আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজে মেয়েরা নিঃশর্ত ও নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন ও সুরক্ষা পায় দু’জন পুরুষের কাছ হতে। তাদের বাবা এবং স্বামীর কাছ থেকে। এরপরের লেভেলে তাদের আনকন্ডিশানল সাপোর্ট আসে তাদের ছেলেসন্তান ও ভাই থেকে। যদি থাকে। এরপরে তারা শেলটার এবং কোঅপারেশন পায় তাদের মেয়েসন্তান ও বোনদের থেকে।
অল্পবয়েসী মেয়েরা এটি বুঝতে পারে না। পাশ্চাত্যমানসিকতা দ্বারা অবসেসড থাকার কারণে তারা এটি মানতেও পারে না। বিশেষ করে, বাবার পরপরই প্রথম ক্যাটাগরিতে স্বামীর ভূমিকার ব্যাপারে তারা সন্দিহান। এটি আমি অনুমান করি। আমার অভিজ্ঞতাও অনুরূপ।
আসলে জীবনের বৃহত্তর বাস্তবতাকে রিয়েলাইজ করার জন্য দরকার বয়স, অভিজ্ঞতা তথা মেচিউরিটির।
‘উচ্চশিক্ষিত আধুনিক নারীদের ক্ষমতার বিকার’ শিরোনামে বেশ ক’বছর আগে আমি একটা সিরিজ লেখা লিখেছিলাম। ১ম বা ২য় পর্ব দেয়ার পরে একদিন রাত ১০টার পরে অপরিচিত এক মেয়ে ফোন করে আমার সাথে পৌণে এক ঘণ্টা ঝগড়া করছিল। লেখাটা কদ্দুর পড়ে তার মাথায় নাকি আগুণ ধরে গেছিল। সে ঢাকায় কোনো এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক।
এক পর্যায়ে সে বললো, ‘আপনারা বয়স্ক লোকেরা কথায় কথায় বয়সের দোহাই দেন। এটি ঠিক না’। আমি তখন বলেছিলাম, ‘দেখেন, বয়সের মাধ্যমে, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যা পাওয়ার, তা তো আপনি এট ইউর থার্টিজ মিয়ার উইশফুল থিংকিং দিয়ে কোনোভাবেই পাবেন না।’
I appreciate her innocence, sincerity and courage. মেয়েটার নাম, ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম, কোনোটাই আমার মনে নাই।
সে যাই হোক।
দেখেছি, দেশে এবং বিদেশে, অল্প বয়সে নারীরা থাকে কম-বেশি নারীবাদী। পরিণত বয়সে তারা বুঝতে পারে, নারীবাদ একটা ফাঁদ। স্বামী সন্তান সংসার, এককথায় ট্রাডিশনাল জেন্ডার রোলই হলো মোস্ট ফুলফিলিং সামথিং। পুরুষেরা যেভাবে তাদের অল্প বয়সে নারীদের রূপসৌন্দর্যের ফাঁদে পড়ে। পরিণত বয়সে বুঝতে পারে, রূপের মূল্য অতিসামান্য। গুণই আসল জিনিস। কাজে লাগে।
সারাজীবন পানের সাথে তামাক পাতা খেয়ে আমার মা ৭০ এর কাছাকাছি বয়সে ক্যান্সার আক্রান্ত হলেন। ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে তখন তিনি লাং ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। সপ্তাহখানেক উনার সাথে থেকে আমি চট্টগ্রাম চলে আসার একদিন পরে উনাকে বড় আপার বাসায় নেয়া হয়। পরের দিন ফজর শুরুর সময়ে উনি বড় আপার হাতে ইন্তেকাল করেন।
আমি যখন উনার সাথে কেবিনে ছিলাম তখন আমি প্রতিটা মুহূর্তে উনার সাথে লেগে থাকতাম। এমনকি এটেনডেন্ট বেডে না থেকে উনার বিছানার নিচে ফোমের উপর শুয়ে থাকতাম। রুমে ফুলটাইম এসি চলার বিষয়টি ভুলে গিয়ে উনি একবার বললেন, ‘এই দেখ তো, শীতকালের রোদ কী সুন্দর…!’। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘মিতুল কই? ওকে দেখছি না কেন? ফ্যাকাল্টিতে গেছে?’ উনি ভুল করে মনে করতেন, উনি আমার ক্যাম্পাসের বাসাতেই আছেন।
ঘুম থেকে উঠার পরে উনি অনেক সময়ে লোকজনকে চিনতে পারতেন না। আমাকে দেখে একদিন বললেন, ‘আপনার মতো দেখতে আমার একটা ছেলে আছে। চিটাগাং ইউনিভার্সিটির টিচার’।
উনার গলার আওয়াজ তখন ক্রমাগতভাবে ছোট হয়ে আসছিল। উনি আমার সাথে সারাক্ষণ কথা বলতেন। কোনো এক ভিজিটর উনাকে কথা না বলতে বলাতে উনি বললেন, ‘আমি আর কথা বলতে পারবো না। তাই যতক্ষণ পারি, বলতেছি।’ শেষের দিকে উনার কথা জড়িয়ে আসতো। দুর্বল স্বর। আমরা শুধু বুঝতাম। আহা, বাঁচার জন্য মানুষের কী আপ্রাণ চেষ্টা…!
একজন বাংগালী নারীর জীবনে তার বাবা আর স্বামীর অবস্থান কোথায়, সেটা বলার জন্য এই ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ।
উনার এ’ অবস্থাতেও আমি উনাকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অন্তত দু’বার জিজ্ঞাসা করেছি, ‘মা, কার কথা আপনার মনে পড়ছে বেশি?’ দু’বারই উনি অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে কিন্তু স্পষ্টভাবে, হাতের দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বলেছেন, ‘দুইজনের কথা। আমার বা’জান আর তোর বাবা’।
সুস্থ থাকতে কতবার উনি আমাদের বলেছেন, ‘দেখ, আমি ভাবতাম, আমার বা’জান না থাকলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। বা’জান মারা গেল কত বছর…! অথচ আমি কী সুন্দর বেঁচে আছি। সংসার করছি…!’ এ’কথা বলে উনি কতক্ষণ নিরবে কাঁদতেন।
আমার মায়ের সাথে আমি খুব ঝগড়া করতাম। রাগারাগি করতাম। ফ্যামিলি সংক্রান্ত নানা বিষয়ে। আমরা ৯ভাইবোন সবাই জীবিত। আমার বড় ৪জন। ছোট ৪জন। বড়রা সবাই অবসরপ্রাপ্ত। বাইরের লোকদের সাথে তো দূরের কথা, ২০০৯ সালে আম্মা মারা যাওয়ার পর হতে ভাই বোন বড়-ছোট কারো সাথে সে’রকম ঝগড়া আর হয় না। কেউ আর আমাকে সেভাবে সহ্য করে না …!
পুরনো হাড় ভাংগলে যেমন জোড়া নেয় না, বয়স হয়ে যাওয়ার পরে, বিশেষ করে বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে, ঝগড়াঝাটির পরে এমনকি ভাইবোনদের সম্পর্কেও স্বতঃস্ফূর্ততা আর ফিরে আসে না। কোনো কারনে দূরত্ব তৈরি হলে তা থেকে যায়।
তাই, যা কিছু যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় তা যেন চিরতরেই যায়। ফিরে আসে না আর। কোথাও যেন এই কথার কন্টিনিউশানে লিখেছিলাম,
এ’জীবন যেন প্রিয়বঞ্চিত এক স্মৃতির কারাগার।
একজন নারীর পরিণত বয়সে স্বামীর শূণ্যতা পূরণ হয় না কোনোকিছু দিয়ে। একইভাবে পরিণত বয়সে স্ত্রীর শূণ্যতা পুরুষদের ঠেলে দেয় আগাম মৃত্যুর মুখে। হিউম্যান বন্ডিং ইজ দ্যা মোস্ট প্রেশাস থিং অন আর্থ। মানবিক সম্পর্কের চেয়ে দামী কিছু নেই এই পৃথিবীতে।
আপন সাহচর্যের নেই কোনো বিকল্প, আধুনিক ব্যক্তি-স্বাধীনতাবাদী জীবনে যার সবচেয়ে বেশি অভাব।