কোনো এক ‘সাহসী’ প্রতিবাদী দ্রোহী কোথাও লিখেছেন, “We don’t want any favour of men during the time of our marriage. We are not products in the market to be sold. Why will we receive their “দেনমোহর”? Are they trying to buy us as a slave?? We don’t need their unlawful money.”

পড়লাম। ভাবলাম, আসলে বিয়ে বলতে কী বুঝায়? দু’জন নারী-পুরুষের একসাথে থাকা? তা যদি হয়, তাহলে লিভ টুগেদারের সাথে বিয়ের পার্থক্য কী? বলতে পারেন, বিয়ে হচ্ছে lawful living together। সেক্ষেত্রে এই lawful বলতে কী বুঝবো?

যদি বলা হয়, আইনগত স্বীকৃতি। তাহলেও সমস্যা ও প্রশ্ন আছে। পাশ্চাত্যে তো লিভ টুগেদারের আইনি স্বীকৃতি আছে। অতএব প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর মধ্যকার বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্ক এবং বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের মাঝে এমন কী রয়েছে যা একটির মধ্যে আছে অথচ অপরটির মধ্যে নাই? ভাবতে থাকুন। খাতা-কলম নিয়ে বসুন। নোট ডাউন করুন। আশপাশের সমঝদারদের সাথে মতবিনিময় করুন।

শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে আপনাকে (১) বিয়ে আর লিভ টুগেদারের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নাই। অথবা, (২) বিয়ে আর লিভলিভ টুগেদার অন্ততপক্ষে ‘এই কারণে’ আলাদা বিষয়। – এই দুইটার যে কোনো একটাতে পৌঁছতে হবে।

আপনি যদি মনে করেন, বিয়ে আর লিভ টুগেদারের মধ্যে আদতে কোনো পার্থক্য নাই তাহলে স্বামীর কাছ হতে স্ত্রী কেন বিয়ের সময়ে দেনমোহর নিবে তা নিয়ে আলোচনার দরকার নাই। কেননা, দেনমোহরটা বিয়েরই একটা অনুষঙ্গ। লিভ টুগেদারে সিস্টেমে দেনমোহর থাকার বিষয়টাই অপ্রাসঙ্গিক।

আপনি যদি বিয়ে এবং লিভ টুগেদারের মধ্যে অন্তত একটা হলেও পার্থক্য আছে এবং তা মৌলিক বলে মনে করেন, তাহলে সেই পার্থক্যটা কি, তা আপনাকে বলতে হবে। লোকেরা বলে, সমাজ এমনটাই বলে, তাই আমিও বলি, এ’কথা বলতে পারবেন না। এমনও বলতে পারবেন না, “ধর্মগ্রন্থে এমনটা বলা আছে। আমি ধর্ম মানি। অতএব, আমি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বলছি, বিয়ে জায়েয। আর লিভ টুগেদার না-জায়েয।”

কেউ যখন যুক্তির আলোচনাতে ঈশ্বরকে টেনে আনেন তখন সে আলোচনা আর আগাতে পারে না। এমন কি আপনি এ কথাও বলতে পারবেন না, “দেশের আইনে বিয়েকে বৈধ করা হয়েছে, লিভ টুগেদারকে বৈধতা দেয়া হয় নাই। এটি হলো এই দুয়ের পার্থক্য।” কোনো বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে তাত্ত্বিক আলোচনায় কোনো স্থানীয় আইনের দোহাই বা উদ্ধৃতি গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা জানি, আইনমাত্রই পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনযোগ্য।

তো, সম্মানিত পাঠক, বিয়ে আর লিভ টুগেদারের মধ্যে কোনো পার্থক্য পেলেন না? যাহোক, এ নিয়ে খোলামনে ভাবতে থাকেন। দেখবেন, বিয়ে আর লিভ টুগেদারের মধ্যে একটা অত্যন্ত মৌলিক পার্থক্য আছে। এর আগে বিয়ে আর লিভ টুগেদারের মধ্যে সাদৃশ্যগুলো আমরা একটু স্মরণ করে নেই।

বিয়ে ও লিভ টুগেদারের মধ্যে সাদৃশ্য

(১) উভয় প্রকার সম্পর্কে উভয় পক্ষকে নৈতিক, নাগরিক ও মানবিক দিক থেকে সমান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। (২) উভয় প্রকার সম্পর্কের ভিত্তি, স্থিতি ও পরিণতি হলো পারষ্পরিক সম্মতি ও সামাজিক অবগতি। (৩) উভয় প্রকারের সম্পর্কে যৌনতা, সন্তান ধারণ ও প্রতিপালন পক্ষদ্বয়ের পারষ্পরিক সম্মতির ওপর নির্ভর করে।

আমাদের সমাজে কী হয়, ওদের সমাজে কী হয়, ইত্যাদি এখানে বিবেচ্য নয়। আমরা যদি মনে করি, কোনোখানে ব্যাপারগুলো ঠিকমতো হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে আলোচনা হতে পারে, কীভাবে তা সংশোধন করা যায়, তা নিয়ে। আমরা এখানে বিয়ে আর বিবাহ বহির্ভূত অথচ পারষ্পরিক সম্মতিমূলক যৌন সম্পর্কের মধ্যে টেকসই কোনো পার্থক্য আছে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করছি।

এতদুভয় ধরনের সম্পর্কের মাঝে আমার দৃষ্টিতে একটাই পার্থক্য। সেটা বলার আগে কিছু সাধারণ কথা বলে নিই।

পরিবার কি একটা প্রতিষ্ঠান?

বিয়ে একটা ব্যক্তিগত চুক্তি যার সামাজিক অবগতি থাকা শর্ত। বিয়ের মাধ্যমে পরিবার গঠিত হয়। পরিবারের সমন্বয়ে সমাজ গঠিত হয়। সমাজ ব্যবস্থার উচ্চতর ব্যবস্থাপনার পরিণতিতে রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়। এই তো ব্যাপার? নিশ্চয়ই মানবেন, রাষ্ট্র একটা প্রতিষ্ঠান। এর কর্মব্যবস্থাপনার জন্যে গঠিত অধঃস্তন প্রতিষ্ঠান হলো সরকার। এরও অধঃস্তন প্রতিষ্ঠান হলো সমাজ।

রাষ্ট্র, সরকার ও সমাজকে যদি প্রতিষ্ঠান হিসাবে মানেন, যেগুলোর প্রত্যেকটার অধীনে রয়েছে বহুবিধ উপ-প্রতিষ্ঠান, তাহলে বলেন, সমাজের অধঃস্তন প্রতিষ্ঠানগুলো কী কী? না, থাক। আমাকে লিস্টি দিতে হবে না। আমি শুধু জানতে চাইছি, পরিবারকে আপনি একটা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মানতে রাজী আছেন কিনা?

যদি সমাজের একক হিসাবে পরিবারকে মানতে না চান, সে ক্ষেত্রে আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে, কীভাবে ‘সমাজ’ নামক এই জটিলতর প্রপঞ্চের আবির্ভাব ঘটলো। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উদারহরণ এ ক্ষেত্রে খাটবে না। কেননা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো অবশ্যম্ভাবী। মাঝখান থেকে কেনা-বেচার সমতার কথা বললে হবে না। কেনা-বেচাতে ক্রেতা-বিক্রেতার সমসুখ অর্জিত হয় বটে। অথচ, একজন একটা কিছু ত্যাগ করে। অন্যজন সেটা গ্রহণ করে। এর বিনিময়ে প্রথম জন একটা কিছু দেয়, যা দ্বিতীয় জনের কাছে ছিলো না। লেন-দেনের মাধ্যমে অর্জিত এই সুখ সমপ্রকৃতির। অথচ এর প্রক্রিয়াটা পরস্পরের বিপরীত। এই সমতা, সামগ্রিক সামগ্রিক বিবেচনায় অর্জিত সমতা। পণ্যের দিক থেকে দেখল বিক্রেতার পূর্ণ ‘ক্ষতি’, ক্রেতার পূর্ণ ‘লাভ’। আবার অর্থের মালিকানার দিক থেকে দেখলে বিক্রেতার পূর্ণ ‘লাভ’ আর ক্রেতার পূর্ণ ‘ক্ষতি’।

হাসছেন? এ ধরনের তুচ্ছ ও অতিসাধারণ কথাগুলো কেন বলছি, ভাবছেন? আজকালকার নারীবাদী স্ববিরোধীদেরকে যুক্তির জালে আটকানোর জন্য এ ধরনের অবভিয়াস কথাবার্তা আবার নতুন করে স্মরণ করতে হচ্ছে। অতএব, বলুন, সমাজ নামক এই প্রতিষ্ঠানটা কীভাবে গড়ে উঠেছে?

আমরা সবাই মানি, ব্যক্তিমানুষ হচ্ছে সমাজের একক। সমস্যা হলো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজ নামক প্রতিষ্ঠান তৈরী করে না। বরং বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ নানাবিধ প্রয়োজনে পরস্পরের সাথে সুবিধা মোতাবেক চুক্তির ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। যা সমাজ হয়ে সরকার, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা রাষ্ট্র-সংঘ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে।

যৌনক্রিয়া, সন্তান উৎপাদন, অর্থনৈতিক সাপোর্ট, নিরাপত্তা ইত্যাদি নানা কারণে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারী যখন পারষ্পরির সম্মতির ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন তা হতে পারে বিবাহভিত্তিক পরিবার অথবা লিভ টুগেদারভিত্তিক ‘পরিবার’। লিভ টুগেদারকে পরিবার বলছি পাশ্চাত্য প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে। সমকামী পরিবার, মুক্ত সম্পর্কের পরিবার, শুধু মাকে নিয়ে একক পরিবার, এ’গুলো আদৌ পরিবার কিনা, সেটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়। আমাদের বর্তমান ফোকাস বিয়ে ও লিভ টুগেদারের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করে দেনমোহরের যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করা। তাই আমরা এখানে পরিবার বলতে প্রাচ্য সমাজে আচরিত পরিবার ব্যবস্থাকে বুঝাবে।

লিভ টুগেদারে নাই, অথচ পারিবারিক ব্যবস্থায় আছে

এতক্ষণে হয়তো বুঝে গেছেন, আমি কী বলতে চাচ্ছি। বিয়ের চুক্তিটা পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের মতো সর্বোতভাবে সমতা ও সমঝোতামূলক। উভয়পক্ষই যার যার দিক থেকে যার যার মতো করে লাভবান হয়। কথা হলো, লিভ টুগেদারেও এটি আছে। লিভ টুগেদারে যা নাই অথচ পরিবার ব্যবস্থায় আছে তা হলো, সমাজের ক্ষুদ্রতম একক বা ইউনিট হিসাবে পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতি বা কার্যকারিতা। এক কথায়, পরিবার হলো একটা সমাজস্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। আর লিভ টুগেদার হলো, কোথাও বা সমাজস্বীকৃত, কোথাও বা সমাজ-অস্বীকৃত পারষ্পরিক সম্মতিমূলক যৌন সম্পর্ক। এটি লিখিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে বিয়ের সাথে এর কার্যত: কোনো পার্থক্য থাকে না। লিভ টুগেদারকে আমরা এক ধরনের অলিখিত যৌন সম্পর্কের চুক্তি বলতে পারি।

কথাটা আরেকবার পরিষ্কার করে বলছি। বিয়ে ও লিভ টুগেদার, উভয়টিরই ভিত্তি হলো পক্ষদ্বয়ের পারষ্পরিক সম্মতি। লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে এই ‘চুক্তিটি’ আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। এটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হয় না।

কারণ?

যে কোনো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপালনের নিরিখে অবস্থানগত ক্রমসোপান থাকবে। তাছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা, পরিচালিত হওয়া ও টিকে থাকা অসম্ভব। যে কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। বিষয়টা এতটাই অবভিয়াস যে এ নিয়ে আর কথা বলা প্রয়োজন নাই, বোধ করি।

বিয়ের মাধ্যমে যদি একটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার বিষয়কে স্বীকার করেন, তাহলে বলুন, সেই প্রতিষ্ঠানটির অবস্থানগত ক্রমধারা বা হাইয়ারআরকি কী হবে? পরিবারভিত্তিক সমাজমাত্রই হয়তো পিতৃতান্ত্রিক হবে, নচেৎ মাতৃতান্ত্রিক হবে। উভয় ব্যবস্থার মধ্যকার কোনো একটাকেই শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হবে। যুক্তির দিক থেকে এতদুভয় অন্ততপক্ষে সমান হওয়া সত্বেও। আমরা জানি, পিতা ও মাতা প্যারেন্টশীপের দিক থেকে পরস্পরের সমান হওয়া সত্বেও সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের দায়িত্ব নারীকেই বহন করতে হয়। এটি প্রকৃতির নিয়ম। ‘প্রকৃতি’ কেন এমন ‘বৈষম্য’ করলো, তা অবশ্য আমার জানা নাই।

পর্বটির ফেসবুক লিংক

*****

নারী-পুরুষের গঠনগত পার্থক্যের আসলেই কোনো ভূমিকা আছে?

এটি অনস্বীকার্য, গঠনগত শক্তিমত্তার কারণে শ্রমনির্ভর অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও নিরাপত্তা রক্ষার দিক থেকে পুরুষেরা পরিবারের পরিচালক বা নেতা হওয়াটা যুক্তি সংগত। বলতে পারেন, প্রযুক্তির এই যুগে শারিরীক বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য এখন অচল। আপনার কথার সাথে আমি খানিকটা একমত হতে পারি। যদি আপনি হালনাগাদের নারীবাদের সমর্থনে নারী-পুরুষের শারীরিক পার্থক্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন বা বর্তমানে অকার্যকর মনে করেন, তাহলে আপনার উচিত এই পোষ্ট আর না পড়া।

নারীবাদের স্বর্গরাজ্য পাশ্চাত্যেও দেখি না, নারীরা যুদ্ধ করছে। সেনাবাহিনীতে নারী সদস্য থাকা আর নারীরা যু্দ্ধ করা, এক কথা না। মহিলা সাহাবীরাও যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতেন। কাফের নারীরাও আসতো। তারা সময়ে সময়ে সম্মুখ সমরও করেছে। কখনো কোনো যুদ্ধে নারী কমান্ডারও ছিলো। এর মানে এই নয় যে, তখন বা কখনো নারীরা যুদ্ধ করেছে। সেখানে আমারা দেখি, মহিলা আর পুরুষ খেলোয়াড়রা আলাদাভাবে প্রতিযোগিতা করে। সেখানেও দেখা যায়, মাতৃত্বের কারণে নারীরা তাদের ক্যারিয়ারে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। একজন হিলারী ক্লিনটন দিয়ে তো আর পুরো মার্কিন সমাজকে বিচার করতে পারবেন না।

পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নারী না হয়ে পুরুষ হওয়ার অন্য আরেকটি কারণ আছে। সেটা সাধারণত ততটা বলা হয় না। সেটি মনস্তাত্ত্বিক। সমকালীন নীতিবিদ্যায় একে ethics of care হিসাবে বলা হয়। নারীরা কেয়ারিং হয়। সহনশীল হয়। তাদের ধৈর্য বেশি। ‘এথিকস অব কেয়ার’ আমার মতো ধার্মিক পুরুষের আবিষ্কার নয়। এটি পাশ্চাত্যের নারী দার্শনিকদেরই প্রস্তাবণা। বিশ্বাস না হলে গুগল করে দেখেন।

আপনি যদি নারী হোন, তাহলে নিজের দিকে তাকান। আর যদি পুরুষ হোন, আপনার আশেপাশে খেয়াল করে দেখেন, দেখবেন, নারীরা তেমন পুরুষকে পছন্দ করে যাদেরকে বশ করা কঠিন। যারা রাফ এন্ড টাফ। নতজানু মেরুদণ্ডহীন, পৌরুষত্বহীন পুরুষকে কোনো নারী পছন্দ করে না। যে পুরুষকে সে খানিকটা বেয়াড়া হিসাবে দেখে, যার মধ্যে সম্পদ, শক্তি, শারীরিক উচ্চতা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষমতা ইত্যাদি আছে তাকেই সে পছন্দ করে। এক কথায়, নারী মাত্রই প্রবল পুরুষকে পছন্দ করে। কোনো নারীই দুর্বল ও অধীনস্ত পুরুষকে পছন্দ করে না। বরং বিবর্তনের দাবি হিসাবে সে বরাবরই শক্তিমান পুরুষের সংগী হিসাবে নিজেকে দেখতে চায়। নারীর ভালো লাগাতে তার পছন্দের গুরুত্ব অনেক বেশি। নারীদের ব্যক্তিগত ভালো লাগার ব্যাপারটা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি মনস্তাতাত্ত্বিক।

বলতে পারেন, বিশেষ সমাজে বা বিশেষ ক্ষেত্রে এমনটা নাও হতে পারে। অথবা, কোনো বিশেষ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। আমি আপনার সাথে এ ব্যাপারে একমত। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম হতে পারে। হয়। তাতে কিছু আসে যায় না। ব্যতিক্রম দিয়ে আইন হয় না। আইন হয় সাধারণ অবস্থা, আচরণ ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে। ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। বড়জোর, ব্যতিক্রমের জন্য কিছু ব্যতিক্রমী বা বিশেষ নিয়ম হতে পারে। এ ধরনের সামগ্রিক ও তাত্ত্বিক আলোচনায় এ ধরনের কোনো বিবেচনা অপ্রাসংগিক।

এতক্ষণের আলোচনাতে যদি একমত হোন, পরিবার হলো ক্ষুদ্রতম সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণভাবে পুরুষ হলো সেই প্রতিষ্ঠানের এক নম্বর ব্যক্তি তাহলে আপনার চিন্তার জট অনেকখানি খুলবে। পূর্বেই বলেছি, বিশেষ কোনো সমাজের বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্য, ঘটনা বা পরিস্থিতি আলোচনার জন্য আমরা এই আলোচনাটা শুরু করিনি। আদর্শ অনুসারে সমাজ না চললে সেই সমাজকে কীভাবে ভেংগে-চুরে সংস্কার করা যায় তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এতে দ্বিমত করার কিছু নাই।

আমরা যখন কোনো মডেল নিয়ে কথা বলবো, তখন আমরা মূলত যুক্তিনির্ভর থাকবো। দেখবো, বিশেষ কোনো কাজ যুক্তি সংগত কিনা। কেউ যদি গোড়ার বিষয়গুলোকেই গ্রহণ করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পর্যায়ের গুরুত্ববহ, এমন কিছু নিয়ে তার সাথে এনগেইজড হওয়ার মানে হয় না।

পরিচালনার সাথে মর্যাদার সম্পর্ক

বিয়ে এক ধরনের আইনসম্মত একত্র বসবাস। তারমানে এই নয় যে, আইনসম্মত একত্র বসবাস মানেই বিয়ে। উভয় ধরনের সম্পর্ক লিখিত বা অলিখিত সম্মতিমূলক চুক্তির মাধ্যমে গড়ে উঠলেও, এর একটি চুক্তির অব্যবহিত পর পরই ক্রমসোপানমূলক (hierarchical or vertical) প্রতিষ্ঠানে পরিগণিত হয়। যাকে আমরা বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করি। অন্যটাতে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্তও সমতলধর্মী (horizontal) থেকে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করে না। লিভ টুগেদারের যদি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ থাকে তবে তা নামে না হলেও কার্যত বিয়ে-ই।

কনফিউজড পাঠকদের বিরক্তির আশংকা সত্বেও দ্বিরুক্তি করে বলছি, উভয় পক্ষ যখন সকল প্রায়োগিক ক্ষেত্রেই সমানে সমান থেকে যায় তখন সেটি আর প্রতিষ্ঠান বা দল হিসাবে আর বিবেচিত হয় না। যে গাড়িতে সবাই সমভাবে পরিচালনার অধিকারপ্রাপ্ত, সে গাড়ী চলতে পারবে না। চললেও এক্সিডেন্ট করবে, নিশ্চিত। গাড়ি পরিচালনায় টিম ওয়ার্ক হতে পারে। জাহাজে কাপ্তান থাকে একজনই। কোনো বাহিনীতে দু’জন কমান্ডার থাকে না। নেতৃত্ব জিনিসটাই হচ্ছে ক্রমসোপানের ব্যাপার। প্রায়োগিক ক্রমসোপান মানেই অবশ্য মর্যাদার ক্রমসোপান নয়। মানবিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত, এককথায় সব দিক থেকেই সব মানুষ আদতে সমমর্যাদার অধিকারী। তৎসত্বেও কার্যত বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য বিশেষ বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব ও আনুগত্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।

বুঝতেই পারছেন, সমতা মানে নিঃশর্ত নৈতিক ও আইনি সমতা। তা না বলে যদি বলা হয়, সমতা মানে বাছবিচারহীন সর্বোত সমতা, তাহলে তা হবে বাস্তবতা ও প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এমন ইনসেইন লোকজনের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার মানে হয় না। আবার কার্যত: কাউকে কর্তৃত্ব দেয়াকে যারা খানিকটা বাস্তবিকপক্ষে মর্যাদাহানিকর হিসাবে মনে করেন, তারাও বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। গাড়ীর ড্রাইভারকে যখন কর্তৃত্ব দেয়া হয় তখন তাকে তো বেশি মর্যাদার বা সুপেরিয়র মনে করা হয় না। আবার বাহিনী প্রধানের নির্দেশ মানা মানে নিজেকে ‘দুর্বল’ ও ‘হেয়’ মনে করা, এমনও নয়। নাগরিক অধিকারের দিক থেকে, আমরা জানি, রাষ্ট্রপ্রধান ও একজন সাধারণ নাগরিকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। পার্থক্য যা কিছু তা দায়িত্বের কারণে।

বিবাহবিচ্ছেদের সমঅধিকার

এ বিষয়টা আশা করি ভালো করে বুঝা গেছে। পরিবার একটা প্রতিষ্ঠান। কালোত্তীর্ণতার মাপকাঠিতে পুরুষ এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি। এইসব কথাবার্তার মানে এই নয় যে, বৈবাহিক চুক্তির যে সমতা তা বাস্তবে অকার্যকর। বরং মূল চুক্তির এই সমতা সর্বাবস্থাতেই বজায় থাকে। যে কোনো পক্ষ চাইলে যে কোনো সময়ে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। যাকে আমরা ডিভোর্স বলি। ইসলাম ধর্ম মোতাবেক, ডিভোর্স দেয়া ও চাওয়ার অধিকারের দিক থেকে স্বামী ও স্ত্রীর অধিকার সমান। পার্থক্যটা পদ্ধতিতে। স্ত্রী ডিভোর্স চাইলে তাকে সালিশের মাধ্যমে যেতে হয়। যদ্দুর বুঝেছি, নারীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই এই ধরনের পরোক্ষ পদ্ধতি। আপনি চাইলে, একে কিঞ্চিত বাধাগ্রস্ততাও বলতে পারেন। এর বিপরীতে, পুরুষ কর্তৃক তিন তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার যে রেওয়াজ তা নিতান্তই রেওয়াজ। এর ধর্মীয় ভিত্তি নাই।

হযরত উমর (রা.) এ ধরনের ডিভোর্স প্রদানকারীদেরকে শাসানোর জন্যই মত দিয়েছিলেন, এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কার্যকর হবে। তিন তালাক যারা দেয় তাদেরকে এ ধরনের কাজে বাধা দেয়ার জন্যই তিনি এই সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। এরই সাথে তিনি এ ধরনের ডিভোর্স প্রদানকারীকে বেত্রাঘাতের আইন জারি করেছিলেন। এখন বেত্রাঘাত নাই। কিন্তু নারীর স্বার্থবিরোধী তিন তালাকের বিধানটা রয়ে গেছে। যেমন করে মুয়াবিয়া (রা.) গমের দাম বেশি হওয়ায় তুলনামূলকভাবে কম মূল্যের খেজুরের সাথে সামঞ্জস্য করতে গিয়ে অর্ধ সা তথা অর্ধেক ওজনের গম ফিতরা হিসাবে দেয়া যাবে, এই মর্মে আইন জারি করেছিলেন। এখন খেজুরের তুলনায় গমের দাম কম হওয়া সত্বেও গমের ক্ষেত্রে ফিতরার নিসাব অর্ধ সা’ই রয়ে গেছে।

আমাদের দেশে বিয়ের আগে কমচে কম তিন মাস পারষ্পরিক দাম্পত্য অধিকারের উপর কোর্স হওয়া উচিত। এমনকি অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেরাও জানে না, নারীদের যখন তখন তালাক দেয়া যায় না। ‘তিন তহুর’ টার্মটার সাথে যদি আপনি পরিচিত না হোন, তাহলে আপনিও কোরআন মোতাবেক স্ত্রীকে তালাক দেয়ার নিয়ম জানেন না। ‘খোলা তালাক’ কথাটার সাথে যদি আপনি অলরেডি পরিচিত না হোন, তাহলে আপনি জানেন না, নারীরা কিভাবে স্বামীকে তালাক দিবে। ‘খোলা’ মানে আমরা বাংলাতে ওপেন অর্থে যা বুঝি, তা কিন্তু নয়।

এখানকার কোনো সামাজিক অপসংস্কৃতি ও গোঁড়ামীর কারণে কেউ যদি ধর্ম ও বিয়েকে বাদ দিতে চান তাহলে তো পাশ্চাত্যের বল্গাহীন উগ্র নারীবাদের কারণে নারীবাদকেও বাদ দিতে হয়। জাহাজের ডেকের লোকদের উপরের লোকেরা পানি দিচ্ছে না। এমতাবস্থায়, নীচতলার লোকেরা সিদ্ধান্ত করলো, তারা তলা ফুটা করে পানি সংগ্রহ করবে। আমাদের এখানকার নারীবাদীদের অবস্থা হয়েছে এমনই। পানি পাচ্ছে না বলে তলা ফুটা করতে চাওয়া অর্বাচীনদের মতো। হাস্যকর। নারীবাদীদের অবস্থা হচ্ছে, throwing the baby with the bathtub water.

দেনমোহর বিয়ের প্রথম ক্যাটাগরির শর্ত নয়

এবার আসেন, দেনমোহরের প্রসংগে। বৈবাহিক চুক্তি হলো সমানে সমান চুক্তি। চুক্তিটা সমানে সমানে হলেও এবং শেষ পর্যন্তও তা সমানে সমান হিসাবে বহাল থাকলেও কার্যব্যবস্থাপনার দিক থেকে এই চুক্তি একটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেয়। যে প্রতিষ্ঠানে উভয় পক্ষের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব, কর্তব্য ও পরস্পরের ওপর সুনির্দিষ্ট অধিকার বহাল থাকে। এ ধরনের অপরাপর প্রতিষ্ঠানের মতোই এটি মেয়াদি চুক্তি নির্ভর। যদিও চুক্তিটা ভেংগে দেয়ার আগ পর্যন্ত অনিদির্ষ্টকালের জন্য অটোমেটিকেলি বর্ধিত হয়। এক কথায়, এটি পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মতিসাপেক্ষ ব্যাপার।

দেনমোহর বিয়ের প্রথম ক্যাটাগরির শর্ত নয়। বিয়ের প্রথম ক্যাটাগরির শর্ত দুইটা। (১) বিবাহযোগ্য নর-নারীর পারষ্পরিক সম্মতি এবং (২) সামাজিক অবগতি। দেনমোহর এসেছে নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। নারী পক্ষের পক্ষ হতে বরপক্ষকে যৌতুক দিতে হতো। যেটি আমাদের এখানে এখনো চলে। দেনমোহরও দেয়া হতো। তবে সেটি পেতো মেয়ের বাবা। মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো না। খাদিজাকে (রা.) উনার পিতা ও পূর্বেকার স্বামীদ্বয় ধনসম্পদ দিয়ে গেছেন। সে হিসাবে তিনি সম্পদ পেয়েছিলেন। তখনকার উত্তরাধিকার আইনে রেখে যাওয়া সম্পত্তি ভাইগণ পেতো। ভাই না থাকলে চাচারা পেতো। এমনও হয়েছে, কোনো সাহাবী বলেছেন, তিনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন অথচ কনে-পণ বা দেনমোহর হিসাবে দেয়ার মতো কিছু নাই। তখন ওই সাহাবি যতটুকু কোরআন মুখস্ত পারতেন তা দেনমোহর হিসাবে ধরে রাসুলূল্লাহ (স.) তার বিয়ে ‘পড়িয়ে’ দেন। ফিকাহর মতে, কোনো বিয়েতে মোহরের পরিমান সাব্যস্ত করা না হলে সংশ্লিষ্ট কনের সামাজিক অবস্থা অনুসারে একটা গড়পরতা মোহর ধার্যকৃত হবে। এর মানে মোহরের বিষয়টা ফয়সালা হওয়ার আগে বিয়ে বৈধ হবে না বা বিয়ে ‘কার্যকর করা’ যাবে না, ব্যাপারটা তা নয়।

এ পর্যায়ে কেউ বলতে পারে, যে নারীর পর্যাপ্ত আর্থিক নিরাপত্তা আছে সে কেন মোহর নিবে? আমার মতে এমন নারীকেও মোহর দিতে হবে। হতে পারে সে নামমাত্র মূল্যের কিছু নিবে। ফুলের একটা মালা নিয়েও সে বিয়ে করতে পারে। এমন কি যেমনটা উপরে বলা হলো, কোনো জরুরী শিক্ষা বা জ্ঞানলাভকেও সে পণ হিসাবে গ্রহণ করতে পারে। কী নিবে বা কী দিবে, সেটা পরস্পরের সামর্থ্যের ব্যাপার। আদৌ কোনো বিনিময় সে নিবে কেন, সেটা প্রশ্ন হতে পারে।

পর্বটির ফেসবুক লিংক

*****

কর্মবিভাজনমূলক ব্যবস্থাপনা কি বৈষম্যর নামান্তর?

আমরা দেখলাম, মোহর গ্রহণ করাটা স্বচ্ছল পাত্রীর ক্ষেত্রে নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা প্রতীকিও হতে পারে। এই প্রতীকি দেয়া-নেয়াটা পারিবারিক ব্যবস্থার গভীরতর তাৎপর্যকে তুলে ধরে বা সিম্বলাইজ করে। তা হলো, পরিবার ব্যবস্থাপনা ও সকল ধরনের নিরাপত্তা তথা রসদ সংগ্রহের দায়িত্ব পুরুষ-পক্ষের। ইসলাম পরিবার ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের কর্মবিভাজন করে। নারীরা অভ্যন্তরীণ কাজগুলো আঞ্জাম দিবে। পুরুষ বাইরের কাজগুলো করবে। এরমানে এই নয়, নারীরা বাহিরের কাজ করতে পারবে না কিংবা পুরুষ ঘরের কোনো কাজ করবে না। যে কোনো সামাজিক ব্যবস্থা ও আইনের প্রচলন করা হয় সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে। যে কোনো মতাদর্শ ও সামাজিক ব্যবস্থাপনার জন্যই এটি প্রযোজ্য। কর্মবিভাজনের ক্ষেত্র ও সীমারেখা কী হবে তা নিয়ে অন্যত্র বিতর্ক হতে পারে। কেউ যদি নারী-পুরুষের কর্মবিভাজনকে আক্ষরিকভাবে ও কঠোর মনোভাব নিয়ে বেমালুম অস্বীকার করতে চায়, সেটি তার ব্যাপার। আমি নিশ্চিত, যুক্তি, পরিচিত উদাহরণ ও এ সংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে মূল্যায়ন করলে কারো পক্ষে এমন প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ অসম্ভব।

তো, প্রাকৃতিক কর্মবিভাজনকে যদি মেনে নেন, তাহলে কথা হতে পারে, এর ক্ষেত্র ও সীমারেখা নিয়ে। সে আলোচনা এই নিবন্ধের আওতাভূক্ত নয়। কর্মবিভাজন মানেই যদি হয় ‘বৈষম্য’ তাহলে মাতৃত্বের ‘বোঝা’ চাপিয়ে ‘প্রকৃতি’ই নারীর ওপর সবচেয়ে বড় ‘জুলুম’ করেছে। পার্থক্য মানেই যদি হয় বৈষম্য তাহলে…, অনেক কথাই বলা যায়। ভদ্রতার খাতিরে ওসব আর বলছি না। ওসব ‘অস্বস্তিকর’ উদাহরণ এখন থাক।

দেনমোহরের প্রতিকী গুরুত্ব

দেখেন, কোনো সেনাপতি যখন তার পিস্তলটা সারেন্ডার করেন, তার মানে সে আত্মসমর্পণ করেছে বুঝায়। কোনো অতিথিকে যখন মেয়র বা নগরপিতা তার শহরের ‘চাবি’ উপহার দেয়, তার মানে অতিথিকে সম্মান করা হলো। কখনো কখনো এ ধরনের প্রতিকী কাজের তাৎপর্য সুগভীর। দেনমোহর দেয়া-নেয়ার বিষয়টাকে সেই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। নির্ভরশীলদের জন্য এটি অর্থনৈতিক অবলম্বন। অনির্ভরশীলদের জন্য এটি অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তার নিদর্শন।

হ্যাঁ, উপার্জনের দায়িত্ব যে পুরুষের ওপর ন্যস্ত তার প্রতীকি নমুনা হলো দেনমোহর। এ পর্যায়ে কেউ বলতেই পারে, কোনো নারীর পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা থাকলে সে কেন নিবে? হ্যাঁ, সে টাকা পয়সা না নিয়ে অন্য কিছু নিবে। হতে পারে তা নামমাত্র। হতে পারে প্রাপ্ত দেনমোহরের টাকা বা সম্পদ অভাবীদেরকে সে দান করে দিবে।

এরপরও কোনো নারীবাদের ওপর পাক্কা ‘ঈমানদার’ কেউ বলতে পারে, “নিবে কেন? বা, নিতেই হবে কেন? সমানে সমান সম্পর্কে তো বাধ্যতামূলক দেয়া-নেয়া থাকা উচিত না।” আবারো সেই পুরনো কথা। কী মুশকিল! সম্পর্ক তো সমানে সমান। বৈবাহিক চুক্তি বা সমঝোতা, অবশ্যই সম ও সুষম। ‘সমস্যা’ হলো এর মাধ্যমে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষের মধ্যকার নিতান্তই অস্থায়ী সমতা ও সুষমতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমতা ও সুষমতার হিসাব, একটু ভিন্ন রকম নয় কি? পরিবারকে প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য না করলে পরিবার ব্যবস্থা কার্যত লিভ টুগেদার হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ে নিছকই ল’ফুল লিভ টুগেদার নয়। যদিও বিয়ে হলো এক ধরনের লিগ্যাল লিভ টুগেদার। এক্টচুয়েলি, ইট ইজ মোর দ্যান লিভ টুগেদার। ইট ইজ মোর ফর্মাল। মোর ইনস্টিটিউশনাল। পুরো আলোচনাটা এখন এসে দাঁড়ালো, পরিবার ব্যবস্থাকে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসাবে গণ্য করা হবে কি-না, তার ওপর।

সম্পর্কের দায় কেন একপক্ষ বহন করবে?

পরিবারভিত্তিক বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামাজিক অবগতি ও পারষ্পরিক দায়-দায়িত্বটাকে বেশি ফোকাস করা হয়। যদি কেউ মনে করে, প্রত্যেকে ফূর্তির জন্য যা খুশী করবে, কিন্তু দায় বহন করবে না, তাহলে বিয়ের চেয়ে লিভ টুগেদারই ভালো। দেখুন, দায়-দায়িত্বহীন লিভ টুগেদার ব্যবস্থা নারীর গঠনগত দিক থেকে দেখলে, প্রকৃতি বিরোধী। যে যার মতো করে ‘কাজ সারবে’ অথচ দায় বহন করতে হবে কেবল এক পক্ষকে, এ আবার কোন বিচার? অথচ, ‘প্রকৃতি’ই কিন্তু সম্পর্কের বস্তুগত ‘দায়’ নারীর উপর চাপিয়েছে। পুরুষের দায় নৈতিক বা সামাজিক। নারীর মতো প্রাকৃতিক নয়। এ ধরনের ‘বৈষম্যের’ জন্য ‘প্রকৃতি’কে যদি ‘দোষ’ দেন, সে ক্ষেত্রে আপনাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনার কৃতিত্বটা কাকে দিবেন, সেটিও ভাইবা রাইখেন।

কোনো নারী, বা বিশেষ শ্রেণীর বা জনগোষ্ঠীর নারী সম্প্রদায় যদি সম্পর্কের সম্ভাব্য ‘দায়’ বহনের সক্ষমতা রাখে, তারমানে কি এই যে, নারীরা সামগ্রিকভাবে (overall) ব্যক্তিগত সম্পর্কের দায় বহনে সক্ষম? ওই যে, বলা কথা আবারো বলতে হয়, আইন করা হয় সাধারণ অবস্থার প্রেক্ষিতে। ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রমই। আমরা যদি প্রাণী জগতের দিকে তাকাই, তাহলে নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের তাবৎ কুতর্ক নিমিষেই অচল হয়ে পড়ে। প্রকৃতির সাধারণ বৈশিষ্ট্য বা প্রাণীরা সাধারণত কী করে, কীভাবে করে ইত্যাদি দেখলেই আমরা সহজে বুঝতে পারি, এ ধরনের বিষয়ে প্রাকৃতিক নিয়মটা কী। প্রকৃতিতে কিছু বিরল উদাহরণও থাকে। বিরল উদাহরণ বা ব্যতিক্রম দিয়ে নিয়ম হয় না, আমরা জানি। প্রকৃতিতে বিরাজমান ব্যতিক্রমী বা অপ্রচলিত-বিরল দৃষ্টান্তকে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ হিসাবে উপস্থাপন করাটাকে অ-আকারগত যুক্তিবিদ্যায় naturalistic fallacy’র একটা ধরন হিসাবে বিবেচনা কার হয়। উগ্র নারীবাদী কথাবার্তা, দেখবেন, নানা ধরনের ফ্যালাসিতে ভরপুর। উদ্ভট ও স্ববিরোধী তাদের সব যুক্তি। যেসব পুরুষেরা উগ্র নারীবাদকে সমর্থন করে তারা আসলে ‘নারীবাদী-পুরুষতান্ত্রিকতার’ অনুসারী। বুঝতেই পারছেন, পুরুষতন্ত্রের একটা নারীবাদী ধারাও আছে।

পাশ্চাত্যের নারীবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা

বলাবাহুল্য, পাশ্চাত্য নারীবাদ প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক। সেখানকার নারীবাদীরা কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো প্রত্যক্ষভাবে পুরুষতন্ত্রকেই ক্ষমতায়ন তথা ক্ষমতাচর্চার মডেল মনে করে। পুরুষতন্ত্র যদি সঠিক না হয়, নারীতন্ত্র কেন সঠিক হবে? প্রান্তিকতা যদি ভুল হয়, তা উভয় প্রান্তিকতার জন্যই তো সমভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। আবার, নারীতন্ত্রও যদি সঠিক না হয়, পুরুষতন্ত্রও যদি সঠিক না হয়, তাহলে কীভাবে চলবে?

মানবতন্ত্রের কথা বলবেন? ভালো কথা। এই মানবতন্ত্র কে পরিচালনা করবে? আসমানের ফেরেশতারা? কেননা, পরিচালনার ভার নারীর হাতে অর্পণ করলে একই সমস্যাই হবে। নাকি, পরিচালনার ভার নির্দিষ্ট মেয়াদে ভাগাভাগি করা হবে? উর্বর কল্পনা দিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা, অবাস্তব ও খণ্ডিত যুক্তিনির্ভর তত্ত্ব কপচানো, এসব চলতে পারে। তাতে করে সমস্যার কোনো ইতিবাচক সমাধান বের হয়ে আসবে না।  সব বিষয়ে পুরুষদের একক কর্তৃত্ব, নতুবা নারীদের একক কর্তৃত্ব – এই ধরনের চিন্তা false dilemma বা black & white fallacy’র লক্ষণ।

কর্তৃত্ব, অধীনতা ও অমর্যাদা প্রশ্নে নারীবাদী অবস্থান

বরং এ বিষয়ে সঠিক অবস্থান হলো, কিছু বিষয়ে নারীর কর্তৃত্ব, কিছু বিষয়ে পুরুষের কর্তৃত্ব, বাদবাকী বিষয়ে প্রেক্ষিত ও সক্ষমতার নিরিখে নারী-পুরুষ যে কোনো কারো কর্তৃত্ব। অবশ্য যারা কোনো কর্তৃত্বই মানতে নারাজ, তাদের কথা ভিন্ন। নারীবাদীরা পরিবারের বাইরে অফিস-আদালত সবখানেই অধীনতা মানে। কিন্তু পরিবারে তারা অধীনতা মানতে চান না। তারা অযথাই মনে করে, কারো কর্তৃত্ব বা পরিচালনা-ব্যবস্থা মেনে নেয়া মানে তার ইনফেরিয়র অর্থে অধীনস্ত হওয়া। আর অধীনতা মানেই অমর্যাদা। এটি তাদের মানসিক সমস্যা। উপরে ড্রাইভারের উদারহরণ দিয়ে এ বিষয়টা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করেছি। অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে গ্যারান্টি দিতে পারি, নারীবাদীদের সাথে আপনি শান্তভাবে কথা বলতে পারবেন না। দ্রুতই সে আপনার প্রতি ব্যক্তি-আক্রমণ ছুঁড়বে। নিজের ব্যক্তিগত বা পরিচিত কারো বিশেষ বিশেষ নেতিবাচক অভিজ্ঞতার একপাক্ষিক বর্ণনাকে ওভারঅল এক্সপেরিয়েন্স বা দলীল হিসাবে মেনে জন্য আপনাকে বাধ্য করতে চাইবে। বলবে, “দেখেন, নিরপেক্ষ বলে কিছু নাই। সবই পুরুষ-পক্ষপাতদুষ্টতার (androcentrism) দোষে দুষ্ট।”

যদি জানতে চান, “এর সমাধান কী? কী করা যায়? আপনার পরামর্শ কী?” দেখবেন, একটু আগের অতিবিপ্লবী আপসে কেটে পড়তে চাইবে। বলবে, “আমাদেরকে সমঝোতা করে চলতে হবে”। এ ধরনের কথাবার্তা।

নেতৃত্ব, পরামর্শ ও আনুগত্যের প্রতিসমতা (counter-balance between leadership, suggestion and obedience)

তো, সমঝোতার মানে সব কাজে সমানে সমান নয়। বরং কিছু কাজ ছেড়ে দেয়া এবং কিছু দায়িত্ব গ্রহণ করা। যখন কেউ কোনো বিষয়ে দায়িত্বগ্রহণ করবে, তখন সে উক্ত কাজে নেতা হবে। নেতৃত্ব, পরামর্শ ও আনুগত্যের এই প্রতিসমতা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের মতো আমাদের পারিবারিক তথা একান্ত ব্যক্তিজীবনেও অপরিহার্য। এটি নারীবাদীদের কে বুঝাবে? তারা তো দিনরাত নানাবিধ ‘বিদ্রোহ’ নিয়েই ব্যস্ত। রাষ্ট্র, সমাজ, সংসার, পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, ঈশ্বর, এক কথায় সব কিছুর বিরুদ্ধে দ্রোহ করতে করতে এক পর্যায়ে তারা স্বীয় নারীত্বের প্রতিই বিদ্বেষী ও বিদ্রোহ-মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে। পুরুষেরা যা করে সে যথাসম্ভব তা-ই করার চেষ্টা করে। এভাবে সে নিজেকে অজান্তেই পুরুষতন্ত্রের কাছে আরো ভোগ্য করে তোলে। অথচ, মনে মনে ভাবে, আমি তো এখন মুক্ত, স্বাধীন।

সমস্যার আসল কারণ ও সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে অস্পষ্টতা নিয়ে মাঠে নামলে যে পরিণতি অনিবার্য

এ সময়কার এক পপুলার নারীবাদীর সাম্প্রতিক একটা লেখায় পড়লাম, সে বলছে, হ্যাঁ, পুরুষতন্ত্র নিজের লাভ বিচার কইরা নারীদের সুবিধা দেওয়ার কারণে অনেকাংশে নারী আন্দোলন হইতে পারছে, নারীবাদের শুরু হইছে, তা অস্বীকার করার উপায় নাই। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, আজকের দিনে আমি পুরুষতন্ত্রের খাইয়া পইরা যদি পুরুষতন্ত্রের উচ্ছেদ চাই, তা কি আসলে পুরুষতন্ত্রের নিজের চাল? অর্থাৎ সময়ের হিসাবে পুরুষতন্ত্রের কি এখন আসলেই সময় ফুরাইয়া গেছে তাই সে নিজ থিকা আমাদের মত নারীবাদীদের উস্কায়ে দিতেছে পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করতে? আমি জানি না।

আমি শুধু জানি, পুরুষতন্ত্রের নিজের চাল হোক বা আমার স্বতন্ত্র ইচ্ছায় হোক, আমি পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা করলে তা যদি নারী পুরুষ ট্রান্সজেন্ডারের সমান অধিকার আদায়ের পথ সুগম কইরা দেয়, তাইলে আমি পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে বইসাই তার বিরোধিতা করবো।

পুরুষতন্ত্রই যদি পুরুষতন্ত্রের ভিতরে থেকে পুরুষতন্ত্রের বিরোধিতা কইরা ‘সমান অধিকার’ আদায়ের পথ সুগম কইরা দেয়, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের পুরুষতান্ত্রিক-নারীবাদ কি পুরুষতন্ত্রেরই আরেকটা খেলা নয়? কার্ল মার্ক্স যেমন ধারণা করতে পারেন নাই, পুঁজিবাদ বিংশ শতাব্দীতে এসে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটিয়ে সর্বহারা তৈরীর পথ রুদ্ধ করে দিবে, তেমন করে নারীবাদীরাও হয়তো বুঝতে পারেন নাই, পুরুষতন্ত্রই নারীবাদকে পুরুষতন্ত্রের অন্যতম বিশেষ একটা ফর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে নারীবাদ নিয়ে এমন করে খেলবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রাচ্য পুরুষতন্ত্র ও পাশ্চাত্য নারীবাদ, উভয়েরই সমভাবে ঘোর বিরোধী। এরই সাথে আমি এতদুভয়ের কারণে নারীদের মধ্যে সৃষ্ট সুবিধাবাদী মনোভাবেরও তীব্র বিরোধী। আমি নারী-পুরুষ সকলের ন্যায্য মানবিক অধিকারে বিশ্বাসী। তাই, সমতার সাথে সাথে ক্ষেত্রবিশেষে আমি সুষমতাকেও মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করি। তাছাড়া, এটি সার্বিক আলোচনা। এক একটা ইস্যু নিয়ে আলাদাভাবে কথা বললে তখন এই নীতির প্রয়োগ কোথায়, কীভাবে কী হতে পারে, তা নিয়ে এক্সক্লুসিভ আলোচনা করা যেতো।

পর্বটির ফেসবুক লিংক

Similar Posts

One Comment

  1. আসসালামু আলাইকুম….. বারাকাতুহ
    একটানেই পড়লাম, শেয়ারও করলাম!
    জাযাকাল্লাহ….

    সাধারণ পাঠকের জন্য ইংরেজি শব্দগুলো বুঝার অসুবিধা বা অক্ষমতার আশঙ্কা দূর করতে (বন্ধনীর ভিতরে) বাংলা শব্দ জুড়ে দিলে ভালো হয়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *