যারা অনুবাদের কাজ করেন তারা অদ্ভুত সব মন-মানসিকতার হয়ে থাকেন। ফিলোসফির বিভিন্ন টার্মের যেসব বাংলা উনারা করেছেন, সেগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত বিদঘুটে, দুর্বোধ্য এবং বাজে। যেমন ইংরেজি শব্দ universalization-এর বাংলা করা হয় ‘সামান্যীকরণ’। এখন আপনিই বলেন, ইউনিভার্সেলাইজেশনের বাংলা কীভাবে সামান্যীকরণ হতে পারে? সংস্কৃত ভাষায় ইউনিভার্সালকে বলা হয় সামান্য। সে হিসেবে universalization-এর বাংলা করা হয়েছে সামান্যীকরণ হিসেবে। এভাবে আরো কত পিক্যুলিয়ার সব বাংলা যে করা হয়েছে তা আর বলতে…!
Infinite regress-এর অনুবাদ করা হয়েছে ‘অনাবস্থা দোষ’ হিসেবে। অথচ এটির অনুবাদ যদি করা হতো ‘অন্তহীন পরম্পরা’, তাহলে যে কেউ চট করে বুঝে যেত যে আসলে সেখানে কী বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এভাবে যদি দেখি তাহলে আমরা দেখবো, ফিলোসফির বাংলা যে ‘দর্শন’ করা হয়েছে সেটাও এই ধরনের অদ্ভুত ধারণার বশবর্তী হয়ে করা হয়েছে।
যুগে যুগে পণ্ডিতেরা নানা ধরনের অনাবশ্যক পাণ্ডিত্য করে গেছেন, যেগুলার দায় নিতে হয়েছে পাঠক এবং সমাজকে। চিন্তার বাহন হিসেবে ভাষার যে দুর্বোধ্যতা সেটার দায় কোনোক্রমে সাধারণ মানুষের নয়। বরঞ্চ চিন্তাশীল, চিন্তাবিদ তথা বুদ্ধিজীবীদের। নতুন কিছু করার ব্যাপারে অনীহা এবং যা আছে তা চলুক না, এ ধরনের মানসিকতাই এ ধরনের অচলায়তন এতদিন পর্যন্ত আমাদের উপর সচল হিসেবে গেড়ে বসে থাকার মূল কারণ। এসবের অবসান হওয়া জরুরি। সেজন্য এসব কিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। ভয়েস রেইজ করতে হবে।
অনুবাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের অতিশুদ্ধবাদিতার পিছনে এক ধরনের হীনমন্যতাবোধ কাজ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক ধরনের সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সিটিও কাজ করে। আমি যে কোনো ধরনের পিউরিটানিজমের বিরোধী। হোক সেটা linguistic puritanism or political puritanism or cultural puritanism। any kind of puritanism is a form of extremism and psychological complexity, no matter it is inferiority complexity or it is superiority complexity.
সব ধরনের মানসিক রোগ থেকে নিজেকে মুক্ত দেখতে চাই। অন্যদেরকেও দেখতে চাই সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক চিন্তাধারার অনুসারী হিসেবে। ভাষাগত জটিলতার আর একটা ধরন বা ফর্ম হলো নানা ধরনের বর্ণ এবং ব্যাকরণের কড়াকড়ি। এগুলো এক ধরনের কৌলিন্যবোধ বা আভিজাত্যবোধ হতে উদ্ভূত। এমনটি হওয়া মোটেও উচিত নয়।
আগেকার সময়ের জ্ঞানীগুণীরা মনে করত, জ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে সাধারণ লোকদের প্রবেশাধিকার না থাকাই ভালো। সেই জন্যই তারা অবাধ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নানা ধরনের কৃত্রিম বাধা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। বোম্বাস্টিক সব পরিভাষা চালু করা এই ধরনের মন-মানসিকতার পরিচায়ক।
আমার ইচ্ছে করে একেকটা পাঠ্যপুস্তক ধরে ধরে এ ধরনের অপ্রচলিত, উদ্ভট এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুল অর্থ প্রকাশকারী পরিভাষাগুলো সংশোধন করি। আমার স্টুডেন্টদেরকে আমি প্রায় সময় সেসব বিষয়ে বলে থাকি। যা হোক, দেখা যাক, কী হয়। সময় পেলে, আল্লাহ দিলে, কোনো সময়ে এই পরিভাষা সংস্কারের বিষয়ে কিছু কাজ করার ইচ্ছা আছে। ভালো থাকেন।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Afnan Hasan Imran: কার্ল মার্ক্সের মতে, জীবন ও জগতকে সামগ্রিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাই দর্শন। দর্শনের ইতিহাস প্রাচীন, তবে ঠিক ততটা প্রাচীন নয় যতটা প্রাচীন মানব উৎপত্তির ইতিহাস। মানুষের চিন্তা বিকাশের কোনো এক স্তরে দর্শনের উৎপত্তি। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী ধোয়াশার জগৎ নিয়ে দর্শনের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে জীবন ও জগতের উথাপিত নানা প্রশ্নের সমাধানে philosophy এক ধরনের ‘দৃশ্যকল্প’ তৈরি করে। ‘দৃশ্য’ শব্দের মধ্যে জীবন ও জগতচিন্তার যে ভাবের ব্যাঞ্জনা তাকে প্রাধান্য দিয়ে যদি philosophy’র ভাবার্থ হয় ‘দর্শন’, তবে তাকে ভুল বলা যাবে কি?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আপনি যে ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সে ধরনের ব্যাখ্যা অনুসারে ফিলোসফির বাংলা ‘দর্শন’ হতে পারে। তবে ফিলোসফির আরো বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা, ভাষ্য বা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হতে পারে এবং আমি মনে করি সেগুলো ‘দর্শন’ হিসেবে ফিলোসফির যে অনুবাদ সেটার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত বা ক্লোজার টু দ্যা ট্রুথ। দর্শন ছাড়াও ফিলোসফির আরো অনেক বিদঘুটে বা অপ্রচলিত বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, সবকিছুর বাংলাকরণ করার চিন্তাটাই বোধহয় ভুল। সেজন্য ফিলোসফির বাংলা ফিলোসফি করাটাই বেটার।
Jahanir Jahan: আপনি যেটা বললেন সেটা তো ইংরেজি philosophy’র বাংলা উচ্চারণ!
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ, যেমন করে table-chair-এর বাংলা হলো টেবিল-চেয়ার।
Jahanir Jahan: কিন্তু দর্শনকে ‘দর্শন’ বলতে অসুবিধা কোথায়? তাছাড়া প্রতিটি ইংলিশ টু বাংলা অভিধানেও philosophy’র বাংলা তো ‘দর্শন’ই করা হয়েছে।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: প্রথম কথা হলো, দর্শনকে দর্শন বলতে অসুবিধা নাই। দর্শনকে দর্শন না বলে শুধুমাত্র দ বা ক খ গ যাই বলি না কেন, তাতে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা যে একজন স্টুডেন্টকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা, যেটাকে আমরা রোল নাম্বার বা আইডি নাম্বার বলি, সেটা দিয়ে আইডেন্টিফাই করি, তাতে অসুবিধা কী?
সুতরাং ফিলোসফি বুঝানোর জন্য ফিলোসফি বা যে কোনো কিছুই বলা যেতে পারে। সিম্বলিক্যালি বা প্রতীক হিসেবে।
আর যদি বলা হয়, অর্থ হিসেবে কী হয়? সে হিসেবে ফিলোসফির বাংলা এক অর্থে দর্শন হতে পারে। কিন্তু সেটি শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিকোণ। অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা ভিন্ন ভিন্ন আরো অনেক কিছু হতে পারে। যেটা আমি উপরের কোনো একটা মন্তব্য বলেছি।
যেমন– ফিলোসফির মূল বিষয় হলো যুক্তি। সুতরাং ফিলোসফিকে কেউ যদি যুক্তিবিদ্যা বলে সেটাও সঠিক। ফিলোসফির মূল বিষয়টা জ্ঞান। সেজন্য ফিলোসফিকে কেউ যদি জ্ঞানবিদ্যা বলে সেটাও সঠিক। ফিলোসফি হচ্ছে একটা তাত্ত্বিক বিষয়। সে হিসেবে একে কেউ যদি তত্ত্ববিদ্যা বলে সেটাও সঠিক।
এভাবে ফিলোসফির আমরা অনেকগুলো কাছাকাছি সংজ্ঞা বা অর্থ বা নাম নির্ধারণ করতে পারি। আসলেই কোনটা সঠিক, সেটা আমরা কীভাবে ঠিক করবো?
দ্বিতীয়ত: ডিকশনারি বা অভিধানে ফিলোসফির বাংলা দর্শন করা হয়েছে, এটি তো কোনো যুক্তি নয়। এই ডিকশনারি যারা লিখেছেন তারা কারা? কীসের ভিত্তিতে তারা সেটা করেছেন? কোনো কিছু কি আমরা শুধুমাত্র এজন্য সঠিক মনে করি যে সেটা কোনো বইয়ে লেখা হয়েছে বা কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বলেছেন? এটা সঠিক কি না?
না, এটি সঠিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র বা ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে কোনো কিছু শুনে সেটাকে সঠিক হিসেবে গ্রহণ করলেও সব ক্ষেত্রে সেটি সঠিক হয় না। সেটি আমার নিজস্ব যে ফিল্ড তথা জ্ঞানতত্ত্ব, এর আলোচ্য বিষয়।