জীবন থেকে নেয়া একটা কথা দিয়ে শুরু করি। মানুষ শাস্তির ভাষা যতটা বোঝে, যুক্তির ভাষা ততটা বুঝে না। এর বিপরীত কথা হচ্ছে, মানুষ যা কিছু করে তার প্রত্যেকটি কোনো না কোনো যুক্তির কারণেই করে।

এই দুটো বাক্যের মধ্যে যুক্তি কথাটা দুইটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রথম বাক্যে যুক্তি বলতে বোঝানো হয়েছে সীমিত স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক বিবেচনায় কোনো কিছু করা বা করার কথা বলা।

দ্বিতীয় বাক্যে যুক্তি শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে স্পেসিফিকেলি ওয়ান-টু-ওয়ান ক্ষুদ্র স্বার্থ বা নিছক ব্যক্তি স্বার্থকেন্দ্রিক বিবেচনায় কোনো কিছু করা বা করার কথা বলা, এই অর্থে।

যুক্তিকে যদি আমরা ভালো যুক্তি এবং খারাপ যুক্তি এভাবে করে ভাগ করি, তাহলে প্রথম ধরনের যুক্তি, অর্থাৎ কোনো বিষয়কে হলিস্টিকালি বা সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে ভালো যুক্তি।

এর বিপরীতে, কোনো বিষয়কে সার্বিকভাবে বিবেচনা না করে সাময়িক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো একটা দিক থেকে কোনো কিছুকে বিবেচনা করা হচ্ছে খারাপ যুক্তি।

যুক্তি হচ্ছে কারণ। কারণ হতে পারে সঠিক কিংবা ভুল। কীভাবে আমরা সঠিক কিংবা ভুল নির্ণয় করছি, সেটি হচ্ছে আসল কথা। ক্রিটিকাল থিংকিং এর মূল কথা।

ক্রিটিকাল থিংকিং বা বিচারমূলক চিন্তন, যুক্তিকে দেখে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি হতে। বিচারমূলক চিন্তন হচ্ছে ভালত্ব বা goodnessকে অর্জন করার একমাত্র উপায়। এর বিপরীতে আছে বিচারবিযুক্ত চিন্তন তথা অন্ধবিশ্বাস।

ভালো বা good জিনিসটা কী, সেটা নিয়ে মেটা-এথিক্স বা পরানীতিবিদ্যায় অনেক আলোচনা আছে। সেগুলোকে সামনে রেখে ভাল’র একটা যুঁতসই সংজ্ঞা আমি ঠিক করেছি। সেটা হলো,

good is that thing which is holistically consistent, no matter if it is particularly important or not.

এই অর্থে ক্রিটিকাল থিঙ্কিং হচ্ছে সৎচিন্তা।

কোনো কিছুকে সামগ্রিকভাবে দেখার উপায়-

প্রত্যেক কিছুর কিছু বেসিক আস্পেক্ট থাকে। কোনো কিছুকে আপনি তখনই সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করতে পারবেন যখন সেই বেসিক আস্পেক্টগুলোকে আপনি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবেন। স্মরণে রাখবেন আপনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। বিবেচনায় রাখবেন আপনার আইডেন্টিটি।

জীবন সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও সুসমন্বিত ধারণা না থাকলে সফলতাকে আপনি কখনোই সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না। কোনো ব্যাপারে ব্যর্থতা কিংবা সফলতাকে নির্ণয় করতে গেলে আপনার ওয়ার্ল্ডভিউ সেখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। ওয়ার্ল্ডভিউর সাথে না মিলিয়ে সফলতা কিংবা ব্যর্থতার যে কথাই আপনি বলেন না কেন, তা হবে খন্ডিত। এবং ডগমেটিক।

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে আমাদের মধ্যে যেসব ভুল ধারণা কাজ করে:

১. ক্রিটিকাল থিংকিং মানে জটিল চিন্তা।
২. সাধারণ মানুষদের জন্য ক্রিটিকাল থিংকিং প্রযোজ্য নয়।
৩. ক্রিটিকাল থিংকিং মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে উপরে উল্লেখিত বিভ্রান্তিসমূহ তৈরি হওয়ার কারণ:

প্রেজেন্টেশান প্রবলেম:

১. ক্রিটিকাল থিংকিং এর কথা যারা বলে তারা সাধারণত বিষয়টাকে সহজ করে উপস্থাপন করতে পারে না। এটি তাদের ব্যর্থতা। এর কারণ হলো, আপাতদৃষ্টিতে তারা ক্রিটিকাল থিংকিং এর এক্সপার্ট হলেও নিজেরা ক্রিটিক্যালি থিঙ্কিং এ অভ্যস্ত নন।

বিষয়টা যাই হোক না কেন, একজন সাধারণ কান্ডজ্ঞানসম্পন্ন জানতে আগ্রহী ব্যক্তিকে যদি সে বিষয়টার মূল কথাটুকু সংক্ষেপে বোঝানো না যায়, তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট এক্সপার্ট আসলে নিজেই বিষয়টা সম্বন্ধে ভালো করে ক্লিয়ার না।

এখানেও প্যারিটো প্রিন্সিপাল প্রযোজ্য।

বিষয় সম্পর্কিত তথ্যমূলক জ্ঞান থাকা বনাম বিষয় সম্পর্কে জানার পার্থক্য-

কোনো বিষয় যদি আমরা সত্যিই নিজেরা বুঝে থাকি এবং সেই বিষয়ে কথা বলার জন্য যদি আমরা একজন বিশেষজ্ঞ বা পাবলিক স্পিকার হয়ে থাকি, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অন্তত এইটি পারসেন্ট আমরা যে কাউকে ম্যাক্সিমাম টোয়েন্টি পার্সেন্ট এফোর্ট দিয়ে বুঝাইতে পারার কথা। অন্যথায় বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের এক্সপার্টাইজ(?) এর মধ্যে নিম্নে উল্লেখিত সমস্যাটি আছে-

যারা মনে করে যে তারা বোঝে অথবা যাদের সম্বন্ধে আমরা মনে করি যে তারা বোঝেন, অথচ তারা অন্যদেরকে বিষয়টির মূল কথাটুকু সংক্ষেপে বুঝাইতে পারেন না, তারা ‘বিষয়টা সম্পর্কে জান’লেও ‘বিষয়টা জানেন না’। অর্থাৎ, they know about the subject, not the subject।

এর উদাহরণ হলো এমন ব্যক্তি যিনি সাহিত্যের অনেক ইতিহাস বলতে পারেন, সাহিত্য সম্বন্ধে অনেক তথ্য বলতে পারেন, কিন্তু তিনি নিজে সাহিত্যিক নন। এমনকি, তিনি সাহিত্য ভালো করে বুঝেন না। লিটরেচারের ফ্লেভার তার মধ্যে নাই।

একই রকমভাবে কেউ ফিলসফির অনেক তথ্য সম্পর্কে জানতে পারেন, অনেক দার্শনিক তত্ত্ব সম্পর্কে অনেক তথ্য দিতে পারেন, কিন্তু হতে পারে, তিনি সামগ্রিকভাবে ফিলসফির মূল সেন্সটাই ধরতে পারেন নাই। যেমনটি দেখা যায় বাংলাদেশে বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা ফিলসফি পড়ান, তাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রে।

যেমন করে, রাজনৈতিক তত্ত্বের খুঁটিনাটি জানা, রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারা বনাম রাজনীতি বোঝার যে পার্থক্য।

টেক্সটচুয়াল জটিলতা-

ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং সম্পর্কে এমনকি শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও এক ধরনের ভীতি এবং ভুল ধারণা থাকার দ্বিতীয় কারণটি হলো, ক্রিটিকাল থিংকিং এর ওপর লেখা বইপত্র।

ক্রিটিকাল থিংকিং সংক্রান্ত বইপত্রগুলোতে গাইড বইয়ের মত এত বেশি পয়েন্টস তুলে ধরা হয়, যা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার পরিবর্তে বিভ্রান্ত করে। ক্রিটিকাল থিংকিং কোর্স করার পরে লোকজন নিজেদের জীবনে বাস্তবে ক্রিটিকাল থিংকিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে না। তার পরিবর্তে তারা ক্রিটিকাল থিংকিং এর ওপরে বলতে পারার ব্যাপারে দক্ষ হয়ে উঠে। গাড়ি চালাতে না পারলেও গাড়ি চালানোর ওপর চমৎকার পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশান দিতে পারা ব্যক্তির মতো।

অভিজ্ঞতায় এটি আমি দেখেছি।

কথার কথা, আপনি কিভাবে সিদ্ধান্ত নিবেন এ বিষয়ে বলতে গিয়ে ক্রিটিকাল থিংকিং এর এক্সপার্টরা ১৪টা পয়েন্টের কথা বললেন। এখন আমরা আমাদের জীবনে যত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি সেখানে বিবেচ্য পয়েন্টগুলোর তালিকা করে এক একটা পয়েন্ট বিবেচনা করতে করতে সব কটি পয়েন্ট এগজস্ট করে অবশেষে আমরা সিদ্ধান্ত নিব, এমন প্রসেসে তো আমরা যাই না।

কমনসেন্স শার্প না হলে দিস সো-কল্ড ক্রিটিকাল থিংকিং দিয়ে কোনো লাভ হবে না।

আমরা আমাদের কান্ডজ্ঞান ব্যবহার করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করি। আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনায় যখন আমরা বিবেচনাযোগ্য সব বিষয়কে সব সময়ে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করার অভ্যাস গড়ে তুলি তখন আমাদের কান্ডজ্ঞানের মধ্যে সেসব (রেশনাল) এলিমেন্ট সাবকনসাস লেভেল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহেণ ভূমিকা রাখে।

তাই ক্রিটিকাল থিংকিং ডিভেলপ করার জন্য কাজের কাজ হচ্ছে স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা জারী রাখা।

এই যে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার কথা বললাম, এইটা নিয়েও আশপাশের লোকদের মধ্যে দেখি অনেক ভুল ধারণা।

বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা সম্পর্কে ভুল ধারণা-

বুদ্ধিবৃদ্ধি চর্চা বলতে লোকেরা মনে করে অনেক ইতিহাস জানা এবং অনেক তথ্য বলতে পারা। কোনো বিষয়কে জানার প্রধানত দু’টি পদ্ধতি:

(১) সংশ্লিষ্ট বিষয়টার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ওপর অধ্যয়ন করার মাধ্যমে সেইটা সম্পর্কে জানা। একে বলা হয় হিস্ট্রিকাল এপ্রোচ

(২) বিষয়টা কী, সেইটা নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে শুরু করা। এ’ক্ষেত্রে হতে পারে আগের ঘটনার কথা পরে আসছে। আবার পরের ঘটনার কথা আগে আসছে। অনেক ঘটনার কথা আসেই নাই। হিস্ট্রির পরিবর্তে থিম নিয়ে কাজ করা। এইটাকে বলা হয় থিমেটিক এপ্রোচ

প্রসঙ্গত উল্লেখ্যে, কোরআনের এপ্রোচ মোটেরওপরে থিমেটিক এপ্রোচ। আমার সাবজেক্টের উদাহরণ দিলে, দর্শনের ইতিহাস দিয়ে শুরু করা হলো ঐতিহাসিক পদ্ধতি। দর্শনের সমস্যাবলী দিয়ে শুরু করা হলো বিষয়নির্ভর পদ্ধতি (thematic approach)।

তো, বুদ্ধিবৃদ্ধি চর্চার যে হিস্ট্রিক্যাল অ্যাপ্রোচ, এটাকেই লোকেরা বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার একমাত্র পন্থা বলে মনে করে।

Knowing about something এরসাথে knowing that thing এর পার্থক্য নিয়ে উপরে যা বলেছি সেটা যদি খেয়াল করেন তাহলে বুঝবেন, চিন্তার ধারাবাহিকতা তথা হিস্ট্রিক্যাল অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস জানা গেলেও জীবনে বাস্তবে কাজে লাগে এমন বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার জন্য হিস্ট্রিকাল এপ্রোচের পাশাপাশি থিমেটিক অ্যাপ্রোচে কোনো বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা জারী থাকা জরুরী।

ঐতিহাসিক ধারাবর্ণনা পড়তে পড়তে মানুষ ইতিহাসের ঘুরপাকের মধ্যে পড়ে যায়, এবং শেষ পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট করণীয় খুঁজে পায় না। ওর কথা, এর কথা, নানাজনের নানা কথার নাগরদোলায় সে অন্তহীন দুলতে থাকে। কোনো কথা শেষ পর্যন্ত নিজের কথা হয়ে উঠে না। অথবা তার নিজের বলে কোনো কথা শেষ পর্যন্ত থাকে না। এটি খুবই বিপদজনক। প্রতিটা মানুষের এজেন্সী বা ইগো থাকা দরকার। এই এজেন্সীর নির্মাণে ক্রিটিকাল থিংকিং দরকারী জিনিস।

আমাদের দেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মূলধারা হিস্ট্রিকাল এপ্রোচের। সেকুলার এবং ইসলামিক উভয় ধারার জন্য এটি প্রযোজ্য। অথচ, এতক্ষণের আলোচনাতে আমরা বুঝতে পারছি, নানা জনের নানা ধরনের চিন্তার কাহিনী সবিস্তারে বলতে পারা, আর অন্যদের কথাবার্তাগুলোকে মোটামুটি জেনে নিয়ে নিজের চিন্তা নিজে স্বাধীনভাবে করতে সক্ষম হওয়া, এবং এভাবে সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার জন্য সচেষ্ট হওয়া, এই দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

জ্ঞান হলো সাবজেক্টিভিটি ও অবজেক্টিভিটির সমন্বয়-

জ্ঞানতত্ত্বের দৃষ্টিতে যা নিজের সাবজেক্টিভিটি বা বিশ্বাস থেকে আসেনি বা বিশ্বাসের ভিতর দিয়া যা প্রবাহিত হয়নি, তা আদৌ জ্ঞান নয়। এমনকি তা যদি সঠিকও হয়ে থাকে। বিচারবিযুক্ত সত্যের দাবীকে বলা হয় lucky guess।

জ্ঞানের বিষয় যাই হোক না কেন, কোনো কিছু জ্ঞান হতে হলে সেটার মধ্যে সাবজেক্টিভিটি এবং অবজেক্টিভিটি দু’টাই লাগে। এই দৃষ্টিতে, জ্ঞান হচ্ছে একটা নরমেটিভ ফেনোমেনা।

যা সার্বিক তা নিজ গুণেই সার্বিক। ব্যক্তিবিশেষ যখন সার্বিককে সার্বিক হিসেবে গ্রহণ করে তখন তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য সার্বিক হয়ে উঠে। ব্যক্তির দিক থেকে তা ব্যক্তিনিষ্ঠ বা সাবজেক্টিভ। ব্যক্তির বাইরের দিক থেকে তা বস্তুনিষ্ঠ বা অবজেক্টিভ।

দুইয়ে দুইয়ে চার – এইটাকে যখন আমরা যাচাই করে গ্রহণ করে নেই তখন তা আমাদের জন্য সার্বিক সত্য হয়ে উঠে। আমরা গ্রহণ করা ছাড়া সত্যের কোনো মূল্য নাই। হোক সেটা স্বতঃমূল্য (intrinsic value) কিংবা পরতমূল্য (extrinsic value)।

ক্রিটিকাল থিংকিং বনাম স্পিকিং স্কিল-

লোকেরা মনে করে, কোনো বিষয় সম্পর্কে সাবলীলভাবে বলতে পারার যে দক্ষতা, ইংরেজিতে যাকে স্পিকিং স্কিল বলা হয়, এটি থাকা মানে সেই ব্যক্তি একজন উচ্চমানের চিন্তাবিদ।

না, ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। হতে পারে কারো মধ্যে ক্রিটিকালি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে কিন্তু তার ভাষাগত দক্ষতা নাই। সে বুঝতে পারে কিন্তু ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারে না। পাবলিক স্পিকিং স্বয়ং একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও পাবলিক স্পিকিং এবং ক্রিটিকাল থিংকিং এক জিনিস না।

যাদেরকে আমরা সাধারণ মানুষ বলি তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ শিক্ষিত লোকদের মতো কথা বলতে না পারলেও, অনেক সময় দেখা যায়, তারা কোনো একটা বিষয়কে সামগ্রিকভাবে বুঝতে পারে। চট করে মূল কথাটা ধরে ফেলতে পারে।

তারা সঠিকভাবে চিন্তা করতে সক্ষম। ভেতর থেকে একটা কিছু তাদেরকে গাইড করে। শেষ পর্যন্ত তারা সঠিক কাজটাই করে। আসলে তাদের core of knowledge তথা কমনসেন্সের বেইজটা অনেক শক্ত। ন্যাচারাল অর গড গিভেন, ইন আ সেন্স।

সংশয়বাদ নিয়ে ভুল ধারণা-

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সন্দেহবাদিতাকে ক্রিটিকাল থিংকিং মনে করা। অথবা, সন্দেহবাদিতাকে ক্রিটিকাল থিংকিংয়ের লক্ষণ বলে মনে করা। না, সন্দেহবাদিতা ক্রিটিকাল থিংকিং নয়।

কিছু কিছু লোক এমন, সব সময় সব কিছুতেই তারা সন্দেহ করে। তারা সন্দেহবাদী। সন্দেহবাদিতাকে তারা বুদ্ধিজীবীতা বলে মনে করে। আমি একটা লেখা লিখেছি, dorshon.com এ আছে, যার শিরোনাম হলো,

পদ্ধতিমূলক সংশয়বাদ বনাম পরিণতিমূলক সংশয়বাদ

লক্ষ্যহীনভাবে সংশয় করা হলো পরিণতিমূলক সংশয়বাদ। অথচ, সকল ধরনের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার পদ্ধতি হলো পদ্ধতিমূলক সংশয়বাদ। পজিটিভ স্কেপটিসিজম হলো, সংশয় দিয়ে শুরু করে একটা পর্যায়ে এসে প্রাপ্ত সত্যকে গ্রহণ করা। আমাদের মনে রাখতে হবে জাস্টিফিকেশন বা যাচাই করন একটা ক্লোজ এন্ডেড ক্লাস-এর ব্যাপার। অর্থাৎ একটা সীমার মধ্যে যতটুকু সম্ভব যাচাই করা।

সম্পূর্ণ যাচাই বলে কোনো কিছু নাই। ‘সম্পূর্ণ যাচাই’ কথাটা open-ended classকে ইনভলভ করে। কারণ কতটুকু হলে সেটা সম্পূর্ণ হবে সেই ব্যাপারে অবজেক্টিভ কোনো বাউন্ডারি কোন বিষয়ে দেয়া নাই। আমাদের শারীরিক মানসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই আমরা কোনোকিছুকে যথাসম্ভব যাচাই করি। উপস্থাপিত কোনো তথ্যকে উপেক্ষা করি না। আবার, সর্বোতভাবে গরহাজির কোনোকিছুর জন্য আমাদের ফাইন্ডিংসকে স্থগিত করেও রাখি না।

যারা বলে, ‘আমার কোনো কথা নাই। আমি শুধু ক্রিটিক।’ তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট। বিভ্রান্ত। শ্রুড। আবার যারা বলে, ‘আমার কোনো প্রশ্ন নাই। আমি বিনাবিচারে বিশ্বাসী।’ এরাও ফাউল পাবলিক। আত্মপ্রবঞ্চক। শঠ এবং মূঢ়।

ক্রিটিসিজম মানে সমালোচনা নয়-

ক্রিটিসিজম কথাটাকে মানুষ ভুল বোঝে। মনে করে, ক্রিটিসিজম মানেই সমালোচনা।

ক্রিটিসিজম মানে সমালোচনা নয়, বরং সঠিক অনুবাদ হলো পর্যালোচনা। পর্যালোচনা মনে পক্ষ-বিপক্ষ আলোচনা। কোনো বিষয়ের সামগ্রিক যে চিত্র, সেইটাকে দৃশ্যমান করার জন্য মুক্ত আলোচনা।

মুক্তচিন্তা মানেই হচ্ছে সৎচিন্তা। যা ভালো তা অর্জন করার পথে অগ্রসর হওয়া।

নৈরাজ্যবাদ ও শূন্যতাবাদ-

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে আরেকটা মারাত্মক ভুল ধারণা হলো, যে যত নৈরাজ্যবাদী, শূন্যতাবাদী সে তত ক্রিটিকাল থিংকিং করা ব্যক্তি।

এনার্কিজম এবং নিহিলিজম খুব ধ্বংসাত্মক ফিলসফিক্যাল থিওরি। এনার্কিজম বা নৈরাজ্যবাদ অনুসারে কোনো অথরিটি আমাদের যা দেয় তারচেয়ে নেয় অনেক বেশি। ভুলভাল বুঝিয়ে কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে শোষণ করে। এক্সপ্লয়েট করে। কর্তৃপক্ষ বলতে যে কোনো কর্তৃপক্ষ।

এনার্কিজমের কাছাকাছি তত্ত্ব হলো নিহিলিজম। এর বাংলা করা হয় নৈরাজ্যবাদ বা শূন্যতাবাদ হিসেবে। জীবনের চূড়ান্ত অর্থহীনতা এর মূল কথা। আমাদের এখানে মুক্তচিন্তার কথা যারা বলে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তারা হলো দার্শনিক দিক থেকে নৈরাজ্যবাদী। শূন্যতাবাদী।

সত্য অনুসন্ধানের পূর্বধারণা বা প্রিসাপোজিশন হচ্ছে, সত্য বলে কোনো কিছু আউট দেয়ার অবশ্যই আছে। ‘জগতের সত্য বলে কিছু নাই’ এই কথাটা হচ্ছে স্ববিরোধী বা সেলফ রিফিউটিং স্টেইটমেন্ট। পর্যালোচনামূলক চিন্তার লক্ষ্য হলো  সত্যকে খুঁজে বের করা কিংবা যতটুকু সম্ভব তার কাছাকাছি যাওয়া।

সত্য একটা পক্ষ। মিথ্যা এর বিপরীত পক্ষ। দিন শেষে আমাদেরকে এতদুভয়ের কোনো একটাকে বেছে নিতে হয়। বাস্তব জগতে কারো নিরপেক্ষ থাকার সুযোগ নাই।

সত্য ও ন্যায়কে খুঁজে পাওয়ার জন্য বিচারমূলক চিন্তা মানুষকে সহযোগিতা করে। আসুন আমাদের কান্ডজ্ঞানকে কাজে লাগাই। এগিয়ে যাই সত্যের পক্ষে। হই সত্যপক্ষ, যতটা সম্ভব।

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে একটা প্রাকটিকাল ক্লাসের অভিজ্ঞতা-

একবার এক ক্লাসে ক্রিটিকাল থিংকিং প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলাম। স্টুডেন্টদেরকে আমি বললাম,

‘মনে করো, পানীয় জল সরবরাহ প্রসঙ্গে এর বিশুদ্ধতা সম্পর্কে তোমাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বলা হলো। একজন পলিসি এডভাইজার হিসেবে তুমি কি শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য পরামর্শ দিবে? নাকি, সহনীয় মাত্রায় কিছুটা দূষিত পানীয় জল সরবরাহের জন্য বলবে?’

শুরুতে তারা প্রায় সবাই বলল, তারা শতভাগ বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের পরামর্শ দিবে।

আমি বললাম, ‘শতভাগ বিশুদ্ধ পানি যারা পান করতে তারা অভ্যস্ত তারা যদি কখনো ঘটনাক্রমে কিছুটা দূষিত পানি পান করে তাহলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। অপরদিকে যারা কিছুটা দূষিত পানি খেতে অভ্যস্ত, তারা যদি কখনো শতভাগ বিশুদ্ধ পানি পান করে তাহলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না।

এমতাবস্থায় তুমি কী বলবে? এ’ক্ষেত্রে তোমার রেশনাল ডিসিশান কী হওয়া উচিত?’

আমার মনে আছে, আমার সর্বমোট প্রায় ৩৪ মিনিট সময় লেগেছিল ক্লাসের সব স্টুডেন্টকে এটি বোঝাতে, কিছুটা দূষিত পানি পান করা, সব সময়ে ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ পানি পান করার চেয়ে অধিকতর নিরাপদ।

মানুষ যে সামাজিক পরিমণ্ডলে জীবনযাপন করে সেইটার বুদ্ধিবৃত্তিক জনপরিসরে শ্রুত কথাগুলোকে সে তোতা পাখির মতো মুখস্ত আওড়াতে থাকে। গ্রুপ কনফরমিটিকে আমরা কেউ এড়াতে পারি না। গ্রুপ কনফরমিটির থ্রু’তে আমাদের মধ্যে চলে আসা আনডিউ বায়াসগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়ার কাজে আমরা ক্রিটিকাল থিংকিংকে ব্যবহার করতে পারি।

আগেই বলেছি, কোনোকিছুকে সামগ্রিকভাবে from bird’s eye view দেখার কাজে ক্রিটিকাল থিংকিং আমাদেরকে সাহায্য করে। দর্শনের ছাত্রছাত্রী হওয়া সত্বেও আমার সেই স্টুডেন্টদের মধ্যে ছিল ক্রিটিকাল থিংকিংএর অভাব।

তাই, ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ পানীয় জল বনাম কিছুটা সহনীয় মাত্রার দূষিত পানীয় জল, পানি সরবরাহ নীতি সম্পর্কিত এই বিতর্কের শুরুর দিকে ‘সর্বদা বিশুদ্ধ পানি পান করবে’, এই মুখস্থ কথা তাদের সবার মাথার মধ্যে গুরছিল।

ক্রস ইগজামিনেশন এবং থ্রেডবেক ডিসকাসশানের পরে তারা বুঝতে পারে, ইমিউনিটি অর্জন তথা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য সহনীয় মাত্রার খানিকটা দূষিত পানি পান করা স্বাস্থ্যের জন্য অধিকতর নিরাপদ। prevention is better than cure -এই প্রচলিত কথার মত আমরা মনে হয় কথাটা এভাবে বলতে পারি, immunity is better than medicine।

মুখস্ত কথা বলা যাবে না। এর বিপদ সমূহ। এর মানে এই নয় যে সব সময়ে সব বিষয়ে নতুন নতুন অভিনব কথা বলতে হবে। আপনি আগের কথাই বলেন বা অন্যদের সাথে মিলিয়ে বলেন, তাতে সমস্যা নাই।

কীভাবে বুঝবেন আপনার প্যারাডাইম ভুল-

হতে পারে কোনো বিষয়ে আপনার পরিপ্বার্শস্থ ডমিনেন্ট কালচারের কোনো উপাদান আসলেই খারাপ। কিন্তু, তা কেউ বুঝছে না। আনক্রিটিকালি স্রোতের টানে চলতে গিয়ে আপনিও ভুলের মধ্যে রয়ে গেলেন। এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।

তাই, জীবন ও জগত সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির যে বুনিয়াদ, সেটার সাথে আপনার প্রতিটা কথাকে, প্রতিটা কাজকে প্রতি মুহূর্তে মিলিয়ে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

একই সাথে জীবন ও জগত সম্পর্কে আপনার যে বুনিয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি, ইংরেজীতে যাকে paradigm বলে, সেটাকেও সব সময়ে যাচাই ও বাছাইয়ের মধ্যে রাখতে হবে। আপনি নিজেকে সঠিক মনে করা সত্ত্বেও আসলেই যে আপনি সঠিক সেটাকে সবসময় যাচাইয়ের মধ্যে রাখতে হবে। যাতে করে ভুল ট্রেনের যাত্রী হিসেবে নিজের কাছে নিজে বোকা সাব্যস্ত না হোন।

মানুষ তার মনের দরজা খোলে ওয়ানটাইম এনালগ ক্যামেরার সাটারের মতো, একবার কিংবা বড়জোর দু’বার। কিছু একটা বিবেচনার ভিত্তিতে যে আদর্শকে সে গ্রহণ করে আজীবন সেটার পক্ষেই সব যুক্তিতর্ক হাজির করে।

ইনজেন্রেল, মানুষ পরিবর্তনকে ভয় পায়। পরিচিত গণ্ডির মধ্যে (comfort zone) থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ক্রিটিকাল থিংকিংএর প্রাকটিস না থাকার কারণে সমুদ্র মনে করে সে যে একটা কুয়ার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারে না। জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বিশেষ কোনো প্রেক্ষাপটে যে আদর্শকে সে সমর্থন করেছে সেটাকেই আঁকড়ে ধরে নির্বিচার জীবন কাটায়। হোক সে মুক্তমনা কিংবা ঐতিহ্যপন্থী।

মানুষ মনে করে, সত্য একবার পেয়ে গেলে তা চিরজীবনের জন্য পাওয়া হয়ে গেল। না, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়।

সব সম্পর্কের মতো, সত্যের সাথে সম্পর্ককেও পরিচর্যার মধ্যে রাখতে হয়। সত্যকে খুঁজে না পাওয়ার মতো সত্যকে পেয়েও হারানোর ঘটনা কমন। মানুষের আবেগ ও ঝোঁকপ্রবণতা, ইংরেজীতে যাকে intentionality বলা হয়, এইটার কারণে এমনটা ঘটতে পারে।

ক্রিটিকাল থিংকিং আমাদের মন্দ প্রবণতাগুলোকে প্রতিহত করে। আমাদের অবচেতনকে পরিচ্ছন্ন রাখে। আমাদেরকে আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হতে সাহায্য করে।

শেষ কথা-

কোনো ইন্ডিভিজুয়াল, ওয়ান-টু-ওয়ান চিন্তা কখনো ক্রিটিকাল হয় না। ক্রিটিকাল চিন্তা হলো একটা বিষয়কে সম্ভাব্য সব দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা।

ডেল কার্নেগীর বইয়ের মধ্যে পড়েছিলাম, তিনি বলেছেন, কাউকে যাচাই করার জন্য তার জুতা পায়ে দাও। এর মানে হল, তোমার দিক থেকে ব্যাপারটা যা সেইটার সাথে সাথে সেই ব্যক্তির প্রেক্ষাপট থেকেও বিষয়টাকে তুমি বোঝার চেষ্টা করো।

এই হলো ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে কিছু জরুরী কথা। নট এন একাডেমিক ডিসকাসশান। তাই একাডেমিক দিক থেকে আপনি একে যত রিফিউট করেন না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। শুরুতেই বলেছি, ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে একাডেমিক পণ্ডিতি ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি ও ভুল বুঝাবুঝির অন্যতম কারণ।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদে শিক্ষকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, সহজ কথাটাকে সহজভাবে না বলে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অনির্ধারিতভাবে কিংবা অন্যের কাঁধে চড়িয়ে দিয়ে বলা হলো কোনো বিষয়ে কথা বলার ‘একাডেমিক পদ্ধতি’। আমি এই পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী। তাই, পেশাগতভাবে একাডেমিক পার্সন হলেও আমার বলার স্টাইল, নন-একাডেমিক। আমার লেখায় রেফারেন্স পাবেন না, অথবা খুব কম। আমি কমনসেন্স এবং যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা বা লিভড এক্সপেরিয়েন্স থেকে কথা বলি। চাইলে যে কেউ সহজে রিলেট করতে পারেন। বাক্যের মধ্যে দূর্বোধ্য বাঙলা শব্দ ব্যবহার না করে আমি কথ্য ইংরেজী শব্দ স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করি।

সে যাই হোক, আপনি যতটুকু বুঝবেন ততটুকু সহজভাবে বলার চেষ্টা করেছি। অবশ্য, বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রম করতে যারা মোটেও অভ্যস্ত নন, তাদের কাছে আমার এই কথাগুলোও অনেক জটিল মনে হবে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির কর্তৃক দিন রাতের পার্থক্য বুঝতে না পারার মতো। আপনি জানেন, you can’t make anyone understand unless he or she understands by himself or herself.

এককথায়, ক্রিটিকাল থিংকিং হলো কোনো বিষয়কে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর আলোকে বিবেচনা করা। critical thinking is holistic thinking.

ফেইসবুকে যারা মন্তব্য করেছেন এবং আমার উত্তর

Shakil Mia: স্যার, প্রমাণ একটা মাপকাঠি। অর্থাৎ পাত্রের আলোকে পাত্রের ভিতরের জিনিসের বিচার। তো পাত্রের বিচার কীসের আলোকে?

Mohammad Mozammel Hoque: মাপকাঠির কোনো মাপ নাই। এটাই নিয়ম।

মোঃ আল আমিন: স্যার,বিচারবিযুক্ত হলেই কি সেটি অন্ধবিশ্বাস? জীবনের পথে অনেক ক্ষেত্রেই তো আমরা বিচার করতে পারি না, হৃদয় বা অনুভূতি যা আবার ব্যক্তিবিশেষের একান্ত উপলব্ধি -সেখানে তো বিচার চলে না। যুক্তিতেই কি সব সময় উত্তর মিলে নাকি যুক্তিও অন্ধবিশ্বাসের মতো অন্ধকারে নিয়ে যায়। যুক্তি কি সব সময় ট্রুথ আবিষ্কার করতে পারে , অন্ধবিশ্বাসের প্রতিও তো এক ধরনের যুক্তি কাজ করে,তাই যুক্তির বাইরে কি কিছু আছে? নাকি যুক্তিকেও আমাদের সন্দেহ করতে হবে?

Mohammad Mozammel Hoque: হ্যাঁ, বিচার বিযুক্ত বিশ্বাস হলো অন্ধ বিশ্বাস। এর বিপরীত কথা হলো, কোনোকিছুকে আমরা সম্পূর্ণভাবে যাচাই করতে পারি না। কোনোকিছুকে মানে কোনোকিছুকেই। এর কোন ব্যতিক্রম নাই। আমরা নিজেরা পার্টিকুলার হওয়ার কারণে আমাদের সকল জ্ঞানই, এই অর্থে, আংশিক বা খন্ডিত জ্ঞান। এটাই বাস্তবতা। সেজন্য আমাদেরকে নির্ভর করতে হয়, কিছু না কিছুর ওপর, কারো না কারো ওপর। কার ওপরে নির্ভর করা যাবে সেটা যখন আমরা যাচাই করে তার কথাটা মেনে নেই, তখন সেই বিষয়টাকে বিচার বিযুক্ত বলা যায় না। যেমন করে আমরা বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করি।

Md. Ashrafuzzaman Jony: ক্রিটিক্যাল থিংকিং প্রাকাশ করা যায় কিভাবে যা আমি সত্যই অনুধাবন করতে পারছি?

Mohammad Mozammel Hoque: প্রকাশের জন্য লাগবে প্রকাশ করা দক্ষতা তথা ভাষাগত দক্ষতা। বুঝতে পারা, সে মোতাবেক করতে পারা; এগুলো এক ধরনের ব্যাপার। আর, বলতে পারা ভিন্ন ধরনের ব্যাপার। যা বললাম, বলার জন্য লাগবে ভাষাগত দক্ষতা। সেটা চর্চার মাধ্যমে অর্জন করতে হবে।

শুধুমাত্র ক্রিটিকাল থিংকিং করার জন্য ভাষাগত দক্ষতার প্রয়োজন নাই।

Md. Ashrafuzzaman Jony: সে মোতাবেক করতে পারা এই কথাটা বুঝতে পারিনি স্যার।

Mohammad Mozammel Hoque: ক্রিটিকাল থিংকিং করার জন্য এটি আমাদের সাব-কনশাস লেভেলে অলওয়েজ একটিভ থাকতে হবে। সচেতনভাবে সব সময়ে সঠিকভাবে চিন্তা করতে করতে এটা আমাদের অবচেতনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সক্রিয় হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অবচেতন পর্যায়কে আমরা সরাসরি বুঝতে ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আবার, অবচেতন আমাদের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত, এমনও নয়। অবচেতনকে উন্নত করতে অভ্যাসের মাধ্যমে। আমাদের প্রতিটি কাজকর্মকে আমরা যদি যুক্তি-বুদ্ধি ও নীতিনৈতিকতা দিয়ে পরখ করার চেষ্টা করি তখন আমরা বুঝতে পারি, ফিগার আউট করতে পারি, আমাদের অবচেতনে একচুয়েলি কী আছে।

অবচেতন থেকে যখন ভাল কিছুর নির্দেশনা আমরা বুঝতে পারি তখন সেটাকে আমরা বলি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বা কমসেন্স। এই কমনসেন্সের মধ্যে যদি ক্রিটিকাল থিংকিং-এর প্রসেসটা একটিভ থাকে তখন আমরা আমাদের ভেতর থেকে ভাল কিছু করার তাড়না বোধ করি। এবং সেই তাড়না বা ইমপালসের চাপে আমরা কাজটা করি।

ব্যপাারটা অবচেতন থেকে আসার কারণে সচেতনভাবে আমরা ঠিক বুঝতে পারি না, কেন আমরা এমনটা করছি। কিন্তু না করেও থাকতে পারি না। এই অবচেতনের অপরনাম intentionality। আমরা বলি নিয়ত। আমি মানে আমার চেতন-অবচেতন মিলিয়ে আমার চেতনার সবটুকু।

দেখা যায়, কেউ গাড়ি চালাতে পারে। সাতার কাটতে পারে। ভাল রান্না করতে পারে। কোনো কাজ সুচারুভাবে করতে পারে। অথচ, তারা মোটেও বলতে পারে না, তারা সেই কাজটি ঠিক কীভাবে করেন।

বলতে না পারলেও ঠিকমতো করতে পারে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে। ভাষাগত দক্ষতা যেমন এক ধরনের দক্ষতা। চিন্তা করার দক্ষতাও এক ধরনের দক্ষতা। দু’টাই প্রাকটিসের ব্যাপার।

অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে ক্রিটিকাল থিংকিংকে অবচেতনে সেট করতে না পারলে ক্রিটিকাল থিংকিং-এর ওপর বক্তৃতা দেয়া যাবে, কিন্তু প্রাকটিকালি ক্রিটিকাল থিংকিং করা হয়ে উঠবে না।

Rowshon Ali: একজন ধার্মিক কি ক্রিটিক্যালি থিংক করতে পারে?

Mohammad Mozammel Hoque: to me, Islamic monotheism or kalema-e-towhid is a rational understanding and conviction; not a dogmatic proposition. I think, you have got the point.

Rowshon Ali: বিশ্বাসীরা কখনও জ্ঞানী হতে পারে না। এটার বিষয়ে আপনার মতামত কী?

Mohammad Mozammel Hoque: আমি একজন বিশ্বাসী। ‘বিশ্বাসীরা জ্ঞানী হতে পারে না’ এই আপ্তবাক্য অনুসারে আমি জ্ঞানী নই। এবং হতেও পারবো না। তাই উক্ত আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী কারো সাথে আমার সাথে কারো কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা হতে পারে না। যে কিনা অর্থপূর্ণ আলোচনা করতে পারে না তার মতামত শোনারও দরকার নাই।

অতএব, আর কী বলবো….!

Rowshon Ali: এটাই বিশ্বাসীদের রক্ষাকবজ।

Mohammad Mozammel Hoque: কোনটা বিশ্বাসীদের রক্ষা কবজ? মানুষ মাত্রই বিশ্বাসী। জ্ঞানমাত্রই বিশ্বাস। যাচাইকৃত হওয়া আর সত্য হওয়া সাপেক্ষে। ইটসেলফ যাচাইকরণকৃত কিছু বা সত্য কিছু জ্ঞান নয়। জানেন?

কথা বলছেন জ্ঞানতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের সাথে। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, কে কাকে কিসের ওপরে কোন পরিস্থিতি কখন ও কীভাবে বিশ্বাস করছেন, এসব সাপেক্ষে বিশ্বাস ও আস্থা অনিবার্য।

মুখস্ত কথা বললে তো আর হবে না।

Rowshon Ali: প্রত্যেক ধর্মের ধার্মিক ব্যক্তিই নিজ ধর্মকে সঠিক মনে করে। যৌক্তিক মনে করে।

Mohammad Mozammel Hoque: প্রত্যেক ব্যক্তিই তার প্রত্যেক চিন্তার ব্যাপারে নিজেকে সঠিক মনে করে। এমনকি যখন সে সন্দেহ করে, তখন সন্দেহ করার এই কাজটিকে সে সন্দেহ করে না। অর্থাৎ সে নিশ্চিত থাকে যে সে সন্দেহ করছে। মানুষ তার নিজের কাছে সদাসর্বদা সৎ ও সঠিক। এটি তাত্ত্বিক অনিবার্যতা। মানুষের চিন্তার পূর্বশর্ত।

Rowshon Ali: একজন ধার্মিক যে ক্রিটিক্যালি থিংকিং করতে পারে না তার প্রমাণ আপনার মতো মহাজ্ঞানী মহাজন। এত পড়াশোনা করেও সত্যকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ সত্যানুসন্ধানই দর্শনের কাজ।

Ibrahim Hossain: there is a correlation between language proficiency and critical thinking. Proficiency in a language can enhance critical thinking skills because language is a tool for expressing and processing complex ideas. A strong command of language allows individuals to articulate their thoughts more effectively, analyze information, evaluate arguments, and engage in reasoned discussions. Additionally, learning multiple languages can provide different perspectives and cognitive benefits that can further support critical thinking abilities. However, it’s important to note that language proficiency is just one factor, and critical thinking also depends on various other cognitive and contextual factors.

Mohammad Mozammel Hoque: I don’t think that language proficiency is a precondition for critical thinking. And I also strongly believe that speaking and writing skill is not necessarily connected with critical thinking. Critical thinking is generating thoughts and arranging all thoughts systematically. It’s a skill. one kind of skill is helping to develop another kind of skill. but each one has to be developed in its own way.

And yes, in the broad sense, language is a must. so, our thoughts also have its own kind of language, which we call language of thought or inner speech.

Though Wittgenstein has opposed any possibility of a private language, and at some time I have offered a seminar paper on this issue, still I do believe that everyone has a private language. rules of logic guide the language of (our very private or personal) thoughts.

someone may think logically without studying the subject logic. someone may think dogmatically though she is an expert in logic as a subject.

Asad Uz Zaman: ঠিক স্যার, অনেক সময় তাত্ত্বিকভাবে অনেক কিছুই সঠিক বলে মনে হয় কিন্তু তা বাস্তবে প্রয়োগ করলে মোটেও ভালো ফল আনে না। তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও রেশনাল প্রয়োগের ভিতর আকাশ পাতাল পার্থ্যক্য থাকে।

Mohammad Mozammel Hoque: তত্ত্ব আর বাস্তব এক জিনিস না। সমস্যা হয় তত্ত্ব নির্মাণ করার সময়ে। কোনো কিছুর ব্যাকগ্রাউন্ডে বহু ফ্যাক্টর কাজ করে। সেই বিষয়ে থিওরি ডিভেলপ করার সময়ে অনেক সময়ে তা নজরে আসে না। না আসাই স্বাভাবিক। আবার কোনোকিছুর বহুমুখী এফেক্ট থাকে, যা প্রাকটিকালি কাজটা না করা বা জিনিসটা না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *