সদা কর্মতৎপর সরলমনা এক স্নেহাষ্পদ আজকে এই টেক্সটটা পাঠিয়েছে, “আচ্ছা, স্যার আপনাকে খেলা বা ওয়েস্টার্ন পলিটিক্স নিয়ে কম লিখতে দেখা যায়? প্রায় (মাঝে মাঝে) সময় দেখা যায় আন নাহদা, মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে লিখতে…! পশ্চিমা হিপোক্রেট ডেমোক্রেসি নিয়ে কি আপনার কোন আগ্রহ নেই? ৯ তারিখ সকাল ৯ টায় হিলারীপন্থী এক ডিপার্টমেন্ট’ম্যাট আমাকে বলল, আমি নাকি রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই বুঝি না। কারণ ছিল আমি বলেছিলাম ট্রাম্পই হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।”
আমার উত্তর, ‘… হ্যাঁ, আমি আদা বেপারী। জাহাজের খবর নিয়ে লাভ কী? মুসলিম বিশ্বের যেখানে ইসলামিস্টরা কিছু করছে, সেখানের ব্যাপারে আমি খোঁজখবর নিয়ে থাকি। ইসলামের দিক থেকে একটা “বাংলাদেশ মডেল” গড়ে তুলতে হবে। এসব খোঁজখবর এ কাজে সহায়ক। এই যা। আমি মাটি ও মানুষ প্রিয়। বলতে পারো, গ্রাম্য। ছোট ছোট নৈমত্তিক বিষয়গুলো ভালো লাগে। ভালো থাকো।’
জানি না, এই উত্তরে সে কতটুকু সন্তুষ্ট হয়েছে। তবে, ‘ভূতের আছরে সন্ধ্যা রাতে পথ হারিয়ে ফেলার’ মতো অহেতুক রাজনীতি চর্চা যে আমাদের যুব সমাজকে অর্থহীন পাঁকে আবদ্ধ করে ফেলেছে, তা বেশ টের পেলাম। ঘটনাক্রমে আজই আমার রাজনীতি-নিষ্পৃহতা নিয়ে অন্য দুজন স্নেহাষ্পদ আমার সাথে সাক্ষাতে কথা বলেছে। তাদের মতে, রাজনীতি না হলে দেশ স্বাধীন হতো না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাদেরকে বিদায় জানানোর পরে বসে বসে ভাবলাম, আজকের বাংলাদেশে প্রধান প্রধান সমস্যা কি কি? মনে হয় না, রাজনীতি হলো আজকের বাংলাদেশ ও বিশ্বের প্রধান সমস্যা। বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে মন্তব্য করার মতো কেপাবিলিটি আমার নাই। বাংলাদেশে নিয়ে বলতে পারি।
হ্যাঁ, প্রত্যেক রাজনৈতিক পক্ষের দৃষ্টিতে আজকের বাংলাদেশে প্রধান সমস্যা রাজনীতি। ভাবছিলাম, কোন কোন রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে সমস্যাটা কেমন ধরনের তা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলবো। এরপর মূল প্রসংগে যাবো। এক্ষুনি আবার ভাবছি, নাহ, তার আর দরকার নাই। কী বলতে আবার কী বলে ফেলি। রাজনীতিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিকোণ হতে দেখা প্রধান সমস্যা বটে। সেটি তাদের স্ব স্ব অবস্থান হতে ঠিকই আছে। আমার মতো দেশের সাধারণ লোকদের দৃষ্টিতে, বিশেষ করে আমার মতো একজন অরাজনৈতিক সমাজকর্মীর দৃষ্টিতে বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা রাজনীতি নয়। অর্থনীতিও নয়। ধর্মও নয়। এমনকি সংস্কৃতিও নয়।
মনোনৈতিক সমস্যা
আজকের বাংলাদেশে প্রধানতম সমস্যা হলো গণমানুষের মনোনৈতিক সমস্যা। ইংরেজীতে বললে, psycho-ethical problem-ই হলো মূল সংকট, গোড়ার সমস্যা। শরীরের অভ্যন্তরে ঘা হলে যেমন জ্বর দেখা যায়, তেমনি এই অন্তর্গত সমস্যার কারণে নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা উপসর্গ হিসাবে ভেসে উঠছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্মীয়-মুক্তবুদ্ধিবাদী, বাংগালী-বাংলাদেশী, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, নবীণ-প্রবীণ ও নিবাসী-প্রবাসী নির্বিশেষে আমরা, আমরা মানে অধিকাংশ বাংলাদেশীরা ‘গোপন অসুখের’ মতো এক ধরনের অন্তর্গত সমস্যায় ভুগছি। কেমন যেন হীনমন্যতায় আড়ষ্ট।
এস্টাবলিশমেন্টের এক প্রবল তাড়নায় আমরা দিনরাত আলোড়িত। গণমানস বলে যে একটা কথা আছে আমাদের এই প্রিয় দেশ ও জাতিতে তা গণহারে নানা ধরনের মনোনৈতিক রোগে আক্রান্ত। কোনো এক দেশে নাকি সব মেয়েদের গলাফোলা রোগ হতো। তো, কোনো মেয়ের এ ধরনের সমস্যা না থাকলে, সবাই তাকে খারাপ মনে করতো। বলতো, ‘মেয়েটা কেমন বিচ্ছিরি। ওর গলাটা ফ্ল্যাট…!’
এখানেও কেউ যদি আলোকিত মানুষ হিসাবে পথ চলে, সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করে। যেন এর মতো বোকা আর হয় না। আপনি মানবিক দৃষ্টিভংগী নিয়ে জীবনযাপন করতে চান? সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে আপনাকে নির্লজ্জভাবে পাগল ঠাওরাবে। এই যে ‘মানবিক দৃষ্টিভংগীর’ কথা বললাম, ‘পার্টি করা’ নামক রোগে আক্রান্ত পাবলিক এটিরও বিশেষ ব্র্যান্ড বানাবে। এক পক্ষের দৃষ্টিতে নাস্তিক হওয়াটাই মানবিক হওয়া। হতে পারেন, হার্ডকোর নাস্তিক, হতে পারেন ‘মুক্তবুদ্ধি’র নামে বর্ণচোরা (সফট) নাস্তিক। অন্যপক্ষের মতে, মানবিক হতে হলে আপনাকে ধর্মবাদী হতে হবে। ধর্মের বাহিরে যেন মানবিকতা নাই। কী অদ্ভুত…!
তো, বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা, এই মনোনৈতিক সমস্যার প্রধান প্রধান উপসর্গগুলোর কয়েকটার উল্লেখ করে আমি দেখাবো, এর কোনোটা রাজনীতির সাথে বেশ খানিকটা সম্পর্কিত হলেও এগুলোর কোনোটাই মূলত রাজনৈতিক সমস্যা নয়। বরং এই গণমনোনৈতিক সমস্যা আমাদের জাতীয় সামাজিক সমস্যা।
সুশিক্ষার অভাবজনিত সমস্যা
দেশে স্বাক্ষরতার হার শৈনে শৈনে বাড়ছে। কিন্তু ‘আপন আলোয় পথ চলার’ মতো সুশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দিন দিন যেন কমছে। ভুরি ভুরি A+ প্রাপ্তরা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষায় গণহারে ফেইল করার ব্যাপারটা কেবলমাত্র বাহিরের চিত্র। অধঃপতনের একটা খণ্ড চিত্র। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকেরও বেশি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা হতে দেখছি, এখানকার শিক্ষক-ছাত্রদের মান কত নিম্নমানের…! ডিগ্রী আর গ্রেড পাওয়ার দিক থেকে অবশ্য আমরা বেশ উন্নত। মানবিকতা ও নৈতিকতার দৃষ্টিতে সবই যেন ‘ষোল আনাই মিছা’।
কেন জানি এটি প্রচলিত হয়ে গেছে, অনেক জানা মানে, অনেক তথ্য উপস্থাপন করতে পারা। তথ্য দিয়ে জ্ঞান নির্মাণ হলেও তথ্য স্বয়ং জ্ঞান নয়। জ্ঞানটা উপলব্ধির ব্যাপার। অনুসরণ করার ব্যাপার। ভেতরকার ব্যাপার। আধুনিক জগতে শিক্ষা ব্যবস্থা bloom’s taxonomy অনুসারে চলছে। আমরা জানি। এখানে এসব প্রয়োগের তোড়জোড়ও চলছে। HEQEP-এর মাধ্যমে দৃশ্যমান অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। ভেতরে ভেতরে কী চলছে, তা আমাদের মতো যারা ভেতর থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন, তারাই ভালো জানেন। যাবতীয় ‘উন্নতি’ ও ‘অগ্রগতি’ নৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে দেখলে, বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠার মতো, অর্থহীন ও নেতিবাচক।
আমাদের জ্ঞানচর্চা ঘুষখোরের ধর্মচর্চার মতো এক ধরনের স্নায়ুবিক ব্যায়ামের বেশি কিছু নয়। যতই আমরা চাপিয়ে দেয়া উন্নয়ন কার্যক্রমের লিস্টি করি না কেন, ভেতরকার নৈতিকতাবোধ আমাদের জীবনের সরল উপলব্ধি হতে গড়ে না উঠলে সব ‘শিক্ষাই’ শেষ পর্যন্ত ফাঁকি দেয়ার উন্নততর কৌশল রপ্ত করার উপায়ে পর্যবসিত হতে বাধ্য।
নারীর মানবিক অধিকার না থাকার সমস্যা
হ্যাঁ, এটি আমাদের জাতিগত মনোনৈতিক পক্ষাঘাতগ্রস্ততার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। অথচ, নারীরাও চান না, তারা মানুষ হিসাবে গড়ে উঠুন। তারা চান, আদর্শ নারী হতে। নিজেদের নারীর অধিক, মানুষ ভাবেন কম। তারা চান নারী অধিকার। এত এত নারীরা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। কতভাগ নারী প্রাপ্ত শিক্ষাকে কাজে লাগাচ্ছেন? সুপাত্র-সঙ্গিনী হওয়া ইত্যাদি এস্টাবলিশমেন্টের জন্যই তারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ নারী গ্রাজুয়েটদের জন্য এটি সত্য। কথাটা তিক্ত, কিন্তু সত্য।
না, আমি নারীদের পাশ্চাত্য আদলে ডিজপ্রপরশনেইট ক্ষমতায়নের কথা বলছি না। নারীদের পেশাজীবী বানানো আমার উদ্দেশ্য নয়। অবশ্য, আমি এর বিরোধীও নই। ব্যাপারটা আয়-উপার্জনের সাথে সম্পর্কিত নয়। নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে, সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে নারী-নিপীড়করাও কিন্তু কম যান না। নারীরা অধিনস্ত নারীদের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবিক আচরণ করে – আপনি কি এটি নিশ্চিত বলতে পারবেন? নারীরা নারীদের ধর্ষণ করতে পারে না। এ ছাড়া নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে তার উল্লেখযোগ্য পারসেন্টেইজ নারীনিপীড়কদের হাতেও ঘটে। কথাটা অস্বীকার করতে পারবেন? শিক্ষিত-অশিক্ষিত ভেদাভেদ এখানে অচল। কেন এমনটা হয়? উত্তর খুবই সহজ। আমরা মানবিক নৈতিকতা গড়ে তুলতে পারি নাই। নীতিবোধ এমন এক জিনিস যা চাপিয়ে দেয়া যায় না।
এখানে এসে আমার মুক্তবুদ্ধিবাদী প্রগতিশীল বন্ধুরা ধর্মকে দুষবেন। তাদের দাবী, ধর্মমুক্ত দুনিয়াতেই শুধুমাত্র শুদ্ধ নৈতিকতা গড়ে উঠতে পারে। তাদের এই দাবীর সাথে আমি গভীরভাবে দ্বিমত পোষণ করি। মুক্ত দুনিয়াতে মানুষের পরিচয়, জগত ও জীবন সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নের উত্তর ঠিক করতে গিয়ে ফিনিক্সের মতো ধর্ম আবার উঠি আসবে কিনা তা নিয়ে তাদের সর্তক থাকার আহ্বান জানাই। ধর্ম নিয়ে প্রগতিশীলদের আপত্তি নিয়ে এখানে আর কথা না বাড়িয়ে তাদের নারীমুক্তি প্রকল্পের একটা মৌলিক গলদ দেখিয়ে এই সাবপয়েন্টটা শেষ করতে চাই।
আমাদের দেশে সম্প্রতি অতিদৃশ্যমান প্রগতিশীলরা আবহমান কালের বাংলার সবকিছুকে গ্লোরিফাই করেন। একসেপ্ট নারী প্রসংগ। তারা বেগম রোকেয়াকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। তারা বাংগালীত্বের সোল এজেন্ট হিসাবে নিজেদের দাবী করেন। তারা একইসাথে নানা বাগাড়ম্বরে পুঁজিবাদেরও বিরোধিতা করেন। অথচ, পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য কর্পোরেট বিশ্ব নারীদের যেভাবে ভোগ্যপণ্য হিসাবে ব্যবহার করে, এদেশীয় নামকরা সব ‘সাম্যবাদীদের’ দেখা যায়, তারা এ ক্ষেত্রে যেন পুঁজিবাদের মাসতুতো ভাই। তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ, আরজ আলী মাতুব্বর ও খণ্ডিতভাবে বার্ট্রান্ড রাসেল পড়িয়ে তারা বাম তত্ত্ব চর্চা করেন। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বামকর্মীদের দেখেছি, মৌজ-মাস্তি আর অবাধ সম্পর্কের স্বাধীনতাই তাদের সংগঠন-চর্চার মূল আকর্ষণ। মার্কসিজম তারা ভালো করে জানে না। ব্যাপারটা দুঃখজনক।
উত্তর চট্টগ্রামে আমার গ্রামের বাড়ি। নারীদের পৈত্রিক উত্তরাধিকার নেয়াকে এখানে স্থানীয় ভাষায় ‘তর্কা নেয়া’ হিসাবে বলে। অশিক্ষিতদের কথা বাদই দিলাম। উচ্চ শিক্ষিতদের শতকরা ৯৮ ভাগ পুরুষ বোনদের ‘তর্কা’ নিতে চাওয়াকে কোনোক্রমেই মানতে পারেন না। বোনদের জন্য একে হারাম খাওয়ার মতো মনে করেন। বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বিবাহিত নারীরা বাধ্য হয়ে ‘তর্কার দাবী’ ছেড়ে দেন। স্বামীহীনা মায়েরাও, ব্যতিক্রম বাদে, নিজ ছেলে সন্তান ও তার মোর পাওয়ারফুল বউয়ের উপর অসহায়ের মতো নির্ভরশীল থাকেন। এখানকার হুজুরদের যত ওয়াজ হয় তার বিরাট অংশ জুড়ে থাকে ‘বেহায়া নারীদের বেলাল্লপনার বিরুদ্ধে’ বিষোদগারে ভরা। মনে হয়, ইসলাম যেন নারীদের সাইজ করার জন্যই এসেছে। কী ভয়াবহ বিকৃতি…!
এবার আপনারাই বলুন, নারীর মানবিক অধিকারের যে মারাত্মক সংকটের চিত্র আমি তুলে ধরলাম, এর সাথে রাজনীতির কী সম্পর্ক?
দুর্নীতির সমস্যা
দুর্নীতি কোথায় নাই? দুর্নীতিই এখন ‘জাতীয় নীতি’। প্রত্যেকটা বিভাগ যেন নিজের মতো করে দুর্নীতি করার এক একটা কারখানা। আপনি দুর্নীতি করবেন না। তাহলে, লোকেরা আপনাকে পাগল ঠাওরাবে। এর বিপরীতে, আপনি দুর্নীতি করবেন, এ জন্য আপনি সামাজিকভাবে অপদস্থ হবেন না। নিশ্চিত থাকেন। বরং দুর্নীতি করার জন্য আপনি বাধ্য হবেন।
একটা ছোট্ট দুর্নীতির কথা বলি। এই যে গণহারে খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়, এটি কি রাজনৈতিক সমস্যা? ভেজাল কি আওয়ামী লীগের লোকেরাই মেশায়? বিএনপির লোকেরা চান্স পাইলে মেশাবে না? অতীতে মেশায় নাই? আর, জামাত? জামায়াত-শিবিরের লোকেরা মিলে যেসব ‘ভাই-ভাই কোম্পানী’ গড়ে তুলেছে, সেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খবর নিতে পারেন। যদ্দুর জানি, প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ করার জন্য যে কোনো প্রচলিত উপায়কে হালালাইজ করার পারঙ্গমতায় তারা অপরাপর দেশী ভাইদের থেকে কম যান না…!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বলুন, সশস্ত্র বাহিনীসমূহের দুর্নীতি বলুন, আমলাদের দুর্নীতি বলুন, এনজিওদের দুর্নীতি বলুন, দুর্নীতির যত চিত্র আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পারি, সেগুলো হলো, head of the iceberg-এর মতো কিছু উদাহরণ মাত্র। প্রকৃত অবস্থা আরো ভয়াবহ। এই যে গণমাধ্যমের কথা বললাম, যারা অন্যদের দুর্নীতির কথা তুলে ধরে, তাদের দুর্নীতির চিত্র আরো ভয়াবহ। এক একটা মিডিয়া যেন, এক একটা ‘মইশ্যা জোঁক’। সাংবাদিকতার একটা কার্ড থাকা মানে ‘চড়ে খাওয়ার’ একটা ওপেন লাইসেন্স…!
তো, দুর্নীতির এই যে মহারোগ, এটি কি রাজনৈতিক সমস্যা? আপনি হয়তো বলবেন, যেভাবে আমার স্টুডেন্টরা আমাকে বলেছে, ‘স্যার, ৮০’র দশকেও বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী অনেক উন্নত দেশের চেয়ে ভালো ছিলো। সুশাসনের মাধ্যমে তারা এতটা উন্নতি করতে পেরেছে।’ এজন্য নাকি রাজনীতি দরকার।
আমি স্ট্রংলি ডিজএগ্রি করি। হ্যাঁ, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ এডমিনিসট্রেটিভ পথে এগিয়ে উন্নয়ন করেছে। তবে, তা প্রচলিত রাজনীতি দিয়ে হয় নাই। বেনিভোলেন্ট ডিকটেটরদের হাত দিয়ে হয়েছে। লি কুয়ান বলুন আর মাহাথির বলুন, তারা আদতে দেশপ্রেমিক-স্বৈরাচারই ছিলেন। এ ধরনের স্টেইটসম্যান আমাদেরও ছিলো। তারা প্রচলিত রাজনীতির প্রডাক্ট ছিলেন না। তারা রাজনীতি ও দেশ উভয়কেই নিজের হাতে গড়েছেন। আমি তাদের নাম নিয়ে বিতর্কে জড়াতে চাই না। দেশের বর্তমান দ্বিদলীয় রাজনীতির মাধ্যমে এ ধরনের রাষ্ট্রনায়ক গড়ে উঠার কোনো সম্ভাবনা আমার দৃষ্টিতে নাই। এ জন্য অন্তত আরো এক দশক অপেক্ষা করতে হবে।
যদি প্রচলিত রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে থাকেন, তো অন্তত এই এক দশক কী করবেন? যারা ক্ষমতা হাতে নিয়ে মানুষের নৈতিকতা গড়তে চান, আধুনিক ধর্মরাষ্ট্র ও স্বৈরাচারী রাষ্ট্রসমূহ তাদের এই অবাস্তব চিন্তার অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ডাণ্ডা দিয়ে মানুষকে নৈতিক বানানো যায় না। আপাতত ঠাণ্ডা করা যায়। বাংগালীর যা বুদ্ধি। যত আইনই করুন না কেন, ফাঁকিবাজ মানুষ ঠিকই ‘পথ’ বের করে ফেলবে।
যদি দেশের একটা কলামও মোটের ওপর দুর্নীতিমুক্ত হতো, তাহলেও কিছুটা আশা অন্তত করা যেতো। বিচারালয় থেকে ধর্মালয়, সবখানে ‘মেইড ইজি’ ধরনের ‘শর্টকার্ট কোর্স’। নিজের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে অপটিমাইজ করার অশুভ প্রতিযোগিতায় সবাই লিপ্ত। আইনের বাঁধন মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারে, নৈতিক বানাতে পারে না। তাই, মানুষকে নীতি-নৈতিকতার পথে আনার কাজটা আপনার-আমার সামনে অবারিত। বরং এটিই কাজের আসল ক্ষেত্র। ভবিষ্যতের বুনিয়াদ।
নৈতিকতা বলতে লোকেরা কেন জানি ব্যক্তিগত যৌন নৈতিকতাকেই বুঝে। অথচ, সামাজিক নৈতিকতাই হলো নৈতিকতার আসল জায়গা। নৈতিকতার পরিসর আইনকে ছাড়িয়ে যায়। এটি জীবনের সব ক্ষেত্র ও পর্যায়ে পরিব্যপ্ত। অনৈতিক লোকের প্রধান পরিচয় হচ্ছে, অনৈতিক ব্যক্তি সব সময়ে অপরের অনৈতিকতার এক্সকিউজ দিবেন। অন্যদের দোষারোপ করবেন। ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ তাদের বর্ম। ভাবখানা এমন, যারা যারা আলোচনা-সমালোচনা করছেন তারা তারা ছাড়া বাদবাকী সবাই খারাপ…!
ইসলামপন্থীদের উদ্দেশ্যে
সবশেষে যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করতে চান, আপনাদের ভাষায় আপনারা যারা ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, রাজনীতি নিয়ে আপনাদের গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভটাই ভুল। দেখেছি, ইসলামপন্থীদের মনোভাব হলো, ক্ষমতা পেয়ে নেই, উপর থেকে সব ঠিক করে ফেলবো। আল্লাহ মাফ করুক, এ যেন চরমপন্থী ISIS-দের সফট ভার্সান। অথবা, মার্কসিস্টদের ‘the factor’ থিওরি। মার্কসিস্টরা অর্থনীতিকে ‘দ্যা ফ্যাক্টর’ মনে করে। আপনারা রাজনীতিকে ‘দ্যা ফ্যাক্টর’ মনে করেন। আপনারা দুই পক্ষই ভুল করছেন। যদিও দুটাই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। রাষ্ট্রক্ষমতার চর্চা করে সমাজ গঠন করা যায় না। যেমন করে আইন করে বা আইনের প্রয়োগ করে নৈতিক মান অর্জন করা যায় না। আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক বিপরীত অনুপাতের। আইনের ভিতরে থেকেও কেউ নিম্নতম নৈতিক মানে থাকতে পারে। এ নিয়ে আমার একটা স্বতন্ত্র লেখা আছে: আইন ও নৈতিকতার মিথষ্ক্রিয়া বনাম বিপরীত অনুপাত সম্পর্ক।
আপনারা যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করতে চান, তারা বলুন তো, আমাদের উত্তর চট্টগ্রামে বিরাজমান যে শক্তিশালী মাজার-সংস্কৃতি, ‘ইসলামী আন্দোলনপন্থী’ ইসলামিস্টরা একে ইসলামের দিক থেকে মারাত্মক আক্বীদাগত সমস্যা মনে করেন। এর সাথে রাজনীতির কী সম্পর্ক? সহীহ আক্বীদার ইসলামপন্থীরা ঢাকায় যত শক্তিশালী সরকারই গঠন করুন না কেন, চট্টগ্রাম থেকে ক্যানসারের মতো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া এই ধর্মীয় তাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক সমস্যাকে আপনারা কীভাবে হ্যান্ডেল করবেন? ডিসি, এসপি আর ইউএনওদের কমিটি করে?
ধর্মীয় সমস্যাকে ধর্মীয়ভাবে মোকাবিলা করতে হয়। সামাজিক সমস্যাকে সামাজিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। সামাজিক সমস্যাকে সামাজিকভাবে মোকাবিলা না করে প্রশাসনিক, সামরিক বা অন্য কোনোভাবে তা করতে গেলে সমাজে ভয়াবহ অন্তর্বিরোধ তৈরী হয়। সমাজটা ভেতর থেকে ভেংগে পড়ে। সমাজটা যেখানে ভংগুর, সেখানে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় উন্নতি সত্যিকারের মানবিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে না। অন্তত ইসলামের দিক থেকে তো নয়ই।
শেষ কথা
অতিরাজনৈতিকতার রোগ থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। যার যার যোগ্যতা অনুসারে সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, “ছোট ছোট বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল”।
তাই আসুন, সবাই মিলে রাজনীতি করার সংস্কৃতি হতে বেরিয়ে আসি। আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে কোনোকিছু অনর্থক সৃষ্টি করেন নাই। আপনিই খুঁজে বের করুন, আপনার ইনার পটেনশিয়ালিটিটা কী। এরপর নেমে পড়ুন সেই কাজে। আমি কাজের লোক। ভোগবাদী ক্যারিয়ারিস্ট আর বকোয়াজবাজ আদর্শবাদীদের আমি এড়িয়ে চলি। আমি মনে করি না, রাজনীতিই আমাদের মূল সমস্যা। আমি মনে করি না, দারিদ্র্যই আমাদের মূল সমস্যা।
আমি মনে করি না, শিক্ষার হার সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি না পাওয়াটা আমাদের মূল সমস্যা। আমি মনে করি, ন্যূনতম মানেও মানবিক হতে না পারা বা অন্য ভাষায় শুদ্ধ জীবনবাদী না হওয়াটাই আমাদের মূল সমস্যা। আপনি যদি এই কথার সাথে একমত হোন, তাহলে আসুন নির্লিপ্ততার জড়তা ভেংগে প্রতিদিন অন্তত একজনকে, যে কোনো একজন মানুষকে, একথা বুঝানো চেষ্টা করি, আমাদের যাবতীয় অগ্রগতির চাবিকাঠি আমাদের কাছেই আছে। সেটি হলো মানুষ হিসাবে পরিচয়, আমাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা। মানবিক বলতে যা বুঝায়।
ফেসবুকে প্রদত্ত মন্তব্য–প্রতিমন্তব্য
Khondoker Zakaria Ahmed: আরো কিছু বিষয় যোগ করা যেতে পারে।
১) নৈতিকতা, সুশাসন ও ন্যায্যতার সমস্যা: নৈতিকতা ও অনৈতিকার সংজ্ঞা আমাদের দেশে নির্ভর করে যার যার সুবিধা-অসুবিধার উপর। প্রাতিষ্ঠান পরিচালনায় সুশানের প্রয়োজনীয়তা সবাই বলি। বাস্তবে সরকারী-বেসরকারী, ইসলামী ও অইসলামী কোথাও তার চর্চা খুঁজে পাওয়া যাবে না। একই কথা ন্যায্যতার ক্ষেত্রে বলা যায়। ইনসাফ বা ন্যায্যতা একটি অখন্ডনীয় বিষয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় কথিত আদর্শের কারণে এর সংজ্ঞা বদল হয়ে যায়। চাকুরীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটে। আমার বিপক্ষে যেটি অবিচার একই কাজ আমি যখন করি তখন বলি আদর্শের জন্য বৃহত্তর স্বার্থে (?) নিজের লোক নিয়োগ দিতে হবে। “জুতার মাপে পা, না পায়ের মাপে জুতা” – এ সমস্যা প্রায় সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠানে আছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনা নেই। আছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। ক্ষমতায় যেয়েও খুব বেশি ন্যায্যতা ও সুশাসনের কালচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় যদি না এটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা না যায়। তথাকথিত ক্ষমতার রাজনীতি না করেও এই ইস্যু নিয়ে বড় ধরনের সামাজিক আন্দোলন করা যায়।
২) মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা: এটি ক্রমন্বয়ে সমাজে কমে আসছে। পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের অসহায় মানুষকে সাহায্য করা ধর্মীয় দায়িত্বের পাশাপাশি সভ্য সমাজের একটি অন্যতম লক্ষণ। অসুস্থকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, দরিদ্র শিক্ষার্থীর শিক্ষাসমাগ্রী ক্রয় ও পরীক্ষার ফি দিয়ে সাহায্য করা, দরিদ্র বয়স্ক অথচ দেখার মত কেউ নেই এ ধরনের অসহায়দের সাহায্য করা ইত্যাদি বহু সামাজিক সমস্যা আছে যা সমাধানে জন্য রাজনৈতিক বা অর্থবিত্তের খুব বেশী প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় উদ্যোগ গ্রহণের। তথাকথিত ক্ষমতার রাজনীতি থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে এ কাজে মন দিলেও সমাজের অনেক উপকার হতো।
Mohammad Mozammel Hoque: অসাধারণ! এটি আপনার টাইমলাইনে স্বতন্ত্র পোস্ট হিসাবে দিলে ভালো হয়।
Khondoker Zakaria Ahmed: ধন্যবাদ।