যুক্তিকে অতিক্রম করে যাওয়া, ইংরেজীতে exhaust করা বলতে যা বোঝায়, তা এক কথা; আর যুক্তি-বুদ্ধির দাবীকে নাকচ করে দেয়া, ইংরেজীতে cancel করা বলতে যা বোঝায়, এই দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

আপনার পরিচিত এলাকা ছেড়ে কোনো যানবাহনে চড়ে আপনি অন্য এলাকায় গেলেন, সেখানে অন্য কোনো যানবাহনে চড়ে বসলেন, গন্তব্যে পৌঁছার জন্য। এইটা একটা দৃশ্য। কল্পনা করুন আরেকটা দৃশ্য। আপনার এলাকাতেই আপনি বসে থাকলেন। লোকাল গাড়িতে চড়ে নিজের এলাকা হতে আপনি বেরই হলেন না। প্রথম ক্ষেত্রে আপনি আপনার হাতের কাছে থাকা সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এরপর অধিকতর উপযোগী ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছেন। কথার কথা, লোকাল বাসকে একজস্ট করে আপনি ইন্টারসিটি বাসের যাত্রি হয়েছেন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি আপনার বেসিক কেপাসিটিকে কাজে না লাগিয়ে সেটাকে অকার্যকর বা কেনসেল করে বসে থাকলেন।

যুক্তি-বুদ্ধির ব্যাপারটাও সে’রকম। আপনার একান্ত নিজস্ব যুক্তি-বুদ্ধিকে আপনি কাজে লাগাবেন লোকাল গাড়ির মতো করে। লোকাল গাড়িতে করে দূর যাত্রায় রওয়ানা হওয়াটা যেমন বোকামি; তেমন করে লোকাল গাড়ি না ধরলে আপনি দূর পাল্লার যানবাহন এভেইল করতে পারবেন না। হেটে ঘর থেকে বের হয়ে লোকাল গাড়িতে চড়ে স্টেশনে না পৌঁছলে আপনাকে ঘরেই বসে থাকতে হবে।

যুক্তিবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের যায়গায় পৌঁছানো বনাম যুক্তিবুদ্ধির দাবীকে পাশ কাটিয়ে আস্থা ও বিশ্বাসে পৌঁছানোর দৃশ্যমান যে চেষ্টা, এই পণ্ডশ্রমের আরেকটা উদাহরণ হলো-

কেউ নিচের থেকে উপরে পৌঁছতে চায়। এরজন্য সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। নিচের তলা পার হয়ে দোতলা হয়ে তিন তলা। এভাবে, বিল্ডিংটা যদি ৪তলা হয়ে থাকে, তাহলে সে চতুর্থ তলায় পৌঁছলো। এ’ক্ষেত্রে সে নিচের তলা একজস্ট করে দোতলায় গেছে। দোতলা একজস্ট করে তিন তলায় গেছে। তিন তলা একজস্ট করে তার গন্তব্য চতুর্থ তলায় পৌঁছেছে।

আরেকজন এমন হতে পারে, যে কিনা দোতলায় যেতে চায় না, তিন তলায় যেতেও তার অনীহা। তার (কু)যুক্তি হলো, ‘আমি তো চতুর্থ তলায় যাবো। আমি কেন দোতলায় উঠবো? তিন তলায় যাবো?’ প্রথমজন দোতলা ও তিন তলাকে একজস্ট করেছে। দ্বিতীয়জন দোতলা ও তিন তলাকে কেনসেল করেছে।

এরপরের কথা হলো, আমাদের অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি সমতলধর্মী (horizontal) কিছু নয়। বরং, ক্রমসোপানমূলক (hierarchical or vertical)।

আমাদের একটা অভিজ্ঞতার ওপর আমরা অপর অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেই। বৃহত্তর কোনো প্রেক্ষাপটের কারণে আমাদের এক ধরনের বুদ্ধির দাবীর ওপর আমরা অপর ধরনের বুদ্ধিগত দাবীকে প্রায়োরিটি দেই। কিছু বুদ্ধিগত মূলনীতির আলোকে আমরা আমাদের সকল অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিকে যাচাইবাছাই করি। নিচের থেকে কমপ্লিটলি কিছুই না দেখা সত্বেও ওয়াচ টাওয়ারের উপরে থাকা ব্যক্তির সতর্ক-সংকেতকে বিশ্বাসকে যুক্তিসংগত বলে মনে করি। আমাদের নিজেদেরই পরবর্তী অভিজ্ঞতা দিয়ে আগের অভিজ্ঞতাকে সত্যায়ন অথবা বাতিল করি।

যুক্তিবুদ্ধিকে বাদ দিয়ে বিশ্বাস করা আর যুক্তিবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বাস অর্জন করা, দুইটা সম্পর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রথমটা ডগমেটিক এপ্রোচ। দ্বিতীয়টা রেশনাল এপোচ। কানে যেমন দেখা যায় না, চোখে যেমন শোনা যায় না; তেমনি করে অভিজ্ঞতার বিষয়ে অভিজ্ঞতাই অগ্রগামী। বুদ্ধি সেখানে অভিজ্ঞতার অনুগামী। অনুরূপভাবে বুদ্ধির বিষয়ে বুদ্ধিই থাকে লিডিং পজিশনে। অভিজ্ঞতা সেখানে বুদ্ধির একান্ত অনুবর্তী।

আমাদের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারা আমাদের বুদ্ধিরই দাবী। অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা তো অতিস্পষ্ট (অবভিয়াস)। সহজ কথাও মাঝে মাঝে বুঝিয়ে না বললে বোধগম্য হয় না। তাই বলছি।

দুইয়ে দুইয়ে চার, এইটা আমাদের বুদ্ধির দাবী। দুইয়ে দুইয়ে চার ছাড়া অন্য কোনোকিছু, কারো বুদ্ধিতে এইটা হাজির করা, চিন্তা করা অসম্ভব। যা সাদা তাকে সাদা না বলে আপনি white বলতে পারেন। তাতে করে আপনার whiteness-এর যে ফিলিং, সেইটার কোনো হেরফের হবে না। ভাষাগত সীমাবদ্ধতার জন্য আপনি সাদা বা white বলতে না পারলেও জিনিসটার যে শুভ্রতা তা অন্তত আপনার কাছে হবে নিসংশয়। প্রশ্নাতীত। নিজের কাছে কেউ কখনো মিথ্যা বলতে বলতে পারে না।

বিশেষ করে ধর্মের লোকেরা অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবুদ্ধির ব্যবহার নিয়ে ভুলভাল কথাবার্তা বলে, যা আধুনিক শিক্ষিতদের কাছে ভুল বার্তা প্রেরণ করে। ধর্মের লোকদের কথা শুনলে মনে হয় আমরা যেন বিশ্বাস দিয়েই শুরু করি। না, আমরা কোনো কিছুই নিছক বিশ্বাস দিয়ে শুরু করি না। সব কিছু আমরা অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। অভিজ্ঞতার কন্টেন্টগুলোকে আমরা যাচাইবাছাই করি বুদ্ধি দিয়ে। বুদ্ধিকে আরো পরিশীলিত করা যায়, বুদ্ধির সীমাবদ্ধতাগুলোকে কাটানো যায়, প্রত্যাদেশ দিয়ে।

এরপরও আমাদের সীমাবদ্ধতা থেকে যায়, অজানা রয়ে যায় অনেককিছু। এটাই স্বাভাবিক। আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে আমাদের অভিজ্ঞতাও সীমিত, বুদ্ধিও সীমিত। শেষ পর্যন্তও যাওয়ার পরও আমরা শেষ পর্যন্ত শুরুও করতে পারি না। কেননা, জানার বিষয় অসীম। অসীমকে কখনো ছোঁয়া যায় না; যদিও সসীম হিসেবে আমরা অসীমের পানে ছুটে চলি নিরন্তর।

Alfred Tennyson এর ভাষায়,

‘… every experience is an arch,
where through gleams that untraveled world,
whose margin fades forever and forever,
when I move’।

কিন্তু আমরা বা যে কোনো জাগতিক সত্তার জ্ঞানধারণের ক্ষমতা সীমিত। এটি Absolute-particular ontology’র মূলকথা। এটাই আমার Divine agnosticism-এর মূলকথা।

নিজের জ্ঞানবুদ্ধিকে যথাসম্ভব কাজে লাগানো এক কথা; আর আল্লাহ প্রদত্ত নিজ অভিজ্ঞতা, বুঝ ও জ্ঞানকে নিছক আন্দাজ অনুমানের ওপর নির্ভর করে কারো কাছে বর্গা দিয়ে রাখা, অভিজ্ঞতা ও বুঝজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনেকিছুকে জোর করে বিশ্বাস করার চেষ্টা; দুইটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। অবুঝ মু’মিন বান্দাহদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য নমুনা হিসেবে ৫০টা কোরআনের আয়াত নিয়ে আমি একটা লেখা লিখেছি, ‘যুক্তিবুদ্ধির পক্ষে আল্লাহ তায়ালা’ এই শিরোনামে। পাবেন mozammelhqডটcom -এ। ডট-এর জায়গায় . দিতে হবে।

আমাদের ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা আল্লাহর নেয়ামত। আমাদের যুক্তিবোধ ও বুদ্ধির সক্ষমতাও আল্লাহর নেয়ামত। ঈমান যেমন করে আল্লাহর খাস নেয়ামত। পরেরটা পেতে হলে আগেরগুলোকে একজস্ট করতে হবে, যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। Kalema is a rational conclusion, not an imposed dogmatic belief. বিশেষত মক্কায় নাযিলকৃত সুরাগুলো পড়লে এটি অনুধাবন করতে পারবেন।

ক্রিটিকাল থিংকিং নিয়ে এরপরে আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

মুরসালিন নিলয়: “কিছু বুদ্ধিগত মূলনীতির আলোকে আমরা আমাদের সকল অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিকে যাচাই বাছাই করি।” যেমন? এছাড়া অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির নিজ জায়গায় অগ্রগামিতার যে জায়গা দেখালেন সেটা অভিজ্ঞতাবাদী ও বুদ্ধিবাদীদের কীভাবে বোঝাবেন?

Mohammad Mozammel Hoque: কেউ তো কাউকে কোন কিছু আন্ডারস্ট্যান্ড করাতে পারে না যতক্ষণ না সে নিজে থেকে নিজেই আন্ডারস্ট্যান্ড করে। কথার কথা, আমি যখন কোনো কিছুকে দেখি তখন আসলে আমি কি সেই জিনিসটাকে দেখি? হুবহু? তাই?

বুদ্ধিবাদীরা বলতে চায়, আমরা যখন কোনোকিছুকে দেখি তখন আমরা কিছু ইন্দ্রিয় উপাত্ত পাই, যেগুলোকে আমরা আমাদের বুদ্ধির ছাঁচে এবং আমাদের পূর্বজ্ঞানের আলোকে যাচাই বাছাই করে সেটাকে সেই জিনিস হিসেবে ডিটারমাইন করি। আমাদের ভেরি এম্পেরিক্যাল প্রসেসের মধ্যেই রয়ে গেছে অভিজ্ঞতাপূর্ব তথা আপ্রাওরাই বিষয়গুলো।

কামাল হোসেন: স্যার, যুক্তিবুদ্ধির পক্ষে আল্লাহ তাআলা’ শিরোনামের আর্টিকেলটির লিংক শেয়ার করলে আমাদের জন্য অধিকতর সুবিধাজনক হবে।

Mohammad Mozammel Hoque: যুক্তিবুদ্ধির পক্ষে আল্লাহ তায়ালা

Ahmed Waris Al Majid: Very very old debate. I’ll add just one thing here… একজন মুসলমান হিসেবে আপনার মূল assumptions কি থাকে?

The answer to this tells you all one needs to understand regarding the faith vs. rationality debate. If you have assumptions a priori, then faith comes first; if you conclude that having faith is the rational outcome, then rationality comes first. I work with both as they support each other.

Mohammad Mozammel Hoque: আমার কাছে ফেইথ বনাম রেশনালিটি, এইটা একটা ফলস বাইনারি।

Ahmed Waris Al Majid: দোনোটার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম: একটা দুনিয়া বুঝতে অন্যটা অদৃশ্য দুনিয়ার আন্দাজা করতে। মিশ্রিত করা খুব খুব বিপজ্জনক।

কামাল হোসেন: কুরআন কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন করাকে কি নিরূৎসাহিত/নিষেধ করে। যেমন: “হে ঈমানদারগণ! এমন কথা জিজ্ঞেস করো না যা তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দেয়া হলে তোমাদের খারাপ লাগবে। তবে কুরআন নাযিলের সময় যদি তোমরা সেসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করো তাহলে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। এ পর্যন্ত তোমরা যা কিছু করেছো, আল্লাহ‌ তা মাফ করে দিয়েছেন। তিনি ক্ষমাশীল ও সহনশীল।

তোমাদের পূর্বে একটি দল এ ধরনের প্রশ্ন করেছিল। তারপর সেসব কথার জন্যই তারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল।”(5:101-102) এ ধরনের আরও আয়াত আছে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *