চবি ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়া স্টুডেন্টরা উন্মুখ হয়ে থাকে, কখন তারা MH স্যারের ক্লাশ করতে পারবে। ক্লাস লোডের কারণে MH স্যার ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাশ নিতে পারেন না। দ্বিতীয় বর্ষে ‘জ্ঞানতত্ত্বের’ কোর্স দিয়ে উনার কোর্স শুরু। তো, এ বছরও তিনি যথারীতি নিউ সেকেন্ড ইয়ারে ক্লাশ শুরু করেছেন।

১.

ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং লেভেল বুঝার জন্য এবং তাদেরকে দর্শন চর্চার পদ্ধতি বুঝানোর জন্য প্রসঙ্গক্রমে তিনি নিম্নোক্ত বিষয়টা বললেন। তিনি বললেন, মনে করো, কিছু মানুষ খানিকটা দূষিত পানি পান করে। যেমন, চবি’র হলে থাকা ছেলে-মেয়েরা। কখনোই পরিষ্কার না করা ট্যাংকির পানি পান করেও তারা দিব্যি সুস্থ থাকে। সহনীয় মাত্রার দূষণ নিয়মিত হওয়ার কারণে তাদের শরীরে অন্তত এ দিক থেকে একধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে।

আবার কিছু মানুষ সব সময়ে বিশুদ্ধ পানি পান করে। যেমন, দক্ষিণ ক্যাম্পাসে বসবাসকারী শিক্ষকগণ। তারা লাইনের পানি ভালোভাবে সিদ্ধ করে ফিল্টারিং করে তবেই পান করেন। স্বভাবতই তাদের মধ্যে ‘ভেজাল’ পানি খেয়ে দিব্যি সুস্থ থাকার মতো ইমিউনিটি বা বডি রেজিসটেন্স থাকে না।

যারা দূষিত পানি পান করতে অভ্যস্ত কখনো যদি তারা বিশুদ্ধ পানি পান করে, তাহলে সেই বিশুদ্ধ পানিকে তাদের কাছে কিছুটা বিস্বাদ মনে হবে, এই যা। এর বিপরীতে, যারা সব সময়ে বিশুদ্ধ পানি পান করে তারা ভুলক্রমে বা অগত্যা যদি কখনো দূষিত পানি পান করে, তাহলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। পর্যবেক্ষণে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ পর্যায়ে উপস্থিত স্টুডেন্টদের কাছ হতে MH স্যার জানতে চাইলেন, বলো তো, এমতাবস্থায় একজন কৌশল প্রণয়নকারী (strategist) হিসাবে তোমার বা তোমাদের পরামর্শ বা নীতি কী হওয়া উচিত?

‘দুয়ে দুয়ে চার মিলানো’ অংকের মতো, উত্তরটা পরিষ্কার। সদা-সর্বদা বিশুদ্ধ পানি পান করার চেয়ে মাঝে মধ্যে বা সহনীয় মাত্রায় দূষিত পানি পান করার ব্যবস্থা অধিকতর নিরাপদ।

জনাব MH স্যারের জন্য রীতিমতো শকিং অভিজ্ঞতা হলো, উপস্থিত স্টুডেন্টদের সবাই এই যৌক্তিক নীতির বিষয়ে একমত হওয়ার জন্য পাক্কা ৪৪ মিনিটি সময় নিয়েছিলো। অধিকাংশ স্টুডেন্ট কোনোমতেই এটি মানতে পারছিলো না। যেহেতু এটি তাদের এ যাবতকাল মুখস্ত করা বিশুদ্ধ পানি পান করার প্রচারধর্মী ‘নীতি’র সাথে সাংঘর্ষিক ছিলো। তারা বিষয়টা বুঝতেছিলো, কিন্তু মানতে পারছিলো না, তাদের বিশ্লেষনী ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার ঘাটতি থাকার কারণে। অপ্রিয় হলেও সত্য বলার নৈতিক সাহস, প্রয়োজনে একলা চলার মতো মনোবল না থাকাও এর কারণ।

সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো, অনেক সহকর্মীও, স্টুডেন্টদের বিশ্লেষনী ও উদ্ভবনী চিন্তাকে (critical & innovative thoughts) মুখস্তবিদ্যার গিলোটিনে গলাচিপে হত্যা করাকে বেটার মনে করেন। এ ধরনের গতানুগতিক ও ধ্বংসাত্মক তথা নেতিবাচক ‘শিক্ষা’কে তারা প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে বরং উৎসাহিত করে।

২.

ওই দিনকার ক্লাসে MH স্যার বলেছেন, দর্শন চিন্তার তিনটা বৈশিষ্ট্যি:

(১) Big issue: দর্শন চর্চা হবে মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে। প্রচলিত কোনো জ্ঞানকাণ্ডের শুরুর দিকে ধরে নেয়া ‘স্বতঃসিদ্ধ’ বিষয়গুলোর আগেকার বিষয়গুলো এবং যেখানে তারা থামেন তার পরের বিষয়গুলো হলো ওই বিষয়ে দর্শন চর্চার আলোচ্য বিষয়।

(2) Free discussion: দর্শন চর্চাতে কোনো বাধা থাকতে পারবে না। openness হলো দর্শন চর্চার অপরিহার্য শর্ত। সকল প্রশ্নকে গ্রহণ করতে হবে, যদিও সেটি ভুল প্রশ্ন হয়।

(৩) Argumentation: কোনো বিষয়ে যে যা-ই বলুন না কেন, আপনাকে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে হবে। এমন কি, যুক্তি যেখানে চলবে না মনে করছেন, তাও আপনাকে যুক্তি দিয়েই বুঝাতে হবে কেন সেখানে সেটাকে আপনি যুক্তির উর্দ্ধে মনে করছেন।

এ সব বিষয়ে আর একদিন বিস্তারিত আলোচনা করা কথা বলে সেদিনের সে ক্লাসে MH স্যার নিরীহ তরুণ দার্শনিকদের এটিই বুঝাতে চাইলেন, দর্শনের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্য ত্রয়ের সাথে সাংঘর্ষিক সাবজেক্ট হিসাবে সাধারণত ধর্মের উদাহরণ টানা হয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে। ধর্ম ও দর্শনের সম্পর্ক নিয়েও তিনি সেদিন তেমন আলোকপাত করলেন না। বরং তিনি তাদের এ কথা বলে সতর্ক করলেন, দেখো, যারা দর্শন চর্চা করে, তাদের একটা বিরাট অংশ দর্শন চর্চা করতে এসে বাস্তবে ধর্ম চর্চা করে। বিশ্লেষনী ও উদ্ভাবনী দক্ষতার বিকাশ না ঘটার কারণে তারা, কথার কথা, কোনো কোনো দার্শনিককে প্রফেট হিসাবে মানে, কাউকে খলিফা এবং কাউকে ইমাম হিসাবে মানে।

তাদের সর্বোচ্চ যুক্তি হলো, অমুক ‘বড়’ ফিলোসফার এই এই বলেছেন। তাদের মেথডলজির ভিত্তি হচ্ছে এই ফলস আন্ডারস্ট্যান্ডিং, “আমরা তুচ্ছ। আমাদের কাজ হলো চোখ বুঁজে মুখস্ত করা। আগে ‘সব’ বুঝা।” বুঝতে বুঝতে তারা এম. এ. পাশ করে যায়, এমনকি দর্শন বিষয়ে শিক্ষকতার চাকুরীও তাদের কেউ কেই পেয়ে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্তও তারা বুঝে না। বুঝে না, তার লক্ষণ হলো বিশ্লেষনী ও উদ্ভাবনী চিন্তার কোনো আছর দেখা যায় না। তাই তো দেখা যায়, পরষ্পর বিরোধী এমন সব দার্শনিকদেরকেই তারা ‘সমভাবে’ গ্রহণ করে। বিরোধপূর্ণ স্কুল অব থটগুলোর সমালোচনায় তারা গৎবাঁধা যুক্তিগুলোকেই কপচাতে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাদের নিজের কোনো কথা বা যুক্তি থাকে না।

এ ধরনের পাঠদান পদ্ধতির কারণেই MH স্যার মজা করে বলে থাকেন, [এ’পাশ + ওপাশ = পাশ]। যদিও এই শুন্যগর্ভ পাশ দিয়ে কেরানীমার্কা চাকুরী লাভ ছাড়া (হোক সেটা বিসিএস কিংবা ব্যাংক জব) সংশ্লিষ্ট বিদ্যার্থী, দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণ সাধিত না হওয়ার গ্যারান্টি, কমচে কম, হানড্রেড পারসেন্ট…!!!

লেখাটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *