‘মানুষ’ মানুষ হয়েছে দর্শন চর্চার মাধ্যমে। মানুষ জানতে চেয়েছে, অতিক্রম করে যেতে চেয়েছে। তাতে সে অর্জন করেছে প্রযুক্তি, গড়ে তুলেছে বিজ্ঞান। হয়েছে সভ্য। চোখ দিয়ে আমরা দেখি। কিন্তু চোখকে দেখি না, যদি না আয়নার সামনে দাঁড়াই। তেমনি দর্শনে ডুবে থেকে মানুষ দর্শন সম্বন্ধে বেখবর হয়ে থাকে। বলে– ফিলোসফি ইজ ডেড। দর্শনের দরকার নাই। দর্শনের বিরোধিতা করার ব্যাপারে আস্তিক, ধর্মবাদী, সংশয়বাদী ও নাস্তিক– সব ক্যাটাগরির লোকদের একাংশের মধ্যে এক ধরনের ঐক্যমত্য লক্ষ্য করা যায়। স্টিফেন হকিংয়ের সাড়া জাগানো সর্বশেষ বইটির একটা চ্যাপ্টার হলো দর্শনের কথিত মৃত্যুর দাবি নিয়ে। এমনকি ‘সোনার বাংলাদেশ ব্লগের’ একজন অতি সম্মানিত বিদ্যজনও সম্প্রতি ইসলামের দিক থেকে দর্শনের বিরোধিতা করে পোস্ট দিয়েছেন।

মানুষ যখন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে তার নিকট স্বীকৃত মানদণ্ড দিয়ে যাচাই করে সর্বোত্তমকে গ্রহণ করতে। এমনকি মানুষ যখন লটারি করে তখনও সে র‍্যাশনাল ডিসিশন গ্রহণ করে। যেমন– সফরে কোন স্ত্রীকে সাথে নিবেন তা ঠিক করতে রাসূল (সা) লটারি করতেন। যেভাবে আম্পায়ার বা রেফারিগণ লটারি করে থাকেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, যখনই আপনি কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন, যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, সেটি অতি অবশ্য আপনার র‍্যাশনাল আন্ডারস্ট্যন্ডিংয়ের মাধ্যমে নিবেন। বলাবাহুল্য, এটিই হচ্ছে দার্শনিক পদ্ধতি। প্রতিটি মানুষই হচ্ছে এক একজন দার্শনিক।

মানুষ প্রতিনিয়ত পদার্থবিদ্যার নিয়ম মেনে চলাফেরা করে, যদিও সে জানে না কেন সে বাঁক নেবার সময় একটা নির্দিষ্ট মাপে হেলে চলে। একজন পদার্থবিদ্যাবিদও তাই করেন। অবশ্য তিনি নিয়মটি জানেন বা জানার চেষ্টা করেন। সেজন্য তিনি পদার্থবিদ্যাবিদ। আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়াদি চলছে। এজন্য আমরা বেঁচে আছি বটে। কিন্তু আমরা জানি না এসব ফিজিওলজিক্যাল প্রসিডিউর কী বা কীভাবে হচ্ছে। একজন শরীরতত্ত্ববিদ সেটি জানেন। আর যা জানেন না, তা জানার চেষ্টা করেন। একজন কৃষক কৃষিবিদ্যার নিয়ম মেনেই চাষাবাদ করেন। কিন্তু তিনি জানেন না কৃষিবিদ্যা বিভাগে এসব বিষয় নিয়ে কী ধরনের জ্ঞানচর্চা হয়ে থাকে। তেমনি, যারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শন চর্চা করেন তারা জানে ও জানার চেষ্টায় থাকেন সব বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান। সংশ্লিষ্ট জ্ঞানগত শাখাটি যেসব বিষয়কে স্বতঃসিদ্ধ বা ধ্রুবক হিসাবে (নির্বিচারে) গ্রহণ করে নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়, দর্শনের কাজ হচ্ছে সেই স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা। তাই, ফিলোসফি ইজ অলওয়েজ ফিলোসফি অফ সামথিং।

মানুষ মঙ্গল গ্রহে নভোযান পাঠিয়েছে। আপনারা, ফিলোসফির লোকেরা কী করেছেন? একজন নবীন শিক্ষার্থীর এমন এক প্রশ্নের জবাবে আমি পকেট থেকে কলম বের করে বললাম, দর্শনের লোকেরা এ রকম একটি কলমও তৈরি করতে পারে নাই। ন্যাশনাল জিডিপিতে তাদের কোনো অবদান নাই। তাহলে আমরা এটি কেন পড়বো? বা এটি কেন পড়ানো হবে? বিশ্বের নামকরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকেরই ফিলোসফি ডিপার্টমেন্ট বলে কোনো বিভাগ নাই। এটি হলফ করে বলা যায়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?

তথাকথিত ভালো কোনো সাবজেক্টে চান্স না পেয়ে বাধ্য হয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হওয়া এই স্টুডেন্টের সাথে একমত হয়ে আমি স্বীকার করলাম, নভোযান পাঠানো তো দূরের কথা একটা সুঁইও দর্শনের লোকেরা বানাতে পারে নাই। তাকে বললাম– আচ্ছা ইরাক, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশে না হয় তেলের জন্য গেছে, মঙ্গল গ্রহে আমেরিকা পাথ ফাইন্ডার কেন পাঠালো? গুহা ও বন্য জীবন থেকে মানুষ কেন বের হয়ে আসলো? মানুষ কেন অজানাকে জানতে চায়? যা কিছু প্রচলিত, মানুষ কেন সেটিকে অতিক্রম করে নতুনকে পেতে চায়?

কারণ, সিন্দাবাদের সেই কাঁধে চড়ে বসা বুড়ো ভূতের মতো দর্শনচেতনা মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। সে বুঝে না– কেন সে ব্যবসায়ী না হয়ে বিজ্ঞানী হলো। বা, কেন সে বিজ্ঞানী না হয়ে সাহিত্যক হলো। যখনই আপনি ‘কেন’ প্রশ্নটির মুখোমুখি হবেন, তখন এই ‘কেন’র উত্তর আপনি যা-ই ঠিক করেন না কেন, এমনকি কোনো উত্তরকেই সঠিক মনে না করলেও, আপনি দর্শনের জালে জড়িয়ে গেলেন। দর্শনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। জ্ঞান হলো দর্শনের পণ্য।

আমরা বিজ্ঞান চর্চা করবো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সুখ, কল্যাণ বা ভালোকে পাওয়ার জন্য। ভালো কথা। কিন্তু সুখ বলতে আমরা কী বুঝবো? কার সুখ? কীসের সুখ? কীভাবে? কীসের বিনিময়ে? আসলে ‘আমরা’ কারা? সবাই তো ভালো চাই। কিন্তু ভালোটা কোথায়? আদৌ কোনো পরম ভালো আছে কি? থাকলে এর যুক্তি কী? এ ধরনের সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর গ্রহণ না করে মানুষ বাঁচতে পারে না। প্রত্যেকে নিজ নিজ দৃষ্টিতে সব মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিয়ে সে মোতাবেক জীবনযাপন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যদিও এসব ব্যাপার নিতান্ত অবচেতনে ঘটে বা ক্রিয়াশীল থাকে। ব্যক্তিকে প্রশ্ন করলে তার অবস্থানটা জানা যায়। দর্শনের ইতিহাস যত দিনের, ‘ফিলোসফি ইজ ডেড’ দাবিটির ইতিহাসও প্রায় ততদিনের। ফিলোসফির বিরুদ্ধে যারা যুক্তি দেন, মজার ব্যাপার হলো তারা কোনো না কোনো দার্শনিক গোষ্ঠীর মতামত ও যুক্তিকেই তুলে ধরেন।

দর্শনের কোনো কনক্রিট ফাইন্ডিংস নাই। থাকতে পারে না। যে বিষয়ে কোনো বিরুদ্ধ মত পাওয়া যাবে না, তা দর্শন হতে পারে না। আর কোনো বিষয়ে বা কোনো কিছু সম্পর্কে মতৈক্য পাওয়া গেলে সেটি দর্শন হতে আলাদা হয়ে একটা স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিন হিসাবে অগ্রসর হবে। যেভাবে একে একে সব সাবজেক্ট দর্শন হতে বের হয়ে গেছে। সর্বশেষ গেছে মনোবিদ্যা। এক সময় ফিজিক্সও ফিলোসফি হিসাবে ছিলো।

দর্শনের কোনো পক্ষ নাই, থাকতে পারে না। তবে দার্শনিকের অবশ্যই কোনো না কোনো পক্ষ থাকবে। যুক্তি-পাল্টাযুক্তির মধ্যে ব্যক্তিমানুষকে কোনো একটা পক্ষে অবস্থান নিতে হয়। সতেচনভাবে না নিলে অবচেতন বা সামাজিকভাবে সে কোনো না কোনো পক্ষে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে। দর্শন-শিক্ষকের কাজ হলো বিপরীত বা বিকল্প মত ও তৎসংশ্লিষ্ট যুক্তিসমূহ তুলে ধরা।

তাহলে আমরা প্রথম কথায় আবার ফেরত আসলাম, অর্থাৎ যখনই আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেই তখন আমরা দার্শনিক পদ্ধতি মেনেই তা নেই। সেটি যা-ই হোক না কেন। ঈশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদী বা সংশয়বাদী যা-ই হোন কেন, আপনি একটি দার্শনিক মতেরই অনুসরণ করছেন। জাতীয়তাবাদী হোন আর আন্তর্জাতিকতাবাদী– যাই হোন না কেন, আপনি একটা প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতবাদকেই সঠিক হিসাবে গ্রহণ করছেন। মানুষকে বলা হয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী। বুদ্ধিচর্চা তো দার্শনিকতারই নামান্তর মাত্র।

তাহলে, ইসলামের সাথে দর্শনের কী সম্পর্ক? ইসলামই হচ্ছে দর্শনের মূলকথা! মজার ব্যাপার হলো দর্শনের খুব কম সংখ্যক লোকেরা এটি জানে। এবং ইসলামের লোকেরা ব্যাপকভাবে শক্ত করে কোমর বেঁধে এ কথার বিরোধিতা করছে ও করবে! আচ্ছা, মুয়াজ ইবনে জাবালকে রাসূল (সা) যখন বললেন, ‘রা-সুল আমরি আল-ইসলাম’ (মূল বিষয় হলো ইসলাম)– এ কথা দ্বারা তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? ইসলামের, বিশেষ করে ঈমানের পদ্ধতি কী? দর্শন চর্চা ইসলামে কতটুকু প্রাসঙ্গিক?

এসব প্রশ্নের জবাব পাবেন পরবর্তী নিবন্ধে

এসবি ব্লগ থেকে নির্বাচিত মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য

নোমান সাইফুল্লাহ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি এই বিষয়টি ভাবছিলাম। এবং আপনার এক ছাত্রের সাথে অনেক কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে আপনার কথা বলেছেন। কিন্তু মাঝে অনেক দিন আপনি ব্লগে আসেননি। তাই কথা বলতে পারছিলাম না। ভালো হয়েছে। আমরা ইসলামের নামে অনেক কিছুই ইসলামবিরোধী বিষয় উপস্থাপন করছি, যা কোনোভাবেই উচিত নয়। যে যেই বিষয়ে জানে না, সে বিষয়ে লেখা মানেই বোকামী করা। আপনাকে আবারও মোবারকবাদ। আশা করছি নিয়মিত ব্লগে লিখবেন।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

ইসলামপন্থী লোকজন যে বিশ্লেষণধর্মী চিন্তার দিক থেকে অনেক সংকীর্ণ ও অনাগ্রহী, মন্তব্যের অত্যল্পতা সেটি প্রমাণ করে। দর্শন, বিশেষ করে নাস্তিকতা নিয়ে যখন আমি সামহোয়্যারে লিখতাম, তখন অনেক মন্তব্য আসতো।

এসবি ব্লগ একটা স্টেরিওটাইপে আবদ্ধ হয়ে আছে। অন্তত পাঠক ও লেখকের দিক থেকে।

“আমরা ইসলামের নামে অনেক কিছুই ইসলামবিরোধী বিষয় উপস্থাপন করছি, যা কোনোভাবেই উচিত নয়।”– আপনার এই মন্তব্যের আলোকে আলোকপাত করুন। আলাদা পোস্ট দিলে, আমাকে দয়া করে বার্তা দিতে ভুলবেন না।

নীলু প্রজাপতি: “দর্শনে ডুবে থেকে মানুষ দর্শন সম্বন্ধে বেখবর হয়ে থাকে।”

এই বেখবরে বেখবর হয়ে থাকা মানুষের খাসলতের একটা অংশ হতে পারে। কিন্তু সে বেখবরকে জাস্টিফাইড করার জন্য যখন লোকে উঠে পড়ে লাগে তখন দ্বন্দ্বে পড়ে যাই।

দর্শন চর্চা বেদাত বা এটা পথভ্রষ্ট করে– এই ধরনের কথার মধ্যে দৈবতার আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে। অথচ, আমরা দেখি সেই দৈবতাকে যুক্তিসম্মতভাবে (অনেক ধার্মিক যুক্তিসম্মত হতে না পারাকে লজ্জার কারণ মনে করেন) উপস্থাপনের কতই না চেষ্টা। কেন এই চেষ্টা?

কিন্তু সেইসব চেষ্টা কেন মানুষ করে? কেন তার এই অন্তর্নিহিত তড়পড়ানী সেই খোঁজ কি নিতে চায়? কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই বেখবরকে খবর করে তোলার চেষ্টাকে (দর্শন নামে) গলা টিপে মারার চেষ্টা করা হয়। আজকাল দেখি সেটাকে বিজ্ঞান নামেও ডাকা হয়। অথচ শুধুমাত্র যদি এই প্রশ্ন তোলা হয় আমরা যা যা নিয়ে কথা বলছি, কেন বলছি? তাহলে হয়তবা কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলে।

কিন্তু যারা নানা দোহাইয়ে নিজেরা দরজা বন্ধ রাখে, অন্যদেরও বন্ধ করার কথা বলে, তারা কেন একবার নিজের দিকে ফিরে দেখে না।

সরি, দর্শন নিয়ে বিপত্তিকর অভিজ্ঞতার কিছু কথা বললাম। আপনার লেখার পরের অংশের অপেক্ষায় থাকলাম।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: দর্শন নিয়ে ইসলামপন্থীদের মনোভাব আপনি যা বলেছেন মোটামুটি সেরকমই, দেখেছি। এসব ভুল ধারণা। তবে, প্রতিষ্ঠিত।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

, এম, বিশ্বাস: “দর্শনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। জ্ঞান হলো দর্শনের পণ্য।”

ডায়ালগটা ভালো লাগল।

আপনি যেই কথাটা বিস্ময়সূচক ও প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে লিখেছেন, “ইসলামই হচ্ছে দর্শনের মূলকথা!?” এই কথাটার সাথে একমত।

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক: হ্যাঁ ভাই, একজন কথিত আহলে হাদীসপন্থী মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা ভাই আজ সন্ধ্যায় বললেন, ইলম বা জ্ঞান অর্জন যে কোনো আমলের পূর্বশর্ত। সবচেয়ে বড় ফরজ। যে কোনো জ্ঞানচর্চার ফাউন্ডেশন হচ্ছে ফিলোসফি।

আমি ইচ্ছা করেই সায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ড হতে ফিলোসফিতে ভর্তি হয়েছিলাম।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

মূল লেখার ব্যাকআপ লিংক

Similar Posts

২ Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *