আজ বিকেলে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে গোলপুকুরের দিক থেকে আসছিল। দেখলাম, একজনের হাতের কনুইয়ের ভিতর দিয়ে আরেকজনের হাত। মেয়েটা আমাদের পাশের বাসার সামনে এসে ছেলেটাকে বললো, ‘এই, আমাকে ওই ফুলটা নিয়ে দাও।’
ছেলেটা ওই বাসার গেইটের দিকে অগ্রসর হওয়ার উপক্রম হতেই আমার পাশে দাঁড়ানো গার্ড তাদেরকে নিষেধ করে ডাক দিল। তৎসত্ত্বেও ছেলেটা একটা ফুল ছিঁড়ার জন্য দারোয়ানকে অনুরোধ করল।
আমি ছিলাম আমার বাসার সামনে। যেখানে ফুলের বেড তৈরীর কাজ করছিল একটা ছেলে। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিলাম। আমি তাদেরকে ডাকলাম। প্রথমে নিজের পরিচয় দিলাম। এরপর ওদের পরিচয় নিলাম। বললাম, ‘এটা তো বাসাবাড়ির এলাকা। ফ্লার্টিং করার জায়গা নয়।’
তখন ছেলেটা আমার সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু করে দিলো। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভালবাসা কি অপরাধ?’
আমি বললাম, ‘ভালবাসা অপরাধ কিনা সেটা নিয়ে তোমার সাথে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। তবে যেখানে সেখানে, বিশেষ করে আবাসিক এলাকার রাস্তায়, অবাধে ভালবাসার চর্চাকে অশোভন কাজ বলে মনে করি।’ সে তো নাছোড়বান্দা।
বলল, ‘প্রগতিশীল শিক্ষকরা এমনটি করে না।’ আরো অনেক কথা। এক পর্যায়ে তারা, ‘এগুলো টিচার….’ ইত্যাদি বলে বকতে বকতে পূর্ব দিকে চলে গেল।
তারা যাওয়ার পরে গার্ড আমাকে বললো, ‘স্যার, আগের ভিসির আমলের ঘটনা। কয়েকজন ছেলে আর মেয়ে একসাথে জীববিজ্ঞান অনুষদের দক্ষিণে অবস্থিত পুকুরে গোসল করছিল। রাত ৩টার সময়ে। গার্ডদের থেকে খবর পেয়ে প্রক্টর অফিসের লোকজন গিয়ে সেখান হতে তাদেরকে ‘উদ্ধার’ করেছিল।
রাতের বেলায় ভালবাসাপ্রবণ স্টুডেন্টদের অশোভন ভালবাসা চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সেন্ট্রাল ফিল্ডের চারিদিকে কিছু এক্সট্রা ফ্লাড বাতি লাগানো হয়। বছর কয়েক আগে। তাতেও ভালবাসাতৃষিত যুগলদের ভালবাসা চর্চাকে রোধ করা যায়নি। এমনকি শীতের রাতে তাদের কেউ কেউ সেখানে কম্বলও নিয়ে যায়। বলল সেই গার্ড।
আমি ভাবলাম, অসুবিধা কী? বেরসিক মশককূলের নির্লজ্জ কামড়ের সাথে সাথে তাদেরকে কি শীতের কষ্টও সহ্য করতে হবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের বরং উচিত সেখানে কিছু অস্থায়ী তাবু আর ওয়াশরুম স্থাপন করে দেয়া।
ফ্যাকাল্টি জুড়ে সব ডিপার্টমেন্টে এখন পরীক্ষা চলছে। এরই সাথে চলছে ছাত্রছাত্রীদের গানবাজনার নানা পদের অনুষ্ঠান। প্রতিদিন। আমি হলফ করে বলতে পারি, একাডেমিক বিল্ডিংয়ের ভিতরে এবং নিকটবর্তী এলাকায় দুনিয়ার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এত গানবাজনা রং তামাশা ঢোল বাদ্য হয় না।
ক্লাস-পরীক্ষায় কোনো ডিস্টার্ব হলে আগে দেখেছি প্রক্টর অফিসে খবর দেয়া হতো। অভিযোগ পাওয়ামাত্র তারা সেখানে গিয়ে হাজির হতো। হইচই থামাতো। এমনকি সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারপারসনকে বললে তিনি গিয়ে স্টুডেন্টদের সামলাতেন। এখন সে সবের বালাই নাই।
চবি জিরো পয়েন্টের সাথে লাগোয়া রেল স্টেশনের নিচের দিকে রেলওয়ের জায়গাতে এখন বাহারি নামের অসংখ্য দোকান হয়েছে। এ’গুলোর অনেকগুলো দিনের বেলাতে খোলেই না। সেগুলো জমে উঠে রাত ১০টা-১১টার পরে। চলে ভোররাত পর্যন্ত। কেউ কিছু বলে না।
ফরেস্ট্রির এক সিনিয়র শিক্ষক একদিন ফজরের ওয়াক্তে দক্ষিণ ক্যাম্পাসস্থ নিপবন শিশু নিকেতনের পাশের যাত্রী ছাউনিতে দু’জন ভালবাসাপ্রবণ স্টুডেন্টকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখলেন। তাদেরকে কিছু একটা বলার পরে তারা উনার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। তিনি নিজের পরিচয় এভাবে বললেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য।’ ভালবাসাপ্রবণ শিক্ষার্থী-যুগল উনার মুখের ওপর বলে দিলো, ‘আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য।’
উল্লেখ্য, ঐ শিক্ষক প্রগতিশীল শিক্ষক রাজনীতির সাথে জড়িত। কিছুটা ব্যাকআপ আছে বলেই হয়তো তিনি ওদেরকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস করেছিলেন। ওই শিক্ষক নিজের মুখে ঘটনাটা আমাকে বলেছেন।
কেউ কেউ আমার মতামত জানতে চায়, ‘মেয়েরা কেন এখন সংসারমুখী হচ্ছে না?’
আমি তাদেরকে বলি, উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা গড়পরতা কমপক্ষে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত যেভাবে চলে, যা কিছু শিখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডমিনেন্ট কালচারাল এনভায়রনমেন্ট হতে যে ‘মূল্যবোধের’ সবক তারা দিবারাত্রি গ্রহণ করে, অথবা passive smoking-এর মতো করে অপসংস্কৃতির যেসব বিষবাষ্প তারা গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়, এসব কিছুর সাথে ট্রাডিশনাল জেন্ডার রোল নির্ভর পারিবারিক জীবনকাঠামোর তো কোনো সম্পর্ক নাই।
কাউকে আপনি পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত উত্তর দিকে চলার ট্রেনিং দিয়ে ছাব্বিশ বছর বয়সে তো তাকে দক্ষিণের যাত্রী বানাতে পারবেন না। আমরা কীসের থেকে কী আশা করছি?
চবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় একটানা বসবাসকারী শিক্ষক হিসেবে আমি সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। গত তিরিশ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সরি টু সে, প্রচলিত পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতিটি অনুষঙ্গকে এখানে ‘ধর্ষণ’ করা হয়। পঙ্গু করে দেয়া হয় গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল বাবা-মায়ের আদরের সন্তানটির সহজ-সরল মনন ও মানসিকতাকে।
তারপরও এখানে মূল্যবোধ আছে। যা আছে তা বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজের মধ্যে আমাদের যে শেকড় এখনো রয়ে গেছে, তারই কারণে।
শুনি এমন কথা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস নাকি এখন চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় অবৈধ মাদক সেবন কেন্দ্র। চোখে দেখি, পুরো চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত প্রেমিকযুগল চবি ক্যাম্পাসে আসে নিরাপদে সময় কাটানোর জন্য।
আমাদের স্টুডেন্টদের থেকে এসব বহিরাগতারা অনেক বেশি ডেসপারেট। তারা মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় মানে তো এমনই। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তাদের মধ্যে এমন ভুল ধারণা তৈরি হওয়ার জন্য কারা দায়ী?
চবি মেডিকেল সেন্টারে মধ্যরাত থেকে ভোররাতে ছেলে আর মেয়ে একসাথে যায়। তাদের নির্দিষ্ট কোনো রোগ নাই। ডাক্তারকে বলে, ‘আমার, বা ওর দুর্বল লাগছে। প্রেশারটা মেপে দেন।’ ডাক্তারদের মুখেই শোনা।
আমার পরিচয়ের সাথে এমন কথা মানায় না। তবুও পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেছে সেটা বোঝানোর জন্য বলতে হচ্ছে। সাধারণ গ্রামবাসী আর কর্মচারীদের কেউ কেউ ছেলেমেয়েদের বেপরোয়া ভালবাসা চর্চা দেখে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘একি বিশ্ববিদ্যালয়? এতো বেশ্যাবিদ্যালয়।’ শুনতে আমার খুব খারাপ লাগে। আমায় ক্ষমা করবেন।
বিশেষ করে আমি ক্ষমাপ্রার্থী ট্রিপল ই’র সেই ছাত্রটির কাছে, আমার বাধার কারণে আজ বিকেলে সে তার ভালবাসার মানুষটিকে একটা তাজা ফুল ছিঁড়ে দিতে পারে নাই। ভালবাসার মানুষের আবদার মেটানোর জন্য মানুষ তো জীবন পর্যন্ত বাজি ধরে। তাই না?
আমি না থাকলে সে ঠিকই হয়তো সেই ফুলটা ছিঁড়ে তার ভালবাসার মানুষকে দিতো। আমি থাকার কারণেই দারোয়ান তাকে বাধা দেয়ার সাহস করেছে। খুব সম্ভবত।
ডিউটিরত গার্ডই বললো, ‘স্যার, ওরা যদি কয়েকজন হতো তাহলে আপনাকে এত সহজে ছেড়ে দিতো না।’ ভাবলাম, কে যাবে ছাত্রদের হাতে মার খেতে? হোক বা না হোক পড়ালেখা, এগিয়ে যাক ভালবাসা।
আমরা কি এমন বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলাম?
মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: “I have not seen such open culture in the USA. They at least maintain integrity in academic buildings and library and as such.” —Md Mohsinur Rahman Adnan
Moinul Islam Nishat: বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বিজ্ঞানের ছাত্র, নিশ্চয়ই তার মাথায় বিজ্ঞানের অনেক জটিল সমীকরণ রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মূল্যবোধ নামক চিরন্তন ধারণার ধারে কাছেও নেই। অপরাধ বোধের বালাই পর্যন্ত নেই। একজন সম্মানিত শিক্ষকের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে সে জানেই না বলে মনে করি। খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে সে তার প্রেমিকা, পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথেই অপ্রত্যাশিত আচরন করে। বিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ আয়ত্ত করলেও তবে কেন মূল্যবোধের সহজ সমীকরণ আয়ত্ত করতে পারছে না?
বস্তুত এই দৃশ্য দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ক্ষেত্র বিশেষে স্কুল লেভেলে। বহু শিক্ষার্থীর এই ধরনের অবক্ষয় (ব্যাধি)। এই অবস্থা হতে উত্তরণের সহজ সমাধান কী হতে পারে?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: ওর বাবা নাকি একটা সরকারি কলেজের শিক্ষক। আমি তখন ওকে বলেছিলাম যে তুমি যদি তোমার বাবাকে এখানে কী ঘটেছে সেটা সঠিকভাবে বর্ণনা করো এবং আমি যা বলেছি সেটা সঠিক হয়েছে কিনা তাকে জিজ্ঞেস করো, তোমার বাবা কিন্তু আমার সাথে একমত হবেন।
এ কথার ব্যাপারে সে সরাসরি কিছু না বলে আমাকে বললো, প্রগতিশীল শিক্ষকরা এমনটা করে না।
kindly, sir I completely agree with you, and given that this is an old and persistent issue, I’m curious about the likely solution.