চাচার ঝুঁটি কাটাইয়া দিছে চাচী। সেলুনে গিয়ে। নিজে দাঁড়াইয়া থেকে। চাচা কোন ছবিটা ফেইসবুকে দিবে, সেইটা চাচী ঠিক করে দিছে। চাচা কোন কোটটা পরবে সেইটা চাচী ঠিক করে দেয়। আচ্ছা, এই চাচা কি চাচীর হাতে নির্যাতিত?
চাচা যদি জোর করে হাদীসের রেফারেন্স টেনে চাচীর নখ কাটাইয়া দিতো, তাহলে আমার ধারণা নারীবাদীরা বলতো, চাচার হাতে চাচী নির্যাতিত। ইসলামী নারীবাদীরা বলতো, চাচার স্পিরিচুয়াল এবিউজের শিকার এই চাচী।
ঘটনার মূল টুইস্টটা এখানে। এখানেই নারীবাদী ব্যক্তিস্বাধীনতাপন্থীরা মাইরটা খেয়ে যায়।
Philosophy of AI কোর্স পড়ানোর সময় বহু বছর স্টুডেন্টদেরকে এই গল্প শুনিয়েছি।
এক লোকের দুইটা ঘোড়া ছিল, দুলকি আর মুলকি। দুলকি ছিল সেরা। অপরাজিত। একদিন এক চোর দুলকিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া শুরু করতেই মালিক টের পেয়ে যায়। সে দ্রুত অপর ঘোড়াটার উপর সওয়ার হয়ে চোরকে পিছু ধাওয়া করে। সে যখন চোরকে প্রায় ধরে ফেলবে তখন তার মধ্যে এক অদ্ভূত চিন্তা ভর করে বসলো।
দুলকির মালিক ভাবলো, চোর ব্যাটা ঠিক মতো চালাতে পারছে না বলে আমার ঘোড়াটা আজ পরাজিত হচ্ছে। জীবনে কোনো ঘোড়া একে হারাতে পারে নাই। নাহ্, চোর ওকে নিয়েই যাক। তবুও সে অপরাজিতই থাকুক।
এ’ধরনের আরেকটা গল্প আমি ছাত্রছাত্রীদেরকে শুনাই।
এক প্রফেসর। তার কেউ নাই। অবসর জীবনে তার সকল অর্থসম্পদ দিয়ে সে এলাকায় একটা পাবলিক লাইব্রেরি দিয়েছে। সেখানে পড়তে আসে এমন একটা তরুণী। তার সাথে আলাপচারিতায় সে জানতে পারলো, তরুণ বয়সে সে যেখানে পড়তে গিয়েছিল, সেখানে সে একটা বিয়ে করেছিল, সেখানে তার একটা কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। তরুণীটি তারই ঔরসজাত সেই কন্যা।
এরপর হতে ওই মেয়ে আর তার পরিবারের সাথে সে এমনভাবে জড়িয়ে যায়, মেয়ের কোনো একটা বিশেষ বিপদে অনেক টাকার দরকার হয়। তখন সে তার লাইব্রেরিটা বিক্রী করে দেয়।
অনুরূপ মানবিক আবেগ ও সিদ্ধান্তের আরেকটা গল্প I, Robot সিনেমাতে দেখানো হয়।
ডিটেক্টিভ স্পুনার সারাজীবন রোবটদের ঘৃণা করতো। কারণ, তার গাড়ী এক্সিডেন্ট করে রাস্তার পাশে জলাশয়ে পড়ে যাওয়ার পরে একটা NS5 রোবটকে সে কমান্ড করে তার কন্যাশিশুটিকে এবং তার স্ত্রীকে উদ্ধার করার জন্য। যান্ত্রিক যুক্তিবাদী রোবটটি সেই আদেশকে অগ্রাহ্য করে তাকেই বরং গাড়ির কাঁচ ভেঙে টেনে বের করে। বাঁচায়।
কেন দুলকির মালিক তাকে হারানোর বিনিময়ে হলেও তার প্রিয় ঘোড়াটাকে অপরাজিত দেখতে চেয়েছে? কেন অধ্যাপক মহোদয় তার লাইব্রেরিটা মেয়ের অর্থসংস্থানের জন্য বিক্রী করে দিয়েছে? কেন স্পুনার নিজে বাঁচতে না চেয়ে তার শিশু বা স্ত্রীকে বাঁচাতে চেয়েছে?
এই সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটাই লজিক্যাল বা অপটিমাল ছিল না। এগুলো সেটিসফাইয়িং ডিসিশন। কেবল মানুষই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মানুষ আপনজনদের কাছে পরাজিত হতে পছন্দ করে। ভালনারেবলদেরকে প্রটেক্ট করে। নারীদেরকে পুরুষরা করে। ছোটদেরকে বড়রা করে। অসুস্থদেরকে সুস্থ সবলরা করে। গরীবদেরকে ধনীরা করে। জনগণকে শাসকরা করে। ইন জেনারেল। আইডিয়েলি।
যেখানে এর ব্যতিক্রম ঘটে সেটাকে আমরা অন্যায় হিসেবে বিবেচনা করি। ন্যায্যতা কায়েমের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মানবিক সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি।
এ’ধরনের মানবিক সিদ্ধান্ত, অনুভূতি ও আবেগের রসায়ন তারা কোনোদিনই বুঝবে না যারা সবকিছুকে সমতার পাল্লা দিয়ে মাপতে চায়। আপাত পরাজয়কে মেনে নিতে পারে না। সবকিছুতে জিততে চায়।
ভালোবাসার কাছে পরাজিত হতে না পারলে, ‘আমরা নারীবাদী, আমরা ভালোবাসা চাই’ – এ’রকম কোরাস গান গলা ফাটিয়ে হারমনিয়াম বাজিয়ে সারাদিন গাইলেও কোনো লাভ নাই।
এ’ধরনের নারীবাদী সমতাবাদীদের জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা আসলেও তাদের অতিস্পর্শকাতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আর অধিকারচর্চার ঠেলায় সেই ভালোবাসা অচিরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
ভালোবাসা যে পথে পাওয়া যায় সে পথে না গিয়ে এসব সমানাধিকারবাদীরা অজান্তেই হয়ে উঠে স্বীয় ভালোবাসার হন্তারক। ভালোবাসাহীনতা তাদের জন্য আত্মকৃত বঞ্চনা। সেলফ ডিপ্রাইভেশান।
সত্যিকার সুখের কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পারিবারিক সুখের কোনো বিকল্প নাই। যে কেনো প্রতিষ্ঠানের মতো পরিবারেও থাকে, থাকতে হবে মর্যাদাগত এবং কর্মনীতিগত একটা ক্রমসোপান। এই পজিশনাল হাইয়ারআর্কি ঠিক জেন্ডার বেইজড নয়। যদিও জেন্ডার এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাপালন করে।
যেমন, একটা যৌথ পরিবার। সেখানে বাচ্চাদের গ্রান্ড প্যারেন্টসও থাকে। ট্রাডিশনাল ফ্যামিলি সিস্টেম অনুসারে সেখানে এক নাম্বার পজিশন হবে ছেলের বাবা। দুই নম্বর পজিশনে থাকবে ছেলের মা। তিন নম্বর পজিশন হবে ছেলের। চার নম্বর পজিশনটি পাবে ছেলের বউ, যে কিনা ওই সংসারে বাচ্চাদের মা। এরপরের পজিশনে থাকবে দাদা-দাদী বা নানা-নানীর নাতি-নাতনীরা। বয়স অনুসারে।
এই সিস্টেমে একটা ফ্যামিলি গড়ে উঠে, প্রপারলি রান করে। এইটাকে জোর করে সমতার আওতায় নিয়ে আসলে লিভ-টুগেদার জাতীয় কিছু হবে। ফাংশানিং কোনো ফ্যামিলি হবে না।
লিভ টুগেদার সিস্টেমে কমন ইনভেস্টমেন্ট থাকে না। বাইন্ডিং থাকে না। লং টার্ম কোনো গোল আর কমিটমেন্ট থাকে না। তাই সেগুলো টিকে না। বায়বীয় ভালোবাসাই যদি হতো দাম্পত্য সম্পর্কের মূল ভিত্তি, তাহলে প্রচলিত পারিবারিক ব্যবস্থার চেয়ে লিভ টুগেদার সিস্টেম অধিকতর টেকসই ও সফল হতো।
‘যাওয়ার জায়গা নাই বলে থেকে গেছি’ এই কথাটা অভিযোগ হিসেবে নারীরা সাধারণত বলে থাকে। কথাটা অপ্রিয়, কিন্তু নির্ভেজাল সত্য। আক্ষরিকভাবেই সত্য। যাওয়ার জায়গা কিছুটা থাকা ভাল। বেশি থাকা ক্ষতিকর।
সেকেন্ড অপশন। থার্ড অপশন। অফুরন্ত অপশনের ভীড়ে কখনো কোনো কমিটমেন্টে কেউ স্থিত হতে পারে না। এটি ইউনিভার্সালি ট্রু। তাই, দায়িত্বপালন করেন। বিনিময়ে অধিকারটুকু বুঝে নেন। ম্যাক্সিম্যালি না হলেও অন্তত মিনিমালি। দেখবেন, ভালোবাসা আপনাতেই গড়ে উঠবে।
‘ভালোবাসা চাই, ভালোবাসা চাই’ বলে চিল্লাইলে হবে না। সত্যিকারের ভালোবাসা গড়ে উঠার জন্য সেক্রিফাইস করতে হবে, ইনভেস্ট করতে হবে। নগদ লাভের লোভ সম্বরণ করতে হবে।
নারীপুরুষ উভয়ের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তানাদি। যত বেশি তত ভাল। সন্তানাদির পরে বড় অর্জন হলো পরিণত বয়সে কারো পাশে থাকা। কাউকে পাশে পাওয়া। শীতের রাতে যে তোমার গায়ে কম্বলটা তুলে দিবে। সবাই চলে গেলেও যে কিনা তোমাকে ছেড়ে যাবে না।
আজকে আর কথা বাড়াবো না। টাকাপয়সা দেয়ার ওয়াদাও করবো না। কবি আখতারুজ্জামান আজাদের মতো টাকা পয়সা চাওয়ার মতো অডিয়েন্স যেহেতু আমার নাই, তাই টাকাপয়সাও চাইবো না।
শুধু জানতে চাইবো, চাচীর হাতে চুলের ঝুঁটি হারানো এই চাচা কি চাচীর হাতে নির্যাতিত? আপনার কী মনে হয়?
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Rafin Joy: কেয়ারিং এক্টিভিটিস এবং ডমিনেটিং এক্টিভিটিসের মাঝে বিস্তার পার্থক্য আছে, স্যার। চাচার প্রতি চাচির এই বিষয়গুলোকে কেয়ারিং এক্টিভিটিস হয়ে থাকলে, ইট’স ওকে। যেখানে চাচাকে একটু সাবমিসিভ ক্যারেক্টার মনে হইলেও বিষয়টা আসলে রেসিপ্রোক্যাল বন্ডিং। তবে নারীবাদী হইলে মানুষ ভালোবাসা পাইতে পারে না সিমস ভেরি ফেইন্ট স্টেটমেন্ট। সাথে সব সময় নারীরই হার মানার বিষয়টা কেনোই বা এতোটা নর্মালাইজড, সেটাও সিমস ভেরি বায়াসড।
অবশ্য আপনার সাথে খুব শীঘ্রই হয়তো অনলাইন ওপেন ডিস্কাশনে যাওয়া সম্ভব হবে। আপনার অপারেশনের কথা জানিয়েছিলেন। নিজের খেয়াল রাখবেন এবং সুস্থ থাকবেন। শুভকামনা।
Ashfaq Reshad: একটা পরিবার গড়ে ওঠে নির্ভরশীলতার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সেটা অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সেই প্রাচীনকাল থেকেই পুরুষের প্রধানতম প্রথাগত দায়িত্ব ছিল তার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করা। অর্থাৎ পুরোদস্তুর একটা নির্ভরশীলতার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এর ফলে পরিবারগুলো টেকসই হতো। পুরুষ একজন আসল পুরুষ হিসেবে গড়ে উঠত।
বর্তমানে নারীদের একাধিক বিকল্প থাকে। সে আর পুরুষের ওপর এককভাবে নির্ভরশীল না। ফলে আজকের সম্পর্কগুলো হয় ভঙ্গুর। আর পুরুষও তার পুরুষালী বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে ওঠে না।
Abdullah Zafar: দুর্ব্যবহার করিনা কারো সাথেই, তারপরও পরিবার বা মাদরাসার ছাত্র, সবাই আমাকে ভয় পায়, সমীহ করে। কেউ কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়নি কোনোদিন। কিন্তু বিয়ের পর থেকে গিন্নির পছন্দের বাইরে কিছু করার জো নেই। ওর পছন্দের জামা পরতে হবে, ওর পছন্দের পারফিউম ব্যবহার করতে হবে… কত কী! প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম। এখন ব্যাপারটা উপভোগ করি। ভালোবাসে এবং ভরসা করে বলেই তো নিজের পছন্দ আমার উপর চাপাতে চায়।