১৯৬৬ সালের ১৮ আগষ্ট হতে হিসেব করলে ৫৬ পার হলো গতকাল। যদি বলি, আরও ৩০ বছর বাঁচতে চাই, তাহলে কি ঠিক হবে? নাকি, ৪০ বছর আরও এডিশনাল হায়াত চাইবো?
২০১১/১২ সালের দিকে হবে। চবি বাংলা বিভাগের স্টুডেন্ট, আমার তৎকালীন অধ্যয়ন সহকারী জান্নাতুল ফেরদৌস আমার লেখাগুলোকে বিভিন্ন জায়গা থেকে সংকলন ও বাছাই করার কাজ করছিল। ওকে বলা ছিল, ছোটখাট লেখা বা কমেন্টগুলোকে বাদ দিতে। একদিন সে বলল, ‘স্যার, এই লেখাটা ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। এইটা রাখি?’ আমি বললাম, ‘লেখাটা কী?’ তখন সে আমাকে শোনালো, আমার কোনো লেখার মধ্যে সে পেয়েছে,
জন্মের চেয়ে বড় বিষ্ময় আর মৃত্যুর চেয়ে বড় সত্য পৃথিবীতে নেই।
হাদিসে আছে, কেয়ামতের ময়দানে প্রত্যেকে হায়াতের জন্য আফসোস করবে। অনেক বয়োজেষ্ঠকে আমি ধমকাইছি, ‘আর বইলো না। ক’দিন আর বাঁচবো, এখন তো মরার সময় হয়ে গেছে’ – এ’ধরনের ন্যাকামি করে কথা বলার জন্য। হায়াত আল্লাহর নেয়ামত। এক মুহূর্ত বেশি বাঁচাটা বড় সফলতা। তারচেয়ে বড় সফলতা হলো সেই মুহুর্তটিকে সর্বোত্তম উপায়ে ব্যয় করার তওফিক অর্জন করা।
তাই, আমিও বেঁচে থাকতে চাই যতটা সম্ভব বেশি। চাই প্রলম্বিত নেক হায়াত। আমি একদিন মারা যাবো; নাই হয়ে যাবো; ‘আমিহীন এই পৃথিবী’ লিখে যারা নাই হয়ে গেছে তাদের মতো বিস্মৃত হবো সহসাই; এটি আমি ভাবতে পারি না। বরং ভাবতে ভাল লাগে, আমি থেকে যাবো আমার পরবর্তী প্রজন্ম, আমার চিন্তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে। আমি বেঁচে থাকবো তাদের ভালবাসায়, জীবনের পথে এগিয়ে যাবার দুর্নিবার প্রত্যয়ে। বেঁচে থাকবো তাদের জীবনবোধ, ন্যায়বোধ আর মোকাবেলার আনন্দে।
কোনো কোনো দিক থেকে আমি যে কত বড় বেকুব, তা মাঝে মাঝে টের পাই। একদিন এক ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তোমার বয়স কত? মেয়েটা আমার ঠিক সামনেই ছিল, তাই। ক্লাসে সবার মাঝে সে ইতস্তত করছিল।
মেয়েদের বয়স জিজ্ঞাসা করা যে এখানকার সোশ্যাল টেবু, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিষিদ্ধ কাজ, তা আমার হার্ডডিস্ক ঠিকমতো রিড করতে পারে নাই; অথবা, আমার মস্তিষ্কের এই অংশটা একটুখানি স্লো। সে যাই হোক, উপস্থিত স্টুডেন্টদেরকে প্রসঙ্গক্রমে বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে সেদিন বলেছিলাম,
আমাদের প্রত্যেকের বয়সের সাথে যোগ করতে হবে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের ইতিহাস। এনসেস্ট্রোল এইজ। আনুমানিক ১.৩বিলিয়ন বছর আগ থেকে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম যৌনপ্রজনন করে আসছে। সে হিসেবে, কথার কথা, আমার ব্যক্তিগত বয়স (Personal Age) এর সাথে আমার পূর্বপ্রজন্ম বয়স (Ancestral Age) যোগ করে আমার প্রকৃত বয়স (Real Age) হবে 56 + 1.3 billion years। ফর্মূলাটা হলো RA = PA + AA।
কেন আমরা তা করি যা আমরা করি, অর্থাৎ আমাদের মন-মানসিকতা ও কাজকর্মের খতিয়ান নিতে হলে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের জীবন ও অভিজ্ঞতাকে অতিঅবশ্যই আমলে নিতে হবে। আমরা চাই বা না চাই, why people do what they do – এই প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেতে হলে এভোলিউশনারি সাইকোলজি ছাড়া গত্যন্তর নাই। তাদের যাপিত জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা সহকারে আমাদের পূর্বপ্রজন্ম বেঁচে আছে আমাদের শরীরে, মনে, চিন্তায়, মন-মানসিকতায়।
জীবন-মৃত্যুর ধর্মীয় ব্যাখ্যা আলাদা। বিবর্তনবাদী মনস্তত্ত্বের এই ব্যাখ্যার সাথে সেটা সাংঘর্ষিকও নয়, (আইডেন্টিকাল অর্থে) একও নয়। বেঁচে থাকতে চায় বলেই মানুষ অবদান রাখতে চায়। এই চাওয়াটা অব্যাখ্যাত। মৌলিক। বিশ্বজনীন। এবং অপ্রতিরোধ্য।
‘Thus let me live unseen and unknown,
Thus, unlamented let me die;
Steal from the world, and not a stone
Tell where I lie.’
আলেকজান্ডার পোপের ‘অন সলিচিউড’-এর শেষাংশ। কখন পড়েছিলাম এই কলিজা মোচড়ানো কথাটুকু? সঠিক মনে নাই। কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে হবে। এরপর থেকে এটি কতজনকে যে শুনাইছি। এটি আমার মুখ থেকে শুনলে আমার ওয়াইফ খুব মন খারাপ করে।
অথচ, সেই আমি কোনো কবিতায় লিখেছি, আমার প্রিয়জনেরা, আমি চাই, তারা আমার কবরের পাড়ে দাঁড়াবে। নিরবে কাঁদবে। আমাকে স্মরণ করবে। আমার জন্য দোয়া করবে।
আসলে আমাদের যে ব্যক্তিজীবন, এটাই আমাদের আসল জীবন নয়। তাই, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য ধরে নেয়াটা মারাত্মক রকমের ভুল। আমাদের যে সামষ্টিক জীবন বা কমিউনিটি লাইফ, ভাল হোক বা মন্দ হোক, সেটাই আমাদের মূল পরিচয়। ব্যক্তিজীবন ইমপর্টেন্ট। বাট কমিউনিটি লাইফ ইজ মোর ইমপরটেন্ট। আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনে বেঁচে থাকি। ‘সংস্কৃতি আমাদের শুদ্ধ মনন’ – এই যে কথাটা বলা হয়, এটি মোর দ্যান ট্রু।
তাই দেখবেন, মানুষের সকল ব্যক্তিগত চাওয়া তার যাপিত জীবনের সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে ঘুরপাক খায়। এগেইন, সাংস্কৃতিক জীবনের নৈতিক বিবেচনা অর্থাৎ নৈতিক দিক থেকে সেটা ভাল বা মন্দ হওয়া ভিন্ন বিষয়। প্রয়োজনে নৈতিকতার দাবীকে স্বীয় সাংস্কৃতিক জীবনের ওপর অগ্রাধিকার দেয়াটা ব্যক্তির উন্নততর নৈতিক মানের পরিচয়। সংস্কৃতির সাথে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব ও এই দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের বিষয় নিয়ে অন্যসময়ে আলোচনা করা যাবে।
আজ শুধু জন্মদিনের প্রত্যাশার কথা।
আমার সন্তানদের মাধ্যমে প্রবাহিত হবে আমার শরীরী বংশধারা। অথবা থেমে যাবে। কে জানে? কিন্তু জানি, বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ধারাবাহিকতায় আমার চিন্তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বেঁচে থাকবো আমি, সত্য আর মিথ্যার এই দ্বন্দ্ব থাকবে এই পৃথিবীতে যতকাল।