে এ সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তকগুলোর মধ্যে, আমি কিছু কিছু জেনুইন অনুপপত্তিকে পাই না। এর একটি হলো, আমার ভাষায়, উদাহরণের অনুপপত্তি (fallacy of examples)। দুটি দৃশ্যত সমপর্যায়ের উদাহরণের একটি আমাদেরকে যে ধারণা দেয়, কখনো কখনো দেখা যায়, অপরটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা দিচ্ছে। অথচ, এই যে বলা হলো, দুইটা উদাহরণই কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে একই ক্যটাগরিভুক্ত।

যেমন, কেউ প্রিজম দিয়ে দেখে। এটি দেখার একটা রকম। আবার আমরা নিজ নিজ চোখ দিয়েই সবকিছু দেখি। আমার চোখ আমার একান্ত দৃষ্টিকোণ। আবার আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ছাড়াও অন্যান্যদের চোখ বা চোখের দৃষ্টিকোণ দিয়েও দেখতে পারি। চোখের মাধ্যমে দেখা আর প্রিজমের মধ্য দিয়ে দেখা, দু’টাই একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ হতে দেখা।

বলতে পারেন, দেখার ব্যাপারটাকে সর্বজনীন বা নৈর্ব্যক্তিক করতে হলে বিশেষ দৃষ্টিকোণকে বাদ দিতে হবে। আসলেই কি তাই?

nowhere point of view বা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ বলে কোনোকিছু কি আদৌ আছে? বা সম্ভব? শুধুমাত্র ঈশ্বরের দৃষ্টিই হতে পারে নির্বিশেষ। কারণ তিনি জগতের অতিবর্তী। এমনকি ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গি নৈর্ব্যক্তিক হলেও ঈশ্বর ও ঐশ্বরিক বাণীকেও আমরা আমাদের ব্যক্তিবিশেষের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যনির্ভর কথাবার্তা দিয়েই বুঝি। আমরা যেহেতু ঈশ্বর নই, হওয়ার প্রশ্নও যেহেতু আসে না, তাই আমরা আমাদের মতো করেই বুঝি বা বুঝতে বাধ্য।

ফলকথা হলো, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মানেই ব্যক্তিক তথা কারো না কারো ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিনির্ভর। তাহলে, আমরা জ্ঞানের সর্বজনীনতা কোথায় পাবো?

আচ্ছা…। কে বলেছে, জ্ঞান সর্বজনীন বা universal? ভাষার মতো জ্ঞানও নির্দিষ্ট কমিউনিটি নির্ভর ফেনোমেনা। এক একটা ভাষাগোষ্ঠীর মতো জ্ঞানও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তাগোষ্ঠীর ব্যাপার। দুনিয়ার সব মানুষেরা যেমন একই ভাষায় কথা বলে না তেমনই দুনিয়ার সব মানুষেরা সব কিছুকে একই ধরনের জ্ঞানচর্চায়ও গ্রহণ করে না। যার যার অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানুষ জ্ঞান নির্মাণ করে। যাকে আমরা জ্ঞান অর্জন করা বলি তা তো আদতে ব্যক্তির নিজস্ব বিবেচনার ব্যাপার। একই ভাষাভাষি জাতি-গোষ্ঠীর মতো সমচিন্তার ব্যক্তিবর্গ এক একটা জ্ঞানগোষ্ঠী (knowledge community) হিসাবে পরিচিত হয়।

বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠী যেমন পরস্পরের সাথে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যের মাধ্যমে পরিচিত হয় তেমন করেই বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠী স্বতন্ত্র জ্ঞানচর্চার ধারা হিসাবে পরষ্পরের সাথে পরিচিত হয়। এই পরিচয় কখনো বন্ধুত্ব কখনো সংঘর্ষে প্রসারিত হয়।
হ্যাঁ, ভাষা যতটা ভিন্ন ভিন্ন, ভাব ততটা ভিন্ন ভিন্ন হয় না। ভাবটা বরং একই। উচ্চারণ ও শব্দগত পার্থক্য মানে ভাবেরও পার্থক্য, এমন নয়। কে কতটুকু কীভাবে ভাবটাকে আসতে দিচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে ভাবের পার্থক্য। কেউ যদি গরম বাতাসের সুইচ অন করে তাহলে সে গরম বাতাস পাবে। কেউ যদি ঠাণ্ডা বাতাসের সুইচ অন করে তাহলে সে ঠাণ্ডা বাতাস পাবে। এরমানে, যে যে ধরনের ভাবকে পছন্দ করবে সে সেই ধরনের ভাবের দরজাকেই খুলবে।

এবার আমাদের মূল টপিক, প্রিজম আর চোখের উদাহরণে ফিরে যাই। প্রিজম এক ধরনের কাঁচের কৌণিক গঠন যার মধ্য দিয়ে আলোর বর্ণচ্ছটা তৈরী হয়। বর্ণগুলো যখন একসাথে থাকে তখন আমরা সেটাকে স্বাভাবিক আলো বলি। প্রিজমের গঠনগত কারণে সেটির মধ্য দিয়ে যখন কোনো ‘স্বাভাবিক আলো’র রশ্মি প্রবেশ করে তখন তার মধ্যে সুপ্ত বা প্রচ্ছন্ন থাকা আলোর বর্ণালীগুলো স্বতন্ত্রভাবে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রিজম কি বর্ণ তৈরী করে? না, বর্ণালীগুলো প্রিজম তৈরী করে না। বরং, ভেতরে জড়িয়ে থাকা, দৃশ্যত ‘বর্ণহীন’ মনে হওয়া আলোর জড়িয়ে থাকা বর্ণগুলোকে সে বিশ্লেষণ করে দেখায়। যদি তাই হয়, তাহলে কি প্রিজমকে ‘অযথা রং তৈরী করার’ ‘দোষে’ অভিযুক্ত করা যায়?

প্রিজম নিয়ে এ ধরনের বিশ্লেষণমূলক কথাবার্তাগুলোকে এড়িয়ে আমরা আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম, প্রিজম দিয়ে দেখা যাবে না, খালি চোখেই দেখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রিজমের তুলনায় চোখকে প্রেফার করলাম। চোখের, মানে খালি চোখের, দেখাটাকেই ‘আসল দেখা’ মনে করলাম। যদিও সব ‘খালি চোখের’ দৃষ্টিশক্তি সমান নয়। সেটাকেও আমরা আপাতত অগ্রাহ্য করে ‘খালি চোখকেই’ স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে গ্রহণ করলাম।

তাতে কি মানদণ্ডের সমস্যা মিটেছে? মোটেও না। কারণ, ওই যে বললাম, শুধুমাত্র ঈশ্বরের ‘চোখই’ হতে পারে নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক। মানুষ মাত্রই নিজের অবস্থান হতে দেখে। তাই তা খণ্ডিত এবং সেই অর্থে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ হতে বাধ্য। বড়জোর একই অবস্থান হতে দেখা ব্যক্তিবর্গের একটা সমদৃষ্টিভঙ্গি গঠন হতে পারে। জ্ঞানের জন্য যে সর্বজনীন নিশ্চয়তার দাবী করা হয় তা আসলে মানুষের পক্ষে অর্জন করা অসম্ভব। এসব জ্ঞানতত্ত্বের তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। এসব থাক।

প্রসংগ হলো, আমি গতকাল একটা ছোট্ট নিবন্ধে বলেছি, “চার ধরনের মানুষ আছে। আত্মস্বার্থবাদী। আদর্শবাদী। নেতৃত্বপ্রিয়। সমাজবাদী।” ওই লেখার প্রত্যুত্তরে একজন একটা নিবন্ধ লিখে আমাকে ট্যাগ করেছেন। তাতে তিনি বরাবর যা করা হয় তাই করেছেন। কিছু বিচ্ছিন্ন কথা একসাথে জড়ো করেছেন। সেইসব কথা স্বতন্ত্রভাবে সঠিক। কিন্তু এর মাধ্যমে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা আমার কাছে ক্লিয়ার হয় নাই। সেখানে তিনি যা বলেছেন তারমধ্যে আছে, “কেউ দুই, কেউ চার, কেউ ছয় আবার কেউ দশ শ্রেণিতে ভাগ করে মানুষ জাতিকে, এতোটুকু পর্যন্ত সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু সমস্যার সূচনা হয় কেউ যখন নিজেকে এই কোন এক প্রকারের মধ্যে নিমজ্জিত করে ফেলে এবং নিজ ক্যাটাগরির ভুলগুলো দেখতে অক্ষম হয়। তখন তারা এই দলীয় প্রিজম দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে পর্যবেক্ষণ করে।”

মনে হলো, তিনি উদাহরণের অনুপপত্তিজনিত ভুলের মধ্যে পড়েছেন। একে অনুচিত বৈকল্পিক অনুপপত্তিও (either or fallacy) বলা যেতে পারে। তিনি চোখ আর প্রিজমকে আইদার-অর ফর্মেটে নিয়ে এসেছেন। অথচ, কোনো ক্ষেত্রে ‘খোলা চোখ’ই সঠিক, আবার কোনো ক্ষেত্রে প্রিজমের মাধ্যমেই সঠিক অবস্থাটা জানা যায়। স্বতন্ত্রভাবে দু’টাই সঠিক। চোখের সামনে থাকা নানা উপাদানকে লোকের অনেক সময়ে সঠিকভাবে শ্রেণিবদ্ধ (categorize) করতে পারে না। যে যেটার সাথে যেভাবে থাকার নয়, চোখের দেখার উপরে নির্ভর করে সেটাকেই সেটার সাথে জুড়ে দিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। বুঝতে পারে না, কোনটা ভরকেন্দ্র আর কোনটা নিছক প্রাসঙ্গিক উপস্থিতি বা অনুষঙ্গ।

ক’দিন আগে এক জায়গায় এটি লিখেছিলাম –

“কোনো কিছুর মধ্যে কিছু উপাদান যখন অপরিহার্য উপাদান হিসাবে ক্রিয়াশীল থাকে তখন মানুষ ভুল করে মনে করে, অমুক বিশেষ উপাদানই হলো মূল উপাদান। বাদবাকি সব এরই কারণে সৃষ্ট বা উপজাত। মনে করেন, একটা বৃত্তের মধ্যে সবসময়েই ক, খ, গ, ঘ ও ঙ –কে দেখা যায়। তো, কিছু লোকেরা মনে করলো, এখানে ক-ই মূল। বাকিগুলো ক-এর ফলোআপ মাত্র। অন্যদের কেউ মনে করলো, এই বৃত্তের মধ্যে খ-ই মূল উপাদান। এভাবে যার যার মতো করে বৃত্তকে ডিফাইন করার চেষ্টা করলো। স্পষ্টত, এগুলো প্রান্তিক চিন্তা। অতএব, ভুল।

মানুষের জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রও এ রকম এক একটা বৃত্ত। প্রতিটা বৃত্তের মধ্যে আছে কিছু কমন বিষয়: রাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধক্ষমতা, যৌনতা, আধ্যাত্মিকতা, আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তি। মার্কসিস্টরা মনে করেছে অর্থনীতিই মূল চালিকা শক্তি। ফ্রয়েড মনে করেছে যৌনতাই যাহা কিছু মানবিক তা সব কিছুর বেসিক স্ট্রাকচার। এভাবে যার যার মতো করে মানুষ নিজ নিজ মনোভাবের আদলে আদর্শকে সাজিয়েছে এবং বাদবাকি সবকিছুকে তদনুযায়ী গড়ে তোলার (indoctrinate অর্থে) চেষ্টা করেছে। লক্ষ করেছি, স্মার্ট ইসলামিস্টদের অনেকেই জানে না, রাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধক্ষমতা, যৌনতা, আধ্যাত্মিকতা, আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির মতো অপরিহার্য মানবিক বিষয়ের মধ্যে ইসলামের মূল অবদান বুদ্ধিবৃত্তিক। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফিলোসফিকে কেন্দ্র করে আর যা কিছু।” [লিংক]

ভাবনার স্থানিকতা কীভাবে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠে তা নিয়ে আমার এই ভিডিওটাও দেখতে পারেন:

https://www.youtube.com/watch?v=AAbBR3uCRCE

যাকে আমরা নিরপেক্ষ দাবী করি তা দিনশেষে কোনো না কোনো পক্ষেরই অবস্থান। জেনেশুনে বা অজান্তে আমি ওই কথিত ‘নিরপেক্ষ’ পক্ষের সাথে নিজেকে আইডেন্টিফাই করি। কে যে সঠিক, কার কথাটা যে নিরপেক্ষ তা জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তি দিয়ে আমরা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও চূড়ান্তভাবে বলতে পারি না, আমিই সঠিক। আর বাদবাকি সব ভুল। তৎসত্ত্বেও আমরা মনে করি, আমিই সঠিক। অতএব, বাদবাকিগুলো ভুল। যদি আমি তা মনে না করি, তারমানে, যদি মনে করি, সবই ঠিক, সব পক্ষই গ্রহণযোগ্য, তাহলে তো আমি নিজেকে একজন অনুপযুক্ত (insane) লোক হিসাবে সাব্যস্ত করলাম। কেননা, পাগলও নিজেকে সঠিক মনে করে। দিনশেষে, কে যে পাগল, আর কে যে সুস্থ-সঠিক তা অকাট্যভাবে নির্ধারণ করার কোনো মেকানিজম, সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হিসাবে, আমাদের হাতে নাই।

ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন এবং যদি শেষ বিচার বলে কিছু থাকে তাহলে সে দিনই কেবল সবকিছুর চূড়ান্ত ফয়সালা হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এমনটাই হবে। এ ব্যাপারে আমার ঈমান অত্যন্ত মজবুত। সবকিছু তাই এখানে এখনি ফয়সালা করার ব্যাপারে আমি অনাগ্রহী। আমি শুধু আমার কথাটাই বলতে পারি। আমার কথা কেউ মানবেন কিনা, সেটি তার নিজস্ব বিবেচনা। আমি শুধু আামর যুক্তির ধারাটাকেই তুলে ধরতে পারি। আমার যুক্তি ও জ্ঞানকে গ্রহণ করার জন্য কাউকে বাধ্য করতে পারি না। প্রত্যেকে নিজের মতো করে সত্যকে খুঁজে নিক, এই-ই আমি চাই। যেভাবে আমি আমার বিশ্বাস ও জ্ঞানকে নির্মাণ করেছি, অর্জন করেছি, খুঁজে নিয়েছি।

বাই দ্যা ওয়ে, চোখের মধ্যে ফিট করা রংগিন ‘কন্ট্রাক্ট লেন্স’-এর কথা ভুলে গিয়ে আমরা ‘খালি চোখে’ দেখবো, না প্রিজম দিয়ে দেখবো, এই বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছি না তো?

ফেইসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Ebrahim Khan Samrat: কোন মানুষের নির্দিষ্ট কোন ভাবের প্রতি যে আগ্রহ সেটা কিভাবে তৈরি হয় বা তার উত্স কোথায়?

Mohammad Mozammel Hoque: সেটা তার অন্তর্গত মনোভাব থেকে আসে। ইংরেজীতে যাকে intention হিসাবে বলে। intentionality is most important. according to Islamic theology, each one will be liable for his or her intention for anything to do, not that he or she has done it or not. For the sins, mere intention to do, will be pardoned. But, for the good jobs, doing is not necessary, intend to do will count as doing the job. It’s all to favour men. In either situation, most inner tendency is the factor.

And, if you ask, where from this ‘intention’, or why any bad intention? That we don’t know. It’s related to predestination. Taqdir issue is a serious issue. I like to engage with this, but as a different issue, at some another time.

এই ভিডিওটা দেখতে পারো

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *