[কেন এই লেখা: ছোটবেলায় বেলুন নিয়ে উপরের দিকে টোকাটুকি করে খেলেছি। বেলুন যখন পড়ে যাবার উপক্রম হয় তখন সেটির নীচে হাতের বাড়ি মারলে আবার উঠে যেতো। এখনও মফস্বল এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এরকম খেলা খেলে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে ফেসবুকেও দেখছি তেমন বেলুন খেলা চলছে। মাঝে মাঝে দেখি পুরনো কোনো লেখা কেউ একজন লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার দিয়ে টোকা দ্যায়। আর এতে সেই লেখা নতুন করে অনেকের টাইমলাইনের নিউজফিডে চলে যায়। তারাও আবার লাইন, কমেন্ট বা শেয়ার করতে থাকে। এ যেন এক মজার খেলা।

সমাজ ও সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে “কামারুজ্জামানের চিঠি ও জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ” শিরোনামে একটা বই ছাপানোর আগে cscsebook.wordpress.com –এ এটির সফট কপি আপলোড করা হয়। এই নিউজটা দিয়ে গত ৬ এপ্রিল একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। গতকাল দেখলাম কেউ একজন এটিতে মন্তব্য করেছে। আমিও উত্তর দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম বেশ ক’জন নতুন করে লাইক-মন্তব্য ইত্যাদি দিয়েছেন।

এক স্নেহাষ্পদ অনুজের কাছে ওয়াদা করেছিলাম, ফেইসবুকে জামায়াত নিয়ে কিছু লিখবো না। অনেকদিন এই ওয়াদা রক্ষাও করেছি। কিন্তু গতকাল গ্লোবের ঠিক উল্টাদিকে বসবাসকারী এক প্রবাসীর মন্তব্য-সূত্রে কী মনে করে যেন ঠাস ঠাস করে কিছু কনক্লুসিভ মন্তব্য করে বসলাম …! পরে মনে হলো জামায়াতের সংস্কার নিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি ও জামায়াতের সাথে আমার সম্পর্ক নির্ণয়ের জন্য এই মন্তব্যগুলো বেশ রিলেভেন্ট। এই কারণে ওইসব চুম্বক-মন্তব্য নিয়ে [কিছুটা ভাষাগত সংশোধন সহকারে] এই নোটের অবতারণা।]

জামায়াত সংস্কার নিয়ে আমার কনসিসটেন্ট এন্ড কনক্লুডিং রিমার্ক:

জামায়াতে কখনো মৌলিক সংস্কার তথা transformative reform হবে না। যা হচ্ছে এবং হবে তা হলো চাপে পড়ে সংস্কার তথা adaptational reform। আমার এই উপলব্ধি আপনার সাথে মিলবে কিনা জানিনা।

জামায়াতের অব্যাহত জনপ্রিয়তার মাজেজা:

লসে পড়া সব শেয়ার ল-টে বিক্রী করে দিয়ে যেমন নিজেকে দৃশ্যত টাকাওয়ালা দেখানো যায়, জামায়াতের গ্রোথও তেমন ধরনের সর্ট অভ মিসরিপ্রেজেন্টেশান বা ম্যনিপুলেশান। আশি ও নব্বই দশকের প্রতিশ্রুতিশীল সংগঠন ছাত্রশিবিরকে আগামীর জন্য তৈরী না করে রাজনৈতিক মাঠ দখলের কাজে লাগানো, ইসলামী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট টোটাল ম্যানপাওয়ারকে পলিটিক্যাল এক্টিভিস্ট হিসাবে পরিচিত করানো হলো জামায়াতের এই গ্রোথ ক্যারিশমার রহস্য।

চিটাগাং ইউনিভার্সিটির এক ‘ষ্পস্টভাষী’ শিক্ষক অনেক আগে আমাকে একদিন বলেছিলেন, দেখো, তোমাদের জামায়াত হচ্ছে এমন এক চোংগা যেটার উভয় প্রান্তের ফুটার মাপ একই। অর্থাৎ তোমাদের মিছিলে যত লোক, ভোটও ঠিক ততটা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মিছিলে অল্পকিছু লোক হাটলেও ভোট পায় তারা অনেক বেশি। অতএব, শো-অফ করে আসলে কারা …?

এদেশে জামায়াত আর বামপন্থানুসারীদের একই পজিশান ও পরিণতি:

জামায়াতের সবাই মিলে যেটা করে, অর্থাৎ রাজনীতি, সেটাও তারা ভালোভাবে করে না। অ-রাজনৈতিক ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট নিয়ে রাজনীতি করে। ইনকনসিসটেনসি হলো জামায়াত রাজনীতির মূল সুর। ভবিষ্যতেও তারা রাজনীতিতে শাইন করতে পারবে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো পাবলিক তাদেরকে প্রধানত ধর্মীয় কারণে কিছুটা সমীহ করে বটে। ব্যক্তি হিসাবে ভালো মানুষও মনে করে। ভেতরে ভেতরে কম-বেশ শ্রদ্ধাও করে। কিন্তু দেশ চালানোর জন্য যোগ্য মনে করে না। মজার ব্যাপার হলো জামায়াতও নিজেকে কখনো রাজনীতির “এ-টিম” ভাবে না। তারা মাঝে মাঝে বা ভিতরে ভিতরে নিজেদেরকে প্রধান বিরোধী দল ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। তারা চিরজীবন “ব্যালেন্সিং পাওয়ার” তথা “বি-টিম” হয়ে থাকতে চায়। এতে তারা সার্থকতা অনুভব করে!!! আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করার কারণে এ দেশে বামপন্থীদের যে পরিণতি হয়েছে, বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করে এ দেশে জামায়াতেরও সেইম পরিণতি অলরেডি হয়েছে।

আমার জামায়াত সংশ্লিষ্টতা:

আমি জামায়াত করেছি। কর্মজীবনের দুই দশক। এবং অনেকের মতো করে আমিও জামায়াতে ইসলামীকে একটা সত্যিকারের ও পূর্ণাঙ্গ “ইসলামী আন্দোলন” মনে করেছিলাম। কখনো ভাবিনি (কোনো) “পার্টি” করবো। আমার স্বভাব অনুযায়ী, আমি যখন যা করি, তা সিরিয়াসলি করি। সমর্থন বা বিরোধিতা যা করি বুঝে শুনে করার চেষ্টা করি। আন্তরিকভাবে করি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখন জামায়াতে ইসলামী নিছক একটা রাজনৈতিক দল। একটা ইসলাম-পছন্দ রাজনৈতিক দল। দিনশেষে এটি আওয়ামী লীগ – বিএনপি’র মতো পার্টি বিশেষ!

আমার বর্তমান অবস্থান ও ভবিষ্যত:

জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমি মনে করি, রাজনীতির বাইরে আমার অনেক কিছু করার আছে। অনেককিছু দেয়ার আছে। এটি গর্ব-অহংকার বা প্রদর্শন-ইচ্ছা নয়। আল্লাহই এর সাক্ষী। এটি হলো দায়িত্বানুভূতি। এ কারণে আমি আমার মতো করে চলছি। বুদ্ধিবৃত্তিনির্ভর একটা সমন্বয়ধর্মী ধারা তৈরীর জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

জামায়াতে ইসলাম, ইসলাম ও বাংলাদেশ:

এদেশের ময়দান জামায়াতের জন্য যতটা সংকুচিত হয়েছে, ইসলামের জন্য ততটা হয় নাই। বিশেষ করে ইয়াং জেনারেশানের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামী মতাদর্শকে ধারণ করে, ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে ভীষণ আগ্রহী। এই আশংকাই ছিলো যে, প্রগতি ও প্রযুক্তির এ যুগে ইসলাম বা সনাতনী নীতি আদর্শমাত্র ভেসে যাবে। তলিয়ে যাবে। কিন্তু না। দেখলাম, ইসলাম এখনো যুগের সবচেয়ে সম্ভাবণাপূর্ণ বিকল্প। যুগপযোগী সামগ্রিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে একে দেশ ও জাতির মূলধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই ভাবছি বাদবাকী জীবন এই লক্ষ্যে কাটিয়ে দিবো, ইনশাআল্লাহ।

সংস্কারের ইউটোপিয়া ও নাজাতের অছিলা:

বর্তমান জামায়াত ট্রান্সফরম্যাশনাল রিফর্মকে এডপ্ট করবে, বা তাদের তা করা উচিত, বা তারা এটি করলে (সবচেয়ে) ভালো হয় – এমন ধরনের চিন্তা বা কথাবার্তা হলো অতিসরল কিন্তু আশাবাদ। অনেকক্ষেত্রেই তা বাস্তববিমুখতা বা পলায়নপরতার ছদ্ম-বহিঃপ্রকাশ মাত্র। অনেকটা দার্শনিক রাজার আশায় বসে থাকার মতো কষ্ট-কল্পনা বা ইউটোপিয়া। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, জামায়াত কোনো না কোনো ভাবে টিকে থাকবে। বরং আরও বাড়বে। যেভাবে এদেশে অপরাপর সংশ্লিষ্ট সব ধারাই টিকে থাকবে এবং বাড়তে থাকবে। লোকেরতো অভাব নাই। কিন্তু তারা বা তাদের সমগোত্রীয় কেউ বা কোনো গোষ্ঠী কখনো সমাজের লিডিং ট্রেণ্ড বা মেইন স্ট্রীম হতে পারবে না। রেটরিক যা-ই হোক না কেন, জামায়াত নেতৃত্বের কাছে ইসলাম থাকবে এক ধরনের enterprise হিসাবে। আর সরলপ্রাণ কর্মী-সমর্থক ও অধস্তন নেতৃবৃন্দের কাছে এক ধরনের সান্তনা, তাদের ভাষায় ‘নাজাতের অছিলা’ হিসাবে। টপ টু বটম, জামায়াতের লোকজনের কাছে পরকালীন মুক্তি বা নাজাতই লক্ষ্য। যে কাজের মাধ্যমে এই নাজাত প্রাপ্তির প্রত্যাশা, দুনিয়া চালানোর সেই যোগ্যতা অর্জনের ও দায়িত্বপালনের ব্যাপারে তাদের ততটাই গাফলতি।

জামায়াত নেতৃত্বের জনবিচ্ছিন্নতা সংক্রান্ত গাণিতিক বাস্তবতা:

জামায়াতের নেতৃত্বের constituency হচ্ছে তাদের ক্যাডার-ভোটাররা যারা রুকন হিসাবে পরিচিত। তারা ফুট-ইঞ্চি দিয়ে মান (quality) মাপে। রাবার টেনে মাপ মিলানোর মতো…!! সাধারণ জনগণতো দূরের কথা নিজেদের কর্মী-সমর্থকদেরও কোনো মূল্যায়ন তাদের কাছে নাই। দরকার কী? অবুঝ (সরলপ্রাণ অর্থে) মহিলা রুকনদের ভোটতো তাদের আছেই ..! তারা কেন জনগণের সেন্টিমেন্টকে অনার করবে? আমার দৃষ্টিতে জামায়াতের মূল সমস্যা তার সিস্টেমের মধ্যে। এই স্থবির সিস্টেম নিয়ে তারা গর্বও করে …!! তাই আমি ব্যক্তি নিজামী বা মুজাহিদকে দোষ দেই না। দে আর দ্য প্রডাক্ট অভ দি সিস্টেম।

জামায়াত রাষ্ট্রের বিপ্লব চায়, নিজেদের বা সংগঠন-পদ্ধতির নয়:

মৌলিক বা যুগপোযুগী সংস্কার মানে প্রাকারান্তরালে বিপ্লব। গণতান্ত্রিক পরিবেশে কাজ করা বা করতে চাওয়া দোষের কিছু নয়। বরং একটা পর্যায় পর্যন্ত সেটিই হতে পারে মন্দের ভালো। তাই বলে “গণতান্ত্রিক পন্থায় বিপ্লব” – এটি স্ববিরোধী ব্যাপার নয় কি? যাহোক, তাদের কাজীর কেতাবের কথামালা অনুসারে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামী আদর্শ নিয়ে বিপ্লব ঘটাতে চান। অথচ নিজেদের জন্য, আভ্যন্তরীণ পরিবেশে তারা যে কোনো গতিশীলতার প্রস্তাবণাকে গলাটিপে হত্যা করেন। সাংগঠনিকভাবে তারা গতানুগতিকতাকেই প্রেফার করেন …!! যুগের যে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে, সেটি তার বুঝতে নারাজ। সুপার কানেকটিভির এই যুগে এখন একশ বছর নয়, প্রতি দশ বৎসরে যে আমূল পরিবর্তন ঘটছে তা অকল্পনীয়। গতানুগতিক পন্থায় যারা সব কিছুকে সাদা-কালোর বাইনারিতে দেখে, তাদের পক্ষে আগামীতো দূরের কথা, অপসৃয়মান বর্তমানকেও সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করা অসম্ভবপ্রায়। মোটকথা হলো, মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জামায়াতে ইসলামী এদেশে ইসলামী আদর্শের ঐতিহ্য হিসাবেই টিকে থাকবে যদি না সেটি দু-পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে মাথাকে সোজা করে রাখে। আমার দৃষ্টিতে তারা এটি করতে সক্ষম হবে না।

করণীয় কী?

করণীয় হলো যে যার মতো করে কাজ করা। স্বাধীন বৃত্ত তৈরী করা। উদ্যোগ গ্রহণ করা। নিরলসভাবে কর্মতৎপর হওয়া। যার যার যোগ্যতা ও ক্ষেত্র অনুসারে। আল্লাহ চাইলে এক সময়ে পারদের সব বিন্দু একীভূত হবে যদি তা সব একই সমতলে থাকে ….

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *