ধরেন, কেউ নিজের কথাটা নিজের মতো করে বলল। আর কেউ এমন, যার নিজের কোনো কথা নাই। অথবা তিনি স্বপক্ষে অনেকগুলো রেফারেন্স নিয়ে আসলেন। কথার কথা, সরাসরি কোনো কথা না বলে তিনি ১০টা প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স নিয়ে এসছেন। আমরা ধরে নিতে পারি যে ১০জন ব্যক্তি বা ১০টা সোর্স থেকে তার কথাটাকে সাপোর্ট করা হচ্ছে। আমরা যদি বিষয় বা ইস্যুটাকে পরিমাণগত দিক থেকে যাচাই করি তাহলে নিজের পক্ষে ১০টা রেফারেন্স যিনি বলতে পারছেন নিশ্চয়ই তার কথাটাকে অধিকতর সঠিক বা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো।
এ’ধরনের রেফারেন্সনির্ভর জ্ঞানদাবীর একটা সমস্যা আছে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে জনসমর্থন কোনো শর্ত নয়। বৈধতাও জ্ঞানের অপরিহার্য শর্ত নয়। জ্ঞানের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে সত্যতা বা ট্রুথনেস। সংক্ষেপে, ট্রুথ। জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা হয়,
(১) বিষয়টা সত্য কিনা,
(২) বিষয়টা যাচাইকৃত বা জাস্টিফায়েড কিনা এবং
(৩) বিষয়টা ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটির মধ্য দিয়ে এসছে কিনা।
সাবজেক্টিভিটির শর্তপূরণ করা হয় বিশ্বাস দিয়ে। সত্যতার শর্ত অবজেক্টিভিটির মাধ্যমে পূরণ হয়। সাবজেক্টিভিটি ও অবজেক্টিভিটির এই ধরনের সম্মিলনে জ্ঞানের কোনো দাবি আদর্শনিষ্ঠ বা নরমেটিভ হয়ে উঠে।
রেফারেন্সিয়াল বনাম কনসেপ্টচুয়াল নলেজ ক্লেইমের যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ অথবা পার্থক্য সেইটার আলোকে বলা যায়, যার কথাকে ১০জন বিশেষজ্ঞ সাপোর্ট করছে সেটাই ভ্যালিড। এ’ক্ষেত্রে একটা জিনিস অনেকেই খেয়াল করে না। তা হলো, ভ্যালিডিটি এবং ট্রুথ কিন্তু এক জিনিস না। হতে পারে something could be valid or evident but not true। আবার হতে পারে, something is true but not valid or evident।
এটা লজিকের একটা একেবারে খুব এলেমেন্টারি একটা বিষয়। অর্থাৎ, সত্যতা ও বৈধতা এক না। যুক্তির জন্য সত্যতা নয়, বৈধতার দরকার। কিন্তু জ্ঞানের জন্য সত্যতা দরকার। জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় বৈধতাকে একটা শর্ত হিসেবে কেউ বলে নাই।
দুই দশকের বেশি সময় থেকে জ্ঞানতত্ত্ব পড়াচ্ছি। কোথাও সত্যতার পরিবর্তে বৈধতার কোনো আলোচনা পাই নাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সত্যতা একটা গূণগত ব্যাপার। পপুলারিটি এবং মেজরিটি দিয়ে ট্রুথ হয় না। ট্রুথনেস বাই নেচার অবজেক্টিভ। মেটাফিজিকেলি অবজেক্টিভ ট্রুথগুলোকেও হতে হয় এপিসটিমোলজিকেলি অবজেক্টিভ।
জ্ঞানতত্ত্বের ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে না গিয়ে এবার আমরা আলোচনা করবো চিন্তার ইতিহাস নিয়ে।
চিন্তা প্রবাহিত হয়। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। জাতি থেকে জাতিতে। দেশ থেকে দেশে। সময় থেকে সময়ে। কোনো বিষয়ে একজন ব্যক্তি বলে। তার পরের ব্যক্তি এসে তাকে সমথর্ন অথবা বিরোধিতা করে। এর পরের ব্যক্তি এসে প্রথম দুইজন ব্যক্তিকে সমর্থন অথবা বিরোধিতা করে। অথবা, পূর্ববর্তী কাউকে সমর্থন করে এবং কারো কারো বিরোধিতা করে। এরসাথে সে হয়তো নিজের কিছু কথা যোগ করেছে। এভাবে চিন্তার একটা ধারাবাহিকতা তৈরী হয়, যাকে আমরা বলি চিন্তার ইতিহাস।
চিন্তার ইতিহাসকে রেফার করে কথা বলা হলো ঐতিহাসিক পদ্ধতি বা হিস্ট্রিকাল এপ্রোচ। চিন্তার সিলসিলাকে প্রয়োরিটি না দিয়া চিন্তার যে বিষয় সেইটাকে প্রয়োরিটি দিয়া আলোচনা করাকে বলে বিষয়নির্ভর পদ্ধতি বা থিমেটিক এপ্রোচ।
আপনি যখন ধারাবাহিকতা বাদদিয়ে সরাসরি আলোচ্যবিষয় নিয়ে কথা বলবেন তখন হতে পারে আপনার আলোচনায় পরের লোকের রেফারেন্স আগে আসছে, আগের লোকের রেফারেন্স আসছে পরে। হতে পারে, চিন্তার ইতিহাসের নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ, এমন অনেক রেফারেন্সের প্রাসঙ্গিকতা আপনার আলোচনাতে আসেই নাই; অথচ আপনার আলোচনাটা কনসিসটেন্ট।
আমাদের এখানকার লোকেরা মনে করে, জ্ঞানের আলোচনা মানেই হলো জ্ঞানের ইতিহাস বা সিলসিলার আলোচনা। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার পর্যালোচনা ব্যতিরেকে তাদের দৃষ্টিতে জ্ঞানচর্চা অসম্ভব। এই ধরনের লোকদের বলতে শুনবেন, এ বিষয়ে ও এটা বলেছে, সে ওটা বলেছে। ইত্যাদি। এভাবে সে নানাজনের নানা কথা বলবে। এই লোকের অনেক কথার মাঝে দেখবেন, তার নিজের কোনো কথা নাই।
ফর এক্জাম্পল, ১০ জন ফিলোসফারের রেফারেন্স দিয়ে আপনি বললেন যে তারা এ’ বিষয়ে এটা এটা বলেছে। থিমেটিক এপ্রোচের একজন আমলদার হিসেবে আমি আপনাকে বিণীতভাবে বলব, ‘আচ্ছা বুঝলাম এই কথাগুলো। এবার বলেন এ বিষয়ে আপনার কথাটা কী? এই ১০জনের কথা থেকে আপনি কি পাইলেন?’ আপনি যদি বলেন, ‘আমি নাখান্দা বান্দা। আমার কোনো বক্তব্য কেন থাকবে। আমি সবাই গ্রেট মনে করি। তাই, এ’ বিষয়ে আমার নিজস্ব কোনো পজিশন বা বক্তব্য নাই।’
তখন আপনাকে আমি ততধিক বিনয় সহকারে বলবো, ‘তাহলে আপনার এটা পড়ারই বা কী দরকার ছিল? আপনার তো ষোল আনাই মিছা’।
আমি একটা পোস্টার বানিয়েছি, যেখানে আমি লিখেছি, “হে প্রভু, দাও উপকারী জ্ঞান”। you can say so many things about something. But হইতে পারে you have missed the main thing। এটি হিস্ট্রিকাল বা ডেসক্রিপটিভ মেথডের প্রধানতম সমস্যা। এখানে ব্যক্তি, আরোপিত চিন্তার জটে আটকে যায়। নানামুখি চিন্তার জটিলতায় কেবলই ঘুরপাক খায়। দিনশেষে বাড়ি ফেরে শূন্য হাতে। এরপর কোনো একদিকে অন্ধভাবে বায়াসড হয়ে পড়ে।
এখানে একটা কথা বলার আছে।
কেউ যদি ডেসক্রিপটিভ কোনো এসাইনমেন্ট লিখতে বসে এবং একটা ডেসক্রিপশন দেয়, তাহলে তো হলো। ডেসক্রিপশন দিয়েছে। ব্যাস শেষ। আর যদি ব্যাপারটা হয় এনালাইটিক, তাহলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার লম্বাচওড়া বর্ণনা বা রিভিউ দেয়ার কোনো দরকার নাই। ডেসক্রিপশান বা রিভিউ আসবে এনালাইসিসের স্বার্থে। কথার কথা, কেউ যদি ১০পৃষ্ঠা ডেসক্রিপশান লিখে তাহলে তাকে এনালাইসিস করতে হবে কমচে কম আরও ২০পৃষ্ঠা।
অতএব, ডেসক্রিপশান দেয়া যাবে কিনা বা কতটুকু দিতে হবে সেটা নির্ভর করবে জিনিসটা কী, what it is meant for, তার ওপর।
আমাদের এখানে সিস্টেমেটিক কোনো আলোচনা নাই। ক্রিটিকাল থিংকিং বলতে লোকেরা বুঝে অর্থহীন সমালোচনা। আলোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষিত লোকদেরও নাই ন্যূনতম স্বচ্ছ ধারনা। একগাদা ইনফরমেশন বলতে পারাকে লোকজন মনে করে সুপার নলেজেবিলিটি। ইনফরমেশনগুলো আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা, তা জানার চেষ্টা করে না। জ্ঞানের নামে অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে শ্রোতাদেরকে বোকা বানানো হয়।
লন্ডন নিবাসী মুফাচ্ছিল সাহেব নাস্তিকতা নিয়ে কথা বলেন। দেখেছি, উনি একবার কাকে যেন অপদস্থ করছেন এভাবে, ‘এই বলেন তো, বিবি আমেনার বাপের নাম কী?’ হায় আল্লাহ! মুহাম্মদ (স.) এর মাতা বিবি আমেনার বাপের নাম তো আমিও জানি না। ঐ লোকেরও জানার কথা না। এবং কোনো ধরনের অর্থপূর্ণ আলোচনায় এটি প্রাসঙ্গিক হওয়ারও কোনো কারণ নাই। এই ধরনের ছুপা-জ্ঞানচর্চাকে বলে সফেস্ট্রি।
সক্রেটিসপূর্ব কূটতার্কিকদেরকে বলা হতো সফিস্ট। সক্রেটিস তাদেরকে মোকাবেলা করেছিলেন দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মাধ্যমে। সফিস্টরা খুব জ্ঞানী হওয়ার দাবি করত। সক্রেটিস বলতেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার কথাটা বুঝি। তোমার এই কথা থেকে তো এই কথা হয়? এইটা থেকে এইটা? তাই না? এক পর্যায়ে তিনি বলতেন, ‘কিন্তু তোমার আগের অমুক কথার সাথে তো এই কথাটা মিলল না। এবার বলো, তোমার কথা কোনটা সঠিক? এবং, কী কারণে?
বলা বাহুল্য, তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারত না। এভাবে তিনি সফিস্টদের মেকী জ্ঞানভাণ্ডারের তলাটা আস্তে করে ফুটো করে দিতেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানি, তখনকার এক্সপার্টরা এই ধরনের প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতিকে পছন্দ করতেন না। এই দ্বিপাক্ষিক আলোচনা পদ্ধতি তরুণদের কাছে ব্যাপক পপুলারিটি পায়। এরপরের ইতিহাস আপনাদের জানা।
সক্রেটিসের মতো আমিও কাউকে আলতো করে একপর্যায়ে বলে ফেলি, then, what is your point? যাদের কুম-ক্যাপটাল আছে তারা কিছু না কিছু বলে। যারা শুধু ডিগ্রীধারী, বিশ্লেষণী জ্ঞানে ব-কলম, আমার পজিশন আর এপ্রোচের কারণে রুষ্টতা দেখাতে না পারলেও তারা এধরনের প্রশ্নে খুব বিব্রত হয়।
প্রয়াত বদরুল আহসান যথার্থই লিখেছিলেন, (formal) education is certified ignorance। তিনি ডেইলি স্টারে ‘ক্রস টকস’ শিরোনামে প্রতি শুক্রবার একটা সাব-এডিটরিয়েল লিখতেন। উনার এই লেখাটা নিয়ে চবি কলাভবন ১০২ নং কক্ষে আমি একটা আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলাম। অন্তত আঠারো-বিশ বছর আগে।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন, ফিলসফিকেলি আমি সক্রেটিসের অনুসারী। ইসলামিকালি ইমাম গাযালির।