লিখতে চাই না। তবুও, মাঝে মাঝে
অনুভবের ব্লাকহোল হতে
hawking radiation-এর মত
কিছু কথা কীভাবে যেন
ছাপার অক্ষরে বের হয়ে পড়ে।
প্যারেন্ট হওয়ার মত লেখক হওয়ার বিড়ম্বনা
অগত্যা শূন্য, নির্দয় ও ক্ষমাহীন।
লেখককে দায়িত্ব নিতে হয়
অন্যকে আহত না করে সত্য বলার।
একসময় লিখেছিলাম,
‘লেখক হতে চাই না।
কথাগুলো শুধু বলে যেতে চাই।’
এখন দেখছি,
না বলার কষ্টের চেয়েও
বলার দায় অনেক বেশি উচ্চমূল্য।
তাই, লিখতে চাই না।
তবুও কীভাবে যেন মাঝে মাঝে
কিছু কথা লেখা হয়ে যায়।
একেকটা লেখা সম্পন্ন হওয়ার পর
উৎপন্ন হয় এক অদ্ভুত অনুভুতির,
খানিকটা আনন্দের, অনেকখানি বেদনার।
আগে ভাবতাম, প্রতিটা লেখা যেন হয়
অকপট সত্যের সাহসী উচ্চারণ। এখন,
বিশেষ করে, সমাজকর্মী হিসেবে
পূর্ণকালীন কাজ শুরু করার পর থেকে,
তেমন আর অন্ধ-সাহসী হতে পারি না।
না লেখার পণ করি মাঝে মাঝে। অথচ,
একেবারে না লিখেও থাকতে পারি না।
মানুষ, মানুষের আবেগ আর অস্তিত্বের অনুভব,
এসব কেমন যেন অসম্ভব এক ব্যাপার।
এ যেন বুদ্ধির অগম্য।
অথচ তা বাস্তবতার সবটুকু।
জ্ঞানী হিসাবে পরিচিত হতে চাই না।
বুদ্ধিজীবী হিসাবে তো ন-ই।
তবুও যখন
জীবনের এই বিস্তৃত অভিজ্ঞতা,
উপলব্ধির বিরল গভীরতা,
আবেগের অদম্য বিস্ফোরণ,
মাঝে মাঝে এমন আচ্ছন্ন করে ফেলে,
তখন কেমন যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি।
তখন না লিখে থাকতে পারি না।
আমার লেখার
আমিই হলাম মূল উদ্দিষ্ট পাঠক।
তাহলে, বলতে পারেন,
কেন এই লেখা প্রকাশ করছি?
এর সঠিক উত্তর আমার জানা নাই।
শুধু জানি, এ হলো এক মানবিক আবেগ।
দেখেছি, আমার একান্ত কথাগুলো
কারো কারো ভালো লাগা ছুঁয়ে যায়।
প্রতিটি মানুষই আসলে
ঈশ্বরের মত প্রকাশ-তুষ্ট।
আমি এর ব্যতিক্রম কীভাবে হবো?
বহুদিন কোনো লেখা কাউকে দেখাই নাই।
সব লেখা একটা ডায়রিতে তুলে
সযত্নে রেখেছিলাম একটা ব্রিফকেসের ভিতরে,
গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির
চিঠিপত্র, ছবি আর সার্টিফিকেটের সাথে।
একদিন, বছর পাঁচেক আগে, দেখলাম
পুরো ব্রিফকেসটা কখন জানি
একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে
উঁইপোকার আক্রমণে।
সব লেখা গেছে।
টাইপ করে রাখি নাই তেমন কিছু।
যেটুকু স্মরণে আছে, তাই শুধু রয়ে গেছে।
ভাবছি, জীবনটাই যখন ফুরাবে একদিন,
ক’টি লেখা দিয়ে কী আর হবে! তবুও,
সদ্যভূমিষ্ট সন্তান হারানো মায়ের কষ্টের মতো
সবগুলো লেখা একসাথে হারানোর
এই গভীর মর্মবেদনা
মাঝে মাঝে প্রবল হয়ে ওঠে।
সার্টিফিকেট তোলা যায়। কিন্তু,
যারা লিখে তারা জানেন,
কোনো লেখা দ্বিতীয়বার লেখা যায় না। তাই,
যা গেছে তা একেবারেই গেছে।
এ নিয়ে ইদানিং অবশ্য
খুব একটা আফসোস করি না।
আছি তো বেশ! ভালোই যাচ্ছে দিনকাল।
মাঝেমধ্যে কিছু একটা লিখে ফেলি,
গদ্যপদ্য মিলিয়ে।
বিশেষ করে, ভয়েস কমান্ডের এই যুগে
লেখাটা সহজতর।
ভালো লাগত অনেক বেশি
যদি লিখতে পারতাম অকপটে।
অনাকাঙ্ক্ষিত পারিপার্শ্বিকতা,
সামাজিক মূল্যবোধ, সংকোচ আর
কিছুটা খ্যাতির বিড়ম্বনার চাপে
সব সময়ে দু’হাত খুলে লিখতে পারি না।
গলা ফাটিয়ে বলতে পারি না
মনের সব কথা।
অযথা বিতর্ক এড়ানোর জন্য
চলমান ইস্যুগুলোতে সাধারণত নীরব থাকি।
জীবনের এই নৈমিত্তিক পাশবিকতা হতে
যদি রেহাই পেতাম,
হয়তো বা তাহলে লিখতে পারতাম
অনেক বেশি, বা অধিকতর অর্থবহ কিছু।
না পারি বলতে সব কথা,
না পারি লিখতে মনের সুখে, তাতে কী?
বেঁচে তো আছি বেশ, মাটি ও মানুষের সাথে
জীবন ঘনিষ্ঠ এই সময়ে।
এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
এক জীবনে একসাথে তো
সবকিছু আর হয় না পাওয়া।