সেদিন চবি জিরো পয়েন্টে বসেছিলাম। কথা হলো এক ছাত্রের সাথে। ইউনিভার্সিটির একটা ডিবেটিং ক্লাবে সে উচ্চপদে ছিল। সম্প্রতি পদত্যাগ করে এসেছে। তার অভিযোগ, এইসব ফোরামের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের মগজ ধোলাই করা হয়। তাদেরকে অভ্যস্ত করা হয় ধর্মবিরোধী ওয়েস্টার্ন লাইফস্টাইলে। এইসব ক্যারিয়ার ক্লাব, সাহিত্য সভা, আবৃত্তি প্রশিক্ষণ আর সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা হারিয়ে ফেলে তাদের ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধ।

ছাত্রটির অভিযোগ অনেকাংশে সঠিক।

বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্যারিয়ার গঠন ও গণমাধ্যম সম্পর্কিত পার্শ্বসংগঠনগুলোতে বামপন্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্যের মোকাবেলায় রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া হতে পারে নিম্নোক্ত তিনটি ধরনে।

প্রতিক্রিয়া-১: সেসব ফোরামে যুক্ত না হওয়া। কোনো কারণে কেউ যুক্ত হলে অবিলম্বে পদত্যাগ করে চলে আসা।

এতে করে ঈমানবিরোধী ক্ষতিকর ধ্যানধারণা ও আচার-আচরণ হতে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। ব্যক্তির আত্মরক্ষার জন্য এটি সবচেয়ে নিরাপদ উপায়।

অসুবিধা হলো, নানা রকমের সুবিধা থাকার কারণে হাজার হাজার স্টুডেন্ট সরলমনে তাদের ওখানে যাবে। মূল্যবোধ-বিরোধী প্রগতিশীলদের মাধ্যমে নানা কারণে তারা একপর্যায়ে মগজধোলাই হয়ে বের হবে। এভাবে বিরোধীপক্ষের হাতে জনগোষ্ঠীকে সমর্পণ করে ময়দান তাদের জন্য ফাঁকা করে দিয়ে ঘরে বসে থাকা, এটি কোনোক্রমেই একজন সমাজকর্মীর উপযুক্ত কর্মকৌশল হতে পারে না।

প্রতিক্রিয়া-২: নিজেরা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিমণ্ডলে এ’ধরনের প্লাটফর্ম গড়ে তোলা।

এর সুবিধা হলো নিজস্ব পরিমণ্ডলে বাতিল মতাদর্শের ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত হয়ে মননশীলতা, সুস্থ বিনোদন ও শিক্ষাসহায়ক আবহ গড়ে তুলতে সক্ষম হওয়া। এ’ধরনের কোনো বিকল্প প্লাটফর্ম দাঁড়িয়ে যেতে পারলে এক সময়ে তা সমাজের মূলধারাতে জায়গা করে নিবে। এ’ধরনের শক্তিশালী বিকল্প ফোরামের প্রভাবে বামপন্থা-নিয়ন্ত্রিত মূলধারা অন্তত এক ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।

বামপন্থীরা যে এখানে রয়ে-সয়ে চলে, এর কারণ হলো বৃহত্তর সামাজিক চাপ।

এই ধরনের প্রতিক্রিয়ার অসুবিধা হলো, কোনো সাইড অর্গানাইজেশান কতটুকু দাঁড় করানো যাবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট মূল প্রতিষ্ঠানটা কত বড় ও শক্তিশালী এবং এর থেকে নতুন উদ্যোগটি কতটুকু সাপোর্ট পাচ্ছে তার ওপর। ঠিক এখানে এসে রক্ষণশীলেরা মার খেয়ে যাবে। অলরেডি খাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, আপনার যদি একটা হাতি থাকে সেটির ছায়াও আপনার ক্রয় করা বা বানানো সবচেয়ে বড় ছাতির থেকে অনেক বড় হবে।

ইউনিভার্সিটির ফ্রেমওয়ার্ক তথা মূলধারার ভিতর থেকে কিছু করা আর পাবলিক ইউনিভার্সিটি নামক এই বিশাল জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সুবিধাদি না নিয়ে নিজস্ব রিসোর্স নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করা, এই দুইটার মধ্যে পার্থক্য বিরাট। এই নিজেদেরকরণ প্রকল্পের মধ্যে নৈতিক শুদ্ধতার আত্মতৃপ্তি থাকলেও কার্যকারিতার দিকে থেকে এটি অতীব দুর্বল কৌশল। অসম প্রতিযোগিতা। এতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবার ঝুঁকি অনেক বেশি।

প্রতিক্রিয়া-৩: মূলধারায় টিকে থাকার চেষ্টা করা।

এর সুবিধা হলো, অন্য দুইটি কর্মপন্থার তুলনায় এটি বেটার অপশন। ইন দ্যা লং রান এটি মোর এফেক্টিভ অলটারনেটিভ। এগেইন, আলোচনাটা হচ্ছে একজন সমাজকর্মীর প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে সমাজ পরিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর খলিফা হিসেবে দায়িত্বপালনের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, এই দৃষ্টিকোণ থেকে।

মাঝে মাঝে এমন হয়, ফ্রন্ট লাইনে কাতারে কাতার সৈনিক মারা যায়। তাদের রক্ত মাড়িয়ে পেছনের লোকেরা মই নিয়ে বেয়ে উঠে দূর্গ দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্রান্সের ন্যারম্যান্ডি উপকূলে মিত্রবাহিনীর অবতরণের দৃশ্যটুকু দেখে নিতে পারেন ‘সেভিং দ্যা প্রাইভেট রায়ান’ সিনেমা হতে।

বাতিল মতাদর্শ প্রভাবিত মূলধারায় টিকে থাকার চেষ্টা করার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, আদর্শ প্রতিষ্ঠাকামীদের বৃহদাংশ আদর্শের জায়গাটাতেই কম্প্রোমাইজ করে ফেলে। নানা ধরনের দুনিয়াবী প্রলোভনের কারণে জনশক্তির একটা বিরাট অংশ হারিয়ে যায়। জম্বির আক্রমণের শিকার হওয়ার পরে নিজেই জম্বি হয়ে যাওয়ার মতো তৈরী জনশক্তির একটা বিরাট অংশ চোখের সামনে প্রগতিশীলতার ভেক ধরে ঘুরে বেড়ায়।

তৎসত্বেও আমি মূলধারায় টিকে থেকে দীর্ঘমেয়াদে লড়াই করার পক্ষপাতী। ভেতর থেকে একটা সিস্টেমকে যেভাবে পরিবর্তন করা যায়, বাইরে থেকে তা সম্ভব হয় না।

গা বাঁচিয়ে যেমন করে যুদ্ধ করা যায় না, তেমন করে জনশক্তিকে নিরাপদ রেখে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন হয় না। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সমাজের মূলধারা হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা, এটি একটি আদর্শবাদী দল বা গোষ্ঠীর জন্য প্রথম পরাজয়। কাইন্ড অফ সেলফ-ডিফিট।

দেশ যদি আমার আপনার সকলের হয় তাহলে দেশের জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে কেন আমরা অপরপক্ষের হাতে ছেড়ে দিবো? ছাতা মাথায় দেন আর রেইনকোট পরেন, বৃষ্টির মধ্যে বের হলে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে কিছুটা লাগবেই। নন্দলালের মতো ঘরে বসে থাকা কখনো সমাধান হতে পারে না।

ইংরেজী শেখা বাদ, পশ্চিমা-বিশ্বে যাওয়া যাবে না, সামরিক বাহিনীতে চাকুরী করা যাবে না, আইসিএস (পাকিস্তান আমলের) বা বিসিএস পরীক্ষা দেয়া যাবে না, ব্যাংক-বীমাতে চাকরি করা যাবে না, ওকালতি করা যাবে না, বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করা যাবে না, মূলধারার রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ কিংবা নেতৃত্ব প্রদান করা যাবে না ইত্যাকার ফ্যান্সিফুল পিউরিটানিজম মুসলিম কমিউনিটিকে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

আপনার দাদা একসময়ে জমিদার ছিলেন, এই সুখস্মৃতি নিয়ে পড়ে না থেকে গ্রাউন্ড রিয়ালিটি তথা বাস্তবতাকে মেনে নেন। অকপটে স্বীকার করেন। যেখানে আছেন সেখান হতে এফেক্টিভ ওয়েতে সামনে আগানোর চেষ্টা করেন। অন্তরের মালিক আল্লাহ।

লেখাটির ফেইসবুক লিংক

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *