যাকাত হলো ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদের একটি। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ দান করতে হয়। নির্দিষ্ট কিছু খাতে এই অর্থ ব্যয় করতে হয়। দারিদ্র্য বিমোচন হলো এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য।

আমাদের দেশে সুষ্ঠু যাকাত ব্যবস্থাপনার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে এর মূল আঙ্গিকের বিচ্যুতি। যাকাতের মূল কাঠামো ত্রিপাক্ষিক: (১) দাতা, (২) আদায় ও বিতরণকারী বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং (৩) গ্রহীতা। যাকাত আদায় ও বিতরণকারী কর্তৃপক্ষের দীর্ঘকালীন অনুপস্থিতির কারণে আমরা যে যার মতো করে যাকাত দিচ্ছি। আমরা ধরেই নিচ্ছি, যাকাত হলো নিছকই দাতা ও গ্রহীতার ব্যাপার। এতে করে দরিদ্রদের কিছুটা উপকার হলেও এই ব্যবস্থার যে মূল উদ্দেশ্য তথা দারিদ্র্য বিমোচন, তা খুব একটা অর্জিত হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, যারা এক দশক আগেও যাকাত নিতো তারা এখনো যাকাত নিচ্ছে।

যাকাত উসূল করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রকে যাকাত দিতে অস্বীকার করাটা সাধারণ ফৌজদারী অপরাধের চেয়েও বড় অপরাধ। ইসলামী শরীয়াহর দৃষ্টিতে এটি রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

আমাদের দেশে যদি উপযুক্ত মানের ইসলামসম্মত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম থাকতো তাহলে সাদাকা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস ও চাল-ডাল বা কিছু নগদ অর্থ দিয়ে যাকাত দেয়া হতো না। বরং, এখনকার সময়ের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা হিসাবে যাকাতের টাকা দিয়ে মিল-কারখানাসহ নানা ধরনের ব্যবসায়িক উদ্যোগ গড়ে তোলা হতো। যাকাতের টাকায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হতো। একেকজন স্টুডেন্টকে যথোপযুক্ত শিক্ষাঋণ সহায়তা প্রদান করা হতো। অবশেষে, দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ শেষে যাকাতের উদ্বৃত্ত অর্থ অন্যান্য দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হতো।

নিচে সংযুক্ত ভিডিও আলোচনায় আমি দেখিয়েছি, দাতাগণ কর্তৃক আদায়কারী প্রতিষ্ঠানে যাকাতের অর্থ-সম্পদের মালিকানা হস্তান্তরের মাধ্যমে বিত্তশালীদের যাকাত দেয়ার ফরজিয়াত আদায় হয়ে যায়। এরপর যাকাত আদায় কর্তৃপক্ষ সার্বিক বিবেচনায় সেই এমাউন্টটি ইমিডিয়েটলি একসাথে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে দীর্ঘমেয়াদে ও কিস্তি হিসাবে তথা নানা ধরনের উপযোগী পন্থায় গ্রহীতাদের কাছে পৌঁছাতে পারে।

যাকাত বিতরণের এই দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বর্তমান সময়ে প্রচলিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রচলিত মাইক্রো-ক্রেডিট সিস্টেমে বিনা পুঁজিতে ঋণ দেয়া হয়। এখানেও তারাই, অর্থাৎ মর্টগেজ দিতে অসমর্থ পুঁজিহীনরাই সাহায্য পাবে। তবে তা ঋণ হিসাবে নয়। বরং ‘দীর্ঘমেয়াদী অনুদান’ হিসাবে। এই সাহায্য তারা পাবে কোনো ইনকাম জেনারেটিং উদ্যোগের পুঁজি হিসাবে।

একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বুঝানো যেতে পারে।

যাকাতের টাকায় ১০ জন দিনমজুরকে একটা করে ১০টা রিকশা কিনে দেয়া হলো। তারা দৈনিক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ‘কর্তৃপক্ষকে’ জমা দেয়। জমাকৃত টাকার একটা অংশ দিয়ে রিকশাগুলোর মেইনটেইনেন্স করা হয়। একটা অংশ ৩ মাস বা ৬ মাস বা বৎসরান্তে উক্ত ১০ জনের নানাবিধ পারিবারিক কাজে সহায়তা হিসাবে দেয়া হয়। জমাকৃত টাকার অবশিষ্ট অংশ জমিয়ে বৎসরান্তে কয়েকটি নতুন রিকশা ক্রয় করে ভাড়া দেয়া হয়।

যাদেরকে ভাড়া দেয়া হবে তারা মালিককে ভাড়া দেয়ার মতো করে যাকাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ হিসাবে যিনি বা যারা কাজ করছে তাদেরকে দৈনিক কিস্তির টাকা দিবে। অর্থাৎ ভাড়া দিবে। তারা এর থেকে আর কিছু পাবে না। নতুন রিকশাগুলোর চালকেরা কোনোভাবেই মালিকানা পাবে না।

এই নতুন ক্রয়কৃত রিকশাগুলোর মালিকানা থাকবে উক্ত ১০ জনের গ্রুপ বা সমিতির কাছে। যদিও কার্যত তা নিয়ন্ত্রণ করবে ‘যাকাত ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক ইয়াতিমের মাল ব্যবস্তাপনার পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকে ইয়াতিমের বৈধ অভিভাবকের হাতে। যদিও ইয়াতিমই থাকে কাগজে-কলমে তথা তাত্ত্বিকভাবে নিঃশর্ত ও নিরবচ্ছিন্ন মালিকানার অধিকারী।

এইভাবে ম্যানেজমেন্ট কন্টিনিউ করতে পারলে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উক্ত ১০ জন রিকশাওয়ালার ‘মালিকানায়’, ধরে নিচ্ছি, ৫০টি রিকশা এসে যাবে। নিয়মিত রিকশা ভাড়া ও মাঝেমধ্যে বিশেষ অনুদান প্রাপ্তির মাধ্যমে ইতোমধ্যে তাদের জীবনমানের ধারাবাহিক উন্নয়ন ঘটবে। যখন তাদের প্রত্যেককে তার নিজেরটাসহ পাঁচটি রিকশার মালিকানা বুঝিয়ে দেয়া হবে, তখন সে অলরেডি ‘কোম্পানি’ হিসাবে সামাজিক পরিচিতি পেয়ে গেছে, সংগত কারণে আমরা তা অনুমান করতে পারি। রিকশাগুলোর লাইসেন্স হাতে পাওয়ার মাধ্যমে সেগুলোর কার্যকর মালিকানা লাভ করার পর সে আর সেগুলো বিক্রি করে পুনরায় দিনমজুর হিসাবে রাস্তায় ফিরে যেতে পারবে না। এক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত পর্যায়ে, বিশেষ করে পারিবারিক জীবনমানের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও পূর্বের তুলনায় বেশ খানিকটা উন্নীত সামাজিক মর্যাদা লাভের বিষয়টি বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং তাকে বর্তমান উন্নততর অবস্থায় সাসটেইন করে রাখবে।

যাকাত ব্যবস্থাপনার এই মডেল বা ফর্মুলাটি, কল-কারখানা বা কৃষি ফার্মের মতো বৃহৎ উদ্যোগেও প্রয়োগযোগ্য।

সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে, এক মালিক তার মজুরের অনাদায়ী মজুরীর অর্থ বিনিয়োগ করে কয়েক বছরের মধ্যে একটা পশুর পাল গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে উক্ত শ্রমিককে মজুরী হিসাবে পুরো পশুর পালটির মালিকানা হস্তান্তর করেন। আল্লাহর কাছে এটি অতীব প্রিয় পুণ্যকাজ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিলো।

একইভাবে, অনুদান ব্যবস্থাপনার অযোগ্য ও দানের ভার বহন করতে অক্ষম যাকাত গ্রহীতাদের প্রাপ্ত মাল-সম্পদকে ইয়াতিমের মাল-সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করা যায়।  তারপর সেগুলোকে প্রপারলি বিনিয়োগ করা ও এক পর্যায়ে যাকাতগ্রহীতাকে সম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো দক্ষ ও উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যায়। এভাবে এক পর্যায়ে পুরো বিনিয়োগটির কার্যকর মালিকানা হস্তান্তর করে দেয়ার মাধ্যমে এক সময়কার যাকাত গ্রহীতাদেরকে সম্ভাব্য স্বল্পতম সময় ও টেকসই পদ্ধতিতে স্বচ্ছল নাগরিক তথা যাকাতদাতায় পরিণত করা সম্ভব।

প্রতিদিন নদীর মধ্যে একটি করে ঢিল না ছুড়ে একসাথে, সমন্বিত ও পরিকল্পিতভাবে সবগুলো পাথরকে নদীর পাড়ে ফেলে সহজেই নদীর ভাংগন প্রতিরোধ করা যায়। একইভাবে প্রতি বছর অনেক মানুষকে অল্প-স্বল্প সাহায্য করার প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে কয়েকজন ধনী ব্যক্তির যাকাতকে একসাথে করে একটা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কিছু বিত্তহীন অথচ উদ্যমী মানুষকে টেকসই পদ্ধতিতে সাহায্য করাই হলো ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার অধিকতর কাম্য পদ্ধতি।

এ বিষয়ে এই অনানুষ্ঠানিক আলোচনাটি ইউটিউবে পাবেন ‘সামাজিক আন্দোলন’ চ্যানেলে–

ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Khondoker Zakaria Ahmed: নতুন ধারণা মনে হয়েছে। আরো আলোচনা করতে হবে। বাস্তবায়নে অনেক জটিলতা আছে। প্রতিষ্ঠিত ধারণা থেকে বের হতে আরো অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনাকে ট্যাগ করবো বলে ভাবছিলাম। মাশাআল্লাহ আপনি পড়েছেন। সময় করে যদি ভিডিওটা দেখেন তাহলে ভালো হয়। সবচেয়ে ভালো হয় এ নিয়ে যদি আপনার সাথে আলাপ আলোচনা করা যায়।

Anamul Haque Humaid: যাকাত এখানে যাকাত হিসেবে থাকতেছে কিনা? অনেকটা ওয়াকফের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে মাইক্রোক্রেডিটের সিস্টেমটা হুবহু নিয়ে আসার কারণে। যাকাত দেওয়ার পর যাকাতদাতা বা অথিরিটির কাছে যাকাতগ্রহীতা দায়বদ্ধ থাকে না। কারণ, আল্লাহর হুকুম হিসেবে সেটা ফরজ দান হিসেবে চলে যায়।

যাকাত অবশ্যই সাসটেইনেবল ওয়েতেই হওয়া উচিত, এক্ষেত্রে দ্বিমত নাই কোনোই। এক্ষেত্রে আপনার সিস্টেমটা যাকাত পাওনাদারদের জন্য কেবল সুপরামর্শ হিসেবে আসতে পারে।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ওয়াকফ করা জিনিসের কোনো ব্যক্তি মালিকানা থাকে না। কিন্তু এখানে মালিকানার বিষয়টি সুস্পষ্ট। যাকাত থেকে যারা উপকৃত হবে তারাই মালিক। কিন্তু সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য যে যোগ্যতা থাকা দরকার সেটাতে তাদের ঘাটতি থাকার কারণে মালিকানার পাশাপাশি (তাদের ন্যূনতম সক্ষমতা অর্জন করার আগ পর্যন্ত) একটা মধ্যস্থতাকারী ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সংযুক্ত করে দেয়ার বিষয়টি হলো এই পদ্ধতির মূল কথা।

Anamul Haque Humaid: বুঝতে পারছি স্যার।

পোস্টটির ফেসবুক লিংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *