আপনার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনলেন। স্পষ্ট। আপনি শ্রুতি-বিভ্রান্তিতে ভুগছেন, এমনও নয়। কাউকে দেখা গেল না। কেউ দরজায় নক করে পালিয়ে গেছে এমনও নয়। মনে করুন, পালানোর বা লুকিয়ে থাকার কোনো পথ নাই। দূর থেকে, মানে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে আপনার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ করারও, মনে করুন, কোনো সুযোগ নাই। এমনও নয়, কোনো ধরনের মিউজিক প্লেয়ার বাজিয়ে এমন শব্দ করা হয়েছে।
তো, একজন বিজ্ঞানমনস্ক হিসাবে ভূতে বিশ্বাস করা ছাড়া আপনার পথ কী? উপর্যুক্ত পরিস্থিতিতে ভূত ছাড়া আপনার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দটা আর কে করতে পারে? মনে করুন, একবার-দু’বার নয়, মাঝে মধ্যেই বা বার বারই আপনি এমন কড়া নাড়ার শব্দ শোনেন। এখন কী করবেন? আপনি যদি যুক্তিবাদী হোন, যদি বিজ্ঞান মেনে চলেন তাহলে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করা ছাড়া আপনার গত্যন্তর নাই।
হ্যাঁ, এমন ধরনের ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার আমরা অহরহ লক্ষ করি। আমি দেহ-মন সম্পর্ক বা দ্বন্দ্বের ব্যাপারটাকে বুঝাচ্ছি। বস্তুকে আমরা জানি এর প্রতিক্রিয়ার (effect) মাধ্যমে। জ্ঞানের কর্তা হিসাবে যখন আমরা (বস্তুগত) প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই, তখন আমরা কোনো অস্তিত্বকে (entity) অনুমান করি এবং সেই অস্তিত্বকে নিশ্চিত (confirm) করি। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে বস্তুগত প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটে নানা ধরনের রাসায়নিক ও স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। এক ধরনের প্রতিক্রিয়াকে আমরা এক ধরনের বস্তু বা ঘটনা বলি। যেমন, কলমের ধারণা ‘সত্যিকারের’ বস্তুগত কলমটার প্রতিনিধিত্ব (representation) করে।
বস্তু বনাম মস্তিষ্কে বস্তুর জ্ঞানগত প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটা অতি-জটিল ও ধোঁয়াটে ব্যাপার। জাংশানে ট্রেন লাইনের একটু এদিক বা ওদিক হওয়ার মতো এটি সূক্ষ্ম কিন্তু সিদ্ধান্তকারী (decisive)। এখানে এ প্রসংগে আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, আমরা এমন অনেক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হই যা বস্তুগত কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি না। সেটি হতে পারে, বস্তুগত ঘটনা প্রবাহ বা বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানগত সীমাবদ্ধতার কারণে। তো, সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল এমন বৈজ্ঞানিক বা কোনো বিজ্ঞানপন্থী যখন এ ধরনের ব্যাখ্যাগত অসম্পূর্ণতার (explanatory gap) সম্মুখীন হবেন তখন তিনি যুক্তি সংগতভাবেই বলতে পারেন, এখন জানা না গেলেও এই ফিল্ডে আরো অগ্রগতি অর্জন করা গেলে এই সব না-জানা বিষয়গুলো সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে।
এ ধরনের বিজ্ঞানবাদীদের যুক্তি হলো, এখন জৈব-প্রযুক্তি (genetics) ইত্যাদির মাধ্যমে যা জানা যাচ্ছে তা যদি পূর্বেকার কোনো ফিলোসফার-সায়েন্টিস্ট বলতো তাহলে তার সময়কার লোকেরা তা বিশ্বাস করতো না। অথচ, এক সময়ে অসম্ভব মনে করা হয়েছে এমন সব বিষয় এখন সুন্দরভাবে (satisfactorily) জানা যাচ্ছে। অতএব, ভুতে বিশ্বাসের মতো কোনো বুজরুকি বাদ দিয়ে বিজ্ঞান গবেষণায় মনোনিবেশ করা উচিত। তাতে করে, ভৌত জগত (physical world) সম্পর্কে আমাদের বর্তমান প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে।
হ্যাঁ, তারা ঠিকই বলেছেন। এক সময়ে যা ব্যাখ্যা-অতীত ছিলো এখন তা সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। এই সূত্রে বা যুক্তিতে আমরা বলতেই পারি, এখন যা কিছু ভৌতিক (ghostly) বলে মনে হচ্ছে, নিরেট বস্তুগত প্রক্রিয়া দিয়ে এক সময়ে তা প্রমাণ করা যাবে। বিজ্ঞানবাদীদের (sciencists) দৌড় এতটুকুই। বিজ্ঞান নিয়ে তাদের ভোজবাজি (mesmerism) এ পর্যন্তই। এ সব শিশুতোষ বিজ্ঞানবাদীরা যুক্তির একটা দিকেই অগ্রসর হোন। যুক্তির অপর দিকটা হচ্ছে, যে কোনো সময়ের সমকালীন বিজ্ঞান সে সময়ের তুলনায় অতীতের, এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে, এটি যতখানি সত্য, ইতোপূর্বে অজানা ছিলো এমন নতুন নতুন সূক্ষ্মতা, জটিলতা ও জ্ঞান-দিগন্তের সম্মুখীন হয়ে অধিকতর সূক্ষ্ম, জটিল ও ব্যাখ্যাতীত প্রশ্ন ও রহস্যের মুখোমুখি হয়েছে, এই অস্বস্তিকর বাস্তবতাও ততখানি সত্য।
এভাবে জানা ও অজানার গড় করলে দেখা যাবে অজ্ঞানতার গড় মাত্রা ধ্রুব রয়ে গেছে। অনেক কিছু জানা গেছে। সাথে সাথে এই সব অভাবিতপূর্ব জ্ঞান আমাদেরকে জ্ঞান ও গবেষণার অভাবিতপূর্ব ক্ষেত্র ও সীমান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে। কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে যাওয়ার মতো জ্ঞানের প্রোজ্জ্বলতর আলো, আমাদেরকে অজ্ঞানতার মহাসমুদ্রের মুখোমুখি করে দিয়েছে। জানা-অজানার ফারাক, আমার হিসাবে, একই রয়ে গেছে। আমি এটিকে Constant Gap Theory (CGT) হিসাবে বলি। সে নিয়ে আর একদিন আলাপ করা যাবে।
আমাদের আলোচ্য বিষয়ে এখনকার কথা হলো, বর্তমান প্রমাণের দাবীকে ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হলো fallacy of future proof। ভবিষ্যত আবিষ্কারের ওপর ভরসা করা হলো, ২+২=৫ বলার মতো বিশুদ্ধ বিশ্বাসের ব্যাপার। কেউ বলতেই পারে, গণিত শাস্ত্রের বর্তমান সময়ে প্রচলিত সূত্র দিয়ে এটি প্রমাণ করা না গেলেও ভবিষ্যতে গৃহীতব্য সূত্রানুসারে তা সঠিক হিসাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ, এখানেই হচ্ছে (বি)জ্ঞানের সাথে বিশ্বাসের মশলার মিশাল। অথবা, অনুসন্ধানের মেশিন সক্রিয় থাকার জন্য বিশ্বাস নামক মেশিন-অয়েল বা মোবিলের কাজকারবার।
শুরুর কথা দিয়ে শেষ করি, দরজায় কড়া নাড়ার স্বাভাবিক শব্দ হলে, কাউকে দেখা না গেলে, একজন কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হিসাবে আমি ‘কারো’ উপস্থিতি ও সক্রিয়তা বিশ্বাস করতে বাধ্য। বস্তুজগতের ঘটনাবলী ব্যাখ্যায় এই ধরনের আধিভৌতিক (mysterious or ghostly) ব্যাপারগুলোর সত্তাগত নাম হলো চেতনা, মন বা আত্মা। অবশ্য, চেতনা, মন ও আত্মার ধারণাগুলোর মধ্যেও আবার অনেক পার্থক্য আছে। সেসব নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা অন্য সময়ে হতে পারে। সে যাই হোক, বস্তুগত পরিমাপে না পাওয়ার কারণে আমরা অবস্তুকে নাকচ করে দিতে পারি না। ঈশ্বরের কাছ হতে সাক্ষ্য নিয়ে যেমন ঈশ্বরে বিশ্বাস করা যায় না, তেমনি বস্তুগত যাচাই পদ্ধতি দিয়ে অবস্তুগত কোনো সত্তার (entity or being) উপস্থিতি নাকচ করা যায় না।
তো, কীভাবে বুঝবো, বস্তু-অতিরিক্ত কিছু আছে? উত্তরটা সহজ। যেভাবে আমরা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বস্তুকে জানি, একইভাবে বস্তুগত প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যাতীত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বস্তু-অতিরিক্ত সত্তা তথা মনকে জানি। ব্যাপারটা সেইম-সেইম। মন, যেভাবে ও যতখানি বিশ্বাসের ব্যাপার, বস্তুও সেভাবে ও ততখানি বিশ্বাসের ব্যাপার। কথাটা অন্যভাবে বললে, বস্তু যেভাবে ও যতখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’, মনও সেভাবে ও ততখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’।
নাস্তিক হিসাবে (ভুলভাবে) পরিচিত বার্ট্রান্ড রাসেলের নিরপেক্ষ একত্ববাদ (neutral monism) ও পরোক্ষ বাস্তববাদকে (indirect realism) আমি এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক মনে করি। উল্লেখ্য, প্রচলিত ধর্ম, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, খ্রিষ্টান ধর্মে তিনি অবিশ্বাসী ছিলেন। এ নিয়ে ‘কেন আমি খ্রিষ্টান ধর্মে বিশ্বাসী নই’ শিরোনামে বই লিখেছেন। আামার ধারণায় এক ধরনের অধিবিদ্যাগত ঈশ্বরে (philosophical God) তিনি বিশ্বাস করতেন। তার কথাবার্তা বিশেষ করে নিরপেক্ষ একত্ববাদের তত্ত্ব হতে অনুমান করা যায়, তিনি প্রচলিত অর্থে নাস্তিক ছিলেন না। বড়জোর অজ্ঞেয়বাদী (agnostic) ছিলেন।
[টীকা: আমাদের অর্জিত জ্ঞান, গবেষণা, বিজ্ঞান ও ব্যাখ্যার সীমাবদ্ধতা, এক কথায় explanatory gap হলো আমার এই আলোচনার মূল বিষয় তথা focal point। বার্ট্রান্ড রাসেলের কথাসহ কিছু কিছু কথা এসেছে প্রসঙ্গক্রমে। দেখা যায়, কিছু কিছু পাঠক, মূল বিষয়ে এনগেজ না হয়ে প্রসঙ্গক্রমে বলা কথাগুলোকে নিয়ে ছুটেন। এটি অনাকাংখিত। আশা করি, বিজ্ঞ পাঠকগণ এটি খেয়াল রাখবেন।]
ফেইসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Istiak Sabuj: “তো, কীভাবে বুঝবো, বস্তু-অতিরিক্ত কিছু আছে? উত্তরটা সহজ। যেভাবে আমরা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বস্তুকে জানি, একইভাবে বস্তুগত প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যাতীত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বস্তু-অতিরিক্ত সত্তা তথা মনকে জানি। ব্যাপারটা সেইম-সেইম। মন, যেভাবে ও যতখানি বিশ্বাসের ব্যাপার, বস্তুও সেভাবে ও ততখানি বিশ্বাসের ব্যাপার। কথাটা অন্যভাবে বললে, বস্তু যেভাবে ও যতখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’, মনও সেভাবে ও ততখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’।”
যে প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বস্তুকে জানি সেটা তো ‘নিশ্চিত’ প্রতিক্রিয়া, ডাইরেক্ট বলতে পারি। কিন্তু বস্তুগত প্রতিক্রিয়ায় ব্যাখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না বলে অবস্তুগত সত্তার অস্তিত্ব মেনে নেওয়া তো পরোক্ষ একটা ব্যাপার। এটি থেকে আমরা অবশ্যই অবস্তুগত সত্তার অস্তিত্ব ধারণা করতে পারি। কিন্তু তা কি করে বস্তুতে বিশ্বাসের মত সমান হতে পারে?
Mohammad Mozammel Hoque: ‘নিশ্চিত’ জানা বলতে অপরোক্ষ আত্মজ্ঞান বুঝালে বস্তুর জ্ঞান প্রত্যক্ষ বটে। যদিও বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞানের মাঝে সংবেদন-উপাত্ত-মস্তিষ্ক-স্মৃতি-বুদ্ধির কাজ কারবার না থাকলে “প্রত্যক্ষ’ বা ‘নিশ্চিত’ বস্তু-জ্ঞান সম্ভব হতো না।
“আমরা অবশ্যই অবস্তুগত সত্তার অস্তিত্ব ধারণা করতে পারি। কিন্তু তা কি করে বস্তুতে বিশ্বাসের মত সমান হতে পারে?”
হ্যাঁ, পারে। সেটা যুক্তি দিয়ে। এখানে প্রত্যক্ষণ বনাম যুক্তি – এই বাইনারিকে একটু ঝালাই করতে হবে। যা কিছু আমরা “সরাসরি” প্রত্যক্ষণ করি, দেখা, শোনা ইত্যাদি ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণের শারীরিক প্রক্রিয়াটার দিকে দেখলে আমরা বুঝতে পারি, ব্যাপারটা ততটা “প্রত্যক্ষ” নয়।
তদুপরি, বস্তুগত প্রক্রিয়া দিয়ে যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা আদতে বস্তুই বটে – এটি বস্তুর ওপর বিশ্বাসের নামান্তর নয় কি?
তাই, বস্তুর ধারণা বা জ্ঞান থাকা স্বীকার করা আর বস্তুবাদিতা – দুটো আলাদা ব্যাপার।
Istiak Sabuj: বস্তু জ্ঞানও আমরা সরাসরি পাই না, তা ঠিক। তারপরও তো তা যুক্তিলব্ধ অবস্তুগত জ্ঞান থেকে অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। বস্তুগত প্রক্রিয়া দিয়ে যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, তা বস্তুই হবে সে কথা বলছি না। কিন্তু তা করে বস্তুর জ্ঞানের মত সমানে সমান প্রমাণিত হতে পারে? অন্তত জ্ঞানতাত্ত্বিক মাপকাঠি থেকে।
Mohammad Mozammel Hoque: বস্তুকে আমরা সরাসরি পাই না। সরাসরি পাই কিছু ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, রাসেল যাকে sense-data বলেছেন। এই সেন্স-ডাটা হতে আমরা বস্তুকে অনুমান করি। indirect realism-কে যদি আমরা অধিকতর সঠিক বলে মনে করি, তাহলে বলতেই হবে, বস্তুকে পরোক্ষ ইন্দ্রিয় উপাত্তের মাধ্যমে প্রত্যক্ষকরণকে আমরা যে আদতে “প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা” হিসাবে গ্রহণ করি তা আমাদের বস্তু-অতিরিক্ত চেতনাগত একটা ক্ষমতা বা দক্ষতা, consciousness-এর আলোচনাতে যাকে binding problem হিসাবে এড্রেস করা হয়।
আমাদের অভিজ্ঞতা খণ্ডিত, কিন্তু অভিজ্ঞতাগত জ্ঞানসহ সব জ্ঞানই অখণ্ড ও সম্পূর্ণ। অভিজ্ঞতা আসে appearance হতে, অথচ এর ভিত্তিতে আমরা যে জ্ঞান নির্মাণ করি তা reality-কে ক্লেইম করে। এই ভিতরের প্রক্রিয়াটা বাহ্যিকভাবে মস্তিষ্কেরই ক্রিয়া, কিন্তু সেটির ভেতরকার দিক থেকে তা বস্তু-অতিরিক্ত কিছু, যাকে আমরা মন বলছি।
তৃতীয়ত: জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে যুক্তিই সবকিছুর ভিত্তি। তাই মনের অস্তিত্বের পক্ষে জোরালো যুক্তি থাকাই সেটির প্রত্যক্ষ জ্ঞান থাকার জন্য যথেষ্ট। আমাদের অভিজ্ঞতার দিকগুলোকে আমরা প্রত্যক্ষভাবে জানি। এটি ঠিক। তবে, তা জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে। অর্থাৎ মনে। বস্তুগতভাবে প্রত্যক্ষভাবে আমরা কিছু জানতে পারি না।
বলাবাহুল্য, জ্ঞান হলো মনেরই একটা ক্রিয়া বা ফ্যাকাল্টি।
Fallacy of future proof এড়িয়ে যাবার রাস্তাটা কি তবে sir? ব্যাখ্যাতীত, অতিলৌকিক ব্যাপার বলে ‘ব্যাখ্যা’ করে দেওয়া কোন ঘটনাকে, যা এখনও বিজ্ঞান সম্পূর্ন বিশ্লেষণ করতে পারছে না? তাহলে তো বেশ মজা হয়, জ্ঞান ও অজ্ঞানের অনুপাত শূন্য হয়ে যায় একদম, ‘ব্যাখ্যাতীত’ বলেই এককথায় সমস্ত ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায়।
“তো, কীভাবে বুঝবো, বস্তু-অতিরিক্ত কিছু আছে? উত্তরটা সহজ। যেভাবে আমরা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বস্তুকে জানি, একইভাবে বস্তুগত প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যাতীত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা বস্তু-অতিরিক্ত সত্ত্বা তথা মনকে জানি। ব্যাপারটা সেইম-সেইম। মন, যেভাবে ও যতখানি বিশ্বাসের ব্যাপার, বস্তুও সেভাবে ও ততখানি বিশ্বাসের ব্যাপার। কথাটা অন্যভাবে বললে, বস্তু যেভাবে ও যতখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’, মনও সেভাবে ও ততখানি ‘বাস্তব’ ও ‘প্রমাণিত’।”
বস্তুগত প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যাতীত প্রক্রিয়া… বেশ সুন্দর ব্যাপারটা। ২+২=৫ এখনই প্রমাণ করে দেওয়া যায় এইধরনের প্রক্রিয়ায়, তাই না? সেটাই ভাল হবে, কারণ এ ধরনের দূরহ ব্যাপার, বিজ্ঞান অন্তত পেরে উঠবে বলে মনে হয়না..
*প্রতিক্রিয়া
আপনার কথাটা বুঝি নাই। মনে হচ্ছে, এই কথাটা আপনার কাজে লাগতে পারে।
there is always ‘gap of explanation’. তো বিজ্ঞানবাদিতার লাইনে কেউ বলতে পারে, ভবিষ্যতের বিজ্ঞান এই ‘অজ্ঞানতার ফাঁক’ পূরণ করতে পারবে। ধর্মবাদিতার লাইনে গিয়ে কেউ বলতে পারে, এই গ্যাপ পূরণ হবে না। তাই এখানে ঈশ্বরকে বসাতে হবে। অর্থাৎ, এটি ঈশ্বরের কাজ।
আমি এই দু’টারই বিরোধী। আমি মনে করি, জানা ও অজানার ফাঁক বরাবরই রয়ে যাবে। এর যুক্তি হচ্ছে, অতীতে যে সব অজ্ঞানতার ফাঁক ছিলো তার অনেকখানিই বর্তমান বিজ্ঞান যুক্তিসংগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে পূরণ করেছে বটে। কিন্তু, বর্তমানে এমন সব নতুন নতুন ‘অজ্ঞানতার ফাঁক’ তথা ডোমেইন অব নলেজ বের হয়ে পড়েছে, জ্ঞানকাণ্ডের এমন সব নতুন নতুন শাখার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যা অতীতে কেউ কল্পনা করে নাই।
আমাদের অভিজ্ঞতা যতই বাড়ুক না কেন, অভিজ্ঞতাগত জ্ঞান তথা বিজ্ঞান যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, তা মানুষের existential question গুলোর উত্তর দিতে পারবে না। কারণ, প্রশ্নগুলো অত্যন্ত মৌলিক। প্রকৃতিকে যতটা সরল মনে করা হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে জানার সমান্তরালে অজ্ঞানতাও পাল্লা দিয়ে ততটাই বাড়ছে। এটি স্পষ্ট।
দেখুন, জগতের শেষ সীমানায় গিয়ে কেউ দেখে আসতে পারবে না যে তারপরে আর কিছু নাই। ভবিষ্যতের কোনো বিজ্ঞানের কোনো উন্নতিতেও এটি সম্ভব হবে না। তাই যদি হয়, তাহলে জগত সম্পর্কে মানুষের যে ‘নাদান’ প্রশ্ন, তারও কোনো পর্যবেক্ষণমূলক উত্তর দেয়া সম্ভব হবে না। সে ক্ষেত্রে যুক্তিই ভরসা। যুক্তি তো একমুখী না। যুক্তি বহুমুখী। একই তথ্য থেকে বিভিন্ন, এমনকি বিপরীত যুক্তিও নির্মাণ করা যায়। সে ক্ষেত্রে কোন্ যুক্তিকে আমরা জ্ঞান নির্মাণের জন্য গ্রহণ করবো?
এই ধারায় আলোচনা করলে দেখবেন, মানুষের অন্তর্গত ঝোঁক-প্রবণতাই ঠিক করে, সে কোন্ ধরনের যুক্তিকে ‘প্রমাণ’ হিসাবে গ্রহণ করবে। এ-ই আর কি …। শেষ কথা হলো, দর্শনের কাজ বিজ্ঞান করে দিবে না। যদিও বিজ্ঞান অনুসৃত কার্যপ্রক্রিয়াতে প্রাসংগিক দার্শনিক সূত্রগুলোকে ব্যবহার করা হয়। যেমন, আরোহ নীতি। যেমন, প্রকৃতির সমরূপতার নীতি যাকে ইংরেজীতে Principle of Uniformity of Nature (PUN) বলে। ইত্যাদি। বিজ্ঞান ছাড়া দর্শন অচল নয়, কিন্তু দর্শন ছাড়া বিজ্ঞান অচল। যদিও বিজ্ঞানবাদীরা তা বুঝতে চান না।