হ্যাঁ, সত্যি। শিক্ষক না হলে আমি কৃষক হতাম। কোনো এক কিষাণীর সাথে জীবন কাটাতাম। অভিজাত কিছু হতে চাইনি কখনো। তবুও হয়েছি। আসলে হতে হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে। প্রান্তজনের সঙ্গ আমার যতটা ভাল লাগে তার ছিটেফোঁটাও লাগে না কৃত্রিম আভিজাত্যঠাসা এলিটদের আশেপাশে থাকতে।

কৃষিব্যবস্থা মানবসভ্যতার সূচনা করেছে। মানুষের আদি পেশা কৃষি। অভিজাত পেশা ব্যবসা। এর বাইরে, বিশেষ করে চাকুরীর মধ্যে, নাই বিশেষ কোনো মর্যাদা, হোক সেই চাকুরীজীবী উচ্চপদের আমলা, গবেষণা-ব্যবসায়ী কিংবা কামলা।

যে ধরনের মানবিক সম্পর্ক ও মূল্যবোধব্যবস্থার আমরা অনুসারী, তা গড়ে উঠেছে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। কৃষি না থাকলে প্রকৃতি থাকবে না। থাকবে না প্রকৃতির ভারসাম্য। থাকবে না প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতার কোনো অনুষঙ্গ। কাঠামো।

২. নরসিংদীর এত মানুষের সাথে আমার পরিচয়! বিশেষ করে মাসউদুল আলম। ছাত্রজীবনে সে আমার সেন্টারে পার্টটাইম কাজ করতো। ছাত্রজীবন শেষে দশ বছর সে ‘সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্র’র নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছে। সিএসসিএস-এর সবকিছু ওর হাতে গড়া। আমার সার্কেলের সব লোক ওকে সমভাবে চিনে।

বৃহত্তর পারিবারিক প্রয়োজনে মাসুদ গত বছর নরসিংদীতে শিফট করেছে। সেখানে যাওয়ার পর ওর দ্বিতীয় সন্তান হলো। ওদেরকে দেখার জন্য গত দশ তারিখে আমরা নরসিংদীতে গিয়েছিলাম। নেক্সট টাইম আরো সময় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা। ওদের গ্রামের বাড়ি দরগাহবন্দেও যাব, ইনশাআল্লাহ।

সেই ভ্রমণ নিয়ে সিএসসিএসের গবেষণা সহকারী ফয়সাল লিখেছে—

“সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে আমরা নরসিংদী শহর ছেড়ে একটা বিলে গেলাম। যান্ত্রিক শহর ছেড়ে যতই বিলের দিকে গেলাম ততই সবুজ গ্রাম। সবুজ আর সবুজ। রাস্তার দু’পাশে ছিল বড় বড় শিমুল তুলোর গাছ। রক্তের মতো লাল ফুলে ছেয়ে আছে গাছগুলো।

একটা ক্ষেতে অনেক গুলো ধবল বক ছিল। হঠাৎ একটা উড়ে গেল দূরে কোথাও। সামনে যেতে যেতে দেখলাম এক অল্প বয়সী মা তাঁর ছোট্ট শিশুকে মাটিতে বসিয়ে মরিচ তুলছে। শিশুটি মাটি দিয়ে সারা শরীর মাখিয়ে ফেলেছে। সে আমাদেরকে দেখে একেবারেই চুপ হয়ে গেল।

বিলটি কচুরিপানায় ভরা। কৃষকরা তাদের হাঁস আনার জন্য কচুরিপানার মধ্যে বিলি কেটে রেখেছে। বিল থেকে হাঁসের পাল আসলো। সৌরভ ভাই হাঁসের, গাছের, ফসলের ছবি তোলায় ব্যস্ত। রুফাইদা মাসুদ ভাইয়ের কোলে। মোজাম্মেল স্যার দু’চোখ ভরে ফসল আর বিলের সৌন্দর্য দেখছে। তাঁর চোখেমুখে লেপ্টে আছে বিস্ময়।

বহুদিন আগে আমি একবার স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না হতেন, তাহলে কী করতেন? উনি খুব নরম তবে স্পষ্ট স্বরে বলেছিলেন, কৃষক হতাম, আদর্শ কৃষক।

আমি অবশ্য সেদিন উনার এই কথা বিশ্বাস করিনি। তবে ধীরে ধীরে তাঁর কৃষি ও কৃষকের প্রতি টান দেখে বুঝেছি সত্যি-সত্যিই লোকটা কৃষক হতো।

সন্ধ্যার অন্ধকারে ফেরার সময় ট্রেন দেখলাম। ধীর গতিতে যাচ্ছে। হালকা আলো, গিজগিজ করছে মানুষে, হকারেরা ব্যস্ত বেচা-বিক্রিতে। আমি সবাইকে বললাম, ছোটবেলা থেকে আমার মনের কোণে যে ট্রেনের ছবি সেটা এই ট্রেনের সাথে মিলে।

রেললাইনের পাশ দিয়ে যে রাস্তা সে পথেই আমরা ফিরছি। পিচঢালা ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা। শিমুল তুলোর গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অন্ধকারের কারণে ফুল দেখা যাচ্ছে না। পাশের সবুজ রঙের ক্ষেতগুলোতেও নেমেছে অন্ধকার। আমরা মোটর গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আগাচ্ছি। গল্প, হাসি, আনন্দে কেটে যাচ্ছে বেলা, কেটে যাচ্ছে জীবন। গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি….”

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *