ফিলসফি পড়ে মানুষ কেন নাস্তিক হয়?

না, ফিলসফি পড়ে খুব কম লোকেরাই নাস্তিক হয়েছে। একইরকমভাবে, ফিলসফি পড়ে খুব কম লোকেরাই আস্তিক হয়েছে। কথাটা উল্টো করে বললে, যারা নাস্তিক তাদের খুব কম সংখ্যক লোকেরা ফিলসফি পড়েছে। অনুরূপভাবে, যারা আস্তিক তাদের মধ্যকার খুব কম লোকই আস্তিকতার পক্ষে দার্শনিক আলোচনা শুনেছে বা পড়েছে। তবে এ’কথা সত্য, ফিলসফি পড়ে নাস্তিক্যবাদের যারা পক্ষে নাস্কিতার ওপর তাদের ‘ঈমান’ বেড়ে যায়। যারা আস্তিক্যবাদের পক্ষে, ফিলসফি পড়ার পর আস্তিকতার ব্যাপারে তাদেরও ঈমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।

মানুষ আস্তিক বা নাস্তিক হয় তার জীবন-অভিজ্ঞতা বা লিভড এক্সপেরিয়েন্স এবং মন-মানসিকতা বা ইনটেনশনালিটির কারণে। পদার্থবিদ্যার সংশ্লিষ্ট সূত্রাবলী না জেনেও লোকেরা যেভাবে হাটাচলা করে।

বিষয়টা নিয়ে চলুন আমরা সিস্টেমেটিক্যালি কিছু আলাপ আলোচনা করি।

আপনি যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, he is a philosopher, তাহলে আপনাকে সম্মুখীন হতে হবে এই প্রশ্নের, ‘then what is his philosophy?’

এমনিতে প্রতিটা মানুষই তো র‍্যাশনালি চিন্তা করে, এবং সেই হিসেবে প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে ফিলসফার। স্বভাবতই মানুষ যখন কোনোকিছুকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করে আসলে সে ফিলসফিক্যালি চিন্তা করে। সমস্যা হলো, সবাই ফিলসফার হলে বিশেষ কারো ফিলসফার হওয়াটা খুব একটা মজাদার হয় না। আমরা সাধারণত ফিলসফার বলি তাদেরকে যারা চিন্তার ইতিহাসে বিশেষ কোনো অবদান রেখেছেন।

এ’প্রসঙ্গে একটা জরুরী কথা হলো, আমাদের যুক্তিবুদ্ধির সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারাটাও কিন্তু আমাদের যুক্তিবুদ্ধির দাবি। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, যুক্তির বাইরে কিছু নাই। যুক্তির মধ্যে আছে ক্রমসোপান বা হায়ারআর্কি। আমি খুব ছোট্ট একটা অন্টলজি দিয়ে এটা বুঝাই। একটু ভারী শোনালেও অন্টলজি শব্দটার মুল কথা হচ্ছে কোনোকিছুকে তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করা।

যেমন, সম্পূর্ণ-কে আমরা অনুমান করি অসম্পূর্ণতা হতে। অভিজ্ঞতায় আমরা কখনো সম্পূর্ণকে পাই না। অভিজ্ঞতায় আমরা এবসলিউটকে পাই না। পার্টিকুলারের অন্টলজিকাল সাপোর্ট হিসেবে আমরা এবসলিউটকে ডিফাইন করি।

মানুষ হিসেবে আমরা কি এবসলিউট? এবসলিউট হিসেবে গড আছে না আছে এটা নিয়ে বিতর্ক হইতে পারে। কিন্তু আমরা সবাই যে পার্টিকুলার, কেউ যে এবসলিউট নই, এটি অভিয়াস।

যে যে রকম তার চিন্তাটাই হবে সে রকম। এনটিটিটি হিসেবে আমরা যদি পার্টিকুলার হয়ে থাকি তাহলে আমাদের এপিসটিমোলজিও হবে পার্টিকুলার বা খণ্ডিত। আমাদের ইন্দ্রিয়জ ক্ষমতা যে রকম আমাদের সামগ্রিক চিন্তাও হবে সেই রকম।

তাই, পার্টিকুলারের চিন্তা দিয়ে কেউ যদি এবসলিউটকে বুঝতে চায় এবং এবসলিউটের কাজকর্মকে র‍্যাশনালাইজ করতে চায়, এইটা ভুল।

আমরা যদি খোদার সাথে জাগতিক কিছুর সম্পর্ক নিয়ে বুঝতে চাই তাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে, খোদার সাথে আমাদের রিলেশন হবে সাব-অর্ডিনেট কারো সাথে তার অথরিটির সম্পর্কের মতো। সাবঅর্ডিনেট-অথরিটির অন্টলজিতে সংশ্লিষ্ট রুলস-রেগুলেশন্স কি সাব-অর্ডিনেট ঠিক করবে? নাকি, অথরিটি ঠিক করবে?

সাবঅর্ডিনেট-অথরিটির তত্ত্ব অনুসারে অথরিটিই ঠিক করবে তাঁর সাবঅর্ডিটে কীভাবে কী করবে। এই অন্টলজি অনুসারে অথরিটি কি খোদা, না আমরা? খোদাকে আমরা বুঝব, নাকি খোদা আমাদেরকে বুঝবেন? নাকি, খোদাও আমাদেরকে বুঝবেন, এবং সমানে সমানে আমরাও খোদাকে বুঝব?

সমক্যাটাগরির পক্ষদ্বয় পরষ্পরকে চাইলে বুঝতে পারে। তাই, খোদার কেন কোনোকিছু করেছেন তা কনক্লুসিভলি জানতে চাওয়া কিংবা নিজের জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে সেই কাজকে অন্যায় বা ভুল বলা, এইটা লজিকেলি রং। সিম্পলি, ক্যাটাগরি মিসটেক।

এই ধরনের মনোভাব পোষণ করা হলো শির্ক। জ্ঞানগত শির্ক। কেউ যদি খোদাকে ‘সঠিকভাবে’ বুঝার দাবি করে তাহলে সে প্রাকারান্তরে কোনো না কোনো দিক থেকে খোদার সমকক্ষতা দাবি করে। খোদার সাথে সমকক্ষতা শুধুমাত্র বিগনেসের ব্যাপার, এমন না। বরং এটা কোয়ালিটেটিভ ব্যাপার। ক্যাটাগরিক্যাল ডিফারেন্স।

খুব সিম্পল, পার্টিকুলার হিসেবে আমাদের উচিত হবে এবসলিউটের প্রতি এবসলিউট আনুগত্য স্বীকার করা।

অবশ্যই আমরা যে কোনো জিনিসকে র‍্যাশনালাইজ করার চেষ্টা করব। আমরা বাই নেচার, ইরেশনাল কোনো কিছু করি না বা করতে পারি না। যদিও বা করি, সেটা কন্টাডিকশন বা হিপোক্রেসি। আনএকসেপ্টট্যাবল। কিন্তু র‍্যাশনালাইজেশানের একটা লিমিট আছে। আমরা সব ক্ষেত্রে অথরিটিকে মানি। অথচ, আমরা কেন জগতের ক্ষেত্রে অথরিটি তথা খোদাকে মানতে চাই না? জগতের ব্যাপারে আমরা কেন খোদার উপর রিলাই করতে না?

এবার আসি আমরা খোদার সাথে মানুষের যোগাযোগের অন্টলজি কী হতে পারে, তা নিয়ে খুব সংক্ষেপে কিছু আলোচনাতে।

খোদা না থাকলে তো নাই। খোদার নামে যা বলা হয়েছে তা সব বানোয়াট। খোদা যদি থেকে থাকেন এবং আমরা যদি প্রত্যক্ষভাবে প্রাকৃতিক নয় এমন সব নৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে খোদার হুকুম জানতে হয় তাহলে আমরা তা কীভাবে জানতে পারি? এ’ ব্যপারে যুক্তি আমাদেরকে কী বলে?

এবসলিউট পার্টিকুলারের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করবে? উইথ হিজ অল এবসলিউটনেস? অর ইন দ্যা ভেরি ওয়ে পার্টকুলার ক্যান গ্রাপস? সমগ্র তাঁর সমগ্রতা নিয়ে বিশেষ-এর সাথে যোগাযোগ করবে? নাকি, বিশেষের কাছে বিশেষের উপযোগী পন্থায় সমগ্র নিজেকে বিশেষের কাছে উপস্থাপন করবে? কোনটা যুক্তিসঙ্গত?

শুধু অধিকতর যক্তিসঙ্গত নয়, বরং একমাত্র যুক্তিসঙ্গত হলো এবসলিউট পার্টিকুলারের মতো করে পার্টিকুলারের সাথে যোগাযোগ করবে। পার্টিকুলারের সাথে পার্টিকুলারের ভাষাতেই সরাসরি কিংবা কোনো মিডিয়ামের থ্রুতে কথা বলবে। কারণ, এবসলিউটের তো কোনো ভাষা নাই। পার্টিকুলার অথচ নির্দিষ্ট ভাষার বাইরে বোঝে না।

হিন্দুরা মনে করে যে গড স্বয়ং মানে অবতার হিসেবে ইনকারনেট করেছে। বিষ্ণু, শিব ও কৃষ্ণ’র মধ্যে। আমরা মনে করি যে না গড এভাবে ইনকারনেইট করে। খোদা তায়ালা তাঁর বান্দাদের মধ্যে থেকে কাউকে চয়েস করে নেয় এবং তাঁর মাধ্যমে বান্দাহদের সাথে কথা বলেন। খোদার সাথে বান্দাহর এই কানেকশানে খোদার হুকুমে মধ্যস্থতা করেন ফেরেশতা ও নবী রাসূলগণ।

ব্যক্তি ও জগতের অস্তিত্বের যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা হিসেবে গড থাকাটা যার কাছে একটা প্লজিবল, রেভিলেশন তার কাছে রেলেভেন্ট এন্ড প্লজিবল। একজিসটেন্স অব গডের আলোচনা হলো নবুয়তের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনার পূর্বশর্ত। প্রথমটি মানলে দ্বিতীয়টা মানবেন। প্রথমটা না মানলে দ্বিতীয়টা মানার প্রশ্নই উঠে না।

এইভাবে আমি এখন যে আলোচনাটা করলাম, এটি এজ ইয়ুজুয়াল ফিলসফিক্যাল; এবং এজ ইয়ুজুয়াল, ভেরি মাচ্চ কনসিস্ট্যান্ট উইথ ইসলামিক থিওলজি। এটা হলো আশারিয়া লাইন অফ থট। আমি আশারিয়া চিন্তাধারার লোক।

যুক্তির লাগাম টানাও যে ক্ষেত্রবিশেষে যুক্তিরই দাবী, মুতাজিলারা সেটি ভুলে গিয়েছিলেন। ওভারঅল। যার কারণে তৎকালিন ফকিহদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মুলধারার আলেমরা যখন কোমার বেঁধে ফিলসফির বিরোধিতা করা শুর করলেন তখন এথিস্ট বা অজ্ঞেয়বাদী বা নাস্তিকরা বুদ্ধিবৃত্তির মাঠ দখল করে নিলো।

নাস্তিকেরা, ইন জেনারেল, বিজ্ঞানবাদী। তারা ফিলসফি পছন্দ করে না। আস্তিকেরা যেহেতু ফিলসফির চর্চাকে নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে তাই নাস্তিকেরা বলছে, ঠিক আছে। লেট আস ইয়ুজ ইট। একচুয়ালি দে এবিউজ ইট।

ফিলসফি ইটসেলফ কিন্তু নাস্তিকতার কথা বলে না। ফিলসফি ইটসেলফ আস্তিকতার কথাও বলে না। ফিলসফি হলো চিন্তার একটা পদ্ধতি। দ্যা ওয়ে অব ক্রিটিকাল থিংকিং। এটাকে যে কেউ নিজের মতো করে কাজে লাগাতে পারে।

মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

Rakibul Islam Rafin: আমরা পড়ছি বা আলাপ আলোচনার সময় বলছি এবসলিউট রিয়েলিটি হলো এমন সত্তা যার ভাষা নাই আকার নাই… বাট আমরা যখন চিন্তা করি আকার নিয়েই চিন্তা করি। মাথায় আসে আমাদের চেয়ে বড় বডি। তাহলে কি আমাদের পক্ষে এবসলিউট রিয়েলিটির জ্ঞান সম্ভব না?

Mohammad Mozammel Hoque: উদাহরণ হিসেবে খুব একটা যুঁতসই বা পারফেক্ট না হলেও এ বিষয়ে আকাশ কিংবা সাগরের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।

আমরা সাগরের বিশালত্ব সম্পর্কে জানি, কিন্তু এক্সেক্টলি এটা বুঝতে পারি না, এটা কতটুকু বড়। আমরা আকাশের বিশালত্ব আমাদের মত করে দেখি বটে, কিন্তু এটা যে কতটা বড়, ঠিক তা বুঝতে পারি না।

আমাদের সসীমত্বের বিপরীতে আমরা অসীমতার ধারণা করি বটে, কিন্তু অসীম যে আসলে কতটুকু অসীম, এবং সেটার সঠিক তাৎপর্য কী, সেটা আসলে আমরা জানি না; এবং জানা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। অসীমসহ যে কোনো কিছুকে আমরা জানি আমাদের মত করে। আমরা আমাদের মত করে যেটা জানি সেটাকেই চূড়ান্ত মনে করা হচ্ছে যুক্তি বুদ্ধির অপপ্রয়োগ বা ঔদ্ধত্য।

এর বিপরীতে আমরা আমাদের মত করে যা কিছু জানি সেটাকে সেভাবে গ্রহণ করা সত্ত্বেও, আমরা যদি এই ধারণাটা পোষণ করি, আরো বৃহত্তর কোনো অথরিটি কিংবা কোনো চূড়ান্ত সত্তা এ বিষয়ে সম্পর্কে আমাদেরকে যা বলবে সেটা হবে অধিকতর সঠিক, এটা যদি আমরা মনে করি, এটা হল আশারিয় চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য; এবং এটাই সঠিক কথা।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *