এ প্রসঙ্গে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এই ভিডিওতে আলোচনা করা হয়েছে তার অন্যতম হলো:
১. ইসলামী শরীয়াহ কর্তৃক নির্দেশিত বিভিন্ন ইবাদতের ব্যাপারে ‘সমতল পৃথিবীর ধারণার’ (flat world system) সাথে ‘গোলাকৃতির বিশ্ব ধারণার’ (global world system) পার্থক্য। ইসলামী শরীয়াহর নানা বিষয়ে সঠিক আমল কী হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে গ্লোবাল ওয়ার্ল্ড সিস্টেমই সঠিক। আমি দেখিয়েছি, এই গ্লোবাল ওয়ার্ল্ডের ধারণা স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের সাহাবীগণের সময়ও কার্যকর ছিলো এবং সে মোতাবেক শরয়ী বিধানগুলোকে অনুসরণ করা হতো।
২. প্রশ্নের চেয়েও প্রশ্নকর্তার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মূল দৃষ্টিভঙ্গি তথা প্যারাডাইমের প্রতি গুরুত্ব দেয়া এবং প্রশ্নটা যেই গভীরতর বিষয়ের সাথে রিলেটেড তা তুলে ধরা। প্যারাডাইম রিকনস্ট্রাক্ট না করে কাউকে কোনো পার্টিকুলার ইস্যু বা প্রশ্নে কনভিন্স করানো কঠিন।
৩. মানুষের লাইফ-প্যারাডাইম গড়ে উঠে দুইটা জিনিসের সমন্বয়ে। একটি হলো সব মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবে বিদ্যমান বেসিক র্যাশনাল স্ট্রাকচার। আর অন্যটি হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত জীবনবোধ বা ইনটেনশন। তাই ভিন্ন প্যারাডাইমের কারো সাথে এনগেইজ হওয়ার সময় আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত, একচুয়েলি আল্লাহ প্রদত্ত, কমন হিউম্যান র্যাশনালিটিকে অ্যাড্রেস করতে পারি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যক্তির ইনটেনশন বা নিয়ত যদি সঠিক ও শুদ্ধ হয়, সে যদি আন্তরিক হয়, তাহলে তার পক্ষে সত্যকে বুঝতে ও মানতে পারার কথা।
৪. স্যার সাইয়েদ আহমেদ খানের rational supernaturalism নিয়ে আলোচনা। র্যাশনাল সুপার-ন্যাচারালিজম হচ্ছে, রিজন ও রেভিলেশনের মধ্য যদি দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তাহলে ধরে নিতে হবে, একই উৎস থেকে উৎসরিত এই দুই জ্ঞান শাখার কোনো একটাকে বুঝার ক্ষেত্রে আমরা কোনো কারণে ভুল করেছি। এর মাধ্যমে অর্থাৎ র্যাশনাল সুপার-ন্যাচারালিজমের এই ফর্মুলা অনুসরণ করে প্রাসঙ্গিক নানা বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব।
ফেসবুক থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য
Abdullah Mamun: তাহলে কি আমরা বলতে পারি, শবে কদর কবে হবে তা নিয়ে আমাদের এত পেরশান না হয়ে হাদীস অনুসরে আমল করে যাওয়া উচিত?
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ, ঠিক তা-ই।
Abdullah Mamun: কিন্তু আমাদের কাছে এর কি কোনো ব্যাখ্যা নেই? নাকি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়?
Sourav Abdullah: আপনি কি পুরো ভিডিওটি দেখেছেন? দেখলে আশা করি ব্যাখ্যা পাবেন।
Jibon Rahman: সরি, আমি কোনো উপসংহার পাইনি, Sourav Abdullah!
একই সময়ে বেজোর রাত্রি এবং জোড় রাত্রির উপস্থিতি এবং বেজোর রাত্রিতে লাইলাতুল কদর তালাশ করার হাদীসের মধ্যে কোনো সমন্বয় আমি পাইনি! এটা আমার সীমাবদ্ধতা।
আপনি কি আমার ‘প্যারাডাইম’ বুঝতে পেরেছেন?
Sourav Abdullah: ধরেন আমাদের এখানে এখন মধ্য দুপুর, নামাজ নিষিদ্ধ। আবার অন্য জায়গায় এখন তাহাজ্জুদের সময়। এখন একই সময়ে তারা তাহাজ্জুদের সময়ের ফজিলত পাচ্ছে, আর আমরা নামাজও পড়তে পারছি না! তাহলে এখন সমন্বয় কীভাবে হবে?
এক্ষেত্রে আমরা যে যার লোকালিটিকে ফলো করবো। এটাই উপায়।
Jahid Hasan: এমন প্রশ্ন আমার মনে এসেছিলো। যেমন হাদীসে আছে– আল্লাহ শেষ রাত্রিতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন! এই ‘নেমে আসা’ কথাটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি আক্ষরিক অর্থেই তিনি নেমে আসেন, তবে বাকি সময় তিনি ঊর্ধ্বাকাশে থাকার কথা! কিন্তু এখানে একটা কন্ট্রাডিকশন তৈরি হয়। যেমন তাঁর শেষ রাত্রিতে পৃথিবীতে নেমে আসা যদি প্রত্যেক মানুষের সাপেক্ষেই হয়, তবে আল্লাহ তো কখনো পুনরায় ঊর্ধ্বাকাশে ওঠার অবসরই পাবেন না, কারণ প্রতিটি আবর্তিত সময়েই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও শেষ রাত্রি হয়ে থাকে। এখন যদি এমন হয়– আল্লাহ সর্বদা প্রথম আসমানেই থাকেন, তবে তো হাদীসে বর্ণিত আল্লাহর শেষ রাত্রিতে প্রথম আসমানে নেমে আসার ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিকই হওয়ার কথা নয়।
তাহলে আমি কীভাবে ব্যাপারটা নিয়ে ডিল করেছি? যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আমি জবাব মেলাতে পারিনি। এটার মতো অনেক উত্তরই মেলেনি। কিন্তু তবু মনটা বিশ্বাসী হয়েই থাকতে চেয়েছে। কারণ এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেক কিছুর উত্তর না জেনেই তো মানুষ প্রতিনিয়ত পৃথিবী ত্যাগ করছে! হয়তো যা এখন জানি না, তার ব্যাখ্যা আল্লাহ পরে জানাবেন। যেমনটা কুরআনে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের প্রসঙ্গে আল্লাহ ব্যক্ত করেছেন: ইহুদীরা মনে করে তারা সঠিক পথে আছে, আর খ্রিষ্টানরা ভুল পথে আছে। আবার খ্রিষ্টানরা মনে করে তারা সঠিক পথে আছে, আর ইহুদীরা ভুল পথে আছে। তাহলে তাদের মধ্যে কারা সঠিক আর কারা ভুল? আল্লাহ কি কুরআনে এ বিরোধ নিরসন করেছেন? না। তিনি বলেছেন– ‘আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন জানাবেন তাদের মধ্যে কারা সঠিক পথে ছিলো।’ অর্থাৎ এমন অনেক কিছুই আমরা পরকালে জানবো, যা নিয়ে আমরা বর্তমানে পরস্পর বিরোধে লিপ্ত আছি। তাই উত্তর না পাওয়া অনেক মেটাফিজিক্যাল প্রশ্ন নিয়ে আমি আজকাল তেমনটা অস্থিরতায় ভুগি না; বরং মনে এক ধরনের সান্তনা পাই– উত্তর আমি কোনো একদিন পাবো, ইনশাআল্লাহ।
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: আল্লাহ তায়ালা শেষ রাত্রিতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন, এ ধরনের কথাগুলো তো ইসলামের মূল যে বিষয় তথা তাওহীদের যে ধারণা, সেটার সাথে কন্ট্রাডিকশন তৈরি করে; যদি বিষয়টাকে আমরা ফিজিক্যাল ইভেন্ট বলে মনে করি।
এই ধরনের সবগুলো বর্ণনাকে নিছক রূপক অর্থে গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ উপরে যা বললাম ইসলামের যে মূল ধারণা, অবস্তুগত অনন্য-অসাধারণ ও সর্বশক্তিমান এক ঈশ্বরের ধারণা, সেটার সাথে এই ধরনের বস্তুগত বর্ণনাগুলো সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। কোরআন-হাদীসের আক্ষরিক ব্যাখ্যার এটাই হচ্ছে মূল সমস্যা।
Jahid Hasan: অবস্তুগত ঈশ্বরের স্বরূপ আসলে কেমন সেটাও তো আমাদের পার্শিয়াল নলেজের মাধ্যমে পুরোপুরি বুঝা সম্ভব নয়! সেক্ষেত্রে আপনি যেমনটা বলেছিলেন, ‘ডিভাইন এগনস্টিসিজম’, অর্থাৎ আমি তাঁকে বিশ্বাস করি, আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয় অনুভব করে তাঁর অস্তিত্ব। কিন্তু তাঁকে আমি ধারণ করতে পারি না, তাঁর জাত কিম্বা সিফাতের ব্যাপারগুলো আমার পুরোপুরি বোধগম্য হয় না! তাঁর সম্পর্কে আমরা আসলে তেমন কিছুই জানি না, শুধু জানি তিনি আছেন!