আজ ফেইসবুকের ইনবক্সে এক আন্ডারগ্রেড স্টুডেন্ট জানতে চেয়েছে: [হুবহু উদ্ধৃত]
এই মহাবিশ্ব যদি অনন্তকাল ধরে কন্টিনিউ করে প্রশ্ন হতে পারে, পৃথিবীর জন্ম কবে হয়েছে?
উত্তর যদি হয়, পৃথিবীর জন্ম এখনও হয়নাই, কখনই হবেনা, কারণ পৃথিবীর জন্ম হওয়ার আগে অসীম সংখ্যক ঘটনা ঘটতে হবে। আর অসীম মানে যার কোনও শেষ নাই, সেই ক্ষেত্রে পৃথিবীকে অনন্তকাল জন্ম হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
কিন্তু পৃথিবীকে আমারা বর্তমান অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। . . .
তারমানে, কোনও একটা ঘটনা যদি ঘটে, বুঝতে হবে যে তার আগে অসীম সংখ্যক ঘটনা ঘটেনি, ঘটেছে সীমিত সংখ্যক ঘটনা, আর সীমিত ঘটনা মানেই, একটা শুরু আছে, তারপর ঘটনাগুলো ঘটতে ঘটতে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। সুতরাং মহাবিশ্বের অবশ্যই শুরু আছে।
. . . এই যুক্তির ফ্যালাসি বা দুর্বলতা কি হতে পারে? অথবা বিপরীত মত বা পাল্টা প্রশ্ন?
আমার উত্তর:
১. ইনফিনিটি: প্রশ্নটা মূলত: ‘অসীমত্ব’ বা ইনফিনিটির ধারণাকে নিয়ে।
২. অসীমত্বকে সংজ্ঞায়নের সমস্যা: যদি এমন বলা হয়, অসীম হলো যা সসীম নয়, আবার সসীম হলো যা অসীম নয়। এভাবে অসীমত্বের সংজ্ঞা দেয়াটা যুক্তিবিদ্যার দৃষ্টিতে চক্রক দোষে দুষ্ট। সসীম বলতে আমরা কী বুঝি, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নাই। কিন্তু ইনফিনিটি বা অসীমত্ব নিয়ে সমস্যা আছে।
৩. গণিতের সংখ্যা হিসাবে ইনফিনিটির সংজ্ঞা [Ꝏ=1=O ]: ইনফিনিটিকে সাধারণত একক ও অপরিবর্তনীয় অর্থে বিবেচনা করা হয়। এটি ধারণা ভুল। ইনফিনিটি মাইনাস ইনফিনিটি = ইনফিনিটি, ইনফিনিটি প্লাস ইনফিনিটি সমান-সমান ইনফিনিটি। ইনফিনিটি বিয়োগ এক অথবা দুই বা যে কোনো সংখ্যা সমান-সমান ইনফিনিটি, ইনফিনিটি যোগ ১ বা ২ .. = ইনফিনিটি। এভাবে অসীমত্বের সাথে কোনো কারবার করা মানে শেষ পর্যন্ত অসীমত্বেই হারিয়ে যাওয়া। ইনফিনিটি একই সাথে বহু। যেমনটা উপরে বলা হলো। ছোট ইনফিনিটি, বড় ইনফিনিটি, প্লাস ইনফিনিটি, মাইনাস ইনফিনিটি। আবার তা একক তথা এক বটে। কারণ, ইনফিনিটির যে কোনো গাণিতিক হিসাব শেষ পর্যন্ত ইনফিনিটিতেই পর্যবসিত হয়। এ যেন এক গোলক ধাঁধা। Every point is the cross-point of infinities in either directions. ব্যাপার যদি তাই হয় এক পর্যায়ে গিয়ে ইনফিনিটি, এক ও শুন্য একাকার হয়ে যায়। [Ꝏ=1=O] ইনফিনিটি সব কিছুকে, ‘সব সংখ্যা’কে ধারণ করে, অথচ (গণিতবিদদের মতে) ইনফিনিটি নিজেই একটা সংখ্যা, নিজেই একটা কিছু, যাকে আমরা Ꝏ – এই চিহ্ন দিয়ে নির্দেশ করি।। কেমন উল্টা-পাল্টা ব্যাপার, তাই না? এতো গেলো গণিতের সংখ্যা হিসাবে ইনফিনিটি’র সমস্যা।
৪. দর্শনে অসীমতার ধারণা: দর্শনের ইনফিনিটি আরও বিদঘুটে, উল্টাপাল্টা, দৃশ্যত: অসম্ভব বা স্ববিরোধী। দর্শনে এটি একাধারে মেটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যাগত, যুক্তিবিদ্যা সংক্রান্ত ও জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় বা সমস্যা। প্রচলিত জ্ঞানতত্ত্ব ও অধিবিদ্যায় একে যথাসম্ভব ও টেকনিক্যালি এড়িয়ে যাওয়া হয়। যুক্তিবিদ্যার কোনো কোনো আসপেক্টে এটি আলোচনায় আসে। সংশয়বাদীদের মূলত ‘আছে কিনা’ তা নিয়ে সংশয় পোষণ করে। তাই আছে বলার মতো নাই বলাটাকেও তারা বাড়াবাড়ি মনে করে। অর্থাৎ অসীমত্বের ধারণার প্রেক্ষিতে বা এটিকে সামনে রেখেই সংশয়বাদী (skeptics) ও অজ্ঞেয়বাদীরা (agnostics) নাস্তিকতা তথা বস্তুবাদকে স্থুল (vulgar) মতবাদ হিসাবে মনে করে। সমীম মানুষের পক্ষে অসীম ‘কোনো কিছু’কে ‘নাই’ বলাটা, তাদের মতে অসম্ভব। আর অজ্ঞেয়বাদীদের মতে থাকলেও তা (অসীম কোনো কিছু) আমাদের পক্ষে কখনোই (পুরোপুরি বা সত্যিকারভাবে, by itself) জানা সম্ভব না।
৫. ধর্মতত্ত্বে অসীমতার ধারণা: অসীমতা নিয়ে দর্শনের যত সমস্যা, ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের সমস্যাও কমপক্ষে অনুরূপ মাত্রার। ইনফিনিটির ধারণা, অস্তিত্ব বা ‘বাস্তবতা’ যেন এক ধরনের সবকিছু ভেংগে পড়ার মতো অবস্থা, kind of melting level -এর ব্যাপার। আপনার আমার সব মত, ধারণা ও ‘জ্ঞান’, অসীমত্বের সামনে এতটাই তাৎপর্যহীন যে, একে ‘নাই হয়ে যাওয়া’ হিসাবেও বলা যাবে না। অসীমত্বের মোকাবিলায় সসীম সকল কিছু অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়ায়, নিছক non-existent হয়ে পড়ে।
৬. Infinity is a must: ইনফিনিটিকে বাদ দিয়ে কোনো কিছুকে প্রমাণ করা অসম্ভব। আবার ইনফিনিটি দিয়ে যে কোনো কিছু প্রমাণ করা সম্ভব।
এই কথাটা সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। উদাহরণ হিসাবে বস্তুবাদ তথা নিরীশ্বরবাদ ও দ্বৈতবাদ বা ঈশ্বরতত্ত্বের (God hypothesis) কথা আলোচনা করা যায়।
৭. যুক্তিকে প্রমাণ হিসাবে হাজির করার গত্যন্তরহীনতা: নিরীশ্বরবাদের পক্ষে যুক্তি রয়েছে। উল্লেখ্য, ফিলোসফিতে কোনো প্রমাণ নাই। সায়েন্সেও নাই। ফিলোসফিতে আছে যুক্তি। গ্রহণযোগ্য যুক্তিকে প্রমাণ হিসাবে দাবী করা হয়। আর সায়েন্সে আছে এভিডেন্স বা পর্যবেক্ষণমূলক উদাহরণ। খণ্ডিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সুবিধাজনক (plausible) evidenceকে প্রমাণ বা pro0f হিসাবে হাজির করা হয়। যখন আমরা মনে করি বা দাবী করি যে এই এই বিষয়ে আমার বা আমাদের কাছে প্রমাণ আছে তখন আমরা মূলত আমাদের উক্ত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানতাত্ত্বিক রিপ্রেজেন্টেশানকেই প্রমাণ হিসাবে মনে করি বা হাজির করি। অর্থাৎ যে কোনো ধরনের প্রমাণ হলো আদতে একটা ধারণা বা human construct। রিয়েল ওয়ার্ল্ড বা বাহ্য জগতে কোনো প্রমাণ বসে থাকে না। রিয়েল ওয়ার্লডে আছে নিরেট তথ্য, বা কিছু ঘটনা, যাকে আমরা বস্তু বলি। যাহোক, সেটি ভিন্ন ধরনের আলোচনা।
৮. অসীমতার ধারণা বস্তবাদের পক্ষে প্রমাণ: হ্যাঁ, অসীমতার ধারণা নিরীশ্বরবাদ তথা বস্তবাদকে প্রমাণ করে। কীভাবে? বিগ-ব্যাং যে একটিই হয়েছে, এমনতো নাও হতে পারে। হতে পারে, অসীম সংখ্যক মহাবিশ্বে অসীম সংখ্যক মহাবিস্ফোরণের ফলে অসীম সংখ্যক মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে। তাত্ত্বিকভাবে এমনটা থাকার কথা চিন্তা করা অযৌক্তিক নয়। আর আমাদের এই দৃশ্যত: সুবিন্যস্ত পৃথিবী সম্পর্কে বলা যায়, ঘটনাক্রমে এমন একটা সুবিন্যস্ত পৃথিবী তৈরী হওয়ার সম্ভাবণা আসলে খুবই খুবই ক্ষীণ। নাস্তিকদের যুক্তি হচ্ছে একটি খুবই খুবই ক্ষীণ সম্ভাবণা কিন্তু নিশ্চিতভাবে (conclusively) একে অসম্ভব প্রমাণ করে না। বরং অসীম সংখ্যক সৌরমণ্ডলের অসীম সংখ্যক গঠন-প্রক্রিয়ায় এমন একটি বা একাধিক পৃথিবীর বাস্তব অস্তিত্বসম্পন্ন হয়ে উঠতে কোনো তাত্ত্বিক অসুবিধা নাই। বর্তমান নয়া নাস্তিকতার পদার্থবিদ্যাগত দুটি ভিত্তির একটি হচ্ছে এটি, অসীম সংখ্যক মহাবিশ্বের (multiverse) ধারণা।
৯. কোনো পরীক্ষণমূলক প্রমাণ নাই: আস্তিক-নাস্তিক কারো কাছেই কিন্তু জগত সৃষ্টির কোনো প্রত্যক্ষ বা পরীক্ষামূলক প্রমাণ নাই। কারণ, জগতের ভিতরে অন্তরীণ থেকে জগত সম্পর্কে কোনো overall বা holistic মন্তব্য করা সম্ভব নয়। খণ্ডিত সামর্থ্য দিয়ে অখণ্ড জ্ঞান অর্জন করা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? এটি ontoligically বা তত্ত্বগতভাবে অসম্ভব। খণ্ডিত দৃষ্টিভংগী নিয়ে সামগ্রিক ও সঠিক ধারণা নির্মাণ করতে যাওয়া আমি অনুচিত বলছি না। বলছি, এটি প্রমাণের দাবীর সকল চাকচিক্য সত্বেও আদতে পরোক্ষ জ্ঞান মাত্র। জ্ঞানের যে নিশ্চয়তার শর্ত, তা কোনো মানবীয় জ্ঞানেই বর্তমান থাকা অসম্ভব। অপরদিকে নিশ্চয়তা ছাড়া জ্ঞানও হবে না। তাই, সব জ্ঞান-দাবী ই শেষ পর্যন্ত তালেগোলে বা quasi ধরনের। এই কারণে Burden of Proof যার ওপরই চাপায় সেই ধরা খায়। যার কারণে উভয় পক্ষ অপরপক্ষের খুঁত বের করার জন্য যতটা উদগ্রীব নিজেদের তত্ত্বকে পূণর্গঠন বা পরিবর্তনের জন্য ততটা আগ্রহী হয় না।
১০. পদার্থবিদ্যার নিয়মাবলী হচ্ছে চিরন্তন – এই কথাটির ব্যাখ্যা: নাস্তিকদের আর একটা অস্ত্র হলো কোয়ান্টাম ফিজিক্স। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতে, everything out of nothing। absolutely nothing। তাদের মতে, কোয়ান্টাম ফ্লাক্চুয়েশানের মাধ্যমে ভর, যাকে আমরা বস্তু হিসাবে জানি, তা তৈরী হয়। এর জন্য দায়ী হলো পদার্থবিদ্যার নিয়মাবলী যা আদি, অকৃত্রিম ও অপরিবর্তনীয়। এই দৃষ্টিতে rules of physics ই হলো মূল ব্যাপার। বিজ্ঞানবাদীদের মতে, এসব নিয়ম-কানুন মানুষ যত বেশি করে ও যত ভালোভাবে জানতে পারবে ততই সে নিজের অস্তিত্বসহ প্রকৃতিকে অধিকতর সঠিকভাবে জানতে পারবে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে পারবে। কথা হলো, এই rules of physics কোত্থেকে এসছে? একজন naturalistic atheist এর কাছে এই প্রশ্নের অত্যন্ত সহজ উত্তর হচ্ছে, rules of physics existed for ever … !! দেখুন, ইনফিনিটির ধারণ এখানে তাদেরকে theory of everything হিসাবে সার্ভিস দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, কোনো না কোনো থিওরি অভ এভরিথিং এর আলোকেই মানুষ তার জ্ঞান-সৌধকে নির্মাণ করে। আর, যে কোনো থিওরি অভ এভরিথিং -এর শেকড় ইনফিনিটির ধারণায় প্রোথিত।
১১. অসীমতার ধারণা আস্তিকতাকে প্রমাণ করে: মজার ব্যাপার হলো এই ইনফিনিটির ধারণাকেই কাজে লাগিয়ে একজন আস্তিক তার ঈশ্বরতত্ত্বকে হাইপোথিসিস হতে উত্তরণ করে প্রমাণে উন্নীত করতে পারে। এক কথায়, অসীমত্বের ধারণা হলো ঈশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্বের (deity theology) পক্ষে বহুল ব্যবহৃত অকাট্য যুক্তি বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ। কীভাবে? একজন নাস্তিক বা সন্দেহবাদী যদি অধরা অসীমত্বকে নিয়ে ডিজকমফোর্ট ফিল না করে তাহলে অসীমত্বের সকল গুণাবলী সম্পন্ন একজন ঈশ্বর কেন কোনো আস্তিকের জন্য সমস্যার কারণ হবে? অন্ততপক্ষে এ ধরনের একজন philosophical God নিয়ে তো সমস্যা থাকার কথা না।
১২. ঈশ্বর ও প্রাকৃতিক আইন: আস্তিকের মতে, God is the embodiment of the (already known and yet to be known) rules of physics। ইসলাম ধর্মের মৌলিক গ্রন্থসমূহে তথা কোরআন ও হাদীসে আল্লাহ তায়ালা কখনো কখনো সৃষ্টিকর্তা, নিয়ন্ত্রণকর্তা বা উর্দ্ধতন অথরিটি হিসাবে নিজেকে প্রকৃতির সাথে আইডেন্টিফাই করেছেন। যেমন, সময়কে গালি দিতে নিষেধ করা। ইত্যাদি। নাস্তিকের প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক নিয়মাবলীই হচ্ছে আস্তিকের ঈশ্বর বা ঐশ্বরিক নিয়মাবলী (Divine Commands)।
১৩. তত্ত্বমূলক যুক্তিগত প্রমাণ হলো দু’ধারী তলোয়ারের মতো: আস্তিকদের TE (theory of everything) হলো God, আর নাস্তিকদের TE হলো তাদের ভাষায় mother nature। অথচ, God ও ‘mother nature’ উভয় নোশনেরই ontological implication সমান। নাস্তিকের কাছে multiverse, black matter ইত্যাদি ধরনের বিষয়গুলো আপাত:দৃষ্টিতে নিতান্তই উল্টাপাল্টা (bizarre) মনে হলেও সেগুলো তাদের বিবেচনায় maximally great and most perfect at the highest level। এটি হচ্ছে ontological argument বা তত্ত্ববিষয়ক যুক্তির মূল কথা। আস্তিকের কাছে ঠিক এগুলোর সমন্বয়ই হচ্ছে ঈশ্বর, এগুলো ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্য অথবা কাজের ধরন।
১৪. দার্শনিক দিকে থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবণাই বিদ্যমান আলোচনার ফোকাস: আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন কোনো personal God থাকতে পারে কিনা, সেটি ভিন্ন আলোচনা। উল্লেখ্য, ধর্মীয় ঈশ্বর হচ্ছেন ব্যক্তি-ঈশ্বর। ব্যক্তি-ঈশ্বরের সম্ভাবণাকে ‘নাকচ’ করলেও philosophical Godএর ধারণা রয়ে যায়। এখানে ঈশ্বরের দ্বিতীয় ধারণাটিকেই ফোকাস করা হচ্ছে।
১৫. অসীমতার ধারণার উৎস কী? অসীমতার ধারণা কোত্থেকে আসলো যদি আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণভাবে বস্তুনির্ভর (empirically confined) ই হয়? অসীমতার ধারণা যদি ভুলও হয়, তাহলেও প্রশ্ন থাকে, এই ভুল কেনো হলো? একে শোধরানোর উপায় কী? গণিত ও দর্শনের কাছে এর কোনো সমাধান নাই। এ পর্যায়ে এসে ধর্মতত্ত্ববিদদেরও খুব খুশী হওয়ার কারণ নাই। কেননা, philosophical absolute বা পরম অর্থে গড আর ধর্মপ্রস্তাবিত personal God এক জিনিস নয়। ধর্মের পক্ষের লোকদের দাবী হলো, ব্যক্তি ঈশ্বরের ধারণা বা অস্তিত্ব, নিরপেক্ষ বা ফিলোসফিক্যাল গডের ধারণা বা অস্তিত্বের অনিবার্য্য বা যৌক্তিক পরিণতি (necessary or logical implication)।
১৬. নাস্তিকতা ও আস্তিকতা দুটোই গ্রহণযোগ্য যুক্তিনির্ভর: নাস্তিকতাবিরোধীরা মনে করে, নাস্তিকতার পক্ষে কোনো যুক্তি নাই। যা সম্পূর্ণ ভুল। আবার আস্তিকতাবিরোধীরা মনে করে, ঈশ্বরবিশ্বাসের কোনো যুক্তি নাই। এটিও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাহলে কি একই সাথে এই দুটি পরষ্পরবিরোধী ধারণা বা দাবীই সঠিক? আমার মতে, যুক্তির বিচারে ব্যাপারটা তা-ই। উভয়দিকেই সমান যুক্তি। ইনফিনিটির ধারণা এই পরষ্পরবিরোধী পক্ষকে সমানভাবে যুক্তি সরবরাহ করে যাচ্ছে। পরিস্থিতি হলো আমার দৃষ্টিতে একটি সত্যিকারের প্রতিসমস অবস্থা (a perfectly counter-balanced situation) ।
১৭. আমার ব্যক্তিগত অবস্থানের ব্যাখ্যা কী? আমার অধিকাংশ আস্তিক পাঠকগণ এ পর্যায়ে এসে আমার ইন্টিগ্রিটি নিয়ে সত্যিই কনফিউজড হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই? আপনার বিভ্রান্তি দূর করার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি না। তবে নিম্নের দুটি বিষয়নিয়ে ভাবতে বলছি। পবিত্র কোরআনের সুরা বাকারার ২৬নং আয়াতের একটা অংশ হচ্ছে, ইউদিল্লু বিহী কাছি-রা, ওয়া ইয়াহদি বিহী কাছি-রা। এর অর্থ হচ্ছে “এরই মাধ্যমে আমি অনেককে পথভ্রষ্ট করি আবার অনেককেই সঠিক পথ দেখাই।” এর পরের বর্ণনা হচ্ছে, কাদেরকে আল্লাহতায়ালা পথভ্রষ্ট করেন তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা। দেখুন, একই বস্তুজগতের মধ্যে বসবাস করে, একই অভিজ্ঞতা লাভ করে মানুষ পরষ্পর বিরোধী তত্ত্ব নির্মাণ করে, সেগুলোতে অভ্যস্ত হয়, এমনকি তার ‘প্রমাণিত সত্যে’র জন্য ত্যাগও স্বীকার করে।
১৮. কোরানিক যুক্তির মূলকথা: দুনিয়ার জীবনে আল্লাহ তায়ালা যুক্তিকে আপাত:দৃষ্টিতে বা বাহ্যত: সমান করে দিয়ে রেখেছেন। মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এখনকার অদৃশ্যগুলো সব মূর্ত হয়ে উঠবে। আল্লাহর সত্ত্বা ব্যতিরেকে সব জাগতিক গায়েব নিরেট অভিজ্ঞতা বা demonstrative proof হিসাবে প্রতিভাত হবে। সেদিনই আসলে পূর্ণাঙ্গভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠা হবে। এর আগ পর্যন্ত আমাদের যার যার প্রবণতা (aptitude বা tendency) অনুসারে আমরা প্রত্যেকে নিজের যুক্তি, প্রমাণ ও (গ্রহণযোগ্য) তত্ত্ব খুঁজে পাবো বা তৈরী করে নিবো। এ টুকু স্বাধীনতা আল্লাহতায়লা এ দুনিয়ায় আমাদেরকে নিয়েছেন।
১৯. মার্ডার কেইস একজামপল: একই তথ্য যে সম্পূর্ণ বিপরীত এভিডেন্স ও প্রমাণ হাজির করতে পারে তা বুঝানোর জন্য আমি আমার ফেভারিট একটা উদাহরণ উদ্ধৃত করবো: ধরুন কেউ ছুরিকাঘাতে নিহত হলো। নিহত ব্যক্তির পাশে রক্তমাখা ছুরি হাতে একজনকে পাওয়া গেলো। এইটুকুন তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত ব্যক্তিকে আপনি হত্যাকারীও সাব্যস্ত করতে পারেন, আবার তাকে উদ্ধারকারীও সাব্যস্ত করতে পারেন। এই খানে হয়তোবা আরও কিছু অতিরিক্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা একটা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি। কিন্তু সব বিষয়ে আমরা পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পাই না। অথচ বিষয়গুলো এমন যে এগুলোকে আমরা বাস্তবে উপেক্ষাও করতে পারি না। এমনকি, কোনো সিদ্ধান্ত নেবো না, এই অবস্থানটিও আমাকে-আপনাকে উক্ত বিষয়ে কোনো না কোনো অবস্থানে চিহ্নিত করে। ব্যাপারটা যেন তরমুজের উপর ছুরি বা ছুরির উপর তরমুজ পড়ার মতো। জগত ও জীবন সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্নগুলো এমনই নাছোড়বান্দা টাইপের …!!
২০. বিষয়ভেদে প্রমাণ-পদ্ধতি: সবশেষে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। একবার ট্রেনে করে একজন গণিতবিদ, একজন পরিসংখ্যানবিদ ও একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী একসাথে যাচ্ছিলেন। তারা ট্রেনের জানালা দিয়ে লম্বা লম্বা ডোরাকাটা একটা অস্ট্রেলিয়ান গরু দেখলেন। তখন কসমোলজিস্ট মহোদয় বলে উঠলেন, দেখো দেখো, অস্ট্রেলিয়ার গরুগুলো এ রকম ডোরাকাটা চামড়ার। তখন পরিসংখ্যানবিদ সেটি সংশোধন করে বললেন, না ভাই, এমনটা বলা যাবে না। বরং বলো যে, অস্ট্রেলিয়ার অধিকাংশ গরু এ রকম ডোরাকাটা চামড়ার। এ পর্যায়ে গণিতবিদ গম্ভীর হয়ে বললো, শোন, তোমরা দু’জনেই বিষয়টাকে অতি-সরলীকরণ করে দেখছো। তারচেয়ে এটুকু বলো যে, অস্ট্রেলিয়ার অন্তত:পক্ষে একটা গরু এ ধরনের ডোরাকাটা চামড়ার। গণিতবিদের ভাগ্য ভালো যে, আমরা অনেক গরু দেখি। কাউকে যদি একটামাত্র গরু দেখে মন্তব্য করতে বলা হতো সে আদৌ গরুকে গরু বলতো কিনা, কে জানে …. !!!
২১. Infinity Dilemma: অসীমতার ধারণাকে জানার চেষ্টা হচ্ছে এমন কোনো গরুর রচনা লেখোর চেষ্টা করা যাকে বা যার অনুরূপ কোনো প্রাণী কেউ কখনো দেখেনি …। এবার বুঝুন ……
এই ডকুমেন্টারিটা আমার কাছে বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে:
আপনার লেখাটি ভালো লাগলো। অনেক পরিশ্রমী ও আমি বলবো মৌলিক লেখা। আপনি একটি যৌক্তিক দিক থেকে হাজার বছরের সমস্যাকে বিচার করেছেন। মৌলিক অংশটি হলো মুদ্রার দুই পিঠের অস্তিত্বকে স্বীকার করা। একই মুদ্রার দুই পিঠের একটি আমি দেখি আর আপনি অপরটি দেখা। আপনি কোন একটি পিঠকে দেখলেও আপনার জ্ঞান এ অপরটিও আছে।
১৬ নম্বর পর্যন্ত আপনার সকল বিশ্লেষণ আমাদের অর্জিত জ্ঞান ভিত্তিক। কমপক্ষে, আমি বলতে পারি যাকে আমরা প্রচলিত জ্ঞান বলি। একে স্বীকার বা অস্বীকার যাই করুন না কেন, আপনার যৌক্তিক বিশ্লেষণ সেই আপাত ও এখনও পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান নিয়ে। ১৭ ও ১৮ নম্বরে এসে দেখা যায়, আপনি কোরআন এর বক্তব্যকে জ্ঞান হিসেবে মেনে নিচ্ছেন যার সাথে আপনার পূর্ব আলোচনার কোন যোগ নেই। এবং সেই কোরআন থেকেই আপনি শুধু বর্তমান নয়, অতীত ও ভবিষ্যৎ অনুমানকে নিশ্চিত বলেই দাবী করলেন। আপনার এই কোরআন তথ্যকে জ্ঞান দাবী করার যুক্তি কি? সূরা বাকারাহ এর ২৬ নম্বর আয়াত?
এছাড়াও, এখানে প্রশ্ন আছে। দুই পক্ষেই সমান যুক্তি আছে, ঘটনা সত্য। কিন্তু, যুক্তির আসল কাজটা কি? যুক্তি কি আমাদের কোন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে, না কি কোন একটি যুক্তির বৈধতা প্রমাণ করাই এর কাজ? একই সাথে একই বিষয়ে দুই বিপরীত ধারণা সত্যি হতে পারে না। তাহলে, আস্তিক ও নাস্তিক এই দুই দিকের যুক্তি ঠিক হয় কি করে? এই দুই দিক একই সাথে ঠিক হয়, কারণ, অথরিটিতে বিশ্বাস। কোরআন আগে থেকে বিশ্বাস করে নিলে এর সকল যুক্তিই বৈধ, এ কথা সব ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রেই সত্য।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের একজন প্রাক্তন ছাত্র।