রুহুল ভাই। সুখী মানুষ। ছিলেন চবি শারীরিক শিক্ষা বিভাগের প্রধান। স্পোর্টসম্যান। এখনো তাগড়া শরীর। যথেষ্ট ফিট। রোভার স্টাউটসের উচ্চ পদে নিয়োজিত। প্রতিদিনকার মতো আজ সকালেও ভাবীকে নিয়ে হাঁটছিলেন দক্ষিণ ক্যাম্পাসে আমার বাসার সামনে দিয়ে।
বছর কয়েক আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করা হয়েছে, কুকুর মারা যাবে না। এমনকি কোনো কুকুর বা বিড়ালকে এলাকাছাড়া করাও যাবে না। এক সময়ে সেনানিবাসের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল সংরক্ষিত এলাকা। এখন সবকিছু উন্মুক্ত। দুনিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই অর্থে এভাবে উন্মুক্ত কিনা, সন্দেহ ঘোরতর।
আমরা তো অনেক দিক থেকেই সেরা। প্রয়োগ থাকুক বা না থাকুক, মনের মাধুরী মিশিয়ে আইন করা হতে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উপযুক্ত পড়ালেখার পরিবর্তে সার্টিফিকেট বিতরণ করা, এ’রকম বহু কাজে আমাদের ‘কৃতিত্ব’ অতুলনীয়। বহু বিষয়ে আমরা পেছনের দিক থেকে নাম্বার ওয়ান।
ছোটবেলায় কোনো সিনেমায় দেখেছিলাম, বনের মধ্যে খরগোশের পিছনে ছুটছে নায়ক-নায়িকা। বড় মেয়ের কাছে সিনেমার সেই দৃশ্যের কথা বলে ওয়াদা করেছিলাম, ওকে খরগোশ কিনে দেবো। সেটি কমচে কম বাইশ/চব্বিশ বছর আগের কথা। ওয়াদা মোতাবেক খরগোশ কিনেছিলাম। সেই থেকে আজ পর্যন্ত বাসার সামনের লনে খরগোশ পালা হয়।
প্রধানত বহিরাগত ভালবাসাতৃষিত বেসরকারী বেপরোয়া দম্পতিদের মতো ক্যাম্পাসে স্ট্রীট ডগের সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। প্রায়শ তারা বাসার দেয়াল টপকিয়ে আমাদের খরগোশ, হাঁস, মুরগী ধরে নিয়ে যায়। তাই, খরগোশ ছেড়ে দিলে লনের একপাশে চেয়ার নিয়ে অথবা দোলনাতে বসে থাকি। আজ সকালেও চা পানের সময়ে বসে ছিলাম। দেখলাম, রুহুল ভাই ভাবীকে নিয়ে বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন।
শুরুতে যা বললাম, রুহুল ভাই সাদা মনের সুখী মানুষ। আপদমস্তক একজন ভাল মানুষ। দাঁড়ানো মাত্রই শুরু করলেন, নাতির গল্প। আমি বললাম, রুহুল ভাই, আমার বড় ভাইবোনরা এ’রকম। তাদের সাথে আলাপে কেউ বুঝবে না, দুনিয়াতে কোথাও যুদ্ধ চলছে, ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না দেশে কোনো সংকট চলছে। অবসরপ্রাপ্ত আমার বড় চার-ভাইবোনের প্রত্যেকেরই একমাত্র পয়েন্ট-অব-ইন্টারেস্ট হলো, ছেলের বউ, মেয়ের জামাই, বেয়াই-বেয়াইন আর নাতি-নাতনীর গল্প।
হরেক রকমের সম্পর্কচর্চার মাধ্যমে পাওয়া Instant gratifications-এর প্রলোভন হতে নিজেকে ‘বঞ্চিত’ করে রুহুল ভাইদের মতো মানুষেরা তাদের প্রথম জীবনে delayed gratification লাভকে টার্গেট করেছিলেন। তাদের জীবনে এখন পরিপূর্ণতা, ফুলফিলমেন্ট অবারিত। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে নাতি-নাতনী নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর যে স্বর্গীয় তৃপ্তি, এই অনির্বচনীয় আনন্দ, এই সব হতে গোলাপি রংয়ের পাঞ্জাবী আর শাড়ি পড়া ভ্যালেন্টাইনিয়ানস বঞ্চিত হবে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই। as you sow, so you reap.
এক হিসাবে দেখা গেছে, এমনকি দৃশ্যত সুখী এমন বিবাহিত নারীদের অন্তত শতকরা চল্লিশ ভাগের কোনো একজন গোপন পুরুষ আছেন। সহকর্মী হিসেবে। পাতানো ভাই হিসেবে। বন্ধু হিসেবে। কোনো না কোনোভাবে। সেই প্রিয় পুরুষটির কাছ হতে মেয়েটি ইমোশনাল সাপোর্ট পেয়ে থাকে। এটি পাশ্চাত্য সমাজের চিত্র। এ’ধরনের অপেক্ষমান পুরুষদেরকে সেই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে back-burners হিসেবে।
আবেগের জোয়ারের সময়ে পেয়ারবন্ডিং না করে আবেগ শুকিয়ে হিসেবের জ্ঞান টনটনে হয়ে উঠার পরে মেয়েরা যখন বিয়ের মাধ্যমে পেয়ারবন্ডিং করতে যায়, তখন স্বভাবতই জামাইদেরকে তাদের আর তত ভাল লাগে না। সব সুখস্মৃতি তো সে স্টুডেন্ট লাইফে ফেলে এসেছে।
যখন তখন যে কোনো জায়গাতে ঘুরে বেড়ানোর এই অবারিত স্বাধীনতাকে হারানোর ভয় এখনকার মেয়েদের বিয়েভীতির অন্যতম কারণ। জামাইয়ের সাথে ফ্লার্টিশাস রিলেশন গড়ে তোলার চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। তারা ‘রেডি’ হয় শুধু বাইরে যাওয়ার জন্য।
যেসব অভিযোগে মেয়েরা ডিভোর্স দেয় তার অন্যতম হলো স্বামীদের পুরুষত্বহীনতা বা দুর্বলতা। জামাইয়ের সাথে তাদের লাগে ‘দীর্ঘ-মিনিট’। অথচ, অমুক-তমুক ‘ফ্রেন্ডস-উইথ-বেনিফিটস’দের সাথে তাদের খুব অল্পতেই ‘হয়ে যায়’। বেডরুম লাগে না। পাহাড়ের চিপাই যথেষ্ট।
আবেগ যেখানে টইটুম্বর, সবকিছু সেখানে খুব সহজেই সুসম্পন্ন হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। প্রায় দেড় দশক বিস্তৃত স্টুডেন্ট লাইফে চর্চিত ‘সেলফ প্লেজারের’ অভ্যাস তাদের দাম্পত্যজীবনে কী প্রভাব ফেলে, সেটা নিয়ে কথা বলে আর ‘ভেজাল’ সৃষ্টি করতে চাই না।
বলছিলাম, রুহুল আমীন ভাই আর ভাবীর সাথে আজ সকালে সাক্ষাতের বিষয়ে। ‘একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে দেখলাম পাহাড়ের ভেতরের দিক হতে বের হয়ে আসতে। আচ্ছা ভাই, একটা ছেলের সাথে ওই মেয়েটা যে পাহাড়ের ভেতরে গেল, মেয়েটা কি নিজের সিকিউরিটির কথা ভাবেনি? সেখানে ওর সিকিউরিটি কে দিবে?’ — রুহল ভাবীর প্রশ্ন।
আমি বললাম, “ভাবী, আপনি পুরনো দিনের মানুষ। তাই মেয়েদের সিকিউরিটির কথা ভাবছেন। রাতবিরাতে বাইরে ঘোরাফিরা করতে নিষেধ করলে আজকালকার মেয়েরা বলে, ‘আমরা কি মুরগী? আমাদের কেন সিকিউরিটি দিতে হবে?’ মেয়েদেরকে সিকিউরিটি দিতে হবে, এটাকে আজকালকার অনেক মেয়ে অমর্যাদাকর ও অসম্মানজনক বলে মনে করে। জাস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে তারা ‘নিরাপদে’ কয়েক দিনের ট্যুর করে আসে।”
আমাদের ডিপার্টমেন্টের কোনো ট্যুরে আমি যাই না। দু’বছর আগে শুধু একদিনের একটা ট্যুরে গেছি জীবনে প্রথম বারের মতো। খাগড়ছড়ির হর্টিকালচারে। এর নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম হলো, ক্ষুধার সময়ে পেটভরে ভাত-তরকারী খাওয়ার পরিবর্তে ছেলেমেয়েদের দিনভর চনাচূর খাওয়া আর চিপস চিবানো মার্কা তরল সম্পর্কচর্চাকে আমি কখনো মেনে নিতে পারিনি।
রাতের হোটেলভাড়া বাঁচানোর জন্য তথাকথিত স্টাডি ট্যুরগুলোতে আসা আর যাওয়ার সময়ে সাধারণত নাইট বাসজার্নি করা হয়। স্যারেরা সামনের সীটগুলোতে ঘুমায়। পিছনে থাকে ছেলেমেয়েরা। সেখানে কী হয় তা সহজে অনুমানযোগ্য। যদিও তা অনুমোদনযোগ্য নয় মোটেও।
পিকনিকের বাসে টিচাররাও ছেলেমেয়েদের সাথে নেচে নেচে কোরাস গায়, ‘রূপবানে নাচে কোমার দোলাইয়া’। ট্যুর শেষে ছেলেমেয়েদের মতো টিচারদেরও দেখি গলা ভাঙ্গা। এই উন্মাদনার মধ্যে নিজেকে কখনো অংশীদার ভাবতে পারিনি। তাই গত তিরিশ বছর আমার যাওয়া হয়নি কোনো ‘শিক্ষাসফরে’।
আমরা পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়েছি। নিতে পারিনি তাদের ক্যাম্পাস হুকিং, প্রমিসকিউটি আর ডেইটিং কালচার। এ’যেন পানিতে নেমে কাপড় না ভেজানোর এক ব্যর্থ চেষ্টা। এমতাবস্থায় করণীয় কী?
এ নিয়ে বহু জায়গায় প্রসঙ্গক্রমে বহু কথা বলেছি। আলোচনা করেছি অন্য অনেকের তুলনায় অনেক খোলামেলাভাবে। ‘কেন চাই সহজ বিয়ে’ লেখাটার সাথে অনুরূপ আরো কিছু লেখা নিয়ে এই নামে একটা বই ছাপিয়েছি। পড়তে পারেন। ডাউনলোড লিংক।
সামাজিক আন্দোলনের রূপরেখা নিয়ে আগামীকালের একটা অনলাইন সেমিনারে বক্তব্য রাখবো। বসেছিলাম সেটার প্রস্তুতি নিতে। ল্যাপটপ খুলতেই মনে হলো, ছেলেবন্ধু সহকারে ওই মেয়েটার সাতসকালে পাহাড়-দর্শন নিয়ে কিছু একটা লিখি।
প্রেম করতে মেয়েদের বাধা দেয়ার পরিণতি সম্পর্কে ধারণা থাকা সত্ত্বেও লিখে ফেললাম। কেউ যদি ফেরে।
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Mohammad Tausif Rafi: স্যার, ভিন্নমতের জন্য দুঃখিত। তবে আমার ধারণা, বিয়ে সহজ না হলে একটা স্বাভাবিকতম ব্যাপার। কথায় প্রভাবিত হবে না। ইসলাম অনুযায়ী সম্পর্ক তো স্বাভাবিক, ইসলাম একে নিয়মতান্ত্রিক করেছে, তবে বিয়ের বয়স ৩৫ করে না অবশ্যই। এখন বিয়ের বাস্তবতায় বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক সহজ না করে যারা শুধু স্বাভাবিকতাকে নিষিদ্ধ করতে চায় সেইসব প্রতিষ্ঠানে বরং যা অন্তত আমাদের মূল্যবোধ অনুযায়ী অস্বাভাবিক সেইসব ঘটে।
Mohammad Mozammel Hoque: এ মন্তব্যের মধ্যে তো ভিন্নমতের কিছু দেখলাম না।