উদযাপিত প্রতিটা জন্মদিন আমাকে আগামীর কোনো অজ্ঞাত মৃত্যুদিনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জানি না, আমার মৃত্যুদিন কবে। কেউ জানে না তার মৃত্যুদিন কোনদিন। তবে ঘটে যাওয়ার পরে বাদবাকি সবাই জেনে যায়, এই ব্যক্তির জীবনকাল এত থেকে এত। তাই, জন্মদিনের মতো করে কেউ নিজের মৃত্যুদিন পালন করার সুযোগ পায় না।

আজ আমার জন্মদিন। এই পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমি স্বীয় সম্ভাব্য মৃত্যুদিনকে স্মরণ করছি। সম্ভাব্য বলছি এ কারণে যে, আমি তো জানি না পরম পাওয়ার এ জীবনের অবসান কখন হবে, কখন শেষ হবে এ জীবনের। আমি কিন্তু খুব একটা ধার্মিক চরিত্রের নই। যদিও জীবনের আর্লি টুয়েন্টিজ হতে ইসলাম চর্চা করছি। ধর্মবাদিতাকে (religiosity) আমি খুব ভয় পাই। যারা বাহ্যত খুব ধার্মিকতা রক্ষা করে চলে তাদের চরিত্র ও জীবনযাপনে আমি মারাত্মক অসংগতি দেখি। একটু বাড়াবাড়ি শোনালেও “The more religious the more consumerist” – এটি বলা যায়। অনেকের কাছে অগ্রহণযোগ্য ও আপত্তিজনক মনে হলেও এটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। ব্যাপারটা অনাকাংখিত ও দুঃখজনক হলেও সত্য।

জন্মদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দৃশ্যত ‘ধর্মীয়’ আবহের এ সব কথাবার্তা থেকে কেউ যেন আমাকে ধার্মিক হিসাবে ‘খুব ভালো’ মনে না করেন সে জন্যই উপরের এই কথাটা বললাম। আমি বরং জীবনবাদী। সম্ভাব্য সব উপায়ে আমি জীবনকে বুঝার চেষ্টা করেছি, করি। জীবন আর মৃত্যু নিয়ে আমার নিজের কাছে সবচেয়ে ভালো লাগা কথা হলো, ‘জন্মের চেয়ে বড় বিস্ময় আর মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য পৃথিবীতে নাই’। আমার বড় সন্তান মাহজুবাহ’র জন্মের পরে এটি লিখেছিলাম।

হ্যাঁ, জন্মের মতো অতীব বিস্ময়কর ঘটনাটা আমরা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি, ব্যাপকভাবে উদযাপন করি, নিয়ত স্মরণ করি। অথচ এরচেয়ে বড় ঘটনা হলেও মৃত্যুকে আমরা মোটেও বুঝতে পারি না, বুঝতে চাই না। ভুলভাবে উদযাপন করি। সব সময়ে ভুলে থাকতে চাই। এই নির্মম সত্য প্রতিনিয়ত আমাদেরকে তাড়া করে ফেরে। এবং সুনির্দিষ্ট একটা সময়ে আমরা ধরা পড়ি। পরাজিত হই। প্রত্যেক মানুষ মৃত্যুর এই দরজাটা অতিক্রম করে। করতে বাধ্য হয়।

আমার মা বলতেন, “আমার বা-জান ছাড়া আমি কীভাবে বাঁচবো তা আমি কখনো ভাবতেও পারি না। অথচ আমি সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি…!” আমার মাও ইন্তেকাল করেছেন। ঠিক সাত বছর আগে বৃষ্টিমুখর এক দিনে তাঁকে আমি নিজ হাতে দাফন করেছি। মনে হয়, আম্মা যেন আছেন, ভাই-বোনদের কারো বাসায়, না হয় নতুন পাড়ায়। উনার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, তিনি কি এখানে…? অথচ আমিই তাকে দাফন করেছি। যে হাতে এই লেখাটা লিখছি ঠিক এ হাতেই আমার বাবা, মা, শ্বশুড়, শ্বাশুড়িসহ আটজনকে দাফন করেছি। অতি সম্প্রতি বড় চাচাকে দাফন করেছি। বাবার কবরের পাশে বড় চাচাকে শুইয়ে দিয়ে উনার মুখটা পশ্চিমমুখী করে কাফনের কাপড়টা সরিয়ে দিয়েছি। উপরে বাঁশের খণ্ড দিয়ে ছাউনি দিতে দিতে উনার মুখটা শেষবারের মতো আমিই দেখেছি।  মনে হলো যেন ঘুমাচ্ছেন। জানি না কেউ এত আপনজনকে দাফন করেছেন কিনা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উনাদের সাথে থাকার অদম্য ইচ্ছা আর জীবনের পরিণতি তথা মৃত্যুর ঘটনাকে উপলব্ধি করার চরম ব্যাকুলতার কারণে আমি এমনটা করেছি।

বেশ ক’বছর আগে ফটিকছড়ির গ্রামের বাড়িতে দাফনের জন্য চবি ব্যবস্থাপনা বিভাগের ড. বদিউল আলম স্যারের লাশবাহী এম্বুলেন্সের পিছনে আমি বসা ছিলাম। গাড়িটা যখন চবি ১নং গেইট অতিক্রম করছিলো, তখন আমি ভাবছিলাম – কখন বদিউল আলম স্যার চবিতে প্রথম এসেছিলেন তা জানি না। আদৌ কেউ সঠিক জানে কিনা, জানি না। কিন্তু তিনি যে আজ চলে যাচ্ছেন, আর কখনো আসবেন না – উনার এই চলে যাওয়ার নিশ্চিত দিনটা সবাই জানলো। এ যাওয়া শেষ যাওয়া। ক্যাম্পাসে আর ফিরবেন না তিনি। এভাবে সব দাপুটে শক্তিমান তথাকথিত নামকরা সব প্রফেসরগণ এক এক করে লাশ হয়ে চোখের সামনে ক্যাম্পাস ত্যাগ করলেন। তেইশ বছরের চাকুরী জীবনের শেষে আজ ভাবি, একদিন হয়তোবা আমিও শেষ বারের মতো যাবো। এর পর হতে আমারও একটা মৃত্যুদিবস পরিচিত সুধীদের জানা হবে। হয়তোবা উনাদের কেউ কেউ কিছুদিন তা পালনও করবেন। তাতে আমার কিছু করণীয় থাকবে না। ওই যে বললাম, কেউ তার মৃত্যুদিবস পালনের সুযোগ পায় না। জীবনের গতি একমুখী, ছেদবিন্দুহীন।

এক দৃষ্টিতে দুনিয়ার আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা অনেক সৌভাগ্যবান। তারা জানেন কখন তারা মৃত্যুবরণ করবেন। জন্মের পর হতেই আমরা সবাই মৃত্যুর ‘দণ্ডে’ দণ্ডিত। দণ্ডিত কথাটা এ জন্য বললাম, আমরা তো কেউ মৃত্যুকে কামনা করি না। জীবনকে কামনা করি, মুত্যুকে কখনো কামনা করি না। না করতেই বলা হয়েছে। হায়াত হলো আল্লাহর নেয়ামত। কেয়ামতের ময়দানে সবাই হায়াতের জন্য আফসোস করবে।

মৃত্যুর এই ‘দণ্ড’ কার্যকরের সময় আমাদের দিক থেকে অর্নিধারিত। জীবনের নেশায় আমরা একে ভুলে থাকি, কার্যত অস্বীকার করি, তথাকথিত স্বাধীন জীবনযাপন করি। জানি, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে পৃথিবীটা ঠিকই ছিলো। কিন্তু আমি ছিলাম না। পঞ্চাশ বছর পরেও হয়তোবা এই গ্রহটা থাকবে। মানুষেরা থাকবে। কিন্তু সেখানে এভাবে কীবোর্ডে পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট লেখার জন্য বা অন্য কোনো কাজে আমি আর থাকবো না। হয়তোবা এই লেখা থেকে যাবে। কীভাবে লেখার মাধ্যমে অপরের সুখ-দুঃখ ও অনুভূতিকে আমরা টের পাই, ভাষা দর্শন, জ্ঞানতত্ত্ব ও মনোদর্শনের সব নামকরা বইপত্র পড়েও আজোবধি তা বুঝতে পারলাম না। ভাষা আল্লাহ তায়ালার অন্যতম এক আশ্চর্য সৃষ্টি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা সঞ্চারিত হয়। কীভাবে যেনো আমরা একজনের কথা, আসলে (মনো)ভাব, বুঝতে পারি। জীবন, ভাষা, সৃষ্টি ইত্যাদি আশ্চর্যজনক সব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলার কারণে আমরা এসবকে সাধারণ ও স্বাভাবিক মনে করি। আশেপাশে মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত দেখে মৃত্যুকেও গা-সওয়া স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে মনে করি। আসলে যেসব বিষয়কে আমরা জানি বলে মনে করি তার কোনোটিকেই কি আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারি? আমরা আসলে কী জানি? যা জানি বলে দাবি করি তা কতটুকু অনুভব করি? শুদ্ধ অনুভব ছাড়া কোনোকিছু তো জ্ঞান হয়ে উঠার কথা না।

জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান চাকুরীপ্রার্থীদের ‘সাধারণ জ্ঞানে’র মতো তথ্য মাত্র। জ্ঞানের পর্যায়ে উত্তরণের জন্য তথ্যের উপর অকপট অনুভবের মূল্য আরোপ করতে হয়। আরোপিত অনুভব-মূল্য ভিন্ন ভিন্ন হয় বলে একই তথ্যের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান উৎপন্ন হয়। জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান, তথ্যের অতিরিক্ত নয়। প্রজ্ঞায় উন্নীত না হলে জ্ঞান, জ্ঞান হয়ে উঠে না। অনেকের কাছে জীবন আর মৃত্যু সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে যা অনুরূপ শুন্যগর্ভ তথ্যধারীদের সাথে তারা আদান-প্রদান করে। জীবনের জ্ঞানের জন্য, মৃত্যুর অনিবার্যতা উপলব্ধির জন্য অসাধারণ বোধশক্তি লাগে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ডিগ্রি দিয়ে এই বোধশক্তি অর্জন করা যায় না। সে জন্য অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত মানুষ মানবিক অনুভূতিশুন্য মূর্খ হয়ে থাকে।

এসব কথা আজ থাক। মৃত্যুর ব্যক্তিগত ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়াও মৃত্যু সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। বুঝতে পারার অসাধারণ অনুভূতি ও ক্ষমতা দিয়ে মানুষ সত্যিকারের অভিজ্ঞতা লাভ ছাড়াই অনেক কিছু বুঝতে পারে। বুঝতে পারার এই মাত্রাটা অন্তহীন। এমনকি নবী-রাসূলগণও জীবন ও মৃত্যুর রহস্য নিয়ে আল্লাহর সাথে ‘প্রশ্নমুখর’ ছিলেন। কোরআন শরীফে এ ধরনের কয়েকটা ঘটনার বর্ণনা আছে।

জীবনে এ পর্যন্ত কী করেছি? যা করার কথা ছিলো তার ছিটেফোঁটাও না। এ হিসাবে আমি ব্যর্থ। আবার অন্য হিসাবে কোনোকিছু করাটাই সফলতার মানদণ্ড নয়, আন্তরিকভাবে করতে চাওয়াটাই ফ্যাক্টর। সে হিসাবে আমি হয়তোবা সফল। সব সময়ে কিছু একটা করতে চেয়েছি। নতুনের পিছনে ছুটেছি। কেউ কেউ এটিকে আমার স্বভাবগত অস্থিরতা মনে করেন। আসলে তারা সনাতনী পরিবর্তনরোধী মন-মানসিকতার কারণে, যা কিছু তারা করতে চান বলে দাবি করেন তা নিয়ে জীবন-পণ এনগেজ না হওয়ার কারণে, আমাকে ভুল বুঝেছেন। ক্ষ্যাপাটে মনে করেছেন। আবেগী ও  একরোখা হিসাবে মন্তব্য করেছেন। হ্যাঁ, আমি আবেগী, ক্ষ্যাপাটে ও একরোখা। এসব প্রণোদনা না থাকলে তারুণ্যের প্রথমভাগ হতে একমাত্র জীবনাদর্শ হিসাবে ইসলামকে গ্রহণ করতে পারতাম না। এ পর্যন্ত কনসিসটেন্টলি এর উপর টিকে থাকতে পারতাম না।

শৈশবে ইউসুফ (আ.) স্বপ্ন দেখেছিলেন এগারোটা তারকা নিয়ে চাঁদ-সূর্য উনাকে সিজদা করছে। রাজদরবারে এগারো ভাইকে নিয়ে মা-বাবা তাঁকে সিজদা করার পর তিনি নিজেই আল্লাহর দরবারে সিজদায় গিয়ে দুআ করেন: “হে পালনকর্তা আপনি আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছেন এবং আমাকে বিভিন্ন তাৎপর্যসহ ব্যাখ্যা করার বিদ্যাও শিখিয়ে দিয়েছেন। হে নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের স্রষ্টা, আপনিই আমার কার্যনির্বাহী, ইহকাল ও পরকালে। আমাকে ইসলামের উপর মৃত্যুদান করুন এবং আমাকে স্বজনদের সাথে মিলিত করুন।” জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমার মনে হচ্ছে অন্তত গূঢ় তাৎপর্য বুঝার দিকে থেকে আল্লাহ আমাকে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞান দান করেছেন। আমি অনেক বেশি বুঝতে পারি। যারা আমাকে ভুল বুঝেন, অবহেলা করেন, তাদেরকে আমি খুব একটা দোষ দেই না। বিটিভির এন্টেনা দিয়ে তো আর ডিশ এন্টেনার কাজ চলে না। মানবিক জ্ঞানের সবচেয়ে বড় কল্যাণ আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। এর বেশি আর কী চাই…!

যারা আমাকে জানেন তাদের কম-বেশি আফসোস হলো, আমি আমার মেধাকে কাজে লাগাই নাই। অভিযোগটা সত্যি। আমাকে নিয়ে আমার কোনো আফসোস নাই। জীবন সম্পর্কে প্রবল বুঝ-জ্ঞান আমাকে সব সময়ে তুষ্ট করে রাখে। আসলে কিছু করতে পারার কি কোনো শেষ আছে? এস্টাবলিশমেন্ট তো একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কতটুকু কী পেলে, উন্নতির কোন্ শিখড়ে পৌঁছলে জীবন সফল হয়েছে বলা যাবে? আমি জানি না। শুধু এতটুকু জানি, আল্লাহ তায়ালাকে একমাত্র হুকুমদাতা, রাসূল মুহাম্মদকে (সা) একমাত্র আদর্শ ও ইসলামকে জীবনব্যবস্থা হিসাবে জানা, বুঝা ও যথাসম্ভব মানার চেষ্টার চেয়ে বড় সফলতা কিছু নাই।

বাহ্যিক সফলতা নয়, কার্যকর পন্থায় কর্মতৎপর থাকাটাই জীবনের বড় সফলতা। কর্মবীরেরা নিজ দায়িত্বেই, অর্থাৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে কর্মে নিয়োজিত থাকে। বাদবাকি লোকেরা ও পরবর্তীতে অন্য লোকেরা তাদেরকে কর্মবীর হিসাবে স্মরণ করে। আম্মা বলতেন, ‘বাক্যবীরের দরকার নাই, কর্মবীর হওয়া চাই’। অবশ্য সকল সফলতাই শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কবুল হওয়ার উপর নির্ভরশীল। জীবনের এ পর্যায়ে এসে জগত ও জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজতে হচ্ছে না, এর চেয়ে বড় সফলতা আর কি হতে পারে? যা পাইনি, তা নিয়ে খুব একটা আফসোস হয় না। হয়তোবা তা আমার পাওয়ার ছিলো না। জীবনে নেতিবাচক যা পেয়েছি, অন্যায্যভাবে যা আমার উপর পতিত হয়েছে, তা হতে হয়তোবা এমন বরকত পেয়েছি বা পাবো, যা আমার ভাবনার অতীত।

অর্ধশত বছরের যাপিত এ জীবনে পাওয়া যত গ্লানি, কষ্ট, দুঃখ, বেদনা, না পাওয়া – সব মুছে গিয়ে আজ মনে হচ্ছে এ জীবনে অনেক বেশি পেয়েছি। যা পাওয়ার ছিলো তারচেয়ে ঢের বেশি। সংশ্লিষ্ট অনেকের সাফল্যগাঁথার তুলনায় আমার এই গভীর প্রাপ্তিবোধকে কারো কারো কাছে হীনমন্যতাসুলভ আত্মসান্তনা মনে হতে পারে। হোক। হোক যত তুচ্ছ ঘটনা, এই আমি, এ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে জন্মেছি। ধর্ম, সংস্কৃতি, মনন, নৈতিকতা ও ভালবাসাপূর্ণ একটা পরিবারে বেড়ে উঠতে পেরেছি। জীবনকে বুঝতে পেরেছি। যত কঠিন সব তত্ত্বকথা, তার সবের মূলকথাটা বুঝতে পেরেছি। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে আজন্ম স্বাচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতায় চলতে পেরেছি। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের সাথে জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় বসবাস করতে পেরেছি। ইসলামী আন্দোলনের সবচেয়ে উর্বর জমিনে সংগ্রামমুখরতায় যৌবন অতিক্রম করতে পেরেছি। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মানবিক উন্নয়ন ও সামাজিক সংহতির জন্য নিবেদিত একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান (সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র) কায়েম করতে পেরেছি। এসবই আমার তুষ্টির বিষয়। মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের বিষয়। হতে পারে এ সবই তুচ্ছ বিষয়। কিন্তু আমি এগুলোকে বড় করে দেখি। সব বীজ আর চারাগাছ নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আমি এক স্বপ্নের বেপারি, প্রত্যাশার ফেরিওয়ালা। নাইবা হলাম আর দশজনের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত। আমার পৃথিবীতে আমি সত্যিই সুখী। দিন শেষে সবাই আমরা যে যার পৃথিবীতেই বসবাস করি। প্রত্যেকেই আমরা যার যার মতো নিজ নিজ দুনিয়াকে গড়ে তুলি।

আমার পৃথিবীতে যারা ছিলো তাদের অনেকেই আজ নাই। এমন অনেকেই এসেছে যারা ছিলো না। জীবন হলো এই অবিরত পথ চলা। জীবনের নদী নিরন্তর ছুটে চলে। মৃত্যুর অসম্ভবতা নিয়ে যে কথা বলে, একদিন সে নিজেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নাই হয়ে যায়। তার পরিচিত আপনজনের কাছে একটি নতুন মৃত্যু দিবস দিয়ে স্মৃতির কোঠরে ঠাঁই নেয়। এক পর্যায়ে মৃত্যুর গহ্বরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মৃত্যুর কোনো অনুভূতি জীবিতরা পায় না। জীবিতরা মনে করে, যেন তারা এ পৃথিবীতে বরাবরই ছিলো, চিরদিনই থাকবে। অথবা মনে করে, মরলে বুঝি বা মাটি হয়ে মুছে যাবে। যেন এটি অনুভূতির কোনো ব্যাপার নয়। অথচ আমরা নিজেদের মধ্যে অনুভব করি এমন এক সত্তার, যা নিজেকে ক্ষণিকের তুচ্ছ পদার্থমাত্র হিসাবে মনে করে সন্তুষ্ট হয় না। জীবনের অখণ্ডতায় বিশ্বাস মানুষের একটা মৌলিক ভাব-প্রবণতা। জোর করে একে অস্বীকার করতে চাওয়াটাই অস্বাভাবিকতা। অসুস্থতা। এ পৃথিবীতে আমাদের জন্ম হলো একটা পর্যায়, এখানকার মৃত্যু হলো এর পরবর্তী পর্যায়ের সূচনা। এভাবে পর্যায়ের পর পর্যায় পার হয়ে চলে মানব জীবনের অন্তহীন পথ চলা। যার জীবনবোধে মৃত্যুর চেতনা মূখ্য ভূমিকা রাখে না, তার জন্য জন্মদিন পালনের মতো মূর্খতা আর হয় না।

গ্রামের বাড়িতে বছর সাতেক আগে লোকমান চাচার পঞ্চাশতম জন্মদিন পালিত হলো। আমি ছিলাম সেখানে। কেক কাটতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যে অনেক বড় হয়েছি, অতো আর ছোট নই, আমার যে পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে, তা জানানোর জন্য এই আয়োজন’। তখন ভেবেছিলাম আমার পঞ্চাশতম জন্মদিনে অনেক কিছু করবো। আজ আমার পঞ্চাশতম জন্মদিন। এ দিনটা ঘনিয়ে আসার পর হতে কেমন যেন চুপসে গেছি। কেউ যেন সস্তা উইশ করতে না পারে সে জন্য দু’দিন আগেই ফেইসবুকে জন্মদিনের নোটিফিকেশন যাওয়ার অপশন বন্ধ করেছি। আজ নতুনপাড়ায় আমার চট্টগ্রামে থাকা চার বোন মিলে বিশাল আয়োজন করেছে, আমি সেখানে যেতেও কেন জানি উৎসাহ পাচ্ছি না। শুধু বাবা-মা’র কথা মনে পড়ছে। কান্না আর উৎসবের বৈপরিত্যের মধ্যে পড়ে বুঝতে পারছি না, কী করবো…! এ জীবনের গঠন হলো যাদের মাধ্যমে তাদের কেউ আজ নাই। জন্মদিন আসলে ছোটদেরই মানায়। বড়দের জন্মদিন যেন তাদের আসন্ন মৃত্যুদিনের ঘণ্টাধ্বনি। আমাদের পরিবারে জন্মদিন পালন করার রেওয়াজ আছে। এমনকি বড়দেরও। মনে পড়ে, সম্ভবত আমার উনত্রিশতম জন্মদিনে আম্মা উপস্থিত ছিলেন। চবি’র দক্ষিণ ক্যাম্পাসে তিন নম্বর বিল্ডিংয়ে। আমার সেজ আপা যখন কাটিরহাট মহিলা কলেজের শিক্ষক, তখন আমার বাবার উদ্যোগে কেক কেটে, মালা পরিয়ে উনার জন্মদিন পালন করা হয়েছিলো। আজ তারা নাই। নতুনদের উচ্চকিত ভীড়ে, যারা চলে গেছে কুয়াশার ওপারে, মৃত্যু যবনিকার অন্তরালে, আজ শুধু তাদেরই কথা মনে পড়ে।

আমরা জন্মদিনকে জানতে পারি, উদযাপন করি, কিন্তু মৃত্যুদিনকে জানি না। অন্যদের মৃত্যুদিনকে ভুলভাবে উদযাপন করি। অনুভবের চেয়ে উৎসবেই মনোযোগি হই। কী আশ্চর্য…!

জীবনের পরিণতি অনিবার্য
তবুও স্বপ্ন
তবুও স্মৃতি
তবুও বিস্মৃতি
বাঁচিয়ে রাখে আমাদের
ভুলে থাকতে আমরা আনন্দ পাই
অন্তরালকে অস্বীকার করে তৃপ্ত হই
তুচ্ছকে নিশ্চিত মনে করে
আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় নির্ভার হই
মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতো
প্রতিটা জন্মদিন যেন
আদতে মৃত্যুদিন
সম্পর্ক শুধু বিপরীত অনুপাতে…

Similar Posts

৩ Comments

  1. পড়তে পড়তে জীবনের অর্থ খুজা শুরু হয়ে গেলো অনেকটা আনমনেই, কত স্মৃতি কত সুজন কত আপনজন…….. এইতো জীবন।
    আল্লাহ আমাদের সবার জীবনকে অর্থবহ করে তুলুন, আমীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *